উন্মুক্ত লিঙ্গ দেখে কারো অনুভূতিতে আঘিত লাগে না অথচ সেই লিঙ্গে কন্ডম পরানোতেই ধর্মানুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত লাগলো৷ বিষয়টি নিয়ে ক্ষেপে উঠেছে উগ্রপন্থী হিন্দুরা৷ কলকাতায় হইচই শুরু হয়েছে অভিনেত্রী সায়নী ঘোষের পুরনো একটি টুইট নিয়ে, যেখানে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে শিবলিঙ্গকে কন্ডম পরানোর ছবিটি পোস্ট করা হয়েছিল। ভারতে জনসংখ্যা বেশি আবার এইডস সচেতনতা কম তাই এ ধরনের পোস্ট মানুষকে সচেতনই করবে৷ উদ্দেশ্য হয়তো তাই ছিল। কিন্তু মূর্খ মৌলবাদীরা তা বরাবরই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ৷ তারা এটাকে দেবদেবীদের নিয়ে অশ্লীলতা দাবি করে তা মেনে নিতে চাইছে না। লিঙ্গ উন্মুক্ত রাখা তাদের কাছে অশ্লীলতা নয়, ঢেকে দেয়া অশ্লীলতা!
ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ বিজেপির তথাগত রায় গত শনিবার কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করে লেখেন, 'ওই টিভি অভিনেত্রীর করা টুইটে একজন একনিষ্ঠ শিবভক্ত হিসেবে আমার ধর্মীয় বিশ্বাস আহত হয়েছে।' পঁচিশ বছর আগে তিনি পায়ে হেঁটে কৈলাস-মানস সরোবর পাড়ি দিয়ে শিবের পূজা দিতেও গিয়েছিলেন, এই তথ্য জানিয়ে তথাগত রায় ভারতীয় দন্ডবিধির ২৯৫এ ধারায় ওই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন।
শিবলিঙ্গ পূজা ভারতীয় আদিবাসীদের ধর্ম থেকে এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। শিব অনার্য দেবতা। শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান উপাস্য দেবতা শিব ও পূজার আদর্শ উপাদান হল শিবলিঙ্গ। আধুনিক হিন্দুরা লিঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেন। কেউ বলেন লিঙ্গ অর্থ মাথা মানে শিবলিঙ্গ হল শিবের মাথা। আবার কেউ দাবি করেন লিঙ্গ মানে মহৎগুণ অর্থাৎ শিবের মহৎ গুণের প্রতিক হল শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গকে ঈশ্বরের বিমূর্ত প্রতীক বা দিব্য আলোকস্তম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়।অনেকের কাছে শিবলিঙ্গ স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতীক রূপে পরিগণিত হয়। তাতে কোন সমস্যাও নেই, আপত্তিও নেই। বাস্তবিক ইতিহাস ও প্রত্ননিদর্শন তা বলে না। বিভিন্ন শিবলিঙ্গের মূর্তি দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায় এটি পুরুষ যৌনাঙ্গের আদলেই নির্মিত হয়েছে। শিবলিঙ্গের সামনে যে রেখাটি আঁকা হয় তাও পুরুষাঙ্গের একটি অংশের মতোই। কামরূপ-কামাক্ষ্যাতে এখনো স্ত্রী-যৌনাঙ্গের পূজাও করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি। কামাখ্যার জাদুবিদ্যা আর সাধকদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গল্প শোনা যায়। এখানে নাকি কামুক পুরুষ ও নারীরা কাম কলার একান্নটি কৌশল শিখতে আসেন। কামের দেবতা হলেন কামদেব। তার নাম থেকেই কামরূপ ও কামাক্ষ্যা। স্ত্রী-যৌনাঙ্গ পূজার সময় নাকি একজন নগ্ন নারীকে বসিয়ে রাখা হয়। আগে নাকি সেখানে শিশুকন্যাও বলি দেয়া হতো।
শিবলিঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। বিভিন্ন গবেষক বলেছেন বিভিন্ন কথা। ১৮১৫ সালে আ ভিউ অফ দ্য হিস্ট্রি, লিটারেচার, অ্যান্ড মিথোলজি অফ দ্য হিন্দুজ গ্রন্থে লেখক ব্রিটিশ মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ড এর মতে লিঙ্গপূজা ছিল, "মানুষের চারিত্রিক অবনতির সর্বনিম্ন পর্যায়"। শিবলিঙ্গের প্রতীকবাদটি তার কাছে ছিল "অত্যন্ত অশালীন; সে সাধারণের রুচির সঙ্গে মেলানোর জন্য এর যতই পরিমার্জনা করা হোক না কেন"। ব্রিটিশরা মনে করত, শিবলিঙ্গ পুরুষ যৌনাঙ্গে আদলে নির্মিত এবং শিবলিঙ্গের পূজা ভক্তদের মধ্যে কামুকতা বৃদ্ধি করে। আবার মনিয়ার উইলিয়ামস তার ব্রাহ্মণইজম্ অ্যান্ড হিন্দুইজম্ বইয়ে লিখেছেন, "লিঙ্গ" প্রতীকটি "শৈবদের মনে কোনো অশালীন ধারণা বা যৌন প্রণয়াকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয় না।" জেনেন ফলারের মতে, লিঙ্গ "পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে নির্মিত এবং এটি মহাবিশ্ব-রূপী এক প্রবল শক্তির প্রতীক।" ডেভিড জেমস স্মিথ প্রমুখ গবেষকেরা মনে করেন, শিবলিঙ্গ চিরকালই পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গটি বহন করছে। অন্যদিকে এন. রামচন্দ্র ভট্ট প্রমুখ গবেষকেরা মনে করেন, পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গটি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা। এম. কে. ভি. নারায়ণ শিবলিঙ্গকে শিবের মানবসদৃশ মূর্তিগুলি থেকে পৃথক করেছেন। তিনি বৈদিক সাহিত্যে লিঙ্গপূজার অনুপস্থিতির কথা বলেছেন এবং এর যৌনাঙ্গের অনুষঙ্গটিকে তান্ত্রিক সূত্র থেকে আগত বলে মত প্রকাশ করেছেন। আাবর জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শিবলিঙ্গকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলেই অনুসন্ধান করে মত প্রকাশ করেছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব জীবন্ত লিঙ্গপূজা করতেন। তারই শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেন শিবলিঙ্গের সঙ্গে পুরুষাঙ্গের যোগ বৌদ্ধ ধর্মের পতনের পর আগত ভরতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত গল্প। শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ ধারণা থেকে অর্থাৎ বলিদানের হাঁড়িকাঠ থেকে। তিনি শিবলিঙ্গকে যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করেননি।
আমরা যতটুকু জানি যে, অবিবাহিতা নারীরা শিবলিঙ্গ পূজা করে ভাল বর পাওয়ার জন্য। এ নিয়ে এতো মতভেদ যে- অন্য ধর্মের মতোই আজকার বহুজনই এতে আধুনিক ও মানবিক ব্যাখ্যা জুড়ে দিতে চান। অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ রীতিমতো ভয় পেয়েছেন। তিনি দাবি করছেন কে বা কারা তার ওয়ালে ওটি পোস্ট করেছিল। হিন্দুরা আরো ক্ষেপেছে- যখন সায়নী ঘোষ বড়দিনে শুভেচ্ছা জানানোতে। এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা দরকার। তাহলেই মানুষ সত্যটা জানতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৮