somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন মায়াজালে বেঁধেছো...

৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



*

'ইফ আই কিল ওয়ান পারসন ইন মাই লাইফ, দ্যাট উড বি ইউ!' অবাক চোখে আমি তার দিকে তাকাই। ভেবেছিলাম বুঝি মজা করেই বলছে। কিন্তু তার চোখ দেখে ভুল ভাঙে। কেমন বিহ্বল খুনে দৃষ্টি চোখে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে শক্ত করে, দৃঢ় হয়ে আসছে চোয়াল। কাঁধের ওপর হাতের চাপ বাড়ছে। হঠাৎ করেই তাকে খুব বেশি অচেনা ঠেকে। মুখ থেকে হাসি খুশি ভাবটা মুছে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। মেঝের ওপর পড়ে থাকা পানির ফোঁটা যেভাবে টিস্যু পেপার শুঁসে নেয়, তেমনই খুব অজানা একটা অনুভূতি আমার মুখের রঙ যেন শুঁসে নিতে থাকে। পেটের ভেতর কেমন শিরশির করে ওঠে, ভীত চোখে তাকিয়ে থাকি ওর চোখে। এক...দুই...তিন...চার...পাঁচ............বার...তের...চৌদ্দ...পনর...ঠিক পনর সেকেন্ড পরে তার চোখের ওপরকার খুনে পর্দাটা সরে গেল। হাল্কাভাবে টেনে নিয়ে আমার কপালে আলতো চুমু খেল, তারপর হাসল। ওই হাসি দেখে একটা খুব দ্বিধাগ্রস্ত হাসি ফুটে ওঠে আমার ঠোঁটে। রিফ্লেক্স! কারো হাসির উত্তরে যেমন হাসতেই হয়। তারপর বুক ঠেলে ওঠে অভিমানে।
-'খুন করবা! এত রাগ আমার উপরে?' ঠোঁট ফুলে ওঠে আমার, হাল্কা নাকও টানি। অভিমান, আহ্লাদ, ন্যাকামো আমার স্বভাবের একটা অংশ। কথায় কথায় ঢং না করলে ভাল লাগে না। তবে সেসব ঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে জানতে হয়।
-'না, রাগ না।' মাথা নাড়ে সে। 'কিন্তু কোনদিন কাউকে খুন করলে আমি তোমাকেই করবো।'
-'রাগ না! তাহলে খুন করবা কেন? কি করসি আমি?'
-'কিছু করো নাই...কিন্তু, যদি করো!' তার চোখ-মুখ আবারও শক্ত হয়ে উঠছে।
-'ইশ! আমি তেমন কিছু করবোই না।' দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলি আমি।
-'জানি।' সযত্নে আমার হাত দুটো গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে সে। বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে।
-'কোথায় যাচ্ছো?'
-'বাইরে, সিগারেট খাবো।'
কেমন পাগল! ভালবাসতে বাসতে মেরেই ফেলবে!
পাঁচ মাস তের দিন হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ে হয়েছে কথাটা বলতে বা শুনতে যেমন সহজ, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তেমন সহজ না। আস্ত একজন অজানা, অচেনা নতুন মানুষের সাথে বসবাস। রোজ একটু একটু করে তাকে আবিস্কার। কিসে তার ভাল লাগা, কিসে মন্দ লাগা, কি করলে সে খুশি হবে, অশান্তি এড়াতে কোন কাজটা বাদ দিতে হবে এসব পুরোপুরি বুঝে ওঠার জন্য একশ তেষট্টি দিন যথেষ্ট সময় নয়। তাই হুটহাট আমার এমন ছোটখাট ভুল হয়েই যায়। অবশ্য আজকের মতন ওকে এমন রেগে উঠতেও দেখি নি কখনো। ও কি আমাকে সত্যিই এত ভালবাসে! আমার কেন যেন বিশ্বাস হতে চায় না। কি আছে আমাকে এতটা ভালবাসবার! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখি। বলতে নেই, এলাকার নামকরা সুন্দরীই ছিলাম বিয়ের আগ পর্যন্ত। কেউ পারে নি আমাকে টেক্কা দিতে। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ, ধারাল নাক-চোখ-মুখ, দীঘল চুল, আকর্ষণীয় ফিগার...ঠিক যা যা প্রয়োজন লোকের মনযোগের কেন্দ্র হতে। আর সেইসব নিয়ে আমি যথেষ্ট সচেতনও ছিলাম বটে! কিন্তু তারপরও...তারপরও ভয় কাটে না। এতকিছুর মধ্যেও আমার সবচেয়ে যেটা জরুরী তারই অভাব ছিল প্রকট, আত্মবিশ্বাস। বিয়ের পরে সেটা কমার বদলে বেড়েছে বরং।

**

কাল রাতে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টের একটা গেট টুগেদার ছিল। ওর ব্যাচমেট, সিনিয়র, জুনিয়র অনেকেই এসেছিল। ওদের চোখে আমার স্বামীকে আবারো নতুনভাবে আবিস্কার করলাম। মেয়েমহলে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে সে সবসময় আত্মপ্রসাদে ভোগে, এ কথার প্রমাণই মিলল যেন। ব্যাচমেট আর জুনিয়ররাতো বটেই এমনকি অনেক সিনিয়র মেয়েরা পর্যন্ত এসে গলে গলে পড়ছিল। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে সবাই শোনাচ্ছিল একটাই কথা, 'ভাগ্য তোমার মেয়ে! এমন রূপবান, গুণবান স্বামী পেয়েছো! আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছো।' হাসিমুখে ছুড়ে দেয়া সেইসব হিংসার তীরে ছ্যাঁকা লাগছিল গায়ে ভীষণ। সত্যি বটে আমার স্বামী দারুণ রূপবান একজন মানুষ। বারবার দেখেও আমার আশ মেটে না, বিশ্বাস হয় না এই লোকটা আমার, একান্তই আমার! তাছাড়া আমার মত বেগুণে নয় সে। সুন্দর গান গায়, দরাজ গলায় আবৃত্তি করে, শখের অভিনয়ও করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোয়। আর লেখালেখিও করে বেশ। এমন একজন পুরুষ যে মেয়েদের কাছে খুব কাঙ্খিত হবে, এটাইতো স্বাভাবিক।
বাড়ি ফেরার পর থেকে চাইলেও পারছি না স্বাভাবিক হতে। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে এই মানুষটা শুধুই আমার নয়। দিয়া নামের লম্বাচুলো মেয়েটা নইলে ওর গায়ে অমন হাসতে হাসতে ঢলে পড়বে কেন? বন্ধু হলেই এমন করতে হবে নাকি! কিংবা চার বছরের জুনিয়র বিপাশার সাথে এত কিসের স্মৃতিচারণ? কবেকার বৃষ্টিতে ভেজার, ঝালমুড়ি খাওয়ার, একসাথে নাটকের রিহার্সাল দেবার। এখনও কি তাদের সাথে তেমন কোন স্মৃতিময় ঘটনা ঘটে? আমার অজান্তে? নইলে কাল থেকে সে এত উৎফুল্ল কেন! কেন! কেন! কিসের এত হাসাহাসি, গল্প, কথা, ঢলাঢলি! এসব আমার একদম সহ্য হয় না কিন্তু। বিয়ের আগে জানতামও না এই মানুষটাকে, কোথায় কার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে, গল্প, আড্ডা দিয়েছে, নাটক আর গানে রিহার্সাল দিয়েছে সেসব আমার জানার কথা নয়। কিন্তু এখন এই মানুষটা শুধুই আমার। আগেকার দিনের ফুলপরীরা হুট করে এসে তার পাশে উড়ে উড়ে বেড়ালে আমি সহ্য করবো কেন? আর সে এখন সেইসব ফুলপরীদের নিয়ে দিবাস্বপ্নে বিভোর। আমার দিকেও তার এতটুকু খেয়াল নেই।
এই যে অভিমানে আমার মুখে আঁধার ঘনিয়েছে, একবারওতো ফিরে তাকাল না। এমনতো হয় না কখনো। কিসের যেন ভয়ে, শংকায় একেবারে সিঁটকে গেছি আমি!

***

যে নিজে বিশ্বাসঘাতী কোন কাজ করে, তার নিজেরও ঠকবার ভয় বেশি থাকাটা স্বাভাবিক। আমার স্বামী আজকাল খুব নজরদারী করছে আমার ওপরে, খুব কৌশলে, গোপনে। কোথায় গেলাম, কত সময় কাটালাম, কে আমার কাছে ফোন করছে, কার সাথে ফেসবুকে কথা বলছি সেসবের কড়া তত্মাবধান চলছে। ভয় কি! আমিতো তোমার মত বহুফুলে উড়ে বেড়ানো মৌমাছি নই। অনেকের অনেক প্রলোভন পেলেও আমি শুরু থেকেই "ওয়ান ম্যান ওমেন"। তবে এসব থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাইরে থেকে যাই মনে হোক না কেন, আমার মতন তারও আত্মবিশ্বাসের তলিটা ফুটো। সেও ভয় পায়, হারাবার।
গত সপ্তায় মুভি দেখতে বসে মূল চরিত্রটার সাথে নিজেকে তুলনা করে ফেলেছিল দূর্বল এক মূহুর্তে।
-'ধরো আমি যদি ওই লোকটার মত অথর্ব হয়ে যাই তখন তুমি কি করবা?' -'ছিহ কিসব অলক্ষুণে কথা বলো!' ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ওর কথা থামিয়ে দেই।
-'না সত্যি! এমনতো ঘটতেই পারে, তাই না? ধর একটা এক্সিডেন্ট হল। খুব বাজেভাবে আমি ইনজুরড হলাম, কোমরের নিচ থেকে বাকিটুকু অবশ। একেতো অকেজো হওয়াই বলে। কি করবা তখন তুমি?' আমি ঠিক বুঝতে পারি না ও কি করতে চাইছে। খুব সূক্ষ্ম একটা মাইন্ড গেম? কেমন জবাব আশা করছে সে আমার কাছ থেকে? ভুল কোন উত্তর দেয়ার চেয়ে অসহায় চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকাটাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ।
-'কথা বলছো না কেন? মাত্রই তুমি সাতাশ এখন। তোমার শরীরের চাহিদা তুমি কিভাবে মিটাবে তখন?' ওর বুকে মুখ লুকিয়ে আদুরে গলায় বলি, 'আমার অত চাহিদা নেই।'
-'তোমার চাহিদা নেই? হাহ্! দেখছিতো গত সাত মাস ধরে। ক্ষুধার্ত একটা বাঘিণী তুই।' শক্ত হাতে আমার চুলের মুঠি ধরে বলে সে। কঠোর হয়ে উঠছে তার চোখ-মুখ, চোখে সেই খুনে দৃষ্টি। চুলের গোড়ায় টান পড়ছে জোর।
আহ ইটজ গেটিং সিরিয়াস নাউ! এই ফাঁদে ফেলতে চাইছো আমাকে? এত সহজে পা পিছলানোর মেয়ে আমি নইগো চাঁদ!
-'শরীরটাই কি সব ভাবো নাকি? আসল হল দখল, বুঝলে? তোমার ওপর আমার দখল। তুমি শুধুই আমার, তোমাকেতো ভাগাভাগি করতে পারবো না। এমনকি অন্য কেউ তোমার দিকে নজর দিলেও আমার সহ্য হবে না। তুমি শুধু আমার থাকলেই হল। শরীরের খেলা হোক কি না হোক, তাতে কিছু আসে যায় না।' ওর চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলি। ডুবে যেতে যেতেও ভেসে উঠতে দেখি ওর আত্মবিশ্বাসকে। হচ্ছে, কাজ হচ্ছে। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, আমার ওপরে ওর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এবার একটু রঙ ঢং করবার সময়। ওর ভেতর ঢুকে যেতে যেতে আদুরে গলায় বলি, 'এখন এসব বাজে কথা বাদ দাওতো। আদর দাও আমাকে। অনেক আদর!'
উন্মাতাল হয়ে উঠি দুজনেই।

****

ওর সম্পর্কে আমার ধারণা দিনকে দিন সে ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছে। সেও ভয় পায়, সন্দেহের তীরে বিদ্ধ হয়, কুৎসিত সব প্রশ্নবাণ ছোঁড়ে। ওকে এমনটা ভাবি নি। আজ বিকেলে আমার খুব ছোটবেলার এক বন্ধু এসেছিল, রাকিব। বহু বছর প্রবাসে কাটিয়ে ফিরেছে দেশে, ছোটবেলার সাথীর খোঁজ নিতে ছুটে এসেছে আমার বাসা অবধি। ফেসবুকের কল্যাণে যোগাযোগ ছিলই, জানতাম আসবে। ভুলটা করেছিলাম এ ব্যাপারে আমার স্বামীকে না জানিয়ে। না, সে কোন অভদ্রতা করেনি অবশ্যই। সত্যিকার ভদ্রলোক আমার স্বামী। তবে ভদ্রতার আড়ালে তার মুখের শীতল মুখোশটা চিনতে ভুল হয়নি আমার। যত সময় যাচ্ছিল, আমরা আমাদের পুরনো স্মৃতি নিয়ে যত বেশি উচ্ছল হয়ে উঠছিলাম, ততই বদলে যাচ্ছিল ওর চেহারা। অস্বীকার করবো না, ওকে হিংসায় জ্বলতে দেখাটা উপভোগ করছিলাম খুব। ভালবাসে বটে লোকটা আমাকে!
কিন্তু রাকিব চলে যাওয়ার পর থেকে গুমোট, থমথমে হয়ে উঠেছে ঘরের পরিবেশ। ওর চারপাশে ঘুরে ঘুরে একথা সেকথায় ভোলাতে চেষ্টা করছিলাম। বেশিক্ষণ লাগল না তার ফেটে পড়তে। কাছে টেনে নিয়ে খুব নরম হাতে আদর করতে করতে কথা শুরু করল সে।
-'কতদিনের পরিচয় তোমাদের?'
-'এখনো যোগাযোগ আছে?'
-'ফেসবুকে সারাক্ষণ এর সাথেই কথা বলো তাহলে?'
-'কি এত কথা?'
-'কতদিনের ভালবাসা তোমাদের? এতই যদি প্রেম তো বিয়ে করোনি কেন? এখন বুঝি নতুন করে প্রেম উথলে উঠেছে?' যতই বলছিল, ওর হাতের বাঁধন ততই শক্ত হয়ে উঠছিল। বদলে যাচ্ছিল মুখের ভঙ্গী। সেই টকটকে লাল খুনে দৃষ্টি চোখে। আমি ছটফট করে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করি ওর শক্ত হাতের বাঁধন থেকে, বৃথাই!
-'আহ ছাড়ো! কিসব কথা বলছো তুমি? মুখেও বাঁধে না!'
-'নোংরামি করার সময় মনে থাকে না? এখন আবার সাধু সাজছো না?' হিংস্র হয়ে উঠেছে ওর গলার আওয়াজ। 'খুন করে ফেলবো একদম। একটু তেড়িবেড়ি করলেই। খুন করে ফেলবো।' সত্যিই ওর মাথায় খুন চেপে গেছে। আমার গলায় এঁটে বসেছে ওর আঙুল, চাপ বাড়ছে ধীরে ধীরে। হায় খোদা, এ আমি কি করলাম! ওর ভালবাসার পরীক্ষা নিতে যেয়ে বিশ্বাসটাই হারালাম? ও যে আমাকে সত্যিই খুন করে ফেলবে। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, চোখের চারদিকে চাপ চাপ অন্ধকার, মাথা আর কাজ করছে না, অনেক চেষ্টাতেও গলা থেকে কোন শব্দ বের করতে পারছি না। দুহাত শিথিল হয়ে আসছে। এমন চন্ডাল রাগ ওর! এমন অন্ধ প্রেম! ও সত্যিই আমায় খুন করল!

*****

-'ক্ষমা করো। আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না সেসময়। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।' রাত থেকে একভাবে সে আমার পায়ের কাছে বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের পানিও শুকিয়েছে। কোনদিন ভাবিনি এত ভালবাসা দিয়েছে যে মানুষটা সেই এমন ভয়ংকর কোন কাজ করবে। আমার মনটাই ভেঙে গেছে। কিছু বলবো দূরে থাক, ওর দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছি। আবার যদি ক্ষেপে উঠে! এত অবিশ্বাস! এত সন্দেহ! কই আমিতো সন্দেহ করি না এইভাবে, যখন মেয়েরা তাকে ফোন করে অনেক অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে, কিসব মেসেজ পাঠায়, ফেসবুকে খুব ফ্লার্ট করে কমেন্টস করে, দেখা হলে গলে গলে পড়ে যায়। কই, আমিতো সেসব নিয়ে একটা কথাও বলি না। সেতো ঠিকই তার মত করে সমস্তকিছু উপভোগ করছে। আমি শুধু দেখেই যাই নিরবে, আর নিজের ভেতরে জ্বলে-পুড়ে যাই। কখনো কখনো মনে হয় এই বুঝি ফেটে পড়ল ভিতরে ফুটতে থাকা উত্তপ্ত গলিত লাভারা, কিন্তু আমি নিজেকে ঠিকই সামলে নেই। শুধু অভিমানে ফুলে ফুলে উঠি। সে সেসব দেখেও না দেখার ভান করে যায়। নিজে অমন করে বলেই বুঝি আমাকেও তেমনি ভাবছে? "আমি তোমার মত নই, তোমার মত নই আমি"। আবারও ফুপিয়ে উঠি। সে আমাকে গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে ধরে।
-'ক্ষমা করো। আর কোনদিন হবে না এমন। তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি।' আমি জানি সে ভালবাসে আমাকে। আমি বিশ্বাস করি! কিন্তু তার এই ভালবাসার ঝড়ে উড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি আমার ছিল না একেবারেই। ভেবেছিলাম সেদিনের পর থেকে সে সংযত করবে নিজেকে, আমার ওপর থেকে তার নোংরা সন্দেহ দূর হবে। অনুতাপ হবে সেই হিংস্র আচরণের জন্য। ভুল ভেবেছিলাম। যত দিন গেল, ওর সন্দেহ যেন বাড়তেই থাকল শুধু। এখন আর সেটা রাকিবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা, কিছু সিনিয়র ভাইও যোগ হয়েছে সাথে। ফেসবুকে কারো মজা করে করা নির্দোষ কমেন্টও তার সহ্য হয় না, কারো সাথে ফোনে দশ মিনিটের বেশি কথা বললেও মুখ-চোখ কঠিন হয়ে যায়। খোঁচা দিয়ে কথা বলাতো আছেই। গায়েও হাত তুলেছে এর মাঝে কয়েকবার। ওর ভদ্র, মার্জিত মুখোশের আড়ালের সন্দেহপ্রবণ, নোংরা, কুতসিৎ চেহারাটা আজকাল খুব প্রকট। এখনও সে প্রাণ-পণে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে সামলে নেবার, মাঝে মাঝেই আগেকার সেই প্রেমময় মানুষটাকে আমি দেখি। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যই। আমাদের সেই আদুরে চড়াই-চড়ুইনির দিনগুলো শকুনে খেয়েছে যেন। আজকাল ওকে ভীষণ ভয় পাই আমি। যতই বলুক না কেন গা ছুঁয়ে "আর হবে না", মনে হয় ও বুঝি আমায় খুন করতে চাইবে আবারো কোন একদিন।
ওর কাছে যাই, কথা বলি, ভালবাসি...কিন্তু মাঝখানে যেন কিসের এক দেয়াল! উত্তাল ভালবাসাবাসি শেষেও মনে হয় কোথায় যেন ফাঁক রয়েই গেল।

******

-'তুমি ভয় পাও আমাকে?'
আমি চুপ!
-'বিশ্বাস করো না?'
এবারেও চুপ আমি! নাক ফুলে উঠছে একটু একটু, চোখে হাল্কা জ্বালা।
-'আমি তোমাকে ভালবাসি।'
-'হু! আমি জানি।' টুপ করে ওর বুকে পানি পড়ে এক ফোঁটা। আমি ধড়মড় করে সরে যেতে চাই। পারি না, শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে রাখে সে আমাকে। ধরা গলায় বলে, 'কখনো চাইনি এমন কিছু করতে। এত চেষ্টা করি নিজেকে কন্ট্রোল করার, কিন্তু কোত্থেকে যে এই ভয়ংকর রাগ এসে সব উলোট পালোট করে দেয়! ভয় পেয়ো না আমাকে। প্লীজ, ভয় পেয়ো না। আমি ভালবাসি তোমাকে।' ওর সেই অনুনয়ের মধ্যেও আমি যেন কঠিন এক হুমকি শুনতে পাই। ভয় পেয়ো না, নইলে সত্যিই ভয়ংকর হবো! কাতর হয়ে আমার দিকে তাকায় সে, আশ্বস্ত হতে চায়। কিন্তু আমার চোখের অবিশ্বাসের ছায়া তার নজর এড়ায় না। হতাশায় দুমড়ে যায় আরো। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সরে যাই আমি, চোখ নামিয়ে নিচু গলায় বলি, 'আমায় একটু সময় দাও। বিশ্বাসটুকু ফিরিয়ে আনতে। আমার যে এখনও ভয় হয় তুমি খুন করবে আমাকে সুযোগ পেলেই!'
আমি ওকে আর বিশ্বাস করি না এটা যেন ওর সহ্য হয় না। তাই কখনো রেগে উঠে, উন্মত্ত হয়ে উঠে আমাকে খুন করবার নেশায়। পালিয়ে বেড়াই তখন আমি। আমাকে তখন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যেতে হয়। শিশুর মত তাকে ভুলাই যে তার করা ভয়ংকর অপরাধ মনে রাখি নি আমি, দিব্যি কাটি এই বলে যে শুধুমাত্র তাকেই ভালবাসি আমি, আর কেউ নেই। তবু তার বিশ্বাস হতে চায় না। চলতে থাকে কড়া নজরদারি। তাই আমাকেও এখন খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। এতকিছুর পরেও শেষ রক্ষা হল না। একদিন বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম ফোনে। হঠাৎ দেখি আমার পাশেই ওর হিংস্র মুখ। হাতের তীব্র ঝাপটায় ফোনটা পড়ে গেল, চুল টেনে ধরে সে আমাকে হিচড়ে নিয়ে গেল শোবার ঘরে। ভয়ে-আতংকে তখন বাধা দেয়ার শক্তিটুকুও হারিয়েছি। বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে ঝাপিয়ে পড়ল সে, কিছু বুঝে উঠার আগেই গলায় এঁটে বসল তার শক্ত মুঠি। চাপ বাড়ছে, ধীরে ধীরে। সামান্য একটু বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করছি আমি। প্রাণপণে বোঝাতে চাইছি ভুল বুঝেছে সে আমায়। আমি বিশ্বাসঘাতিনী নই। জানি না কখন সে চোখ মেলে চেয়ে দেখেছিল আমার নীল হয়ে যাওয়া মুখ। তার অনেক আগেই জ্ঞান হারিয়েছি আমি।
এ ঘটনার পর সে হতাশায় মুশড়ে পড়ল একেবারে। অফিস আর বাসা, এছাড়া আর কোথাও এখন আর যায় না সে তেমন। বন্ধুদের আড্ডা, গান, মুভি, ফেসবুক, মেয়েদের তোষামোদ কোনকিছুতেই খুব একটা আগ্রহ নেই আর এখন। বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে। কাজের ফাঁকে দেখি গভীর মনযোগে আমাকে লক্ষ করে প্রায়ই, আর কি যেন ভাবে। সময় পেলেই হাত ধরে কাতর স্বরে প্রশ্ন করে, 'তুমি কি এখনও ভয় পাও আমাকে? বিশ্বাস করো না? তোমার এখনও মনে হয় আমি তোমাকে খুন করতে পারি?' বুঝি আমার একটা কথাতেই ওর পৃথিবী আমূল বদলে যাবে, ও আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তবু আমি চাইলেও পারি না তাকে আশ্বস্ত করতে। তার চোখের দিকে চাইতে। আমার নির্বাক দৃষ্টি মেঝেতে বিদ্ধ হয়।

*******

আমার স্বামী মানসিকভাবে পুরোপুরিই ভেঙে পড়েছে। এখন আর আগের মত রাগ, উন্মত্ততা নেই, সন্দেহও না। সে নিজেও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সে চাইলেই পারে আমাকে খুন করতে। তার মধ্যে একজন খুনির বাস, এই চিন্তাটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেকদিন হল বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন সে। যার মুখে একসময় দেশ-বিদেশ ঘোরার গল্প শুনতাম, তার গুণমুগ্ধ নারীকূলের গল্প শুনতাম, গান, কবিতার গল্প শুনতাম সে এখন আর সেসব নিয়ে ভাবে না। তার খোঁজও তাই রাখে না এখন আর কেউ। যে মানুষটা উন্মাতাল ভালবাসায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতো, তার শরীর এখন আর জাগে না। ডাক্তার তাকে কড়া ঘুমের অষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে বেশিরভাগ সময়ে। এখন সে নিতান্তই জড়ভরতে পরিণত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে শরীর, নষ্ট হয়েছে সুন্দর চেহারা।

সে এখন চেনে শুধু আমাকে! শুধুই আমাকে!

ঘুমাচ্ছে সে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে একতালে বুক উঠানামা করছে। দীর্ঘ ঘুমের পরেও মুখে কী ভীষণ ক্লান্তির ছাপ! ঘুমের ঘোরেই আমার হাত চেপে ধরে আছে তার শক্ত মুঠোয়। শরীরটাই কি আর সব! তারচেয়ে বড় হল দখল, একান্তই নিজের করে পাওয়া। এই যে এখন সে আমাকে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, কাউকেই চেনে না, এই যে এখন তার চারপাশে উড়ে বেড়ানো ফুলপরী আর পাখিরা নেই, আছি শুধুই আমি...সে কি আর এমনি এমনি পাওয়া যেতো! ওকে একান্তই নিজের করে পেতে কিছু ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে, প্রকৃতিই করে দিয়েছে আমার হয়ে সেসব। এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। আমার ভালবাসায় এতটুকু ভাগাভাগি সইতে পারবো না যে!

ওর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে উঠে গেলাম ব্যালকনিতে। দিনের আলো নিভে যাবার আগে শেষবারের মত জ্বলে উঠেছে আগুনের শিখার মত। কি অপার্থিব সৌন্দর্য! এত সুন্দর যে দুজন মিলে উপভোগ করতে হয়! বুকে শ্বাস চেপে আগুন জ্বলা আকাশ আমি দেখি, একা...

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৭
৬৬টি মন্তব্য ৬৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×