বিজ্ঞানী থিওডসিয়াস ডবঝনস্কি বলেছিলেন, "জীববিজ্ঞানকে বিবর্তনবাদের আলোকে না দেখলে কোনো কিছুই আর কোনো অর্থ বহন করে না।" এখন চিকিৎসাবিজ্ঞান, ফসিল বিদ্যা, জীনতত্ত্ব, অণুজীববিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন, অণুপ্রাণবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ববিদ্যা, খণিজজীববিদ্যা, বাস্তুসংস্থানসহ বিজ্ঞানের বহু শাখা রয়েছে যেখানে বিবর্তন তত্ত্বকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিবর্তন তত্ত্বকে নিয়ে গবেষণা অনবরত চলছে। কাজে লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
বিবর্তন তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে নোবেল বিজয়
বিবর্তন তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তিন বিজ্ঞানী সবুজ জ্বালানি ও কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধ তৈরির পথ দেখিয়ে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। এতে জ্বীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমবে আবার কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার এন্টিবডি ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে। বিবর্তনের জন্য আর্নল্ড ডিএনএ পুনর্গঠনে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস, যেমন আখকে জৈব জ্বালানিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে। পরিবেশবান্ধব অনেক রাসায়নিক উপাদান তৈরিও সম্ভব হয়েছে। এতে কাপড় ও থালাবাসন ধোয়ার ডিটারজেন্টের মতো প্রতিদিনের ব্যবহার্য পণ্যগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো গেছে। জর্জ স্মিথ ও গ্রেগরি উইন্টর এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যাতে, এমন অবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যেখানে একটি ভাইরাস একটি ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমণ ঘটায়। এই সংক্রমণ থেকে নতুন প্রোটিন তৈরি হয়, যা শরীরে আক্রমণ করা ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সহায়ক হয়। এমন উদ্ভাবন বিবর্তনবাদকে নতুন উচ্চতায় নিয়েছে। এই তত্ত্বকে এখন কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে নতুন স্তরে নিয়ে যাবে। বিবর্তন তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে গবেষণা করে এর আগেও আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন।
মস্তিষ্কের বিবর্তনের প্রমাণ
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ আবিষ্কারে করেছেন যে, মানুষ একটি বিশেষ বিবর্তনবাদী বংশধর। কয়েকটি দুর্ঘটনাজনিত মিউটেশনের কারণে মানুষ তাদের জ্ঞানীয় দক্ষতাকে বিকশিত করেছিল। বড় মস্তিষ্কের বিবর্তন সাধারণ আণবিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার কারণে হতে পারে। মানব বিবর্তন প্রকৃতপক্ষে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, কারণ এটি একটি বৃহৎ সংখ্যক জিনে প্রচুর সংখ্যক মিউটেশন অন্তর্ভুক্ত করে। আণবিক পর্যায়ে বিবর্তন অধ্যয়ন করার এক উপায় হল শরীরের প্রোটিন কখন এবং কোথায় পরিবর্তিত হয় তার পরিবর্তনগুলি পরীক্ষা করা। গবেষকরা গবেষণায় মস্তিস্কের বিকাশ ও ফাংশন নিয়ে জড়িত ২১ টি জিনের ডিএনএ পরীক্ষা করেছেন। এই মস্তিষ্ক সম্পর্কিত প্রতিটি জিনের জন্য, তারা এমন পরিবর্তনগুলি চিহ্নিত করে যা প্রোটিনের গঠন পরিবর্তন করে। প্রোটিনের কাঠামো পরিবর্তন করে এমন জেনেটিক পরিবর্তন শুধুমাত্র বিবর্তনীয় নির্বাচন সাপেক্ষে হতে পারে। প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের প্রোটিন পরিবর্তনের হার বেশি। মস্তিষ্কে সম্পর্কিত জিনের জন্য, মানুষের বংশের বংশধরদের মধ্যে বিবর্তনের পরিমাণ তারা পরীক্ষা করে দেখেছে অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় অনেক বেশি। গবেষকরা অনুমান করেছেন যে হাজার হাজার জিনে হাজার হাজার মিউটেশন হয়েছে যা মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে অবদান রাখে।
জলবায়ু পরিবর্তনে লাল হরিণে বিবর্তন
মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্কটল্যান্ডের একটি দ্বীপে হিন্ডস নামের একদল লাল হরিণের মধ্যে বিবর্তনের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। স্কটল্যান্ডের হেব্রিডিস দ্বীপপুঞ্জে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই লাল হরিণদের মধ্যে জিনগত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। ১৯৭০ এর দশকের তথ্য ব্যবহার করে এই গবেষকরা দেখেন, জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা সৃষ্ট উষ্ণায়নের ফলে এই হরিণরা প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু আগে বাচ্চা প্রসব করছে। ফলে পুরো জীবদ্দশায় এদের বাচ্চা দেওয়ার সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব "প্রাকৃতিক নির্বাচন" এর কারণে ওই হরিণদের মধ্যে এই জিনগত পরিবর্তন হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন। এটি অল্প কিছু উদাহরণের একটি যেখানে বিবর্তনকে কার্যক্ষেত্রে প্রতিফলিত হওয়ার উদাহরণ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু উষ্ণায়নের সঙ্গে প্রাণিদের খাপ খাওয়াতে এই জিনগত পরিবর্তন সহযোগিতা করছে। প্রাণির ব্যক্তিগত জীবনকালের ওপর দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ফলে বোঝা যায় কীভাবে এরা পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রতি সাড়া দেয় এবং কীভাবে এই প্রভাব সামলিয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে স্কটিশ ন্যাচারাল হেরিটেজের পরিচালক স্যালি থমাস বলেন, ‘প্রাণিজগতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অসাধারণ এক উদাহরণ এই গবেষণা। বিভিন্ন প্রজাতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে ব্রিটেনসহ সারা বিশ্বেই গবেষণা চলছে’।
এরকম প্রত্যেকটি পরীক্ষাতেই বিবর্তন তত্ত্ব সফলভাবে পাশ করে গেছে। আর তাই বিবর্তন তত্ত্ব একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী তত্ত্ব হিসাবে বিজ্ঞানীদের কাছে পরিগণিত হচ্ছে। কিছু উদাহরণ দেয়া যায়-
দেহে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যান্সার সেলের বিবর্তন ঘটে। ঔষধের প্রতিক্রিয়া থেকে রেজিস্টেন্ট হয়ে উঠছে। আবার বিবর্তন চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকেই এর সমাধান পাওয়া যায়।
বিবর্তন তত্ত্ব ব্যবহার করে অভয়ারণ্য নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
জৈব তথ্যবিজ্ঞানের মত বিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে উঠেছে যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বিভিন্ন প্রজাতির জিনের অনুক্রমের তুলনা করা।
জীবাণু ও কীট-পতঙ্গ ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ওষুধশাস্ত্র এবং কৃষিবিজ্ঞানে এই প্রতিরোধক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিবর্তন তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়।
মৎস্যচাষে উচ্চ ফলনের জন্য বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানো হয়।
উচ্চফলনশীল ধান, বেশি দুধ প্রদানে সক্ষম গাভী, ছোট বড় নানা জাতের কুকুর এবং কবুতরের বিভিন্ন প্রজাতি মানুষের দ্বারা তৈরি কৃত্রিম নির্বাচনেরই ফল।
হোক্স জিন, প্যাক্স ৬ জিন সংক্রান্ত এভো ডেভোর সাম্প্রতিক গবেষণা অন্ধত্ব নির্মূলসহ বহু জটিল রোগের চিকিৎসায় আশার আলো দেখাচ্ছে।
স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা ক্লাউদিয়া ক্যাস্টিলোর মত মৃত্যুপথযাত্রী রোগিদের বাঁচিয়ে তুলছে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ৮:০০