এক ভিক্ষুক গিয়েছেন এক বাড়িতে ভিক্ষে আনতে। গৃহকর্ত্রী তাকে বসিয়ে রেখে ভেতর বাড়িতে গেলেন চাল আনতে। গিয়ে তিনি তার পোষা কুকুরকে ছেড়ে দিলেন। অপরিচিত লোক দেখে কুকুর ভিক্ষুককে কামড়ানোর সমূহ চেষ্টা করছে। ভিক্ষুকের বেহাল দশা দেখে ভেতর বাড়ি থেকে গৃহকর্ত্রী মিটিমিটি হাসছেন। কুকুরের তাড়া খেয়ে ভিক্ষুক চিৎকার করে বলছে,“ভিক্ষা চাই না মা! কুত্তা সামলা”। কুকুর’র বিবর্তিত শব্দের জন্য আমাকে কেউ দয়া করে দোষারোপ করবেন না কেউ। ভিক্ষুক এভাবেই বলেছিলেন। উদাহরণটি রুপক হলেও দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকেও একসময় এটা বলতে হবে। কিন্তু কেন? কি এমন সংকট যে আমাদের এমনটা বলতে হবে? বলছি! বলার জন্যই তো লিখছি।
দেশে এই মূহুর্তে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫০ টি! এর মধ্যে ১ মাসের ব্যবধানে সদ্য অনুমোদিত ৪ টি! বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিই মনে হচ্ছে বর্তমানের একমাত্র এজেন্ডা। আপনি এখন বলতেই পারেন যে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে তাতে সমস্যা কোথায়! বরং উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে ।তাতে তো সামনের সময়টা আরো ভালো হবে। এটা তো সবারই জানা যে জাতিগত উন্নতি আর্থিক নয় বরং সামাজিক উন্নতি দিয়ে নির্ধারিত হয়। উচ্চ শিক্ষার দ্বার যত উন্মোচিত হবে ততই মঙ্গল।
আমিও তাই বলি, মঙ্গল। কিন্তু দ্বার উঠতে উঠতে যদি দ্বারসুদ্ধো উঠে যায়, বিপদটা হবে তো তখন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো চারটেখানি কথা নয়। এখানে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রিই শুধু দয়ো হয় না, দেয়া হয় সামনের সময়টার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার স্পেশাল কোচিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি? সেটা শুধু পুথিঁগত বিদ্যাতে সীমাবদ্ধ নয়। উচ্চতর গবেষণা করে জ্ঞানের নতুন দ্বার উন্মোচন করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সে জন্য প্রয়োজন যথাযথ জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষক। এই মূহুর্তে বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা নিয়োগ পাচ্ছেন তাদের একটা বড় অংশের নেই উল্ল্যেখযোগ্য গবেষণা, নেই তেমন আগ্রহও। তাহলে এই যে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেখানে কারা পড়াবেন? যারা কেবল গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। তাদের না আছে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, না আছে কোন মৌলিক গবেষণা। অগাজগা দিয়ে চলবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো।
আরোও আছে। দেশের মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে শিক্ষিত বেকার। নতুন যে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত যোগ্য কাজ। আপনি যত কিছুই বলুন না কেন, একজন আন্ডারমেট্রিক কিংবা নিরক্ষর লোক যে কাজটি অনায়েসে করতে পারবেন একজন গ্র্যাজুয়েট হয়তো বাধ্য হয়ে সে কাজটি করবেন। তাহলে সে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে জ্ঞান অর্জন করেছেন তার সুযোগ্য ব্যবহার করার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। এতে করে তৈরি হবে নতুন বেকারত্ব। বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে তারা কিন্তু যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন না। বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের উচ্চস্তরের কর্মকর্তার লিস্ট দেখলেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এটা তিক্ত সত্য কথা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারছেনা। কিন্তু কেন? তার অনেকগুলো কারন রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারন হচ্ছে পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব। আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী, গবেষনার বাজেট মাত্র ৪ কোটি। মাথাপিছু চার হাজার করে টাকা। এই টাকা দিয়ে গবেষণা করতে হলে শিক্ষার্থীকে না খেয়ে থাকতে হবে। সকালের নাস্তার টাকা দিয়ে সার্ভের প্রশ্নমালা প্রিন্ট করাতে হবে। এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এমনটা কিন্তু হচ্ছে।
এই যে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে তাতে করে একদিকে যেমন একটি কর্মবিহীন ভবিষ্যত তৈরি হতে যাচ্ছে তেমনি পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটে সরকারি অনুদানের কাটছাট হতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়বে, শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়বে, শিক্ষিত বেকার বাড়বে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য জাতীয় ঋণ (পাবলিক ডেট) বাড়বে, ঋণ পরিশোধ করার জন্য কর বাড়বে, বাড়বে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম, এর লেজ ধরে বাড়বে মূদ্রাস্ফিতি।এই খরচ বৃদ্ধির দুষ্টচক্র কিন্তু চলতেই থাকবে। এতো কেবল একটার উদাহরণ বললাম। আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে। এটাকে অর্থনীতিতে বলা হয় “Fiscal Headroom” । সে আলোচনা অন্য কোনদিন। যে কয়টা মেগা প্রজেক্ট এখন আছে, তার সাথে যে পরিমান জাতীয় ঋণ আছে তাতে সেদিন বেশী দুরে নয় যে দিন দেশের মানুষ বলবে “ উন্নয়ন চাই না মা! খরচ সামলা!” কিন্তু সামলানোর জন্য ভিক্ষুকের মতো সেদিন দেশের মানুষ তেমন মা পাবে কি না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
(ছবিসূত্র:ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:১৭