হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন গ্রন্থে সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম তথ্য রয়েছে। ঋগ্বেদে বলা হয়ছে সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অন্তকোষ থেকে। পুরুষসূক্তের মতে- দেবতাদের দ্বারা পরাজিত পুরুষ নামক এক অলৌকিক মানবের ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে নানা বস্তুর সৃষ্টি। শতপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী- সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি সৃষ্টির আদিতে সম্পূর্ণ একা ছিলেন। তাই তনি নিজেকে পুরুষ ও স্ত্রী-রূপী দুটি খণ্ডে বিভক্ত করেন। স্ত্রী ও পুরুষ ক্রমে ক্রমে প্রত্যেকটি প্রাণির দুই ভিন্ন প্রজাতি তৈরি করলেন। এই প্রজাপতিকেই পুরাণে ব্রহ্মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোথাও পাবেন ব্রহ্মার মুখ থেকে সৃষ্টি হয় ব্রাহ্মণ, হাত থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য আর পায়ের ময়লা থেকে শুদ্র।
বৌদ্ধ ধর্ম মতে সৃষ্টি, পরিচালন এবং ধ্বংস এই ত্রিকাজ কোন ঈশ্বর করেন না, স্বংক্রিয়ভাবে সংগঠিত হয়। একেক প্রাণি একেক লোকভূমির উপর বাস করে। মৃত্যুর পরে কর্মফল অনুযায়ী একেক লোকভূমিতে সে চলে যায় এবং জন্ম নেয়। নির্বাণ লাভ হলেই পরম মুক্তি ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মের লক্ষ্যই হল দুঃখ নিরসন। আজ যে মানুষ সে মন্দ কর্মফলে মৃত্যুর পরে কুকুর হযে জন্মাতে পারে আবার একটি শিয়ালও ফিরে পেতে পারে মানব জীবন। এটা এক অনন্তকালের প্রক্রিয়া।
ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস মতে, আদম/এডাম ছিলেন প্রথম সৃষ্ট মানুষ। ইসলামের দৃষ্টিতে, তিনি প্রথম নবী ও আদি মুসলমান। পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধির সূচনা সত্তা। আর ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্ম মতে, তিনি পরমেশ্বরের মনোনীত সেবক। হাওয়া (আ.) কে তারা ‘হবা’ বলে থাকেন। আর হিন্দু ধর্ম মতে, প্রথম মানব-মানবী হলোÑ ‘মনু’ আর ‘অদিতি’। মনুর সন্তান বলে আমরা মানুষ। মাটি দ্বারা সৃষ্টির পর আদম ও হাওয়া (আ.) এর অবস্থান ছিল জান্নাতে। তারা সেখানে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে তিরস্কৃত হয়ে মাটির পৃথিবীতে এসে পড়েন দুজন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। আদম (আ.) সরণদ্বীপ পর্বতে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা ধরা হয়) আর হাওয়া (আ.) আরব উপত্যকায়। দীর্ঘদিন পর আরাফাত প্রান্তরে তাদের পুনর্মিলন হয়।
পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্ম বিলুপ্ত হয়েছে। এখনো টিকে থাকা ধর্মের সংখ্যা প্রায় ৪৩০০টি। মানুষ সৃষ্টি অন্তত ৪৩০০টি মত রয়েছে। কোন মতই বিজ্ঞান সমর্থন করে না। বিজ্ঞান প্রমাণ করেই বলতে চায় কোনটি সত্য ও সঠিক। এজন্য তারা তথ্য অনুসন্ধান করে। সে অনুসন্ধানও নতুন নয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যেই প্রথম অলৌকিকতার পরিবর্তে বস্তুজগৎ থেকে প্রাণের বিকাশের ধারণা জন্ম নেয়। দার্শনিক থেলিস বলেন, ‘পানি থেকেই প্রাণের উৎপত্তি’। ভারতীয় দর্শন এর পরে পঞ্চভূতের কথা বলেছিল। ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রধানত জাগতিক। জীবন ও বস্তু জগতের মূলে কি আছে, এ প্রশ্নের জবাবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত শাখা এরূপ মনে করত যে, জীবন ও জগৎ হচ্ছে- মৌলিক উপাদান- ক্ষিতি (মাটি), অপ (পানি), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) ও ব্যোম (আকাশ) এর সম্মিলন। এগুলোও কোন বিজ্ঞানভিত্তিক কথা নয়, এমনকি মৌলিক উপাদানও নয়। প্লেটো ও এরিস্টটলও বিশ্বাস করতেন এই বিশ্বের সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের পরিকল্পনার ফসল- মানুষ বা পশুপাখিতো অবশ্যই।
এক প্রজাতির প্রাণি এমনকি মানুষও যে অন্য কোনও প্রজাতির প্রাণি থেকেই উদ্ভুত- এ ধারণাও প্রথম আসে গ্রীক দর্শনেই। অ্যানাক্সিমান্দার অফ মিলেটাস (খৃস্টপূর্ব ৬১০-৫৪৬) প্রস্তাব করেছিলেন- পৃথিবী ছিল জলমগ্ন আর স্থলবাসী মানবজাতির পূর্বপুরুষের উদ্ভব ঘটে জলেই। মানুষ নিশ্চয়ই অন্য কোন প্রজাতির সন্তান সম্ভবত মাছের। এমন ভাবনাগুলোকে স্তব্ধ করে দেয়া হয় প্রথমত প্লেটো-এরিস্টটলের প্রভাবে, তাতে বিবর্তনবাদের চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে। এরপর খৃস্ট ধর্মের প্রসারে সমস্ত চিন্তার জগৎ স্তব্ধ হয়ে যায়- থাকে শুধু অন্ধকার মানে শুরু হয় অন্ধকার যুগ। দীর্ঘ অন্ধকার যুগ পেরিয়ে রেনেসাঁ শুরু হলে আবারো খুলে যায় মুক্তচিন্তার পথ।
১৯৫৮ সালে চার্লস ডারউইন এক নতুন বিবর্তনের তত্তেব্র প্রস্তাবনা করেন। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলে। শুরুতে বিবর্তনবাদ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠতো। অনেক তথ্য (মিসিং লিংক) না থাকায় এর বিরুদ্ধে সৃষ্টিবাদীরা বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতো। ধীরে ধীরে মিসিং লিংকগুলো পাওয়া যেতে থাকে মূলত ফসিল থেকে। এছাড়া আরো বহুদিক দিয়ে প্রমাণিত হতে থাকে বিবর্তনবাদের। তাতে বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানীমহলে একটি স্বীকৃত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য পায়- তারা কোথা থেকে এসেছে! এক প্রাণির সাথে আরেক প্রাণির মধ্যে থাকা মিলগুলোর কারণ বুঝতে পারে। বুঝতে পারে- এক প্রজাতি কিভাবে বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় আরেক প্রজাতিতে, কিভাবে এককোষি প্রাণি হয়েছিল বহুকোষি প্রাণি, কিভাবে কোন এপজাতীয় প্রাইমেট থেকে বিবর্তিত হয়ে হয়েছে মানুষ। এমন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণগুলো মানুষকে সত্যানুসন্ধানের এক চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়েছে। নিজের সৃষ্টির একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ দেখে শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে মানুষেরই। মানুষই একমাত্র প্রাণি যারা জানে কিভাবে তারা এসেছে, এমনকি জানে অন্য প্রাণিও কিভাবে এসেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:১১