somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

-ইতিহাসে অ-লেখা খলিল আর নুরিয়ের প্রেমকাব্য (বাস্তব ঘটনা)

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবির মানুষটির নাম হালিল ছাম। বাংলায় আমরা যাকে খলিল বলতে পারি। পাশে তার স্ত্রী নুরিয়ে ছাম। হালিল নিজে একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। বয়স বেশী নয়। ৫৫ তে নতুন পদার্পন করেছেন।


হালিল ছাম ও তার স্ত্রী নুরিয়ে ছাম

তার স্ত্রী বয়স এখন ৪৮ বছর। ১৯৯০ সালে বিবাহ করেন তারা। কোন প্রেমের বিবাহ ছিল না তাঁদের। পাশাপাশি গ্রামের তবে অন্য আত্মীয়দের মাধ্যমেই তাঁদের পরিচয়।


তাঁদের বিবাহের ছবি। বিবাহ করেছিলেন ১৯৯০ সালে

১৯৯০ সালেও তার্কিতে বিবাহ করার জন্য ছেলে বা মেয়েকে,"আমরা এই মেয়েকে তোর জন্য পছন্দ করেছি। বা ছেলেকে। তাকেই বিয়ে করতে হবে" বলে চাপিয়ে দেয়া হত না। আবার কোন কারনে ছেলে বা মেয়ে না করলে, যারা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন তাঁদের মন ও এমন ভাবে বেজার হত না যে আমাদের অবমূল্যয়ন করা হয়েছে। তারা তখনই বুঝত ছেলে আর মেয়ে নিজেদের কাছে ভাল লাগাটা আগে দরকার। কিন্তু আফসোস আমরা ২০১৮ তে এসেও এই বিষয়টা এখনও পারি নাই।

প্রস্তাব এসেছিল। হালিল আর নুরিয়ে নিজেদের মাঝের বোঝাপাড়াটা করে ফেলেছিলেন। বিয়ে হয়ে গেল। হালিল গ্রাম থেকে জেলা শহর এস্কেশেহীরে নিয়ে এলো তার স্ত্রীকে। সেখানেই তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলেন।
মাঝ থেকে প্রায় ১০ বছর চলে গেলে। তাঁদের প্রথম সন্তান তাঁদের কোলে তখন। হালিল ৯-৫ টা অফিস করে বাসায় ফেরেন।
হালিলের বর্ননা মতে, " আমরা তখন ১+১ একটি বাসায় থাকতাম। মানুষতো মাত্র ২ জন। খুব ভাল আর সুখে ছিলাম"।

হঠাৎ একদিন রাতে স্ত্রী নুরিয়ে মাথা ব্যাথা বলে মাটিতে পরে গেলেন। হালিলের সামনেই।
হালিল, "আমি বসে ছিলাম। নুরিয়ে উঠে দাড়াল। আর সাথে সাথে আবার পরে গেল। আমি কি হয়েছে জানতে চাইলাম। কিছু বলতে পারছিল না। আমি সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। আমাদের সরকারী মেডিকেল বিমা ছিল। কিন্তু তখনকার তার্কি আজকের তার্কির মত ছিল না। রাতে জরুরী বিভাগে যে ডাক্তার ছিলেন উনি চোখ ডলতে ডলতে উঠলেন।
আমাকে,'কি হয়েছে?' জানতে চাইলেন। আমি তাকে অবস্থা বুঝিয়ে বললাম। উনি বললেন, 'এখন পারব না। আমার চোখে অনেক ঘুম। কাল সকালে আসেন'। আমি সে রাতে আর কাউকে পেলাম না। মেডিকেল এর বারান্দায় (আমাদের মেডিকেল এর নামটিও বলেছিলেন। তবে সেই মেডিকেল আর এখন আগের মত না) সারারাত আমার অজ্ঞান স্ত্রীকে নিতে কাটিয়ে দিলাম। (আমাদের সমনে তখন তার স্ত্রী হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। সাথে হালিল নিজেও)।


তাঁদের অতীত থেকে

পরের দিন সকাল ৯ টায় নতুন ডাক্তার এলো। তার কাছে দৌড়ে গেলাম। এদিকে আমার একমাত্র ছেলে পাশের বাসায় রেখে গিয়েছি। আর কেউ নেই আমাদের সাথে।
তখন তার্কির নিয়ম ছিল; কাউকে মেডিকেলে ভর্তি করাতে হলে সেই বিষয়ের ৩ জন ডাক্তারের স্বাক্ষর লাগত। আমার এগুলো পেতে পেতে বেলা তখন ২ টা। আমার স্ত্রীকে ভর্তি করলাম। ডাক্তার দেখলেন। এদিকে আমি বাড়িতে একটা ল্যান্ডফোন দিয়ে ফোন করলাম। তাঁদের সাথে আমাদের পথের দুরত্ব ৫০-৬০ কিলোমিটার। কিন্তু তাঁদের খারাপ রাস্তার কারনে আসতে সময় লাগল সেদিনের সন্ধা। আর এখন আনকারা ৪০০ কিলোমিটার মানুষ সকালে গিয়ে অফিস করে আবার সন্ধা ফিরে আসে।" বলে ভেতরে থাকা অনেক কষ্ট যেন বাহির করে দিলেন এমন একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।


গত ১৮ বছর হালিল তার স্ত্রী এবং সন্তানের সেবা করে এসেছেন

আবার বলতে শুরু করলেন, "ডাক্তার আমার স্ত্রীকে দেখে বললেন, তার ব্রেইন স্টোক হয়েছে। আমি তাকে আগে কেন নিয়ে এলাম না। আমি বললাম, 'আমি তো রাতেই এসেছিলাম।' ডাক্তার, "ও" বলে চলে গেলেন। সাথে এটাও বলেছিলেন আমার স্ত্রী আর কোনদিন ভাল হবেন না। তার ব্রেইনের চার ভাগের ৩ ভাগ অকেজ। যার ফলে সে এখন থেকে আর চলাচলও করতে পারবেন না। প্যারালাইসড হয়ে গেছেন। আমি স্তম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুদিন পর স্ত্রীকে নিয়ে এলাম বাসায়। আর আমি চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে এপার্টমেন্টের নিরাপত্তার কাজ শুরু করি। যেখানে থাকতাম সেখানেই। যাতে আমি আমার স্ত্রীর কাছে থাকতে পারি। সেই থেকে আজ ১৮ বছর। ১ মিনিটের জন্যও আমি তাকে আমার থেকে দূরে রাখি নাই।"

নুরিয়ে যখন অসুস্থ হয়েছিল, হালিল তখন ৩৩ বছরের একজন টাগড়া যুবক। আর নুরিয়ে যুবতী। কিন্তু হালিলের কাছে এখন সে বোঝা। কিন্তু না। হালিল তাকে কোন দিন বোঝা মনে করেন নাই। ১৮ বছর অব্দি স্ত্রীর নোংরা কাপড় থেকে শুরু করে তার রান্না করা, তাকে খাওয়ানো, ঘর পরিস্কার করা, বাচ্চাটাকে বড় করে তাকে বিবাহ করানো। পরে তাঁদের আর একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তাকেও বড় করা। সবই করেছেন হালিল ২ হাতে। আর এখন ২ জন নাতনীও আছে এই জুগলের।
নুরিয়ের কথা একমাত্র হালিল বুঝতে পারেন। আমরা পাশে ছিলাম। খুব কম বুঝতে পেরেছি। তবে নুরিয়ে আমাদের কথা বুঝতে পারেন। ব্রেইনের যে অংশ কাজ করে তার মাধ্যমে। চলতে পারেন না এক কদমও। হালিলের পায়ে ভর করে চলে আসছেন গত ১৮ বছর। হালিলের হাতেই খেয়ে এসেছেন এই প্রায় দেড় যুগ।


ভাল থাকিক হালিলদের মত মানুষেরা। এটি তাঁদের পুরোনো কিছু ছবির ছবি

এমন স্বামীকে নিয়ে তার মাধ্যমেই বলছিলেন, আমার স্বামী পৃথিবীতে একবারই জন্ম নিয়েছেন। আর নিবেন না। আর সেটা আমার জন্য।

হালিল শেষ কথা হিসেবে বলছিলেন, "আমার স্ত্রীকে আমি খুব ভালবাসি। সেও আমাকে। তাকে ছাড়া আমি কিছু এখনও ভাবতে পারি না। আমার এই অচল স্ত্রী-ই আমার জীবনের আনন্দের উৎস। আজকাল কার প্রেম দেখে আমার খুব রাগ হয়। আজ আছে তো তাল বিচ্ছেদ। এটা প্রেম নয়। এটা প্রেমের সস্তা বাজার।"

আমি আবারও প্রশ্ন করলাম, চাইলে তো একটা বিয়ে করতে পারতেন?
"আমার স্ত্রী আছে। আমি কিভাবে আবার বিয়ে করি? সে যেদিন থাকবে না সেদিনও আমি তার এই চেয়ার আর এই প্লেট নিয়ে আবার তার কাছে যাওয়া অব্দি বেঁচে থাকব। তবে দোয়া করি, আমার আগে যেন সে চলে যায়। নইলে এপারে তার ভোগান্তি আমি ওপারেও সহ্য করতে পারব না" হালিল ছাম বলছিলেন।
সাথে বললেন, " আমার স্ত্রী সেদিন অসুস্থ না হয়ে যদি আজ হত তাহলে ফলাফল ভিন্ন কিছুও হতে পারত। সে আসলে অসময়ে অসুস্থ হয়েছে"।

আমি আর মুরাদ সেদিনের মত চলে এসেছিলাম। তবে একটি জীবন্ত কিন্তু ইতিহাসে অলেখা প্রেম কাব্যের সাক্ষী হয়ে।
এখন আম্নি মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে খোজ নেই হালিল আর নুরিয়ের। তারা ভাল থাকুক সেই কামনা করে আবার ফোনটি রেখে দেই। আর ভাবি, হালিলেরা বোধায় এমনই হয়।।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩০
১১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×