somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
নিজেকে বোঝার আগেই মনের মধ্যে একটা চেতনা তাড়া করে ফিরতো। এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, একটা বিপ্লব দরকার। কিন্তু কিভাবে?বিপ্লবের হাতিয়ার কি? অনেক ভেবেছি। একদিন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো একটি শব্দ, বিপ্লবের হাতিয়ার 'কলম'।

করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৫)

২০ শে এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বাসার সামনে ছোট্ট একটি পার্ক।ঘরের ভেতর থেকে পার্কের সবুজ ঘাসে আবৃত ভূমি এবং প্রশস্ত আকাশ দেখা যায়।মাঝে মাঝে সাদা মেঘের পাহাড়ের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হই। ড্রয়িং রুমের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দুপুরের রোদ এসে উঁকি দেয় ঘরের মধ্যে। কিন্তু,মধ্য মার্চে শেষের দিকে বাইরে ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে। মুক্ত বাতাসের জন্য দিনে দুই একবার উষ্ণতাবর্ধক পোশাক পরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়।ঘরের মধ্যে ইলেকট্রিক হিটারের উষ্ণতায় গরম চায়ের কাপে চুমুক,টেলিভিশনের পর্দায় খবর, মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়েই কয়েকটা দিন ভালোই কেটে গেলো।ধীরে ধীরে প্রাত্যহিক এমন জীবন ধারায় একটু অস্থির হয়ে উঠলো মন, শরীরটাও ভারী ভারী অনুভব হয়, গলা ব্যথা ও খুশখুশে কাশি লেগেই আছে।ডাক্তারের বারণ বাইরে না যাওয়ার। কিন্তু এমন আবদ্ধ জীবনে কেমন যেন মানসিক অসুস্থতা বোধ হতে লাগলো।মনে হলো অনেকটা শৃঙ্খলিত হাজত বাস চলছে জীবনে।জীবনের প্রকৃত হাজত বাসের অভিজ্ঞতা সাথে মিলে খুঁজে পাচ্ছিলাম চলমান আবদ্ধ জীবন ধারায়।

২০০৩ সাল, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী পরিচালিত ক্লিন হার্ড অপারেশন চলছে।দেশ জুড়ে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের জন্য এক ভীতিকর পরিস্থিতি।সরকারী দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে কথিত ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছে।তখন আমার তারুণ্য দৃপ্ত ছুটে চলা জীবন।পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি,থিয়েটার,স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা,বিএনসিসি’র কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রাণোচ্ছল ব্যস্ততা।কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাশীল বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের প্রার্থীকে হারিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী প্যানেল থেকে বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি।কিন্তু আমাদের দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল। তখন প্রাক্তন ওয়ার্কাস পার্টির নেতা আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের বিএনপিতে যোগদানের কারণে ছাত্র মৈত্রীর অনেক স্থানীয় নেতা ছাত্রদলে যোগদান করেছে।প্রাক্তন বিএনপি এবং নব্য খৈয়ম অনুসারী বিএনপির নেতা কর্মীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিরাজমান।এর মধ্যে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজন হলো জেলা ছাত্রদলের সম্মেলন।ঢাকা থেকে আসলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল সম্মেলন সম্পন্ন করতে।কিন্তু সম্মেলনে তার ঘোষিত কমিটি পছন্দ হল না খৈয়মপন্থী ছাত্রদল নেতাদের।কেন্দ্রীয় সভাপতির সামনেই শিল্পকলা একাডেমীর অডিটোরিয়ামের চেয়ার ভেঙে বিদ্রোহ ঘোষণা করল খৈয়মপন্থী ছাত্র নেতারা।কেন্দ্রীয় সভাপতি এই ঘটনাকে চরম অপমানের সহিত নিলেন। জানালেন কেন্দ্রীয় ঊর্ধ্বতন নেত্রীবৃন্দের নিকট।উপর থেকে নির্দেশ আসলো রাজবাড়ী জেলা পুলিশের নিকট।সম্মেলনে বিশৃঙ্খলাকারী সবাইকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তারা পুলিশ কাস্টরি দেখতে চান।শুরু হল শহর জুড়ে পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের ছোটাছুটি।একদিন চলে গেলো কিন্তু তালিকাভুক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারলো না পুলিশ।ফলে পুলিশের উপর ওপরের চাপ বাড়তে থাকল।আমার এলাকার বন্ধু সাবেক ছাত্রদল নেতা আহমেদ হোসেন সাগর(ছাত্র মৈত্রী থেকে আসা) এই অভিযুক্তদের তালিকায় শীর্ষের একজন।ওর বাড়িতে পুলিশ কয়েকবার হানা দিয়েছে কিন্তু ধরতে পারেনি।আমি সবকিছু জেনে স্বাভাবিক ভাবে ঘোরাঘুরি করছি।এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে চলার কোন উদ্বেগ আমার মধ্যে জাগেনি বিন্দু মাত্র।কারণ,আমি অন্য একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সদস্য।
রাজবাড়ী রেলওয়ে হলে থিয়েটারের মহড়া শেষ করে দুপুরে বাড়িতে এসেছি।গোসল সেরে বিকেলে উচ্চ মাধ্যমিকের এক ছাত্রীকে হিসাববিজ্ঞান পড়াতে যেতে হবে,সেই চিন্তায় মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি।হঠাৎ বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে করা নড়ে উঠলো। কেউ একজন বলছে উজ্জ্বল ভাই বাড়ীতে আছেন? আমার মা ডাক শুনে বাড়ীর গেট খুলে দিলেন। মধ্যবয়সের এক লোক বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন।আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটিকে চিনতে পারলাম।জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার লোক।আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে সিভিল পোষাকে মাঝে মাঝে ডিউটি করে। আমি ভদ্রলোককে ঘরে আসতে বললাম।ভদ্রলোক খুব শান্ত গলায় বললেন, ভাই আমাদের স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলবে, উনি রাস্তায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।আমি পোশাক পরিবর্তন করে যেতে চাইলাম। কারণ আমার পরনে বাসায় পরার লুঙি এবং গেঞ্জি।ছেয়েছিলাম প্যান্ট পরে গেঞ্জিটা পরিবর্তন করে নিতে।কিন্তু ভদ্রলোক বলল এখনিতো চলে আসবেন,দরকার নেই। আমি সরল বিশ্বাসে ওনার সাথে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলাম। মাকে বললাম,আমি আসছি।আমার মধ্যে পুলিশ ভীতি নেই কারণ স্থানীয় সাংবাদিকতা করার কারণে থানা,পুলিশ,আইন আদালতে মাঝে মাঝে যাওয়া আসার অভিজ্ঞতা ছিল।বাড়ী থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ হাঁটার পর ভদ্রলোকের সঙ্গে আরও চারজন লোক যুক্ত হল।এদের মধ্য থেকে একজন খুব শক্ত করে আমার কোমরে হাত দিয়ে লুঙ্গি পেঁচিয়ে ধরলেন।আমি বললাম,আমিতো আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি লুঙি ছেড়ে দেন।উত্তরে বলল, এমনিতেই ধরে আছি, চলুন।বেশ কিছুটা পথ এগুনোর পর আমি পেছন ফিরে তাকালাম,দেখি আমার পেছন পেছন এলাকার অনেক মানুষ হেঁটে আসছে।এলাকায় দুদিন ধরে পুলিশের অভিযানের কারণে আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া দেখে মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।আমাকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে? আফছারের দোকান তিন রাস্তার মোড় আসার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আপনাদের স্যার?একজন বলল,আপনাকে কিছু সময়ের জন্য থানায় যেতে হবে, উনি থানায় আছেন, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করে ছেড়ে দেয়া হবে।আমার মধ্যে তখনও কোন আতংক কাজ করছেনা। বললাম, তাহলে চলুন।আমাকে একটা রিক্সায় ওঠানো হল।আমার সাথে রিক্সায় উঠলেন দুইজন গোয়েন্দা পুলিশ।একজন আমার কোমরে লুঙি পেঁচিয়ে ধরলেন, অন্যজন শক্ত করে ধরলেন হাত।আমি এদের আচরণে আশ্চর্য হচ্ছিলাম, এরা কেন আমার সাথে এমন আচরণ করছে! রিক্সায় থাকাকালীন সময়ে কারো সাথে তেমন কথা হলনা।বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলাম থানায়। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল থানার ওসি’র রুমে। ওসিকে ঘিরে বসে আছে চার পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তা।আমাকে বসানো হল মাঝের একটি চেয়ারে।যারা আমাকে ধরে নিয়ে আসলো তাদের মধ্য থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তাদের বললেন, স্যার একে এরেস্ট করতে খুব কষ্ট হয়েছে, দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো,সবাই মিলে তাড়া করে ধরে নিয়ে এসেছি।এমন একটি মিথ্যা শুনে একটু হোঁচট খেলাম।মনে মনে বললাম, আমিও ওদের কথার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এসেছি, এমন একটি মিথ্যা কথা কেন বলল? কিছুক্ষণের মধ্যে শুধু হল একের পর এক প্রশ্নবান।প্রথমেই ছাত্রদলের সম্মেলনে বিশৃঙ্খলাকারী খৈয়মপন্থী কয়েকজন ছাত্রনেতাদের নাম উল্লেখ করে প্রশ্ন করলেন, এরা সবাই কোথায় আছেন?যাদের নাম বললেন আমি তাদের সবাইকে চিনি,কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা কোথায় আছে আমি জানিনা।স্বাভাবিক কারণে আমি উত্তর দিয়েছি, আমি জানি না।আর একজন প্রশ্ন করলেন, এদের মধ্যে কে কে অস্ত্রবাজি করে? যেহেতু এদের কারো সাথে আমার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক বা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নেই, সুতরাং অস্ত্রবাজি কেউ করে থাকলে আমার জানার কথা নয়।তাই, উত্তরে বললাম আমি জানিনা।পুলিশ কর্মকর্তাদের একজন বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, উপুড় করে ঝুলিয়ে নাক দিয়ে গরম পানি ঢালুন ওসি সাহেব,সব বলে দেবে, এমনিতে কোন কিছু বলবেনা।এদের এমন আচরণ এবং প্রশ্নে আমি অনেকটা ঘাবড়ে গিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছিলাম। কারণ জীবনে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আমি পড়িনি কখনো।আমি কান্না অবস্থায় ওদেরকে বলছিলাম, আমিতো বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র রাজনীতির সাথে জড়িত, ছাত্রদলের সম্মেলনেতো আমি উপস্থিত ছিলাম না, এই ঘটনার সাথেও আমি সম্পৃক্ত নই। তাহলে এদের সম্পর্কে আমি জানবো কি করে? ওদের একজন বললেন,যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সবাই ছাত্র মৈত্রী করত,ওরা সবাই তোর বন্ধু, তুই জানিস ওরা কোথায় আছে।যেহেতু, প্রকৃতই আমি কিছু জানিনা সেহেতু ওদের কাঙ্ক্ষিত উত্তরও আমার কাছ থেকে ওরা পাচ্ছিল না।জেরা করার একটা পর্যায়ে একজন পুলিশ কনস্টেবল আমার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দিলো।কিছুক্ষণ পর ওসির রুম থেকে আমাকে এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের রুমে নিয়ে এলো। এখানে হ্যান্ডকাফের দড়ি জানালার গ্রিলের সাথে বেধে একটি চেয়ারে বসতে দিলো।নিজেকে গরু ছাগল মনে হতে লাগলো।কারণ, গরু ছাগলকে গলায় দড়ি পরিয়ে এভাবে বেধে রাখা হয়। একটু পর বয়সে তরুণ এক সহকারী পুলিশ সুপার আমার কাছে আসলো, যিনি আমাকে প্রশ্ন করার সময় ওসির রুমে উপস্থিত ছিলেন।ভদ্রলোক হয়তো কয়েক বছর আগে ছাত্রজীবন শেষ করে চাকুরীতে প্রবেশ করেছে।ক্যাম্পাসের ছাত্র রাজনীতি ও সহিংসতা সম্পর্কে তার প্রকৃত ধারণা রয়েছে।আমি কি পড়ি, কি করি ইত্যাদি খুব আন্তরিকতার সহিত জিজ্ঞেস করল।আমি সব বর্ণনা করার পর, বলল ক্যাম্পাসে অস্ত্রবাজির রাজনীতি করার কি দরকার। ভালোমতো পড়াশুনা করলেই তো হয়, তাহলে এই জাতীয় ঝামেলায় পরতে হয় না।আমি বললাম,ছাত্র রাজনীতি করি ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য, কিন্তু অস্ত্রবাজিতো করিনা।ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে বলল, এটা সবাই বলে।বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর যাবার বেলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভয় পাবার কিছু নাই, তোমার বন্ধুদের ধরতে পারলেই তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে।তরুণ পুলিশ কর্মকর্তাটি হয়তো অনুধাবন করেছিলো এই ঘটনার সাথে আমি প্রকৃতই সম্পৃক্ত নয়।
আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে এ ঘটনা ইতোমধ্যে শহরের রাজনীতি অঙ্গন ও পরিচিত স্বজনদের মধ্যে মুহূর্তেই প্রচার হয়ে গিয়েছে। প্রথমেই থানায় ছুটে আসলো পারভেজ ভাই।উনি প্রথমত ঐ সময়ে আমার নিজ রাজনৈতিক দলের বড় ভাই এবং আমার ক্লাসের বান্ধবী পলিনের বর।পারভেজ ভাই কর্তব্যরত এস আইকে বললেন, ও আমার মিসেসের ক্লাস মেট, খুব ভালো ছেলে, ওকে ধরে এনেছেন কেন? এস আই মহিলা বলল, এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবোনা, বিষয়টি এখন আইনি প্রক্রিয়ায় চলে গিয়েছে। আপনি ওসি স্যারের সাথে কথা বলুন।কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ কনস্টেবল এসআই’র অফিস কক্ষ থেকে আমাকে নিয়ে গিয়ে থানা হাজতে ঢুকিয়ে দিলেন।কাস্টরীর দরজায় ঝুলিয়ে দেয়া হল বড় একটা তালা।কথা ছিল, থানার কর্মকর্তার সাথে কথা বলার কিন্তু করা হল বন্দী। প্রতিটি ঘটনার একটি যোগসূত্র থাকে কিন্তু আমার এই বন্দীদশার সাথে কি যোগসূত্র রয়েছে? ভেবে পাচ্ছিলাম না।ঐ মুহূর্তে জীবন,ভাগ্য,দুর্ঘটনা, সমাজ,রাষ্ট্র ,রাজনীতি সম্পর্কে আমার মধ্যে নতুন এক ধারণা তৈরি হল।মনে হল, আমরা যে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি,এই সমাজে আমি অপরাধ না করলেও অপরাধী প্রমাণিত হতে পারি। আবার অপরাধ করেও সমাজে সাধুর স্বীকৃতি মিলতে পারে।পৃথিবীতে নিয়মের সূত্রের বাইরেও অনেক অনিয়ম হয়। এই যে হাজতের ছোট্ট ঘর, এই ঘরের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করা মানুষদের প্রতি দৃষ্টির পার্থক্য বিস্তর। যারা ভেতরে থাকে, বাইরে থেকে তাদেরকে দেখা হয় অপরাধী হিসেবে।বিবেচনা করা হয়না, ভেতরের মানুষটি আসলেই অপরাধী কিনা। বন্দী হলেই বাইরের মুক্ত মানুষগুলোর আচরণ হয় অসৌজন্য এবং অসম্মানজনক।কেউ বাইরে যত বড় সম্মানিত,প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোকনা কেন, একবার এই ঘরের ভেতরে ঢুকলেই অন্যেরদের তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়।এমন পরিস্থিতিটিতে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম,অনেকক্ষণ চোখের জল ঝরিয়ে গলা ছেড়ে কেঁদেছিলাম।কয়েকদিন ধরে এই হাজতে বন্দী দশা চলছে মধ্যবয়সী আর একজন মানুষের। এমন কান্না দেখে মানুষটি আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। সব ঘটনা শুনে বলল, তোমার তেমন কিছু হবেনা ভাতিজা। প্রথম বারের মত এমন পরিস্থিতিতে পরেছ, তাই তোমার ভয় লাগছে।ভদ্রলোক শিক্ষিত,নাম মান্নান এবং রাজবাড়ীর সোনালী ব্যাংকের একটি শাখার কর্মকর্তা ।তার বড় ভাই একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।রাজনৈতিক ও পারিবারিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী।জেলা সার্কিট হাউজের সেনা ক্যাম্পের অভিযোগ বাক্সে পড়েছে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজির অভিযোগ।সেনা সদস্যরা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গ্রেপ্তার করে হাজতে পুরে রেখেছে কয়েক দিন ধরে।ভদ্রলোকের কথাবার্তায় সাহসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী।আমাকে বলেছিল, কান্না করে কি হবে ভাতিজা, তোমার কান্না শুনে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে দেবে না। তুমি ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছ।তোমাকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তার কথায় আমি কান্না থামিয়ে স্বাভাবিক হয়েছিলাম।ভেতরে সাহস সঞ্চার হয়েছিলো।এর মধ্যে আমার বাবা থানায় এসে দেখল আমি থানা হাজতে বন্দী অবস্থায়।সে থানার মধ্যেই চিৎকার শুরু করল, কেন আমার ছেলেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে? এক পুলিশ অফিসার বলল, অপরাধ করেছে তাই বন্দী রাখা হয়েছে।বাবা বলল, এমন ছেলে জন্ম দেইনি,যে হাজতে বন্দী থাকার মত অপরাধ করবে। অফিসার বলল, প্রত্যেক বাবার কাছে তার ছেলে নিরাপরাধ, কিন্তু বাইরে ছেলেরা কি করে বেড়ায়, সে খবর কি রাখেন? এর মধ্যে আমাদের এলাকার অনেক পরিচিত লোক এসে থানায় ভীর জমিয়ে ফেলেছে।এলাকার মানুষের বিশ্বাস ছিলোনা আমি কোন কারণে পুলিশের দ্বারা গ্রেপ্তার হতে পারি।সেই কৌতূহল ও ভালোবাসার টানে ছুটে এসেছে তারা।ছোট বেলা থেকে তারা দেখেছে আমার সোজা সরল জীবন যাপন ও চলাফেরা।ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা নেতৃবৃন্দের মধ্যে থানায় ছুটে আসলেন রাজবাড়ী সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি রেজাউল করিম রেজা ভাই,জেলা যুব মৈত্রীর নেতা অ্যাডভোকেট শফিক ভাই,জেলা ওয়ার্কস পার্টির নেতা আরবান কমিশনার। সবাই থানার ওসির সাথে কথা বললেন, আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য।থানার ওসি তাদের বললেন কেসটি এখন জটিল পর্যায় রয়েছে, আমরা চাইলেই ছেড়ে দিতে পারবো না। শফিক ভাই বলেছিল, জটিল হলে ওকে কোর্টে চালান করে দিন আমরা জামিনে বের নিবো।সবাই আমাকে কোন চিন্তা করতে নিষেধ করলেন,বললেন আমরা আছি তোর পাশে,ভয় পাওয়ার কারণ নেই।এর মধ্যে একই কারণে ফরহাদ নামের এক বিদ্রোহী ছাত্রদল কর্মীকে পুলিশ ধরে এনে হাজতে ঢোকালেন। হাজতের ছোট্ট ঘরের মধ্যে আমাদের সংখ্যা দুই থেকে তিনে উন্নীত হলো।তিনজন একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে অনেকটা হতাশা কাটিয়ে উঠেছি।ফরহাদের প্রতি আমার রাগ হওয়ার কথা ছিল, কারণ তাদের অপকর্মের ফল আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। কিন্তু ঐ সময় তার প্রতি আমার বিন্দু পরিমাণ ক্রোধ কাজ করেনি, বরং সহানুভূতি অনুভব হয়েছিল।মনে হয়,এই ছোট্ট ঘরে যারাই ঢোকে তারা সবাই আপনজন হয়ে যায়। কারণ আইনের গ্যাঁড়াকলে মাস্তান, প্রভাবশালী সবাই এই ঘরের মধ্যে অসহায়।সন্ধ্যা নেমে আসছে, রমযান মাস, চলছে থানার কর্মরত পুলিশদের ইফতারের প্রস্তুতি। আমাদের হাজত ঘরের সামনে দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইফতার সামগ্রী।ভেবেছিলাম আমাদেরকেও ইফতার দেয়া হবে।ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও মানবিক দিক চিন্তা করে।আমাদের তিনজনের মধ্যে দুইজন রোজাদার। দুজনেরই ইফতারের সময় পার হয়ে গেলো মুখে কোন খাবার না দিয়ে।কোন পুলিশ সদস্য জিজ্ঞেসও করলনা আমাদের মধ্যে কেউ রোজাদার কিনা।একটু হতাশ হলাম, এদের এমন আচরণে।হাজত ঘরে ঢুকলেই কি মানুষ অপরাধী হয়ে যায়? অপরাধী হলেও কি তার মানবিক আচরণ পাওয়ার অধিকার নেই?
সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ পর বাবা ইফতার, কিছু পরনের কাপড় ও একটি পাঠ্য বই নিয়ে আসলেন।তিন হাজতবাসী ভাগ করে ইফতার করলাম।দিন কয়েক পরে পরীক্ষা তাই বন্দিত্বের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে বাবাকে বই আনতে বলেছিলাম।হাজত ঘরটি বেশ স্যাঁতসেঁতে, এই ঘরের এক কোণে সামান্য উঁচু দেয়ালের টয়লেট,টয়লেটটি তৈরির পর কখনো আর পরিষ্কার করা হয়েছিলো কিনা সন্দেহ রয়েছে।ভেতরের স্তর পড়া শ্যাওলা দেখে তাই মনে হলো।টয়লেটের ওয়াল এতো নিচু যে, কাস্টরির মধ্যে বসে টয়লেটের ভেতরের মানুষটির সবকিছু দেখা যায়।প্রসাব ছেপে রেখে কষ্ট করেছি কিন্তু টয়লেটে ঢোকার সাহস হয়নি।মনে হল, হাজতের মধ্যে নিচু ওয়ালের টয়লেট বানানো হয়েছে হয়তো দুর্ঘটনা এড়াতে বন্দীকে চোখে চোখে রাখার জন্য। টয়লেটের এমন বেহাল দশার কারণে লাভ হয়েছে হাজতের পাহারারত পুলিশের।কোন বন্দী পাহারারত পুলিশের হাতে পাঁচ টাকা ধরিয়ে দিলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায় থানার স্টাফদের টয়লেটে।এমন পরিস্থিতিতে দারুণ একটা উপলব্ধি হল নিজের মধ্যে, সরকারের নির্ধারিত বেতনের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই বাড়ী, গাড়ি,বিলাসী জীবন যাপন করে থাকে।কিন্তু, এমন শান শওকত জীবন যাপন তো নির্ধারিত বেতনের পয়সায় হয়না।পুলিশের এই অতিরিক্ত টাকা আসে যাদের আমরা আসামী বলে থাকি তাদের পকেট থেকে।সেই কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকেও তো থানা হাজতের ছোট্ট ঘরটি ন্যূনতম মানুষের বাসযোগ্য করে রাখতে পারে।একটি গরুর গোয়াল ঘরও প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়।শোয়ার জন্য নিচে নাড়া পেতে দেয়া হয়। মানুষ আসামী হলেই কি গরুর ছাগলের চেয়োও নিচু প্রাণী হয়ে যায়?

হাজতের মধ্যে একটি ছোট মাদুর পাতা,যেখানে একজন মানুষ বসতে পারে।যখন দুজন ছিলাম, তখন দুজনে চেপে বসে মাদুরের উপর সময় কাটাচ্ছিলাম ।কিন্তু তিনজন হওয়ার পর আমাদের মধ্যে একজনকে বাধ্য হয়েই ঠাণ্ডা ফ্লোরে বসে থাকতে হল।সঙ্গে রক্তচোষা বড় বড় মশার দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে তিন জনের শরীরের উপর ।আত্মরক্ষার্থে মশা প্রতিহত করতেই তিনজন ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।রাত দশটার দিকে দলবেঁধে ছাত্রদলের নবনির্বাচিত জেলা কমিটির নেত্রীবৃন্দ আসলো থানায়।আমাদের কাস্টডির সামনে সবাই এসে হাজির হল।ছাত্রদলের ফরহাদের সঙ্গে এই সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলল খুব ভালো ভাবে।আমি নবনির্বাচিত সভাপতি মিজানুর রহমান টিটুকে বললাম, ভাই এই ঘটনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই , এছাড়া আমি ছাত্র মৈত্রী করি, ওসিকে বলুন আমাকে ছেড়ে দিতে। উত্তরে তিনি বললেন, ঐ বালের সংগঠন করো কেন? করো বলেইতো ধরে নিয়ে এসেছে। ওনার এমন প্রতিউত্তরে আমি আর কথা বাড়াইনি।ছাত্র মৈত্রী’র প্রতি তার একটি ক্ষোভ বা প্রতিহিংসা ছিল।কারণ, কোন এক সময় কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্রদলের মধ্যকার এক সহিংস ঘটনায় ছাত্র মৈত্রীর ছেলেদের দ্বারা সে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন।যাইহোক,আমি যখন ঢাকাতে পড়াশুনা করি তখন মিজানুর রহমান টিটু জেলা ছাত্রদলের সভাপতি থাকা অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে গ্রিনরোডের সমরিতা হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।অনেকই বলে থাকে, তিনি যখন কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ছেলেদের দ্বারা আহত হয়েছিলেন তখন হসপিটালে ভুলবশত এক ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত তার শরীরে ঢোকানো হয়েছিলো।সেখান থেকেই নাকি তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেধেছে।সে সময় অনেক চিকিৎসা ও চেষ্টায় তার জীবন রক্ষা পায়নি।

রাত বারোটা পর্যন্ত চলল থানার ভেতরে বাইরের মানুষের আনাগোনা।এরপর থানার মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হল।থানা জুড়ে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।পাহারারত কয়েকজন জন পুলিশ হাঁটাহাঁটি করছে, আর আমাদের তিন হাজতবন্দীর মধ্যে মৃদু স্বরে একে অপরের সুখ দুঃখের আলাপ চলছে ।রাত প্রায় একটা বাজে, এমন সময় থানায় প্রবেশ করল ক্লিন হার্ড অপারেশন ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের একটি টিম।আমার মধ্যে এক অজানা ভয় চেপে বসলো।বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা সংগঠিত অনেক রহস্যজনক ঘটনা ঘটার কথা ভেবে। একবার ওসির রুমে পুলিশের একটি টিমের অবান্তর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।এবার যদি সেনা সদস্যরা এই গভীর রাতে ডেকে নিয়ে একই প্রশ্ন করে।অর্থাৎ,জেলায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কারা করে? কার কার কাছে অস্ত্র আছে? তাহলে কি বলবো। এই চিন্তায় ভয়ে হৃদকম্পন বেড়ে গেলো।শরীরে ঘাম অনুভব করছি।দিনের বেলায় সর্বক্ষণ পরিচিত মুখগুলোর আনাগোনা ছিল থানায়। সেকারণে তেমন ভীতি কাজ করেনি।কিন্তু, এখন টর্চার করলেও কেউ দেখার নেই।কিছুক্ষণ পর আমাদের মধ্য থেকে ব্যাংকার ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া হল ওসির রুমে, সেখানে সেনা সদস্যদের টিম বসে আছে।আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবছি, ওনার পরে হয়তো আমার পালা।প্রায় এক ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদের পর ওনাকে আবার কাস্টডিতে ঢোকানো হল।জিজ্ঞেস করলাম কি হল,বললেন কেস সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ।প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলো কিন্তু আমার আর ডাক পড়লো না।এর কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যের টিমটি থানা থেকে বেরিয়ে গেলো। মনে হল বুকের উপর থেকে যেন একটি পাথর নেমে গেলো।সারা দিন মানসিক শারীরিক ধকল গিয়েছে, শরীরটাকে এবার মেঝেতে এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হল।ছোট্ট মাদুরটুকু বাকী দুজনের দখলে, আমার জন্য পড়ে আছে ফাঁকা ফ্লোর।বাবা একটি পত্রিকা দিয়ে গিয়েছিলো,বুদ্ধি করে ফ্লোরে পত্রিকাটি বিছিয়ে তার উপর পরনের কাপড় পেতে শুয়ে পড়লাম,বালিশের বিকল্প হিসেবে মাথার নিচে দিলাম মোটা একটি বই।কিন্তু মশার কামড়ে দু চোখ বন্ধ করার সুযোগ হল না। প্রায় নির্ঘুম একটি অভিশপ্ত রাত পার হল জীবন থেকে।

হিম শীতল সকালে শরীরে কালো চাদর জড়িয়ে থানায় আসলেন সাপ্তাহিক তদন্ত প্রতিবেদন পত্রিকার সম্পাদক শহীদুল ইসলাম হিরন ভাই।বয়সে আমার অনেক বড় হলেও ঐ সময়ে হিরন ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সমবয়সী বন্ধুর মত।প্রতিদিনের একটা সময় কাটে তার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।সকাল বেলা হাজতের বন্দী খাঁচার ভেতর থেকে ওনার চেহারা দেখে মনটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠলো।বিপদের সময় আপন মানুষের চেহারা দেখলেও মনে বল পাওয়া যায়।সংবাদের প্রয়োজনে সাংবাদিকদের থানা পুলিশের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক থাকে।মনে হল, হিরন ভাই আমাকে মুক্ত করার ব্যাপারে চেষ্টা করবেন।বেশ কিছুক্ষণ ওনার সঙ্গে কথা হল হাজতের লোহার শিকে ঘেরা দেয়ালের এপার ওপার থেকে।উনি বললেন,চিন্তা করোনা দেখি তোমাকে মুক্ত করার জন্য কি করা যায়,ওসি সাহেব থানায় আসলে আমি কথা বলবো।
থানার বেশ কিছু পুলিশ আমাকে চেনে,প্রতি বছর যখন বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে রাজবাড়ী জেলা স্টেডিয়ামে কুজকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় তখন আমি রাজবাড়ী সরকারী কলেজের বিএনসিসি প্লাটুনের নেতৃত্বে সামনে থাকি। আমাদের প্লাটুনের সামনে থাকে রাজবাড়ী থানা পুলিশ। সেই সুবাদে অনেকের চেহারা চেনা। এমন দুই তিনজন পুলিশ থানায় ডিউটিরত অবস্থায় আমাকে হাজতের খাঁচায় বন্দী দেখে এগিয়ে এসে কথা বলল, কেন আমি এখানে? জানতে চাইল।তাদের সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কিছু করার নেই।সেই সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে আবার ডিউটি শুরু করল।পুলিশ মানেই খারাপ নয়, অনেক মানবিক পুলিশ সদস্যও রয়েছে।তারা জানে এই খাঁচার মধ্যে শুধু অপরাধীরা থাকে না, অনেক সময় ষড়যন্ত্রের স্বীকার অনেক নিরাপরাধ মানুষের স্থান হয় এই অভিশপ্ত জায়গায়।অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ভালো মন্দ বিচার না করে গ্রেপ্তার করে আনতে এমন মানুষদের।এমনি এক মানবিক সিনিয়র পুলিশ কনস্টেবল আমার কাছে এসে অনেকক্ষণ গল্প করলেন।বললেন আপনি অন্যায় করেননি, কিছুটা হয়রানি হতে হবে কিন্তু কোন ক্ষতি আপনার হবে না, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।আমার পুলিশের চাকুরী জীবনে চক্রান্তের স্বীকার হয়ে আপনার মত এমন হাজত বাস কাটাতে হয়েছে।কিন্তু, আমারই জয় হয়েছে, কারণ আমি অন্যায়ের সাথে ছিলাম না।
আমি ভেতরে কিন্তু আমাকে মুক্তির জন্য বাইরে ছুটাছুটি অনেক প্রিয় মানুষ।কলেজের অধ্যক্ষ ফোন করেছে পুলিশ সুপারকে আমার রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল রেখে, তিনি বলেছেন আমার কলেজের বিএনসিসি প্লাটুনের কমান্ডারকে আপনাদের থানায় বন্দী দেখেছেন, ওকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুণ তা নাহলে এবারের জাতীয় দিবসের কুজকাওয়াজে আমার কলেজের বিএনসিসি প্লাটুন অংশ গ্রহণ করবে না। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দও বিএনপি’র নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করে এই সমস্যার একটি সমাধানের পথ খুঁজছে। বাবা থানায় এসে জানালেন চেষ্টা চলছে ছেড়ে দিতে পারে। এর মধ্যে ছাত্রদলের ফরহাদ ও ব্যাংকার ভদ্রলোকে সকালে হাজত থেকে নিয়ে যাওয়া হল অন্যত্র। আমি এখন এই ছোট্ট বন্দী শালায় একা। মাঝে মাঝে নিজের ভেতর অস্থির লাগছে, সারাদিন সবাই আশ্বস্ত করছে ছেড়ে দেয়া হবে,কিন্তু তালবদ্ধ দুয়ার খুলছে না কোন এক অদৃশ্য সংকেতের কারণে।জীবনের এতোটা দিন ইচ্ছে মত মুক্ত আলোবাতাসে ঘুরে বেড়িয়েছি, বাধা ছিলোনা কোন। আজ আমি চাইলেই কোথাও যেতে পারবোনা।অন্যের ইচ্ছের উপর নির্ভর করছে আমার মুক্ত আলো বাতাসে বিচরণ করা। ভেতরটা ছটফট করছে, কখন মুক্ত বিহঙ্গের মত খোলা আকাশে ডানা মেলে ভেসে বেড়াবো এই ভাবনায়।বিকেল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন আশার আলো দেখছিনা,কেউ একজন বলল আজ হয়তো ছাড়া হবেনা, কোর্টে চালান করা হতে পারে।শুরু হল খাঁচায় বন্দী ডানা ঝাপটানো পাখীর মত ব্যকুলতা।বন্দিত্ব যে কি কষ্টের তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি ঐ মুহূর্তগুলোতে। দিনের শেষের দিকে ছাত্রদলের অভিযুক্ত বিদ্রোহী ছাত্র নেতারা জেলা বিএনপি’র নেত্রীবৃন্দের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করল আর আমার হাজতের বন্ধ দরজা সহজে খুলে গেলো।বাবা আমাকে থানার ওসির রুমে নিয়ে বন্ডে সই করলেন, ওসি বাবাকে বললেন , আপনার দায়িত্বে ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু আমরা যে কোন প্রয়োজনে ডাকলে তাকে থানায় নিয়ে আসতে হবে। বাবা সব শর্ত পূরণ করে আমাকে বাড়ীতে নিয়ে আসলেন, এলাকার মানুষ ভিড় জমিয়ে ফেললেন আমার ছাড়া পাওয়ার খবর শুনে।মা নিম পাতার গরম পানি তৈরি করলেন গোছলের জন্য।
পরদিন বাইরে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে।প্রায় এক সপ্তাহ কাটল মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, কেন ধরে নিয়ে গিয়েছিলো পুলিশ? কি ঘটেছে বন্দি অবস্থায়?
কোন কোন বিপদ মানুষকে অনেক কিছু শেখায়।আপন পর চেনায়। এই বিপদের মধ্য দিয়ে আমার প্রতি মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেরে আপ্লূত হয়েছিলাম। সমাজে অন্যের ক্ষতি না করে সোজা সরল জীবন যাপন করলে মানুষের অন্তরের ভালোবাসা পাওয়া যায়।তারই প্রমাণ পেয়েছি। পরবর্তী জীবনে এই অভিজ্ঞতা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, জীবন,সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।একটা প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, কোনদিন খাঁচায় বন্দি রেখে কোন পাখী পুষব না।কারণ, খাঁচায় বন্দি পাখীর কষ্টটা কেমন হয়ে থাকে তা বুঝেছিলাম ঐ চব্বিশ ঘণ্টার বন্দি জীবন থেকে।

চলমান করোনা কালে আমরা কয়েক দিনের গৃহবন্দী জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।অথচ, আমাদের অনেকেই বনের বিহঙ্গকে খাঁচায় বন্দী করে বাসার এককোণে ঝুলিয়ে রেখে আভিজাত্য দেখায়।যে পাখি উন্মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়, সেই পাখিটিকে ছোট্ট একটি খাঁচায় বন্দী করে মাসের পর মাস ওর কষ্টের জীবন থেকে বন্য আনন্দ লাভের চেষ্টা করি।একবারও কি বোঝার চেষ্টা করি, পাখিটির অতৃপ্ত, অশান্ত মনে খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাপটিয়ে বেড়ানোর কষ্ট।
বনের পাখিকে আদর দিলে খাঁচায় ঢুকিয়ে পোষার প্রয়োজন হয়না, এমনিতেই আমাদের কাছে আসতে পারে। আমার বাসার বারান্দায় প্রতিদিন বিষ পঁচিশটি কবুতর, কাক,দোয়েল খাবার সন্ধান করে।বাসার উচ্ছিষ্ট খাবার ডাস্টবিনে না ফেলে বারান্দায় রাখা নির্দিষ্ট একটি পাত্রে রেখে দেই।ওরা মনের আনন্দে সেগুলো খেয়ে নেয়।আমি কখনো বারান্দায় বের হলে কবুতরগুলো দূর থেকে ছুটে আসে আমার কাছে,নির্ভয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে পিছু পিছু।
ওরা ভাবে,আমি নই ওদের ভয়ের কোন জন,
আমি ওদের আপন
হয়তো এনেছে খাবার
হবে এবার ক্ষুধা নিবারণ …..।
করোনা কালের ডায়েরি। (পর্ব -১ )করোনা কালের ডায়েরি। (পর্ব -২ )করোনা কালের ডায়েরি। (পর্ব -৩ )
করোনা কালের ডায়েরি (পর্ব ৪)

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ ভোর ৪:৪৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×