ছবিসূত্র- উইকিপিডিয়া,মৎস্য পুরাণ পাতা।
মৎস্য অবতার হিসেবে মহাপ্রলয়ের মহাকবল থেকে মানবকুলকে রক্ষা করার পর মনুকে নতুন আর্যবসতি স্থাপনের নির্দেশনা দান করে স্বর্গে চলে গেলেন দেবতা বিষ্ণু। তারপর লক্ষ-কোটি বছর গত হয়েছে।বহু যুদ্ধ,সংগ্রাম,ত্যাগ-তিতীক্ষার প্রহর পার হয়ে আর্যদের নতুন বসতি এখন উগান্ডা। বাংলাদেশ এবং উগান্ডা একই সাথে স্বাধীন হলেও উগান্ডা সেই অচ্ছুৎ,নীচ,অনার্য, বয়াংসী,জংলী বাঙালিদের চেয়ে পিছিয়ে আছে সবদিক থেকে। অথচ এই আর্যরা একসময় ধনে-জ্ঞানে, রুচিতে, আভিজাত্যে, মর্যাদায় পৃথিবীর সেরা ছিলো। অথচ পাপ-পঙ্কিলতা, অশিক্ষা, কুসংস্কারের জালে আটকা পড়ে অধঃপতিত হয়ে আবারো মহাপ্রলয়ের সম্মুখে এসে দাড়িয়েছে আর্যরা। মহাপরাক্রমশালী আর্য জাতির আজ এ কী অবস্থা!!! "আমি নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছি এদের!! পরিপূর্ণ নির্দেশনাও দিয়েছি!! তারপরও তাদের এমন অধঃপতন!! এত নির্বোধ এরা হলো কি করে??" আক্ষেপ ঝরে পড়ে বিষ্ণুদেবের কণ্ঠ থেকে। "যদি বুদ্ধি থাকতো তাহলে বাংলাদেশকে দেখেই শিখতে পারতো। নাহ! আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আমাকে আবারো মর্ত্যে যেতে হবে।" সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি।
কিন্তু কিভাবে আসবেন মর্ত্যে? কল্কি অবতার হিসেবে যাওয়ার সময় আসে নি এখনো। মানুষ হিসেবেও যাওয়া যাবে না। উগান্ডার মানুষেরা কেউ কারো কথা সহজে শুনতে চায় না।কেউ কাওকে গোণে না।তাহলে কী করা যায়! ভাবতে থাকেন বিষ্ণুদেব। অবশেষে পেয়ে যান তার সমস্যার কাঙ্ক্ষিত সমাধান। উগান্ডার নদীগুলো দূষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।সেখানে জীবনের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই নদীগুলোর কোনো একটাতে যদি তিনি আবার মাছ হিসেবে আসেন তাহলে হুলস্থূল হয়ে যাবে চারিদিকে। পচা-কালো পানিতে প্রাগৈতিহাসিক কালের রূপালি নদীর জলের রূপালি মাছ, তার ওপর সেই মাছ যদি হয় কথা বলা মাছ,তাহলে তো কথাই নেই।তিনি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যাবেন স্রষ্টার অলৌকিক সৃষ্টি হিসেবে। তখন সবাই তার কথা শুনবে। উগান্ডাবাসী আর্যরা ধর্মের ব্যাপারে খুবই প্রতিক্রিয়াশীল ও সংবেদনশীল। তাই তিনি পুনরায় মৎস্য অবতার হিসেবে আর্যদের রক্ষা করার লক্ষ্যে মর্ত্যে আগমন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।
বিষ্ণুদেব এক প্রমাণ সাইজের রুইমাছের রূপ ধারণ করে উগান্ডার ইবোলা নদীতে অবতরণ করলেন। নদীতে অবতরণের সাথে সাথেই পচা ইবোলা নদীর তলদেশের একটা বর্জ্যবোঝাই পলিথিন তার মুখে ঢুকে গেল।মাছের তো হাত থাকে না। তাই অনেক কষ্টে মুখ থেকে তিনি পলিথিন বের করলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি টের পেলেন, তিনি কথা বলতে পারছেন না। হায়! হায়! তার পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। কথা না বললে আর্যদের বাঁচাবেন কিভাবে তিনি? অন্যসব মাছের সাথে তো আর কোনো পার্থক্য রইলো না তার। প্রবল দুশ্চিন্তা এবং অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগা দূষিত পানিতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্বাস নেবার সুতীব্র ইচ্ছায় তিনি নদীর পানির ওপরে ভেসে ওঠেন। অবসন্ন হয়ে পড়ে তার শরীর। একটু পরেই বহু আর্যের সম্মিলিত কোলাহল শুনতে পান তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ধরা পড়েছেন আর্যদের হাতে। তিনি কিছু বলতে চাইলেন। পারলেন না।
ধরা পড়ার পর থেকেই তিনি শুধু মানুষ, মানুষের মাথা, ফ্ল্যাশ লাইট, মোবাইল,ক্যামেরা দেখে চলেছেন। তিনি ভাইরাল হয়ে গেছেন। সবাই সেলফি তুলছে। ইবোলা নদীতে প্রমাণ সাইজের রুইমাছ। এ একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কোলাহল, মানুষ, ফ্ল্যাশলাইট এ-সবকিছুর ধকল তিনি নিতে পারলেন না। অনেকক্ষণ হয় তাকে ডাঙায় তোলা হয়েছে। তার বাকশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। তাই তিনি মাছ হিসেবে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নরক-যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেলেন। মনে মনে বললেন,"এদেরকে স্বয়ং ভগবানও ঠিক করতে পারবেন না।" তিনি তখনই স্বর্গের পথে পা বাড়ালেন। কিন্তু গেলেন না। যাওয়ার আগে সাধের দেহটার কী গতি হয় সেটা দেখার খুব ইচ্ছা জাগলো বিষ্ণুদেবের মনে।
তিনি দেখলেন তার মরদেহটাকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।তারপর সেটাকে একটা ঝাঁজালো গন্ধযুক্ত তরলে ডোবানো হলো। তিনি সেটার সাথে পরিচিত। তিনি স্বর্গে বসে আগেই দেখেছেন আর্যরা মাছেদের ফরমালিন নামক এই তরলটাতে নিমজ্জিত করে। এরপর তাকে বাজারে ওঠানো হলো। তার দেহের আকার আর দেহের রঙে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই আসে তাকে কেনার জন্য। আর্যরা দাম জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই দোকানি মাছের কানকো টেনে ওপরে তুলে বলে, " এই দ্যাহেন,পুরা তাজা মাছ।এইমাত্র ধরা পড়ছে।" কানকো টানা দেখে বিষ্ণুদেবের গালে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয়।ভাগ্যিস! মরে গেছেন! নইলে এসবও সহ্য করতে হতো!! তাজা মাছ দেখে সবারই পছন্দ হয়। কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করে। "ওষুধ মারো নাই তো?” তখন দোকানি রাগন্বিত হয়। ক্রোধমিশ্রিত কণ্ঠে বলে, " হারাম ব্যাবসা করি না মিয়া। মাছ নিলে নিবেন, না নিলে যান গা!" যারাই মাছ কিনতে আসে তাদের বেশির ভাগই দাম শুনে চম্পট দেয়। কেউ কেউ দর কষাকষি করে। তবে দোকানি মাছের দাম কমায় না।এত বছর পরে ইবোলা নদীতে এত বড়ো রুই ধরা পড়েছে। কম দামে বিক্রি করবে না সেটা দোকানি।
অবশেষে একজন ক্রেতা পাওয়া যায় মাছের। সে কোনো দরদাম না করেই মাছটি কিনে নেয়। আবার কিছু টাকা বখশিশও দেয় দোকানিকে। আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখা যায় দোকানির চেহারায়। মাছটা কিনেই কাকে যেন ফোন করে ক্রেতা। তারপর সে গাড়িতে ওঠে মাছটা সাথে নিয়ে।কিছুক্ষণ পরেই গাড়িটা একটা দালানের সামনে এসে থামলো। বিষ্ণুদেব দেখলেন দালানের ওপরে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা, "ডিস্ট্রিক্ট ভূমি অফিস,উগান্ডা।" সেই ক্রেতা মাছটি নিয়ে ঢুকে গেলো একটা ঘরে। সেখানে বিশাল চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন আরেকজন।তাকে দেখে বোঝা যায় তিনি খুব বড় মাপের লোক। বেশ রাশভারি গোছের চেহারা,সাথে ফুটবলের মতো পেট। ক্রেতা গিয়ে তিনবার স্যার ডাকতেই তার ঘুম ভাঙলো। ক্রেতাটি মাছটা দেখিয়ে স্যারকে বললো, "আমার ব্যাপারটা একটু দেখবেন স্যার।" স্যারের চোখ চকচক করে ওঠে মাছটা দেখে।কিন্তু চেহারায় আগের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই তিনি সেই ক্রেতাকে আশ্বস্ত করে বিদায় নিতে বললেন। ক্রেতা বিদায় নেবার পরপরই স্যার মাছটি নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন। এমন মহান মানুষের পেটে সাধের দেহটা যাবে বলে খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বিষ্ণুদেব। রাগে তার নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে। কী করতে এসেছিলেন আর কী হচ্ছে!! স্যারের পত্নী মাছটা মাছটা দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি আজই মাছটাকে ফেইসবুকে দেখেছেন। অথচ এটা এখন তারই বাড়িতে। নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই ঈর্ষান্বিত হয়ে যান স্যারপত্নী।বাবার বাড়ি,শ্বশুর বাড়ি, বান্ধবী, ভাবী সকলকে ফোন করে জানিয়ে দেন এই আশ্চর্যজনক মাছ এখন তার বাড়িতে। অনেকেই তোষামোদ করে তাকে। তবে প্রায় সবাই ঈর্ষান্বিত হয় তার ভাগ্যে। তার মনে হতে থাকে তার ভাগ্যগুণেই এমনটা হয়েছে। পাশের বাসার ভাবীরা খবর পেয়ে দেখে যায় একবার। সবকিছু শেষ হবার পর তিনি মাছটা কাটতে বসলেন। পরম যত্নে তিনি মাছটা কেটে শেষ করলেন। কিন্তু শেষ করার সাথে সাথেই তিনি ফোনে খবর পেলেন তার মা মারা গেছে। মাছ যেমন ছিলো তেমনটা রেখেই তিনি ছুট দিলেন বাপের বাড়ি।সাথে স্যারও গেলেন। দেহটাকে এভাবে টুকরো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আবারো দুঃখ পেলেন বিষ্ণুদেব।
দিন-পনেরো পরে পত্নীসহ স্যার ফিরলেন বাড়িতে। তার বাড়ি ফিরে দেখলেন কাটা মাছ ফ্লোরে পড়ে রয়েছে।যেমন ছিলো তেমনই আছে। একটুও পচন ধরেনি। "এমন মেডিসিন দিছে যে, পনেরো দিনেও পচলো না? এ মাছ খাওয়া যাবে না"। একথা ভাবা মাত্রই স্যার মাছগুলো পলিথিনে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসলেন। দেহটা ডাস্টবিনে চলে যাওয়ায় দুঃখ পেলেও মহান মানবের পেটে না যাওয়াতে হালকা স্বস্তি পেলেন বিষ্ণুদেব। ডাস্টবিনেই তার দেহটা পচে-গলে যাবে এই ভেবে স্বর্গের পথে পা বাড়ালেন তিনি। কিন্তু এবারো যেতে পারলেন না। তিনি দেখলেন দুটো কুকুর টানাহেচড়া করছে তার দেহভর্তি পলিথিনটাকে। তাদের দাঁতের আচড়ে পলিথিন ছিড়ে তার দেহের টুকরোগুলো বাইরে ছড়িয়ে পড়লো। দুটো কুকুরই খেতে লাগলো সেগুলো। কিন্তু বেশিক্ষণ খেতে পারলো না। সেখানে আর্যশিশু সহ হাজির হলো এক আর্য মাতা। ধূলায় ধূসরিত শরীর, পরনে শতচ্ছিন্ন বস্ত্র। তারা কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে পরীক্ষা করতে থাকে মাছের টুকরোগুলো। তাদের চোখ আনন্দে চকচক করে।মাছগুলো ভালো। রান্না করে খাওয়া যাবে। অল্প কিছুতেই মুখ দিয়েছে কুকুরেরা। কুকুরের মুখ লাগা মাছগুলো কুকুরকে দিয়ে বাকি মাছগুলো নিয়ে বাড়ির পথ ধরে তারা। কতদিন পর মাছ খাচ্ছে কে জানে? তারা প্রাণভরে ধন্যবাদ দেয় সৃষ্টিকর্তাকে। তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকেন বিষ্ণুদেব। মহাপ্রলয় থেকে আর্যদের রক্ষা করতে না পারলেও এক আর্যশিশু ও আর্যমাতাকে সাময়িকভাবে ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি। তার দেহটার সদগতি হয়েছে। অবশেষে প্রশান্ত চিত্তে উগান্ডা থেকে স্বর্গের পথে ধাবিত হলেন বিষ্ণুদেব।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৭