প্রথম পর্ব
তোর কাছে চিঠি (৬)
২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০১২
কতদিন লিখি না তোকে! অথচ রোজই ভাবি আজ লিখবোই। কিন্তু কেমন যে একটা আলস্য পেয়ে বসে, তাই লিখতে বসাই হয় না। রাগ হয়েচে মার ওপর? একটু একটু রাগতো এখন তোর হয়ই, খুব জানি। কিন্তু মার ওপর কি আর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায়!
এখনতো তুই বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছিস। পাক্কা এক ফুট। আর দেখতেও একদম ছোট্ট একটা ডলপুতুল হয়ে গেছিস। হাত, পা, নাক, ছোট ছোট চোখ, একটা মুখ, হাঁসের বাচ্চার রোমের মতন চুল, মুখের ভেতরে ছোট ছোট দাঁতের গোড়াও গজিয়ে গেছে। আমার সোনামণিটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে!
যেদিন তোকে প্রথম দেখলাম আল্ট্রাসনোগ্রামের স্ক্রীনে, ছোট্ট মানুষটা তুই ভেসে বেড়াচ্ছিস, হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে রাখা, আর তোর বুকটা কী ভীষণ শব্দে ধুকপুক করে যাচ্ছে! তোকে কেমন করে বোঝাবো কেমন লাগছিল! টলোমলো চোখে শুধু চেয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর স্ক্রীনটা ঝাপসা হয়ে এল। তোর বাবাকে ডাকা হল দেখার জন্য। তার চেহারাটা যদি দেখতি তখন। মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, বুঝতে পারছিলাম গলা শুকিয়ে কাঠ, চোখে কেমন উদভ্রান্ত দৃষ্টি! ওই বিশাল মানুষটা, বের হয়ে দেখি সেও চোখ মুছছে। সোনামানিক, তোকে আমরা অনেক অনেক ভালবাসি।
আর যেদিন তুই প্রথম নড়ে উঠলি, সেওতো চব্বিশদিন হয়ে গেল। পেটের ভেতর ছোট্ট নরম একটা ধাক্কা। একেবারে বোঝা যায় কি যায় না, এতই হালকা। ওই প্রথম, তোর অস্তিত্বের জানান দিলি তুই। কেঁদেছিলাম ওইদিনও, বড় সুখের কান্না সেটা।
আর এখনতো তুই খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস। রীতিমত যুদ্ধ চালিয়ে যাস মাঝে মাঝে। আর জোরেসোরে গান চললেতো কথাই নেই। একেবারে ব্রেক ড্যান্স শুরু হয়ে যায়। বাবার মতই গানপাগলা হচ্ছিস বুঝি দিনকে দিন! কাল রাতেইতো, বাংলাদেশের খেলায় সাপোর্ট দিতে তোর সে কি লাফালাফি! কালতো আমার হেরেই গেলাম সোনা। মন খারাপ হয়েছিল খুব, বাবার মত? এইজন্যই আজ এত চুপচাপ হয়ে আছিস? কাল হেরেছি তো কি হয়েছে? এরপরের বার আমরা ঠিকই জিতবো দেখিস। তোকে অবশ্যই এটা মেনে নেয়া শিখতে হবে যে, খেলায় হারজিত আছে, থাকবেই। কিন্তু আমরা চেষ্টা করে যাবো।
মার শরীর আজকাল খুব খারাপ থাকে, তুই কি বুঝিস? খুব কষ্ট করে কাটাতে হচ্ছে দিনগুলো। কিন্তু তোর জন্য মা সব করতে পারে। শুধু তুই যেন ভাল থাকিস, সেজন্য যেকোন কষ্ট সহ্য করতে পারে। এই বিশ্বাসটুকু রাখিস।
তোকে অনেক ভালবাসি ছোট্ট পাখি...অনেক অনেক বেশি...
তোর কাছে চিঠি (৭)
১৭ই অক্টোবর, ২০১২
আমার আজকাল তোকে নিয়ে কী ভীষণ ভয় যে হয়েছে! সবকিছুতেই আমি ভয় পাই। কিছুদিন আগেও যে ভয়টা আমি পেতাম শুধু তোর বাবাকে নিয়েই, বিচিত্র সব ভয়!
আমি ইদানিং বড় বড় দালান দেখলে ভয় পাই। মনে হয় এখন যদি ভূমিকম্প হয়, কি উপায়টা হবে। যদি সব হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে, ধ্বংস হয়ে যায়। আমরাতো কেউ বাঁচবো না। তাহলে আমার সোনামণিটাকে আমার আর দেখাই হবে না। ছুঁয়ে দিতে পারবো না তোকে, আদর করা হবে না। ভয়ে আমার গা শিউরে উঠে। একটা মুভী দেখেছিলাম কিছুদিন আগে, ইনসাইড নাম। সবটা তোকে বলবো না, ভয় পেয়ে যাবি। কিন্তু কয়দিন ধরে রোজই যখন রাতের বেলা রাস্তা দিয়ে একা ফিরি আমার মনে হয় খুব ষন্ডা-গুন্ডা লোকজন এসে আমাকে আক্রমণ করবে আর ওইভাবে তোকে নিয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। আমাকে যদি কেটে-কুটে ফেলে, তাতে আমার একটুও ভয় নাই। কিন্তু তোকে যদি নিয়ে যায় সোনা, আমি কি নিয়ে থাকবো তখন! আমি একটুতেই তাই চমকে উঠি।
এই পৃথিবীর আর কাউকে তোর জন্য নিরাপদ মনে হয় না, কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। তোর এক খালামণির কথা শুনেছিলাম, বাবু হওয়ার পর ডাক্তাররা তাকে গোসল করানোর জন্য একটু সরিয়ে নিতেই সে নাকি জোর চিৎকার করছিল, 'কোথায় নিচ্ছেন আমার বাবুকে!' তখন শুনে হেসেছিলাম। কিন্তু এখনতো আমারও এমন মনে হয়। এমন সব মানুষদের ভয় পাই আর সন্দেহ করি...যারা কখনো কোনদিন তোর কোন ক্ষতি করতে আসবে না। খুব খুব ভালবাসে তারা তোকে। তবু তাদেরও আমার ভয়। আমার কথা শুনলে ওদের নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হবে। তুইও কি আমাকে খারাপ ভাবছিস সোনা? কি করবো বল! আমি যে মা!
তোর নানুমনিকে যখন বলি আমার কত কষ্ট হচ্ছে, তখন আমাকে বলে "মা হতে হলে কষ্ট করতেই হয়। কষ্ট না করলে মা হওয়া যায় না। আমরাও এমন কষ্ট সহ্য করেছি তোমাদের জন্মের সময়।" এরজন্যই বুঝি তোর জন্য আমার এত টান, এত ভালবাসা! মায়েরাতো এমনই হয়।
এরজন্যই বাঘ যখন নিজের বাচ্চাকে খেতে আসে, বাঘিনী জীবন বাজি রেখে লড়াই করে। তখন বাচ্চাই তার জন্য সবকিছু। মা পাখিটা নিজে না খেয়ে বাচ্চাকে খাওয়ায়। মাতো মা-ই, যে পাখি মা-ই হোক, বাঘ মা-ই হোক, আর মানুষই হোক।
কাল যখন সন্ধ্যার পর থেকে তোর নড়াচড়া টের পাচ্ছিলাম না, তুই কি জানিস কেমন অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম আমি! এইভাবে মাকে টেনসনে ফেলতে হয় বুঝিরে পাজী! ঘুমাচ্ছিলি তুই? সারাদিন খেলে টেলে ক্লান্ত ছিলি খুব। একটুখানি টুক টুক করেওতো জানান দিতে হয়, মা, আমি আছি। খুব ভাল আছি। নাকি সারারাত ঘুম হয় নি বলে ক্লান্ত ছিলি খুব! কষ্ট হয়েছিল তোর? আর তোকে কষ্ট দিবো না। প্রমিজ করছি সোনা। তুই ভাল থাকবি, অনেক অনেক ভাল। মা তোর জন্য কত অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তাতো তুই জানিস। মার জন্যই তোকে ভাল থাকতে হবে।
তোর জন্য অনেক অনেক ভালবাসা...
তোর কাছে চিঠি (৮)
১লা নভেম্বর, ২০১২
আজকাল প্রায়ই মন খারাপ থাকে আমার, বিষণ্ণ থাকি খুব। সারাক্ষণ গোমড়ামুখে বসে থাকি, লুকিয়ে লুকিয়ে চোখও মুছি। যেন কত দুঃখ আমার মনে। দুঃখ পাওয়ার মত কিছু ঘটেছিল বটে। তবে আমি প্রমিজ করেছিলাম সেসব নিয়ে একদম ভাববো না, সব ভুলে যাবো। কিন্তু ভুলতে পারছি কি ছাই! আরো নতুন নতুন কত কি ঘটে মন খারাপের...নতুন-পুরানো সব মিলে আমি তখন আরো বেশি করে ডুবে যাই বিষণ্ণতায়।
আমার এইসব মন খারাপের সময়ে তুই আমার একটুখানি আনন্দ। তুই কি টের পাস এখন মায়ের মন খারাপ, দুঃখী মুখে বসে আছে বোকা মেয়েটা! আর তখন তুই টুক টুক করে নড়ে চড়ে মাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করিস বুঝি! মায়ের জন্য কষ্ট হয় বুঝি তোর? মায়ের কাছে থাকলে তখন কি করতি সোনা? গলা জড়িয়ে ধরে খুব করে আদর করে দিতিস, চুমু দিয়ে গাল ভরে দিতিস? কবে যে তোর ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো গালে ছোঁয়াতে পারবো, তোর তুলতুলে পা দুটোয় চুমু খেতে পারবো! অপেক্ষার সময়টা আজকাল বড্ড দীর্ঘ লাগছে।
তুই আসছিস...তাই নিয়ে কত লুকোচুড়িই না করতে হয়েছে আমাকে শুরু থেকে! তোর নানুমণি, দাদী কড়া করে আমাকে না করে দিয়েছিলেন হুট করেই যেন কাউকে বলে না বসি তোর আসার খবর। বলতে নেই নাকি! আমি ভেবেই পাই না, এত্ত খুশির একটা খবর কেন লুকোতে হবে, কেন বলতে নেই! কতজনকেই দেখেছি বাবু আসছে, বাইরে থেকে দেখে বুঝা যায় বলে তাদের লজ্জার শেষ নেই। লোকের সামনে যেতেও তাদের লজ্জা। আমাকেও কতজন বলেছে একটু সামলে থাকো, ঢেকে-ঢুকে থাকো। কিন্তু আমি এটাই বুঝি না, এতে লজ্জার কি হল!
আমি মা হচ্ছি...এরচেয়ে বড় গর্বের বিষয় আর কি হতে পারে! মা হওয়ার সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠেছে আমার শরীরে, এরচেয়ে বড় সৌন্দর্য আর কি হতে পারে! ওইদিন শাড়ী পরে যখন নামছিলাম সিঁড়ি দিয়ে, আমার নিজেরই নিজেকে কেমন পুতুল পুতুল লাগছিল। এটা যে কত সুন্দর একটা ব্যাপার, যারা বুঝে না বা বুঝার চেষ্টাও করে না, তাদের জন্য সত্যিই দুঃখ হয়।
তোকে কেন এইসব কথা বলছি তুই কি বুঝতে পারছিস? মনে রাখিস, সবাই সবসময় চাইবে তাদের সংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা তোর উপরে চাপিয়ে দিতে, তোকে বাধ্য করবে সেইসব কাজ করতে। তুই কিন্তু কখনো এসব ভুলকে প্রশ্রয় দিবি না। যা সত্য আর সুন্দর তাই ধারণ করবি। তবে সেটা করতে গিয়ে অন্যের মনে দুঃখ দিস না যেন। তোকে শিখতে হবে কিভাবে একইসাথে অন্যকে ভাল রাখা যায় আবার সঠিক পথে চলে নিজেও ভাল থাকা যায়।
মায়ের মত নরম মনের হোস, কিন্তু দৃঢ় থাকিস নিজের অবস্থানে। কাউকে সুযোগ দিবি না তোকে কষ্ট দেয়ার, বা তোর অবস্থার সুবিধা নেয়ার। অনেক অনেক মুহূর্তই আসবে তোর জীবনে এমন, যখন যুক্তির চেয়ে আবেগ বড় হয়ে দাঁড়াবে। আমি তোকে কখনো আবেগ বিসর্জন দিয়ে যুক্তিসর্বস্ব হতে বলছি না, কিন্তু আবেগের জোয়ারটা এমনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করিস যেন সেটা তোকে গ্রাস না করে নেয়। সবসময় মনে রাখিস, অন্যকে সুখী করা যেমন অসম্ভব আনন্দের একটা ব্যাপার...তেমনি নিজে সুখী হওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করিস সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে।
আজ তোকে খুব কঠিন সব কথা বলে ফেললাম বোধহয়। ভয় পেয়ে যাসনিতো সোনা? ভয়ের কিচ্ছু নেই। যখন এইসব ঘটনাগুলোর ভেতর দিয়ে যাবি, একটু সাবধানে পা ফেললেই দেখবি প্রতিটা ব্যাপার কতই না সহজ আর সুন্দর।
ভাল থাকিস আমার লক্ষ্মীসোনা...অনেক অনেক ভাল...
তোর কাছে চিঠি (৯)
১৯শে নভেম্বর, ২০১২
তুই এখন আমার অস্তিত্বে এমনভাবে মিশে আছিস, প্রতিটা মুহূর্তে তোকে বলবার মত এত এত কথা থাকে যে আলাদা করে আর লিখবার কথা মনে থাকে না। এই বড়-সরটা হয়েছিস তুই এখন। গায়ে বোধহয় শক্তিও হয়েছে বেশ। হঠাৎ হঠাৎ এমন একেকটা ঢুশ মারিস, মাতো ব্যথাই পেয়ে যাই...দুষ্টুটা! আর একটু পর পরই একটা করে ডিগবাজি। কদিন আগেও হাত দিয়ে না ধরলে বোঝা যেতো না কি করছিস। কিন্তু আজকাল বাইরে থেকেই বেশ বুঝতে পারি। পেটের এপাশ থেকে ওপাশ যখন ঘোরাফেরা করিস, পেটটাও তখন এদিক ওদিক ফুলে ওঠে। গান শুনালেতো কথাই নেই, ওইদিন বাবা যখন গান গাইছিল তুইও এদিক ওদিক খুব একচোট নেচে নিলি। আর বাবারতো একেবারে চোখ ছানাবড়া। তোর বাবার ধারণা তুই ছেলেই হবি, মেয়েদের গায়ে নাকি এত শক্তি নাই। তুই যদি মেয়ে হোস, তবে বাবাকে দেখিয়ে দিস, মায়ের মত সবাই অত দুর্বল নয়। মেয়ে বলে তুই দুর্বল, এমন অপবাদ কক্ষণো কেউ যেন দিতে না পারে।
পেটের ভেতর এতটুকু জায়গায় তুই আছিস এখন। তোকে জায়গা দিতে তাই আমার পেট আরেকটু বড়, আরো একটু বড় হল। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই চামড়া কিছুটা ফেটে গেছে পেটের আশেপাশের। প্রথম প্রথম আমার খুব মন খারাপ হতো এটা দেখে, "কেমন বিচ্ছিরি হয়ে গেছে দেখতে"। কিন্তু ওইদিন খুব ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম, চারদিকের চামড়ায় ফাটা ফাটা দাগ দেখতে কেমন বাঘের ডোরাকাটা দাগের মত লাগছে। মনে পড়ল কয়দিন আগে দেখা একটা ভিডিওর কথা, যার শিরোনাম ছিল এমন "I am a proud tigress who earned her scratch…"।
সত্যি আমি সেই গর্বিত বাঘিনী, যাকে বহু কষ্ট স্বীকার করে তার ডোরাগুলো অর্জন করে নিতে হয়েছে। পৃথিবীর কোন পুরুষের এই গর্ব অর্জন করার সৌভাগ্য হবে না কখনো। তারা এই কষ্ট, এই ত্যাগের সামান্যতমও কোনদিন অনুভব করতে পারবে না। পারবে না অনেক নারীও। যারা মা হওয়ার এই আনন্দ, এই গর্ব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে, তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই।
তোকে এইসব কথা বলছি কারণ আমি চাই তুই এই গর্বের ভাগীদার হবি। যদি মেয়ে হোস তাহলে একদিন তুইও হবি একজন গর্বিত বাঘিনী। আর যদি ছেলে হোস তবে সম্মান করতে শিখবি মেয়েদের, মায়েদের।
তুই মেয়ে বা ছেলে যাই হোস না কেন তুই যেন সুস্থ, স্বাভাবিক, একজন ভাল মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে আসতে পারিস সেই দোয়াই করি।
অনেক অনেক ভাল থাকিস আমার সোনাটা!
তোর কাছে চিঠি (১০)
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২
তোর বুঝি এক্ষুণি এক্ষুণি চলে আসবার খুব তাড়া হয়েছিল! এইজন্যই মাকে আর বাড়িসুদ্ধ লোককে এইভাবে ভয় দেখালি সেদিন। সকাল থেকে যখন হঠাৎ দেখলাম তোর কোন সাড়া-শব্দ নেই, নেই তো নেই...প্রায় বারটা বেজে যাওয়ার পরেও, আমিতো ভয়েই অস্থির। তোর বাবাকে বললাম, সে প্রথমে বুঝতেই পারল না। ভয়ে ভয়ে তোর নানুমণিকে ফোন করলাম। উনিতো সাথে সাথেই বললেন, তক্ষুণি হাসপাতালে চলে যেতে। তারপরও একবার ডাক্তারকে ফোন করে নিলাম। ডাক্তারও যখন একই কথা বলল, তখন সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। কোন কিছু চিন্তা করার আর সুযোগ ছিল না। তৈরি হয়ে তোর বাবার সাথে চলে গেলাম হাসপাতালে। তারও বেশ কিছুক্ষণ পর টের পেলাম তোর নড়া-চড়া একটু একটু করে। ওফ কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম!
হাসপাতালে যেতেই ডাক্তার পেটের ওপরে একটা যন্ত্র রেখে তোর হার্টবিট মাপলেন। ধুক পুক...ধুক পুক...ধুক পুক...ওহ, মনে হচ্ছিল যেন টগবগ টগবগ করে পাগলা ঘোড়া ছুটেছে। অত অস্থির কেন রে? এক্কেবারে বাবার মতই হয়েছিস। যে নার্স হার্টবিট মাপছিল সে তো এই নিয়ে এমন মজা করছিল!
অত জোড়ে আর দ্রুত ধুক পুক হচ্ছিল শুনে সে বলছিল, ছেলে হবে তোমার। আমার জামাই আসবে। ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয়ের মিছিল নিয়ে।
সত্যি যদি তুই আজ চলে আসতি, বেশ হতো। কিন্তু সোনা আমার, এখনো সময় হয়নি কিন্তু। যদিও জানি চলে আসবার জন্য তুই অস্থির হয়ে আছিস খুব। আমিও অস্থির হয়ে আছি অপেক্ষার এই দিনগুলো কবে শেষ হবে সে আশায়। তারপরও আরো কিছুদিন তোকে অপেক্ষা করতেই হবে। আমাকেও।
আর অল্প কয়টা দিন সোনা। এই কয়টা দিন একটু ধৈর্য ধরে থাক। আর ভাল থাকিস খুব।
তোর কাছে চিঠি (১১)
২৭শে জানুয়ারী, ২০১৩
অবশেষে তুই এলি! যেকোন দিন চলে আসবি তার জানান দিচ্ছিলি আরো দু-তিনদিন আগে থেকেই। যেমন তোর নানু আর দাদী বলেছিল, একটু একটু ব্যথা হবে, আস্তে আস্তে বাড়বে...
শেষের দিনগুলোতে আমি অপেক্ষা করতে করতে আমি অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন ব্যাপারটা শুরু হল তখন কেমন যেন ঘাবড়ে গেলাম। মনে হল 'এখনই না, আরেকটু সময় পেলে ভাল হতো'।
হঠাৎ করেই ওইদিন ভোর সাড়ে ছটায় ঘুম ভেঙে গেল, চোখ মেলে বুঝতে চাইছিলাম কি হল। ওই সময়ে ব্যথার অনুভূতিটা জানান দিল। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন করলাম তোর নানুকে। বলল, আরো কিছুক্ষণ দেখতে। ব্যথাটা আরেকটু বাড়ে কি না। বাড়ছিল...একটু একটু করে...বুঝলাম সময় হয়ে আসছে। ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। তারপর তোর বাবাকে জাগালাম। তোর দাদী উঠে এসেই বলল, এখনি হাসপাতালে যাচ্ছি আমরা।
যেতে যেতেও আমি খুব স্বাভাবিক আচরণ করছিলাম, যেন কিছুই হয় নি। সবার মধ্যে আমিই বোধহয় সবচেয়ে নিরুদ্বেগ ছিলাম। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরে ডাক্তার সব দেখে-শুনে বলল, দেরি হবে। আমার ডাক্তার আসবে আড়াইটায়। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে। জানি না, ঠিক কয়টায় আমার ব্যথাটা ভীষণরকম বেড়ে গেছিল। বেডে শুয়ে একটু পর পর মুচড়ে উঠছিলাম। তোর বাবা শুকনো মুখে হাত ধরে বসেছিল পাশে। এরমধ্যে সিটিজি করা হল। তোর হার্টবিট খুব কম দেখাচ্ছিল, কোন নড়াচড়া নেই। এরমধ্যেই ডাক্তার এসে বলল আর দেরি করা যাবে না। এক্ষুণি সিজার করতে হবে। আমাকে ওটি ড্রেস পরিয়ে যখন হুইল চেয়ারে করে লিফটে তোলা হল, তখন আমি একেবারেই একা। তোর বাবা বা দাদী কেউই ছিল না সাথে। ব্যথায় অস্থির লাগছিল, সেইসাথে কী ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে! শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম লিফটের দেয়ালের দিকে।
ওটিতে পৌঁছানোর পর আমার বোধ প্রায় লুপ্ত হল বলা চলে। পরে ভাবছিলাম 'মানুষের জন্য এটা বিশাল সৌভাগ্য যে তারা ব্যথার অনুভূতি ভুলে যায়। তা না হলে দ্বিতীয়বার সন্তান ধারণের চিন্তা কোন মা কখনো করতো না'। ওটি টেবিলে শোয়ানোর প্রায় দশ মিনিট পরে যখন আমাকে এ্যানেসথেসিয়া দিল, ম্যাজিকের মত আমার সমস্ত ব্যথাতো বটেই কোমরের নিচ থেকে বাকিটা একেবারে অসাড় হয়ে গেল। আমার মুখের সামনে একটা পর্দা টানিয়ে দিল যাতে আমি কিছু না দেখি। কিন্তু উপরের বিশাল লাইটের গ্লাসে আমি সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। নিপুণ হাতে ডাক্তার আমাকে কেটে কুটে ফেললেন। এমনকি চামড়ায় যে টানটা পড়ছিল, তাও আমি টের পাচ্ছিলাম। ছোপ ছোপ লাল রক্ত দেখা যাচ্ছিল। তখন আর ভয় পাচ্ছিলাম না মোটেও, একমনে আল্লাহকে ডাকছিলাম শুধু। তারপর কতক্ষণ কতক্ষণ পরে শুনলাম তোর কান্না। তোকে তুলে নিয়ে ডাক্তার অন্য একজনের হাতে দিয়ে দিল। তারা তোকে অন্য রুমে নিয়ে গেল। আমি শুনতে শুনতে কেমন নিস্তেজ হয়ে গেলাম। ঘুমে চোখ নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল। তখনও জানি না আমার মেয়ে হয়েছে নাকি ছেলে। ডাক্তার দুজন গল্প করতে করতে কাটা অংশটুকু সেলাই করছেন, আর আমি ঘুমে ঢলে পড়ছি। এরমধ্যেই আয়া এসে দেখাল, দেখেন আপনার মেয়েকে। তুই জানিস তোকে দেখে কোন কথাটা প্রথমে বলেছিলাম? 'বুচি হইছে একটা!' আমার মত খাড়া নাক পাস নি দেখে বড় দুঃখ পেয়েছিলাম তখন। আরো চারঘন্টা আমি ছিলাম পোস্ট-অপারেটিভে। এরমধ্যে দুবার তোকে নিয়ে এসে খাইয়ে নিয়ে গেল। আমার এমন কাঁপুনি উঠেছে তখন, তোর চেহারাটাও ঠিক করে তখনও দেখি নি। কেবিনে নেয়ার পরেও না। আমিতো শুয়েই ছিলাম ওইদিন, তারপর দিনও দুপুর পর্যন্ত।
যখন প্রথমবারের মত তোকে কোলে নিলাম, মনে হচ্ছিল এই পুটুলিটা কি সত্যি আমার! অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলাম। প্রায় দুটো রাত আমি নির্ঘুম তোকে কোলে করে বসেছিলাম নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য যে তুই সত্যিই আমার! সত্যিই আমি এখন এক মেয়ের মা!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৫০