খালেক মিয়ার ইটের কথা পুরো এলাকা জানে। যারা এলাকায় নতুন আসে তারাও দু-এক দিনের মধ্যে তার শ্যাওলা ধরে সবুজ হয়ে যাওয়া ইটের ব্যাপারে জেনে যায়। তাতেও খালেক মিয়ার মন ভরে না। তার মনে হয় তার ইটগুলো কম গুরুত্ব পাচ্ছে। সারা পৃথিবীর জানা উচিৎ তার ইট সম্পর্কে। কত কষ্ট করে কত বছর ধরে সে এই তিন হাজার ইট কিনেছে!
প্রথম পাঁচটি ইটের বয়স তার বড় ছেলের চেয়ে পনের দিন বেশি। এই পাঁচটি ইট সে গামছায় বেঁধে পিঠের পেছনে ঝুলিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। তার পোয়াতি বউটা ইটগুলো দেখে খুশি হবে ভেবেছিলো। কিন্তু হলো হিতে বিপরীত। শেষ ধাপের পোয়াতি হওয়ায় মেঝে থেকে ঝাঁটাটা তুলতে পারে নি তার বউ। তুলতে পারলে আর রক্ষা থাকতো না। অনেক দিন আগে ছোটবেলায় মায়ের হাতে ঝাঁটার বাড়ি খেয়েছিলো সে খুব সামান্য একটা কারণে। পাশের বাড়ির ছমিরদের আমগাছের নিচে ছমিরসহ আরও কয়েকজনের সাথে খেলছিলো সে। তখনই গাছ থেকে একটা পাঁকা আম টুপ করে পড়ে খালেকের সামনে। খালেক সেটা লুকিয়ে ফেলে লুঙ্গির মধ্যে,পরে খাবে বলে। কিন্তু ছমির সেটা দেখে ফেলে। এরপর ছমির গিয়ে আম চুরির নালিশ করে খালেকের মায়ের কাছে। দারিদ্র্যপীড়িত সংসারে মানসম্মানটাই সবচেয়ে বড় অবলম্বন। নিজের ছেলেকে চোর বলায় তিনি রাগে দুঃখে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়েছিলো তার মা। সে অনেকদিন আগের কথা।তার মা মারা গেছে কয়েক বছর হলো। আজ হঠাৎ বউয়ের ঝাঁটা তোলার চেষ্টায় তার মায়ের কথা মনে পড়লো। মনের অজান্তেই বলে উঠলো "বড় ভালা মানুষ আছিলো আমার মায়ে।" কিন্তু হঠাৎই তার বউয়ের ঝামটায় সম্বিত ফিরে পায় সে। বউ তার রাগে কাঁপছে।
"ঘরে চাইল নাই,গোলামের পুতে ইট লইয়া আইছে। আহেন আপনেরে ইট ভাইজ্যা খাওয়াই।"
আসলেই তো। ঘরে চাল নেই।সে এটা ভুলে গেল কী করে? কাছে তো টাকাও নেই।ইট কিনে ফেলেছে।এখন কী হবে? বউয়ের হাতে ঝাঁটাটা তুলে দেবে ভাবলো একবার। তাকে পিটিয়ে যদি বউয়ের রাগ কমে তাহলে শান্তি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো,রাগ কমলে তো আর পেট ভরবে না। শেষ বেলার পোয়াতি ক্ষিদা সহ্য করতে পারবে না।তাছাড়া এই বয়সে বউয়ের হাতে ঝাঁটার বাড়ি খাওয়াটা ভালো কিছু না।মানসম্মান কিছু থাকবে না। এসব ভেবে কিছু না বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এক পোটলা চাল নিয়েই সেদিন ফিরেছিলো ঘরে। সেদিন আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে বউয়ের ক্রোধ থেকে সে বেঁচে গিয়েছিলো।
দিন, মাস, বছর চলে যেতে থাকে।এভাবে তিনটি,চারটি করে অনেকগুলো ইট জমিয়ে ফেলে সে।প্রতিটা ইট কেনার পর সে তার মাটির ঘরের দেয়ালে দাগ কাটতো। কিছুদিন আগে সে গুণে দেখেছে প্রায় দেড় হাজার ইট হয়েছে।এর মধ্যে তার চারটি ছেলে দুটি মেয়ে হয়েছে। বড় ছেলেটা বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। চাকুরিতে ঢুকবে কিছুদিন পরে। সবাই বলে ছেলে নাকি পড়াশোনায় অনেক ভালো। দ্বিতীয় ছেলেও এবার ইন্টার পরীক্ষা দেবে। সে গর্বিত পিতা। গ্রামের চায়ের দোকানে যখন সে যায়,তখন গ্রামের অনেকের ঈর্ষান্বিত মুখ দেখে সে আরাম পায় মনে। কিন্তু ছেলেদের চেয়ে তার ইটের গল্প করতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
"জানো নি মিয়ারা?? এইগুলি এক্কেরে এক নম্বর ইট। আমি নিজে বাইছ্যা লইয়া আইছি। আমারে ঠকানো এত সহজ না। আমার বাপে আছিলো……."
কথা শেষ করতে পারে না সে। শ্রোতাদের একজন জিজ্ঞাসা করে বসে,
"এক নম্বর তো বুঝলাম।দামও তো বেশি নিছে মনে হয়।"
খালেক গর্বের সাথে তার কথার উত্তর দেয়,
"আরে মিয়া আগেই তো কইছি আমারে ঠকানো সহজ না। প্রত্যেকটা ইটে দাম বেশি চাইছে।খাচ্চরের মতো মুলাইয়া মুলাইয়া দাম কমাইয়া তারপর আনছি। আপনেরা দুই নম্বর ইটে যেই দাম দেন আমি এক নম্বর ইট হেই দামে আনছি।"
তখন পাশ থেকে একজন ফোড়ন কাটে,
"তাইলে দ্যাহেন গা গিয়া।দুই নাম্বার ইটই দিছে আপনেরে।আপনে বুঝতে পারেন নাই।"
এবার চটে যায় খালেক।
"আমার বুদ্ধি লইয়া খোঁচা মারছ হালার পুত!!"
বলেই সে মারামারি শুরু করে দিলো। এরপর থেকে কেউ আর ইট নিয়ে খালেক মিয়াকে চটাতে চাইতো না। এলাকায় জনশ্রুতি ছিল, খালেক মিয়া তার বউয়ের চেয়ে আর ইটগুলোকে বেশি ভালোবাসে। তারা আসলে মিথ্যা কথাও বলতো না। খালেক মিয়াকে প্রতিদিন দেখা যেত তার ইটে পানি ছেটাচ্ছে। যখন ইটের সংখ্যা কম ছিলো তখন সে প্রতিদিন সেই ইটগুলোকে ধৌত করতো। তার বউয়ের হাজার চিৎকার চেচামেচি তাকে ফেরাতে পারে নি। কিন্তু ইট বেড়ে যাওয়ার পর সে একটা একটা করে ইট ধৌত করতে পারছিলো না সে তার বাক্সের মতো করে সাজিয়ে রাখা ইটগুলোতে বালতির পর বালতি পানি ঢালতো। সে নিশ্চিত হতো যাতে তার সব ইটে পানি পৌঁছায়। সেখান থেকে কোনও ইট সে কাওকে স্পর্শ করতেও দিতো না। একবার বন্যার সময় তার এক প্রতিবেশি তার কাছ থেকে কিছু ইট ধার চেয়েছিলো। সে মানা করে দিয়েছিলো। কিন্তু তার বউ অনুমতি দিয়ে দেয়। প্রতিবেশি যখন খালেকের বউয়ের কথা শুনে ইট নিতে যায় তখনই সে উঠোনে নেমে এসে গগণবিদারী চিৎকার করে বলে ওঠে,
"আমার হ্যানতে যে একখান ইট নিবো,আল্লায় হ্যার মাতায় ঠাডা হালাইবো।"
একথা শুনে প্রতিবেশি তাড়াতাড়ি ইট ছেড়ে বাড়িতে চলে যায় খালেক মিয়ার ঠাডার হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে।
খালেক মিয়া এভাবেই সারাজীবন তার ইটগুলোকে আটকে রেখেছে। সে সব মিলিয়ে দু হাজার ইট কিনেছিলো। সে যখন মৃত্যুশয্যায় ছিলো তখন তার ছেলেমেয়েরা সকলে প্রতিষ্ঠিত। তার মাটির ঘরের জায়গায় এখন বিল্ডিং হয়েছে। ছেলেরা তার ইটগুলো বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করে নি পুরনো বলে।তাছাড়া তাকে চটাতেও চায় নি কেউ। কিন্তু তার মনের কথা কেউ জানতো না। প্রথমবার যখন তার বউ পোয়াতি হয়েছিলো তখনই সে মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিলো একটা বাড়ি হবে তার। প্রথমে ইট কিনবে, তারপর রড,তারপর বাকি জিনিস। কিন্তু এজীবনে ইট ছাড়া আর কিছু কিনতে পারে নি। ছেলেরা বাড়ি করেছে।সেই বাড়িতেই সে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে।তার এই অত্যধিক ইটপ্রীতির কারণ জানা গিয়েছিলো ঠিক তার মৃত্যুর আগে। তার অস্পষ্ট শব্দের অস্পষ্ট কথা তার বউ শুনতে পেয়েছিলো পাশে বসে,
"ইটাডি কিনছিলাম বাড়ি কইরা থাকমু হেল্লিগা।আর অইলো না থাহা।"
একথা বলার পরেই সে শুধু বউকে বলেছিলো,
"বালা থাহিস।যাই গা।"
এরপরই মানুষটা মৃতের দেশে চলে যায় তার সাধের ইটগুলোকে রেখে।
খালেক মিয়া মারা যাওয়ার পর তার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিলো। তার ছেলেরা বুদ্ধিমান ছিলো। একেবারে তার মতো। তারা সেই দুই হাজার ইট দিয়ে খালেক মিয়ার কবরটা খুব সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছিলো।সেখানকার একটা ফলকে খালেক মিয়ার নামটা স্পষ্ট দেখা যায় সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:২৯