somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লঞ্চ ভ্রমণ বৃত্তান্ত

১৬ ই নভেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছবিসূত্র- Banglanews24.com

আমার বাড়ি নারায়নগঞ্জে হলেও জীবনের প্রায় ছয় বছরের মতো সময় অতিবাহিত হয়েছে বরিশালে। একা থাকতাম সেখানে,মাসে দুয়েকবার বাড়ি আসতাম।বরিশাল থেকে ঢাকায় যাতায়াতের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম লঞ্চ।আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হবার সুবাদে অন্য পরিবহনের চেয়ে লঞ্চে যাত্রী থাকে বেশি।প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাঁচ থেকে ছয়টি লঞ্চ বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে।আবার ঢাকা থেকেও একই পরিমাণ লঞ্চ ছেড়ে আসে। নানা ধরণের,বর্ণের লোকের সমাগম হয় লঞ্চে।বরিশাল থেকে বাসে ঢাকায় যেতে সময় লাগে ছয় ঘন্টা।লঞ্চে লাগে আট ঘন্টা।এত সময় লাগলেও লঞ্চে বেশি যাত্রী হবার কারণ এর সাশ্রয়ী ভাড়া। লঞ্চের ডেকের ভাড়া একশো থেকে দুইশো টাকার মধ্যেই থাকে সবসময়। অন্যদিকে বাসভাড়া ৩৫০ (লোকাল) থেকে শুরু।এজন্য লঞ্চ কখনো খালি থাকে না।

আমি সবসময় লঞ্চে যাতায়াত করেছি।দিনের বেলায় কাজ সেরে সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠতাম।ভোরবেলা পৌছে যেতাম বাড়িতে। আমি ডেকেই যাতায়াত করতাম বেশি।আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখতাম। তাদের কথাবার্তা,চালচলন সবকিছু দেখতাম।অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি।মজার ঘটনা যেমন ছিলো,তেমনি বিষাদপূর্ণ ঘটনাও ছিলো অনেক।

প্রথমদিকের ঘটনা। তখন রাত একটা কি দুটো বাজে।লঞ্চ পূর্ণ গতিতে চলছে।পূর্ণিমা রাত। চারিদিকে সবকিছু ফকফকা।হঠাৎ করে লঞ্চের গতি কমে গেল।অনেকেই লঞ্চের রেলিং এর কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে গেল ঘটনা কী!! আমিও গেলাম। দেখলাম এক লোক নদীর পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে।তাকে তোলা হলো লঞ্চে। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে। একটু পরে যখন সে ধাতস্থ হলো তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো সে নদীতে পড়লো কিভাবে!! সে বলল, " ভাইয়ো,বাতরুম খালি না পাইয়া লোঞ্ছের সাইডে বইছেলাম পোরছাপ হরতে। কাম শ্যাষ হইররা ওটতে যামু তহনই সিলিপ খাইয়া নদীতে পড়ছি।" কথা শুনে উপস্থিত সবাই প্রচণ্ড পরিমাণে হাসলো।সাথে ভুক্তভোগীও যোগ দিলো।তাকে দেখে বোঝার উপায় রইলো না যে সে একটু আগে নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। এরকম আরো একদিন দেখেছিলাম নদীর মাঝে লোক হাবুডুবু খাচ্ছে।সেদিন আর লঞ্চের গতি কমলো না,বরং গতি বাড়িয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গিয়েছিলো লোকটার বিপদ আর লঞ্চওয়ালাদের এমন নিস্পৃহতা দেখে।সকাল বেলা কেরানিকে জিজ্ঞাসা করলাম এরকম করার কারণ। তিনি বললেন যে সে লোকটি আসলে ডাকাতদের লোক। ডাকাতেরা রাম দা,দেশীয় রাইফেল হাতে দূরেই ট্রলারে অবস্থান করছিলো।ভাগ্যক্রমে সারেং এর চোখে পড়েছিলো। লঞ্চ স্লো করলেই তাদের কবলে পড়তে হতো। কথা সত্যি না মিথ্যা সেটা জানি না।তবে ডাকাতের কথা শুনে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো।

শীতের সময় নদীর পানি অনেক কমে যায়।নাব্যতা সংকট দেখা দেয় অনেক জায়গায়। তখন লঞ্চ চলাচলে অনেক অসুবিধা হয়।তাছাড়া নদীতে অনেক কুয়াশাঁ পড়ে।এক গজ দূরের জিনিসও দেখা যায় না অনেক সময়।সার্চ লাইটেও বেশি দূর দেখা যায় না।তখন লঞ্চ কখনো গতি কমিয়ে ,কখনো থামিয়ে,কখনো গতি বৃদ্ধি করে চালানো হয়।তারপরও অনেক সময় লঞ্চ ডুবোচরে আটকে যায়। তখন লঞ্চকে অনেক কষ্ট করে আবার গভীর পানিতে নামাতে হয়। একবার মাঘ মাসের শীতে লঞ্চে যাতায়াত করছিলাম।হঠাৎ করে মাঝরাতে লঞ্চটি একটি ডুবোচরে আটকে গিয়ে সামান্য কাঁত হয়ে যায়। লঞ্চের পাশের একটু অংশ চরে আটকে গিয়েছিলো।লঞ্চে চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু হলো।অনেকেই ভয় পেয়েছে।কিন্তু আমার চোখের সামনেই এক লোককে দেখলাম গায়ে কম্বল জড়িয়ে নদীতে লাফ দিলো। সবাই হতবাক হয়ে গেল। আমরা অনেকেই রেলিং এর পাশে গিয়ে দাড়ালাম। দেখি লোকটি বাচাঁও,বাচাঁও বলে চিৎকার করছে।সে লাফ দিয়ে ডুবোচরেই পড়েছিলো।পানি ছিলো তার বুক সমান। কিন্তু কম্বলের কারণে সে তার হাত নাড়াতে পারছিলো না।এজন্য ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে।তার কাণ্ড দেখে লোকজনের হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হবার যোগাড়।তাকে যখন লোকেরা তুলতে যাচ্ছিলো তখন শুনতে পেলাম এক মহিলা লোকটিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে।পাশে চার-পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট একটা পুতুলের মতো মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।লোকটিকে ওঠানোর পর মহিলাটি বললো " হালার পুরুষ জাতটাই খারাপ।" পরে জানতে পেরেছিলাম যে মহিলাটি লোকটির স্ত্রী এবং বাচ্চাটি লোকটির মেয়ে। লঞ্চকে কাঁত হতে দেখে ডুবে যাবে ভেবে জীবন বাঁচাতে স্ত্রী কন্যাকে রেখেই লাফ দিয়েছিলো সে। কিন্তু অনেক ভেবেও আমি বের করতে পারলাম না যে,এই পৌষ মাসের শীতে বরফঠাণ্ডা জলে লাফ দেয়ার সময় লোকটি গায়ে কম্বল কেন পেঁচিয়ে নিয়েছিলো??? আগে তো তার গায়ে কম্বল ছিলো না!!

বিষাদপূর্ণ ঘটনার মধ্যে আছে দুটো মৃত্যু।এক বৃদ্ধ লোককে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।পথিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার একটু আগে বললেন, "সগীর মোর ধারে ১৭ টাহা পাইবে।দিয়া দিস।তোরা ভাল থাহিস।" এরপর বিড়বিড় করে কি যেন বলে মারা গেলেন। কেমন একটা ব্যাথা অনুভব করেছিলাম সেদিন। আরেকদিন দেখলাম এক মেয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে নদীতে লাফ দিয়ে হারিয়ে গেল।সেদিন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিলো।

একবার বৈশাখ মাসে লঞ্চে ভ্রমণ করছিলাম। মাঝরাতে চাঁদপুর আসার আগে আগে প্রচন্ড ঝড় উঠলো,সাথে বজ্রপাত আর প্রচণ্ড শব্দ।আমি লঞ্চের ছাদে ছিলাম।এরপর নিচে নেমে এলাম ডেকে। সেখানে মারাত্মক অবস্থা।কান্নাকাটি চলছে সমানে।বাতাসে লঞ্চ কাঁত হয়ে যাচ্ছিলো।সাথে মেঘনা নদীর প্রচণ্ড ঢেউ। কেউ ভয়ে লাফ দিচ্ছিলো না।দিলে ঢেউয়ে তলিয়ে যাবে এই ভয়ে।লঞ্চের লোকজন একটু পরে এসে লঞ্চের সাইডের ত্রিপলগুলো উঠিয়ে দিলো।তখন লঞ্চ কাঁত হওয়া কমে গেল। কিন্তু দুলুনি কমলো না। ঝড় এত তীব্র ছিলো যে,লঞ্চটি মাঝ নদীতে প্রায় ১৫ মিনিটের মতো নোঙ্গর করা ছিলো। সেবার মনে হচ্ছিলো মরেই যাব বোধহয়। আম্মা কে ফোন দিতে গেলাম। দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই।খুব অসহায় লাগছিলো।

এবার একটা ভালোলাগার স্মৃতি বলছি। লঞ্চে ওঠার সময় খুব হুড়োহুড়ি হয়।যে আগে উঠবে সে জায়গা পাবে। আমি এভাবে উঠতে অভ্যস্ত নই বলে সবার শেষেই উঠতে হতো সবসময়।সেবার ভীড় এতো বেশি ছিলো যে, ডেকে যায়গা পেলাম না। শেষ পর্যন্ত লঞ্চের একেবারে ছাদে উঠে গেলাম।গিয়ে লাইফবোটে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু শুয়ে থাকতে পারলাম না।মায়াবি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিলো সবকিছু। মাথার পাশে বিশালাকার চাঁদ।পুরো নদী দেখা যাচ্ছিলো।এমনকি নদীতীরের গাছ বাড়িঘরও ভেসে যাচ্ছিলো রূপালি জ্যোৎস্নায়।সে কী রূপ!! চোখ ঝলসে যাচ্ছিলো!! নদীর পানিতে চাঁদের ছায়া,জ্যোৎস্নার ছায়া!! এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম এই রূপ।লঞ্চের ছাদে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলো না। জ্যোৎস্নার তেজ কমার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেক গুলো ঘটনার মধ্যে অল্প কয়েকটিই বললাম মাত্র। অনেকগুলো ভুলে গেছি। এ কয়েকটি কখনো ভোলার মতো নয়।বিশেষ করে কম্বল কাণ্ড এবং রূপালি জ্যোৎস্না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:১১
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×