গভীর রাত। চারদিকে শুনশান নীরবতা। সময় বুঝে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে ইতিমধ্যেই ইলেক্ট্রিসিটি ও চলে গেছে সিটির বাইরে। এরই মাঝে আকাশ বিদীর্ণ করে থেমে থেমে বিজলী চমকানো ও বিকট শব্দে বাঁজ পড়া শুরু হয়েছে। শহুরে দালান-কোঠার ভিড়ে আমাদের ঘরের টিনের চালে বাঁজ পড়ার আওয়াজ স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ জোরেই শুনা যাচ্ছে। বিজলীর আলো-আধারী ও তার পরক্ষনেই ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার, এযেনো পুরদস্তুর একটা ভূতুরে পরিবেশ। আমি ভয়ে আরো জড়ো-সরো হয়ে আব্বার বুকে মুখ লুকাচ্ছি। যেনো এই মহা বিপদে তার সুঠাম লোমশ বুকই আমার একমাত্র ভরসা ও একান্ত নির্ভরতা। আর আব্বাও পরম মমতা ও ভালোবাসায় আমাকে জড়িয়ে ধরে আশ্রয় দিলেন তার বুকে, সাহস দিয়ে গেলেন সারা রাত। তাগিদ দিলেন আল্লাহর নাম জপার। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে গুটি-শুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ঘুম ভাঙলে রাতের ভয় পাবার কথা মনে করে সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।
-না এটা কোন গল্পের বইয়ের পাতা থেকে তুলে আনা ঘটনার অংশ বিশেষ নয়। আমার জীবেনেরই ঘটে যাওয়া কতো-শত ঘটনার একটি উদাহরণ মাত্র। তখন বয়স আর কতো? নয় কিংবা দশ! কিন্তু এতো বছর পরও আজো তা স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের ঘটনা।
আমাদের বাড়ী সিলেট শহরের ঐতিহ্যবাহী হাওয়াপাড়া এলাকায়। সিলেট শহরে মূল বাড়ী হওয়ায় আমাদেরকে অনেকেই সিলেটী ভাষায় 'কুট্টি' হিসেবে ডাকেন। তা সে যাই হোক, আমাদের পরিবার ঠিক একান্যবর্তী পরিবার না হলেও বাবা-চাচারা সবাই একই বাড়ীতে, একই ছাঁদের নিচে বসবাস করি। আমার আব্বা ছিলেন তার ভাইদের মাঝে সবার বড়। গুরুগম্ভীর এবং হ্রাসভারী চেহারার আমার বাবা ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। মনে আছে চাচাতো ভাই-বোনসহ বাড়ীর সবাই আব্বাকে বাঘের মতো ভয় করতেন। কোন একটা ঘটনা ঘটলে সবাইকে এক লাইনে দাড়ঁ করিয়ে কান ধরে উঠ-বস করাতেন। আবার এর উল্টো পিঠ ও আছে। আমরা সবাই এক সাথে মিলে আব্বার কাছে তাদের ছেলে বেলার গল্প শুনতাম। শুনতাম মুক্তিযুদ্ধের গল্প। সেই সময়ের দুর্বিসহ জীবনের কথা। কিভাবে হেটেঁ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন তার কথা। আব্বার গল্প বলার ভঙ্গী ছিলো অসাধারণ। তিনি খুব সহজেই গল্পের চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতেন। আমরা অপার বিস্ময়ে তার গল্প শুনতাম। আমাদের মনে হতো কোন রূপকথার গল্প শুনছি।
আমার দাদা হাজী মাওলানা মোহাম্মদ মাহমুদ ছিলেন সিলেট শহরের কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদের পেশ ইমাম। দাদার বাবা মৌলভী আকরম খান ছিলেন একই মসজিদের প্রতিষ্টাকালীন ইমাম। দাদা ও দাদার বাবা মিলে কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদে টানা আশিঁ বছর ইমামতি করেছেন বলেও আব্বার কাছ থেকে গল্প শুনেছি। সে হিসেবে সিলেট শহরে আমাদের বাড়ীর একটা আলাদা পরিচয় ছিলো। সবাই "ইমাম ছাব'র" বাড়ী হিসেবেই চিনতেন। আমার আব্বা আলহ্বাজ মোহাম্মদ মছউদ ছিলেন ছোটখাট একজন ব্যবসায়ী। মধ্যবিত্ত পরিবার। অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী না হলে ও মোটামুটি লেগেই থাকতো। তবুও আব্বার মুখে কোনদিন হাসিঁর কমতি দেখিনি। আব্বার আরেকটি গুণ ছিলো, তিনি ছিলেন পরোপকারী ও অতিথিপরায়ন। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের ঘরে মেহমানদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্হা করা হতো। কেউ এলে দুপুরের খাবার না খেয়ে যেতে পেরেছেন এমন রেকর্ড খুব কমই আছে।
আব্বার সাথে আমার যে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো তা কিন্তু না।তিনি ছিলেন কিছুটা গুরুগম্ভীর এবং রাগী প্রকৃতির। তাই অনেক সময়ই তাকে এড়িয়ে চলতাম। আমার সবচেয়ে সমস্যা হতো যখন আব্বার সাথে খাবার খেতে বসতাম তখন। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। আজ এটা রান্না হয়েছে তো এটা খাব না, অন্য কিছু একটা খাব। এমনটা ছিলো আমার নিত্য দিনের উৎপাত। তো আব্বার সাথে খেতে বসলে এই কথা বলার কোন সুযোগই ছিলো না। কারন আব্বা ভাতের সাথে তরকারী মাখিয়ে দিয়ে বলতেন, তিনি খাবার শেষ করার আগেই যেনো আমি শেষ করি। তা না হলে খবর আছে। কি আর করা, তার বিখ্যাত বেঁতের বাড়ির ভয়ে মনের দু্ঃখ মনে রেখেই চোখের নোনতা জলের সাথে একাকার করে প্লেট ভর্তি খাবার শেষ করতাম নিমিষেই।
ভাগ্যান্বেষণে আজ আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পারি দিয়ে আস্তানা গেড়েছি বিলেতে। সে ও প্রায় চার বছর হতে চললো। বন্ধুবর অগ্রজ সাংবাদিক ফায়সাল আইয়ূবের সাথে সখ্যতার জেরেই এখানে আসা। এসেই ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে একটু সময় পেলেই প্রায় প্রতিদিনই কথা বলতাম দেশে রেখে আসা আমার স্নেহময়ী মা ও আমাদের জন্য জীবন-যৌবন তুচ্ছ করা বাবার সাথে। সময়ের প্রয়োজনেই ২০১২ সালের প্রথম দিকে এখানে জীবন সাথী হিসেবে বেচেঁ নেই লায়লা নামের এক তরুণীকে। অস্হায়ী আস্হানা পাকাপোক্ত হয় বার্মিংহামে। আমার বিয়েতে আসার বড় সখ ছিলো আব্বার। কিন্তু তার শারীরিক অবস্হার কথা বিবেচনা করে তাকে আর নিয়ে আসা হয়নি।
এর মাঝেই শুনতে পাই দেশে আব্বার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মনকে আর বুঝাতে পারিনি। আনুষাঙ্গিক কাগজ পত্র রেডী করে স্ত্রী-কে নিয়ে জুন মাসে দেখতে যাই জন্মদাতা পিতাকে। তখন তার অবস্হা খুব একটা ভালো নেই। কাউকে আর চিনতে পারছেননা। আম্মা এবং মেঝো ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি, অসুস্হ্য হবার পর তিনি নাকি সব সময় আমার নাম ধরে আমাকে খুঁজতেন। তাকে বিছানায় ওভাবে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। কেদেঁছি হাউমাউ করে। একমাস দেশে অবস্হানকালে তার শারীরিক অবস্হার কিছুটা উন্নতি হয়েছিলো। জুলাই মাসে আবারও ফিরি যান্ত্রিক জীবনে। এর প্রায় দুই মাস পরেই তার শারীরিক অবস্হার অবনতি হতে থাকে। তিন দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে জীবন যুদ্ধে হেরে যান আমার প্রিয় বাবা। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দেশে থেকে খবর আসে আব্বা আর নেই! ইহজীবনের সকল মায়া-মমতা ত্যাগ করে তিনি পারি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। আব্বা মারা যাবার প্রায় একবছর হতে চললো। এরই মধ্যে আমার এক ফুটঁফুটে পূত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। সবাই বলেন ও নাকী দেখতে অবিকল আমার আব্বার মতোন। তাই ওর মাঝেই এখন আমি আমার আব্বার মুখটা খুঁজে ফিরি। আর মাহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেনো আমার আব্বাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করে নেন। আমীন।