বিদায় হজের ভাষণ-
মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব, শুক্রবার ফজরের সালাত আদায় করেন এবং সুর্যোদয়ের পর মিনা হতে রওনা হন। আরাফাহ্ ময়দানের পূর্বদিকে “নমিরা” নামক স্থানে পৌছে দুপুর পর্যন্ত সেখানে তাঁবুতে অব্স্থান করেন। তারপর তিনি 'কসওয়া' নামক উটনীর উপর আরোহন করে আরাফা’র সন্নিকটে “আরনা” নামক সমতল প্রান্তরে উপস্থিত হন।
প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার লোকের সমাবেশে মানবজাতির কল্যাণে পথ নির্দেশনা স্বরূপ তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের খুতবা বা ভাষণ দেন। তাঁর প্রতিটি বাক্যই রাবিয়া বিন উমাইয়া বিন খালাফ (রাঃ)-কর্তৃক পুনরাবৃত্তি হয়েছিল।
আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞা জানিয়ে মানবতার মহান নেতা রাসূল (সাঃ) বললেন:-
# হে মানবমন্ডলী! তোমরা আমার কথা শোন। আমি জানি না যে, এরপর এভাবে কোন সভায় আমি তোমাদের সাথে পুনরায় মিলিত হতে পারব কিনা।
# আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই। তিনি একক। কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং তাঁর একক সত্বাই সমগ্র বাতিল শক্তিকে পরাভূত করেছে।
# হে মানবমন্ডলী, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং পরে তোমাদেরকে বিভিন্ন দল ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহকে বেশী ভয় করে চলে। সুতরাং কোন আরব অন্য কোন অনারব বা আজমী ব্যক্তির তুলনায় মোটেই শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি কোন অনারব বা আজমী ব্যক্তিও কোন আরব ব্যক্তির তুলনায় মোটেই শ্রেষ্ঠ নয়। কাল ব্যক্তিও সাদা ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি সাদা ব্যক্তিও কাল ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। হাঁ, মর্যাদা ও সম্মানের যদি কোন মাপকাঠি থাকে, তবে তা হলো একজন ব্যক্তির তাকওয়া বা পরহেজগারী। সমগ্র মানবজাতি একই আদমের সন্তান এবং আদমের প্রকৃত পরিচয় এটাই যে, তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহর ঘরের হেফাজত, সংরক্ষণ ও হাজিদের পানি পান করাবার ব্যবস্থা আগের মতই বহাল থাকবে।
# হে কুরাইশগণ, এমন দশা যেন না হয়- তোমরা যখন আল্লাহপাকের দরবারে উপস্থিত হবে তখন তোমাদের ঘাড়ে দুনিয়ার বোঝা চাপানো থাকবে, আর অন্যেরা আখিরাতের পুণ্য সঞ্চয় কোরে উপস্থিত হবে। সত্যিই তোমাদের অবস্থা যদি এমনই হয় তাহলে সেদিন আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারব না।
# হে কুরাইশগণ, আল্লাহ মিথ্যা অহংকার-অহমিকা নির্মূল করে দিয়েছেন। সুতরাং বাপ-দাদার কীর্তি-কাহিনী নিয়ে অহংকার করার আর কোন অবকাশ নাই।
# হে মানবমন্ডলী, তোমাদের রক্ত, বিত্ত-সম্পদ ও ইয্যত পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম করা হলো। আজকের এই দিন এই পবিত্র মাস বিশেষভাবে এই শহরে অবস্থান কালে তোমরা যেভাবে এর গুরুত্ব দিয়ে থাক- এসব বিষয়ের গুরুত্বও ঠিক তদ্রƒপ। তোমাদের সকলকেই আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে এবং তিনি তোমাদের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। মনে রেখ, আমার পরে পথভ্রষ্ট হয়ে পরস্পর মারামারি হানাহানি আরম্ভ কোরে দিও না। যদি কারও কাছে কোন আমানত রাখা হয় তবে সেই আমানতী জিনিস যে ব্যক্তি আমানত রেখেছে তার কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব তারই।
# হে মানবমন্ডলী, একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের ভাই। মুসলমানগণ পরস্পর ভাই-ভাই।
# নিজের অধীনস্থ কাজের মানুষের প্রতি খেয়াল রাখবে। তোমরা নিজেরা যা খাও, তাদেরকেও তাই খেতে দেবে। তোমরা যেমন জামাকাপড় পর, তাদেরকেও তেমন পরাবে। মজুরের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরী মিটিয়ে দিও।
# অন্ধকার জাহেলি যুগের সকল নাম নিশানা আমি পদতলে নিক্ষিপ্ত করেছি। জাহেলি যুগের রক্তের সকল প্রতিশোধ দাবি রহিত করা হলো। এখন থেকে জাহেলি যুগের সুদ আর পরিশোধযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে না।
# হে মানবমন্ডলী, মহামহিম আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকটি হকদারকে ন্যায্য অংশ বা অধিকার নিজেই দান করেছেন। এরপর থেকে কোন ব্যক্তি যেন ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারীর জন্য ওসিয়ত না করে।
# চারটি কথা স্মরণ রেখোঃ ১/ শির্ক (আল্লাহর অংশী) করো না। ২/ অন্যায় ভাবে নর হত্যা করো না। ৩/ চুরি করো না। ৪/ ব্যভিচার করো না।
# ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কোন ভাইয়ের সন্তুষ্টি ছাড়া তার নিকট থেকে কোন জিনিস গ্রহণ করা জায়েজ নয়। তবে সন্তষ্ট হয়ে যদি কিছু দান করে তাহলে আলাদা কথা। ধার হিসেবে কোন কিছু গ্রহণ করলে তা অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। উপহারের বিনিময় দেয়া উচিত। কেউ কারও জামিনদার হলে অবশ্যই জামিনের শর্ত পালন করা কর্তব্য। তোমরা নিজেদের উপর ও অন্যদের উপরে জুলুম করিওনা।
# হে মানবমন্ডলী, তোমাদের উপর তোমাদের নারীদের অধিকার রয়েছে এবং তাদের উপরও তোমাদের সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে এবং তাদের জন্য খাদ্য ও বস্ত্রের সংস্থান করবে। তোমরা যাদেরকে পছন্দ করনা তাদেরকে তারা যেন বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে এবং কোনরূপ বেহায়াপনায় লিপ্ত না হয়।
# স্ত্রীদের সাথে তোমরা সদ্ব্যবহার করিও। তাদের ব্যাপারে আল্লাহর কথা স্মরণ রাখবে, কারন আল্লাহর নামেই তোমরা তাদেরকে জীবনসাথী হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং তাঁর নামেই তারা তোমাদের জন্য পবিত্র রূপে গণ্য হয়েছে।
# আমার কথা তোমরা উত্তমরূপে বুঝে নাও। আমি দ্বীন অর্থাৎ জীবনবিধান পৌছে দেবার দায়িত্ব পালন করেছি।
# আমি তোমাদের কাছে এমনই একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যেন তোমরা পথভ্রষ্ট না হও, অবশ্য যদি তোমরা এটার উপর কায়েম থাক- এটা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু দ্বীন অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করিও না। কারন তোমাদের পূর্বেও মানুষকে এসব কারনে ধ্বংস কোরে দেয়া হয়েছে।
# এখন থেকে এ নগরীতে শয়তানের ইবাদত করার আর কোন আশা রইল না। তবে যেসব বিষয়কে তোমরা কম গুরুত্ব দাও সেসব বিষয়ে তার কথা মান্য করার মত আশংকা অবশ্যই আছে। সুতরাং তার খপ্পর থেকে তোমরা তোমাদের ইমান রক্ষা কোরে চল।
# হে মানবমন্ডলী, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় কর, পূর্ণাঙ্গ এক মাস রোজা রাখ, সন্তুষ্টচিত্তে নিজেদের ধন সম্পদের যাকাত আদায় কর, আল্লাহর ঘরের ইয্যত কর এবং নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের কথা মেনে চল, তাহলে তোমরা জান্নাত লাভ করতে পারবে।
# এখন থেকে অপরাধী ব্যাক্তিই তার অপরাধের জন্য দায়ী হবে। পিতার বদলে পুত্রকে পাকড়াও করা হবে না, কিংবা পুত্রের জন্য পিতাকেও দায়ী করা হবে না।
# শোন, এখানে যারা উপস্থিত আছ তাদের কর্তব্য হবে, যারা আজ এখানে উপস্থিত নেই তাদের কাছে এই নির্দেশ ও বাণীগুলো ঠিকমত পৌঁছে দেয়া। অনুপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে কেউ হয়ত এর মর্ম তোমাদের চেয়ে উত্তমরূপে বুঝবে ও সংরক্ষণ করবে।
# হে মানবমন্ডলী, তোমাদেরকে আমার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। বল, সেদিন তোমরা আমার সম্পর্কে কি উত্তর দিবে? সমবেত জনতা উত্তর দিল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি দ্বীনের আমানত পৌঁছে দিয়েছেন, আপনি রেসালতের হক আদায় করেছেন এবং আমাদের কল্যাণ কামনা করেছেন। এ কথা শুনে রাসূলাল্লাহ্ (সাঃ) নিজের শাহাদাত আঙ্গুল আকাশের দিকে তুললেন এবং উপস্থিত জনতার দিকে ইশারা কোরে তিনবার বললেন: ইয়া আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থাক, ইয়া আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থাক, ইয়া আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থাক।
.........................................................................................................
যে যেভাবে পারেন, ঘনিষ্ঠ জনদের কাছে এই ভাষণটি ছড়িয়ে দিন-
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:৪৪