ভণ্ডপীরদের নিয়ে প্রথম যে গল্পটি বাঙালি সমাজে আলোড়ন তুলে তা হল আবুল মনসুর আহমদ এর হুজুর কেবলা।তাঁর আয়না গল্পগ্রন্থভূক্ত গল্প হুজুর কেবলা পাঠ্যভূক্ত থাকায় সমাজ পরিবর্তনে কিছুটা ভূমিকা রাখে।গল্পের এমদাদ দর্শনে অনার্সের ছাত্র ছিল। পারিবারিক অবস্থাও ছিল ভাল। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে সে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিল। গভীরভাবে ধর্মপালন করতে করতে এক পীরের মুরিদ হল। ভিতরে থাকা শিক্ষার কারণেই তার পক্ষে পীরের ভণ্ডামী বুঝতে পারা সহজ হয়। পীর এক এলাকায় গিয়ে এক মুরিদের সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে পছন্দ করে। তিনি বহু নাটক করে মোরাকেবায় বসে আরেকজনের দেহে মহানবীর আত্মাকে নিয়ে আসে। সেখানে মহানবী পীরকে নির্দেশ দেয় ছুন্নত পূরণ করার জন্য চার নম্বর বিয়ে করতে। নবীর নির্দেশে অন্য মুরিদরাও সব ব্যবস্থা করে ফেলে। বিয়ের আসরে বসে ভণ্ডপীর। এমদাদ বুঝে ফেলে- জনতার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘তোমরা নিতান্ত মূর্খ। এই ভণ্ডের চালাকি বুঝিতে পারিতেছ না? নিজে শখ মিটাইবার জন্য যে হযরত পয়গম্বর সাহেবকে লইয়া তামাসা করিয়া তাঁর অপমান করিতেছে। তোমরা এই শয়তানকে পুলিশে দাও।’ কিন্তু মূর্খ জনতা এমদাদকেই পাগল ভাবতে থাকে। তারা হুজুরে কেবলাকে অপমান করায় এমদাদের কান ধরে গ্রাম থেকে বের করে দেয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু ভণ্ডপীরদের নিয়ে লেখা সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস। এখন সারাদেশটাকেই মনে হয় মহব্বতনগর। মজিদে মজিদে ভরে গেছে দেশটা। ভণ্ডপীর ধর্মপ্রচারক প্রতারক মজিদ মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে দাবি করে জাকিয়ে বসে।ঢেকে দেয় লালসালু দিয়ে। আমরা বহুভণ্ড কথিত প্রেরিত পুরুষকেও দেখেছি একই ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিতে। উচ্চ মাধ্যমিকে আমাদের পাঠ্য ছিল। পড়াতেন মোকতার স্যার। তিনি ছিলেন মজিদের দ্বিতীয় তরুণী বউ জমিলার মতোই চপল। পড়াতেন একটি গার্লস কলেজেও। আমাদের বলতেন, রহিমা/জমিলার কথা যখন অভিনয় করে বলতাম তখন মেয়েছে হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর লুটিয়ে পড়তো। উপন্যাসে মজিদই সব। সহায়সম্বলহীন নিঃস্ব মজিদ এক মাজারের উসিলায় পেয়ে যায় সব। এক নারীতেও তৃপ্ত থাকেনি। যখন সুযোগ এসে যায়, পিতা হওয়ার অজুহাতে অল্প বয়সী জমিলাকে বিয়ে করে নেয়। সে তো নিজে জানতো, সবই প্রতারণা, ভণ্ডামি, মিথ্যাচার। আমরা দেখি ভণ্ড পীরেরা কখনোই এসব প্রতারণার কথা প্রকাশ করে না। চপল জমিলাকে বাগে আনতে মজিদ বেছে নেয় নিপীড়নের শাশ্বত পথ। জমিলা থুথু ছিটিয়ে দেয় মজিদের মুখে। স্বপ্ন দেখি একসময় মজিদদের হাতে প্রতারিত-নিপীড়িত সব নারীই থুথু ছিটিয়ে দিবে।
কাছাকাছি আরেকটি উপন্যাস পড়েছি আহমদ ছফার ‘একজন আলি কেনানের উত্থান পতন’। ধরন, উপস্থাপনা, গাথুনী সবই ভিন্ন তবে আলি কেনান নিজেও আকড়ে ধরেছিল সেই মাজার। তাঁর উত্থান যেমন ঘটে তেমনি পতনও ঘটে চূড়ান্তভাবে। আলি কেনানও কোন চর থেকে শহরে আসে। মোনায়েম খানের প্রাসাদেই চাকরি পায় এবং ক্ষমতার দাপট দেখায়। একসময় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে বিদায় নিতে হয় এবং একটি গায়েবী মাজারকে কেন্দ্র করে নিজেকে প্রভাবশালী পীরবাবায় পরিণত করে। স্বাধীনতার পরে আরেকটা মাজার দখলে নিতে পারলে তার প্রভাবপ্রতিপত্তি আরো বেড়ে যায়। একসময় সরকার বদলের মতো তাকেও ক্ষমতা হারাতে হয়। প্রত্যাশিত পতন দেখি। তবে সারাদেশেই মজিদ ও হুজুরে কেবলাদের পতন ঘটেনি। আমরা এখনো উত্থানই দেখছি। তাদের পতন ঘটাতেই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:৫১