somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের স্বরূপ

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্লগের একটি পোস্টে চোখ আটকে গেল।সেখানে একজন সম্মানিত ব্লগার বাংলা সাহিত্যকে মরাকান্নার সাহিত্য আখ্যা দিয়ে বিদেশি সাহিত্যের গুণগাণ গেয়ে একাকার করে ফেলেছেন। তার পোস্টটি অপপ্রচার এবং একচোখা বিশ্লেষণে ভরপুর।হয় তিনি বেছে বেছে মরাকান্নার সাহিত্য পড়েছেন অথবা যেকোনো সাহিত্যে মরাকান্নার অংশ পড়ে আর পড়েন নি। আর বিদেশি জিনিসের প্রতি বাঙালির আদিখ্যেতা নতুন কিছু নয়।সেটা সেই পোস্টেও প্রকাশিত।

দুই সাহিত্যের তুলনা করতে গেলে আমাদের এই দুই অঞ্চলের সমাজ,দর্শন ও মানসিকতা নিয়ে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। মরুভূমির সাথে মেরু অঞ্চলের সাদৃশ্য মেলাতে গেলে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যই পাওয়া যাবে। প্রাচ্য দর্শন ও পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ বিদ্যমান। প্রাচ্য সমাজ আধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদে বিশ্বাসী। আর পাশ্চাত্য সমাজ ভোগবাদে। আর তাই প্রাচ্য সমাজে মানবতাবাদের প্রাধান্য দেখা যায় আর পাশ্চাত্য সমাজে ভোগ,দখল,যুদ্ধ বিগ্রহ। ওরা যখন জ্ঞান,বিজ্ঞানে উন্নত হচ্ছিলো আমরা তখন ওদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সংগ্রামে রত থেকেছি। শরৎ, মানিক,বিভূতির লেখায় তিনি মরাকান্না পান।অথচ তাদের লেখায় সমকালীন সমাজ,রাষ্ট্র,রাজনীতি উঠে এসেছে সেটা তার চোখে পড়ে নি। শরতের পথের দাবি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ,যার ফলে বইটি নিষিদ্ধ হয়।নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহ এসেছে।

তিনি দেব-দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মানুষের কথা বলে ইউরোপীয় সাহিত্যকে মহীয়ান বলে ঘোষণা করেছেন অথচ বাংলায় যে একজন চাঁদ সওদাগর বসে আছেন সেটা তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন।দেবী মনসা শেষ পর্যন্তও তাকে টলাতে পারে নি।

বাঙালির বীরত্বের ইতিহাস খুঁজে পান না তিনি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে আগস্ট আন্দোলন,নীলদর্পন নাটকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম,পথের দাবী উপন্যাসের স্বদেশী আন্দোলন,তারাশঙ্করের অরন্যবহ্নি তে সাওতাল বিদ্রোহ সহ বাঙালির সংগ্রামের বিবিধ উপাদান আছে বাংলা সাহিত্যে।অথচ তিনি শুধু রুশদের বিপ্লবের কাহিনির কথাই বললেন।

সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঘরে-বাইরে ও গোড়া তে। বিভূতি লিখেছেন আরণ্যকে।সেখানে পরাধীন ভারতকে কটাক্ষ করেছেন এইই বলে যে "ভারতবর্ষ কোথায়?"

তিনি ইংরেজদের সাহিত্যের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ না করেই। শেক্সপীয়ার তাঁর দেশের দরিদ্র মানুষদের নিয়ে লেখেন নি।কেন লেখেন নি? এটা কি সত্যের অপলাপ নয়? তিনি সত্যকে লুকিয়েছেন। লেখকের মতো আমি যদি এখন একচোখা মন্তব্য করি তাহলে শেক্সপীয়ারের বিখ্যাত রচনাগুলোতেও মরাকান্না ছাড়া আর কিছু নেই। তাঁর প্রত্যেকটা নাটকের মূলকথা একটাই।নায়ক আকাম করবে,নায়িকা/নায়ক একে অপরকে ভুল বুঝবে।শেষ পর্যন্ত নায়ক নায়িকা মরে গিয়ে নাটক শেষ।একেবারে ফুল ফরম্যাট। অথচ এসব কথা বললে শেক্সপীয়রের সাহিত্যকর্মকে অবমূল্যায়ন করা হবে।তাঁর নাটকের মহিমা বুঝতে পারবে না পাঠক।

বরিনসন ক্রুসো,গালিভারস ট্রাভেলে অ্যাডভেঞ্চারকে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।এই দুটোই দখলদারী এবং ঔপনিবেশিকতার কাহিনি। রবিনসন দ্বীপ দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। অথচ বাংলায় বিভূতি চাঁদের পাহাড় নামক বিশুদ্ধ অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লিখেছেন যেখানে বাঙালি যুবক আফ্রিকায় পরিব্রাজন করেছে এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থেকেছে।

তিনি হোমারের ইলিয়ড,ওডিসির কথা তুলেছেন অথচ সফক্লিসের ইডিপাস এবং অন্যান্য লেখকের ইলেক্ট্রা,প্রমিথিয়াস বাউন্ডসের কথা বলেননি। ওগুলোতে মরাকান্নার উপাদান ভর্তি। কিন্তু মরাকান্না ছাপিয়েও সেখানে আরো কিছু আছে।তাই সেটাকে ফোকাস করলে এসব ট্রাজেডির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

লেখার শেষে এসে তিনি দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সান্টিয়াগো জীবনযুদ্ধে পরাজিত বৃদ্ধ।সে জয়ী হয় নি।কিন্তু হাল ছেড়ে দেয় নি। পুরো উপন্যাসেই মরাকান্না ভর্তি।কিন্তু শেষ পর্যন্ত নতুন জীবনের আশাবাদ বজায় রেখেছেন আর্নেস্ট হেমিং ওয়ে।এটাই এই উপন্যাসের বিশেষত্ব। অথচ এমন উপন্যাস বাংলায়ও আছে।বিভূতির পথের পাচালি। অপু সারাজীবন ঠোকর খেয়েও পথ চলা থামায় নি। তেমনি রয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামার তমিজ। তারা যেমন সমকালীন ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে লিখেছেন তেমনি বাংলার লেখকগণ সতীদাহ প্রথা নিয়ে লিখেছেন।কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা তেমন একটি উপন্যাস। ধর্ম ব্যাবসা নিয়ে লিখিত ওয়ালীউল্লাহর লালসালু,বহীপীর।

বীরত্বের বেলায় শুধু ইংরেজেই থেমে থাকে নি বাংলার লেখকগণ।মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল নিয়ে বহু উপন্যাস নাটক,কবিতা লেখা হয়েছে।

আলবেয়ার কামু, ইউজিন আয়োনেস্কো,স্যামুয়েল বেকেট যেমন অ্যাবসার্ড তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন তেমনি সাইদ আহমদ, বাদল সরকার,মোহিত চট্টোপাধ্যায় অ্যাবসার্ড তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন। ফ্র‍য়েডিও তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ,বিষ্ণু দে,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

টি এস এলিয়টকে খুব উচ্চাসন দেয়া হয় বিশ্বসাহিত্যে। অথচ টিএস এলিয়ট যে ঘরানায় লিখেছেন একই ঘরাণার কবি জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,বিষ্ণু দে,অমিয় চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এদের কবিতা যদি আপনার মরাকান্না মনে হয় তাহলে টি এস এলিয়টের কাব্যগুলোকেও মরাকান্না বলতে হবে আপনার কথা মতে।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েল যেমন গোয়েন্দা উপন্যাস লিখেছেন তেমনি সত্যজিৎ,শরদিন্দু,সুনীল,প্রেমেন্দ্র মিত্রও গোয়েন্দা উপন্যাস লিখেছেন।

হাস্যরসাত্মক সাহিত্য লিখেছেন প্যারীচাদ মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী, রাজশেখর বসু,প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ।

জাদুবাস্তব সাহিত্য লিখেছেন আখতারুজ্জামান ইলয়াস, শহীদুল জহির।

বিজ্ঞানভিত্তিক জীবন দর্শন নিয়ে লিখেছেন অক্ষয়কুমার দত্ত,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে মার্ক্সিজম,ফ্রয়েডিজমের প্রয়োগ করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক ,সরীসৃপ, সিঁড়ি এমন গল্প। পুতুল নাচের ইতিকথায় দেখিয়েছেন মানুষ নিয়তির হাতের পুতুল না। প্রত্যেকটি ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন।মার্ক্সিজমের সফল প্রয়োগ করেছেন পদ্মানদীর মাঝি তে।আগস্ট আন্দোলন তুলে ধরেছেন চিহ্ন তে।

আরব্যোপন্যাসে স্বভাবতই সমুদ্রযাত্রা থাকবে। কারণ তাদের দেশে ফসল হতো না।অন্য দেশে ব্যবসা করেই পেটে ভাত জুটতো তাদের।আলাদীন আলীবাবা চোরের ওপর বাটপারী করেছে।অন্যের লুকিয়ে রাখা সম্পদ আত্মসাৎ করেছে।এটা ভালো স্বভাবের পরিচয় দেয় না।অপরদিকে আমাদের নিজেদের খাবার আমরা নিজেরাই উৎপাদন করে আসছি হাজার বছর ধরে।এজন্যই আমরা জাগতিক বস্তু বাদ দিয়ে আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তা করতে পেরেছি।ইউরোপীয়ানরা সারাজীবন অন্যকে লুটেছে।অন্যকে লুটতে না পারলে নিজেদের লুটেছে।যেমন ভাইকিংস জাতি। সেই লুটের কাহিনিকে বীরত্ব হিসেবে প্রচার করেছে তাদের সাহিত্যে। অন্যদিকে আমাদের অঞ্চল হাজার বছর ধরে বিভিন্ন দেশ লুটছে।প্রথমে বৌদ্ধ,তারপর হিন্দু,মুসলমান এরপর ইংরেজ। বাংলার মানুষও সংগ্রাম করে গেছে। একই সাথে নিজেদের জীবন ও যাপন করে গেছে। এখন আমি যে জীবন যাপন করছি সেই জীবনের প্রভাব আমার ওপর পড়বেই। বাঙালির জীবনে দুঃখ যেমন আছে তেমনিসংগ্রাম বীরত্বের ইতিহাসও আছে।এখন যদি আপনি মরাকান্না নিয়ে পড়ে থাকতে চান তাহলে সেটা আপনার ইচ্ছা।বেশি করে কাঁদুন।আর অন্যেরটা দেখে হা হুতাশ করুণ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৭
২০টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×