২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে টাকা জমা রাখা হয়েছে ৬৬ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ ৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা ৷ এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এসব ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে টাকা জমা করা হয়েছিলো প্রায় ৫৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ ৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা ৷ ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে টাকা জমা রাখার পরিমাণ ১৯ শতাংশ বেশি ৷
২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার। টাকার অংকে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। একটা হিসাব দিলে পরিমাণটা বুঝতে সুবিধা হবে। ২০১৬ ‘১৭ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। মানে এক অর্থবছরে যে পরিমাণ টাকা ভ্যাট হিসেবে পাওয়ার কথা ছিলো, তার চেয়েও বেশি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গত ২ মে এ তথ্য প্রকাশ করে। মূলত আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এই অর্থের বড়ো একটি অংশ পাচার করা হয়েছে।
গত অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পেরে সংশোধিত বাজেটে তা ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। মানে কেবল অর্থ পাচার ঠেকাতে পারলেই ভ্যাট খাতের আয় নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হতো না এনবিআরকে।
আজ থেকে শুরু হচ্ছে নতুন অর্থবছর। এবার ভ্যাট খাতে আদায়েল লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। এজন্য বাজেটে বেশিরভাগ পণ্য ও সেবার ওপর ১৫% ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিলো। যদিও শেষ মুহূর্তে সে অবস্থান থেকে সেরে এসেছে সরকার।
এখন এই পরিমাণ ভ্যাট আদায় হবে কিভাবে তা নিয়ে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হবে এনবিআরকে। অথচ টাকা পাচার ঠেকানো গেলে ভ্যাট খাতে এই পরিমাণ চাপ দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। ভোক্তারাও স্বস্তি পেতো।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। অথচ দেশের ইতিহাসে এবার যে সর্ববৃহৎ বাজেট দেওয়া হয়েছে তার আকারই ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। কারা পাচার করছে এই টাকা? ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি চাকরিজীবি--কে করছে না? হুন্ডি করে, ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে, বিদেশে বসে ঘুষের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে টাকা। টাকা পাচারের দিক থেকে পাকিস্তানকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ!
নতুন আরেকটি হিসাব প্রকাশিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। তাতে দেখা যাচ্ছে, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের টাকা রাখার পরিমাণ আরও বেড়েছে। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিলো ৫ হাজার ৫৬০ কোটি ৪৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা। আগের বছর এর পরিমাণ ছিলো ৪ হাজার ৬২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে জমার পরিমাণ বেড়েছে ৯৩৩ কোটি ৩৩ লাখ ২৪ হজার টাকা।
এবার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষিখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৬ কোটি টাকা, যা মোট এডিপি বরাদ্দের তিন দশমিক ৯২ শতাংশ। মানে ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে পরিমাণ টাকা জমা ছিলো তা প্রায় এবারের বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দের প্রায় সমান।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬’ শিরোনামে বার্ষিক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ৪১ কোটি টাকা। এছাড়া ২০০৮-এ ৮৯৮ কোটি, ২০০৯-এ ১ হাজার ২৫২ কোটি, ২০১০-এ ১ হাজার ৯৭৯ কোটি, ২০১১-তে ১ হাজার ২৭৯ কোটি, ২০১২-তে ১ হাজার ৯২২ কোটি, ২০১৩-তে ৩ হাজার ১২৩ কোটি এবং ২০১৪ সালে ছিলো ৪ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। সে হিসাবে দেখা যায়, ২০১২ সাল থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। মাঝে সবচেয়ে কম জমা হয়েছে ২০০৮ সালে, যখন এক/এগারোর সরকার ক্ষমতায় ছিলো। অথচ ভারত-পাকিস্তানসহ সারা দুনিয়া থেকেই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমার পরিমাণ কমেছে।
অনেকেই বলছেন, সুইস ব্যাংকে যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হোক। কিংবা সুইস ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হোক। তারা হয়তো জানেন না, সুইস ব্যাংকগুলো কঠোরভাবে গ্রাহকের তথ্যের গোপনীয়তা মেইনটেইন করে। কাজেই চাইলেই জানা সম্ভব না, সেখানে কে, কোন ব্যাংকে কতো টাকা রেখেছেন। সেই টাকা ফেরত আনাও কঠিন। আর আনবেই বা কে? যাদের ফেরত আনার কথা তারাই তো সেখানে জমা রাখে।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ লেখক ও রাজনীতিক জেফরি আর্চারের ‘ক্লিন সুইপ ইগনেশিয়াস’ নামের বিখ্যাত সেই গল্পটা আলোকপাত করা যেতে পারে।
ইগনেশিয়াস আগারবি নাইজেরিয়ার মানুষের কাছে আহামরি কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। ১৭তম অর্থমন্ত্রী হওয়ার সময় তাকে নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি কেউ। তবে দ্রুতই পরিস্থিতি বদলে গেলো। অর্থমন্ত্রী হয়েই ঘুষ, দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। দুর্নীতির দায়ে একে ধরছেন তো ওকে মারছেন। দুর্নীতি করায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, পুলিশের আইজিপিও তার হাত থেকে রেহাই পেলেন না। এতে দ্রুতই মানুষের কাছে আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন তিনি। দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করায় নামই হয়ে গেলো ‘সুইপ ইগনেশিয়াস’। একদিন তাকে ডেকে পাঠালেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ওটোবি। সব ধরণের সমর্থনের আশ্বাস দিয়ে তিনি ইগনেশিয়াসকে একটি পিস্তল উপহার দিলেন, যাতে শত্রুর হাত থেকে তিনি নিজেকে রক্ষার করতে পারেন।
ইগনেশিয়াসের এবার লক্ষ্য সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারকারীরা। একদিন চলে গেলেন জেনেভায়। সেখানকার গারবার অ্যাট সিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে একটা ব্রিফকেস হাতে নির্ধারিত ক্ষণে হাজির হয়ে গেলেন তিনি। দ্রুতই কাজের কথায় এলেন। চাইলেন তার দেশের নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সব তথ্য। এজন্য প্রেসিডেন্টের দেওয়া অনুমোদনের চিঠিও দেখালেন। কিন্তু ব্যাংক চেয়ারম্যান তথ্য দিতে রাজি হলেন না। নাছোড়বান্দা ইগনেশিয়াস নানা ধরণের লোভ দেখালেন, ব্যবসা বাড়ানোর কথা বললেন। কিন্তু কাজ হলো না। মক্কেলের তথ্য কোনো অবস্থাতেই চেয়ারম্যান দিতে রাজি হলেন না। এরপর ইগনেশিয়াস ভয় দেখাতে শুরু করলেন। দেশের সঙ্গে সব ধরণের ব্যবসা বন্ধসহ সুইজারল্যান্ডের দূতাবাসে তালা দেওয়ার হুমকিও দিলেন। তাতেও কাজ হলো না। গোপনীয়তা রক্ষার নীতিতে অটল থাকলেন চেয়ারম্যান। এবার শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলেন ইগনেশিয়াস। পকেট থেকে ছোট্ট পিস্তলটা বের করে চেয়ারম্যানের কপালে চেপে ধরলেন। ভীষণ ভয় পেলেও সিদ্ধান্তে অনড় ব্যাংক চেয়ারম্যান। সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারম্যানের কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে নিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন ইগনেশিয়াস। ব্রিফকেসটা তুলে নিলেন। তাতে থরে থরে সাজানো ১০০ ডলারের নোট, পাঁচ মিলিয়ন ডলারের কম হবে না। তারপর সেই ব্যাংকেই অ্যাকাউন্ট খুলে খুশি মনে দেশে ফিরলেন ইগনেশিয়াস।
দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে-এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। প্রতিবছর বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা যখন এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন দু'চারদিন আলোচনা হয়। তারপর আমরা আবার ভুলে যাই। কারণ, কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করার চেয়েও আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে আলোচনার জন্য। 'ঈদ' বানান কি হবে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্য থাকবে কিনা, অপুর সংসার জোড়া লাগলো কিনা, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত না পাকিস্তান-কাকে সমর্থন দেওয়াটা জায়েজ, রোনাল্ডো নাকি মেসি-কে সেরা খেলোয়াড়-আরও কতো কি? এতোসব আলোচনা শেষে অন্য কোনো ইস্যুতে আলোচনার মতো যথেষ্ট সময় আমরা আর করে উঠতে পারি না। করতে পারলে হয়তো নিশ্চয়ই ফাটিয়ে দিতাম!

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ১:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




