আমি বাঙালী হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন জগতে বিশাল সাফল্যে খুবই ঈর্ষান্বিত। ‘কোরিয়ান ওয়েভ’ বা এই ‘হাল্ল্যু’ শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তর্জালে এমন বিশেষ আর কোন প্লাটফর্ম নাই যেখানে কোরিয়ান’রা নাই। নাটক/সিনেমা/সিরিজ এবং গান থেকে শুরু করে পরিচালনা এবং চিত্রনাট্যে একের পর এক ভালো কাজ উপহার দিচ্ছে। দীর্ঘদিন আমার হাতে সর্বশেষ বিনোদন পাওয়ার মত অপশন ছিলো হলিউড ও বলিউড আর কিছু দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা। হলিউডের প্রতি আমি আমার সর্বশেষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলি জেমস বন্ডে লেসবিয়ান ইস্যু জোর করে প্রবেশ করানোর পর।
ব্রিটিশ-হলিউডের এই ফ্র্যাঞ্চাইজি মোটামুটি ২০১১-১২ সাল থেকে দেখছিলাম। দুঃসাহসী বন্ড সাহেব মৃত্যুর সাথে বারবার পাঞ্জা লড়ছিলেন। শৈল্পিক গল্প এবং দুর্ধর্ষ সব কান্ডে দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে কোনদিন কোনো বিরক্তি আসেনি। ওদিকে ‘LGBTQOA+’ মুভমেন্ট চলছে কিন্তু সেটার বহিঃপ্রকাশ জেমস বন্ডের মত ফ্র্যাঞ্চাইজি সিনেমায় প্রকাশ পাবে আমি তা কোনদিনই ভাবিনি (Movie: No Time to Die)।
এরমধ্যে জাপানীজ অ্যানিমেশন সিরিজে প্রবেশ করি। আমি এখনো সময় পেলে জাপানীজ সিরিজ দেখে থাকি। ‘ডেথ নোট (Death Note)’ আমার সবচেয়ে প্রিয় একটি জাপানীজ অ্যানিমেশন সিরিজ। দুই একটা রাশিয়ান, কানাডিয়ান, ইরানিয়ান, স্কটিশ, চাইনিজ, অস্ট্রেলিয়ান ইত্যাদি চোখে পড়লে সেগুলো দেখার চেষ্টা করি। ডিজনীর সর্বশেষ ‘Coco (2017)’ ছাড়া বিশেষ কিছু উল্লেখ করার মত আমার হাতে নাই। Marvel খুব বেশি টানে না, DC কিছুটা টানে।
বলিউড গত কয়েকবছরে শুধু ফ্লপ-ই দেয় নাই, ঠিকঠাক কোন সিনেমা উপহার দিতে পারে নাই। এত বেছে বেছে সিনেমা দেখা বড় কষ্টের। কারণ আমি বলিউডের বিশেষ করে ২০১১-১৪ সালের যত সিনেমা ছিলো তার সবগুলো প্রায় দেখেছি। এরপরের বলিউড প্রায় পুরোপুরি বদলে যায়। সিনেমা যদি মুক্তি পায় ১০টি তাহলে দেখার যোগ্য সিনেমা মনে হয়েছে সর্বোচ্চ একটি। বলিউডের পরিবর্তে তাই পুরোপুরি দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা দেখা শুরু করি।
কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাও অনেক আগেই আমার কাছে পানসে হয়ে গেছিলো। একই প্যাটার্নের এই সমস্ত সিনেমা এক সময় আরো বিরুক্তিকর হয়ে উঠলো। টালিগঞ্জের বাংলা সিনেমা তারও আগে আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু এখনো দেব দা’র জন্য দুই একটি সিনেমা দেখা হয়। সর্বশেষ ‘কাছের মানুষ (২০২২)’ চোখে জল এনে দিয়েছিলো। কিন্তু দেব নিজেও কিছু অপ্রাসঙ্গিক সিনেমা উপহার দেয়, যেমন, ‘কিশমিশ (২০২২)’।
কন্নড়, তামিল, তেলেগু এবং মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রি মিলে বেশ কিছু দেখার মত সিনেমা উপহার দিয়েছে। কিন্তু ক্ষয়ে যাওয়া বলিউড কে পেয়ে দক্ষিণের যা তা সিনেমাও বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে। কথায় আছে, অধিক সফলতা মানুষের মধ্যে অহংকারের জন্ম দেয়। ঠিক তেমন করেই এই সমস্ত ইন্ডাস্ট্রির প্রধান অভিনেতা/অভিনেত্রীদের যে প্রতাপ দেখি সেটা কখনোই প্রত্যাশা করিনি।
আমি বেশিরভাগ সময় পাইরেটেড সিনেমা দেখি কারণ এত সিনেমা কীভাবে জোগাড় করতে হয় সেটা ঠিক জানি না। কিছু সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে এবং কিছু সিনেমা স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে দেখেছি। কিন্তু বর্তমানে আমি এখন রাতের বেলা খুঁজে বেড়াই ঠিক কি দেখবো? কারণ সারাদিন আমি পড়ি আর লিখি, রাতেও তো আবার পড়াশোনা বা লেখালিখি করা আর সম্ভব নয়।
আবার চিন্তা করি যাতে একটি উপন্যাস পড়া হয়ে যায় এমন কোন সিনেমা বা সিরিজ দেখা উচিত। কিছুদিন আগে তেলেগু সিনেমা ‘Hi Nanna (2023)’ দেখে মনে হলো, ভালো চেষ্টা ছিলো কিন্তু মোটেই জমলো না। সুতরাং ভারতীয় সিনেমা দেখা আপাতত বন্ধ। আর হলিউডের বর্তমানে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো পূর্বের হলিউড কে লজ্জা দেয়। তাছাড়া বলিউড কে তো পুরোপুরি বয়কট করেছি।
বলিউড হচ্ছে এক অদ্ভুত জগতের নাম। এই জগতের সাথে বাস্তবতার কোন মিল নাই। বর্তমান বলিউড আরো অনেক বেশি অখাদ্যে ভরপুর। বলিউড এত অন্ধ যে, এরা দেখতেই পায় না, একজন সাধারণ মানুষের জীবন কেমন হতে পারে? একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে চিন্তা করে? কাজ করে? প্রেমে পড়ে?... বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব এবং শত্রুর সাথে শত্রুতা প্রকাশেও ব্যর্থ এই বলিউড কে দীর্ঘসময় কীভাবে সহ্য করেছি জানিনা। কারণ তুলনা করার মত আশেপাশে কেউ ছিলো না।
কিন্তু স্ট্রেসলেস ‘কে-ড্রামা (K-Drama)’ দেখার পর কিছু প্রশ্ন মাথায় আসতে শুরু করেছে। কেন বলিউড আমাদের সংস্কৃতির জন্য একটি মাফিয়া চক্র? এই চক্রের উদ্দেশ্য কি? এখন এসব আমার কাছে অনেকখানিই স্পষ্ট। অবশ্য অর্ণব গোস্বামীর বলিউড মাফিয়া মানে ‘মাদক’ নয়। না কোন খান পরিবার, না কোন কাপুর পরিবার।
বলিউড খোদ নিজেই এক ভিন্ন জগত যার প্রভাব এত ভয়ানক আমরা হয়তো কল্পনাও করি নাই। চারপাশে যা যা অপসংস্কৃতি আমরা দেখছি তার প্রধান কারণ হয়তো বলিউড নয় কিন্তু ভয়ানক এক অনুঘটক। আমাদের দেশে বলিউডের সিনেমা মুক্তির পর কফিনে শেষ পেরেক মারা হয়ে গেছে। কারণ জায়েদ খানের ডিগবাজী আর যাইহোক আমাদের জন্য ক্ষতিকর ছিলো না!
পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির প্রধান বাই প্রোডাক্ট হচ্ছে বলিউড। কারণ এই বলিউড সেই হিন্দি সিনেমা আর নয়। এই বলিউড নতুন বলিউড। এই বলিউড আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে ভুলভাবে নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে হয়, এই বলিউড শেখাচ্ছে কীভাবে ঘৃণা করতে হয়, এই বলিউড শেখাচ্ছে আপনি কি ভুলভাল পোশাক গায়ে পরবেন।
এই বলিউডে এমন কিছুই নাই যা আপনার বা আমার ব্যক্তি জীবনের সাথে সম্পৃক্ত কোন গল্প। এই বলিউড আমাদেরকে মানসিক ভাবেও অসুস্থ করে তুলছে। একজন বলিউড সিনেমা ভক্তের মধ্যে ‘Inferiority Complex’ ঢুকতে বেশি সময় লাগবে না।
একটা মাফিয়া চক্রের ঠিক কি কি উদ্দেশ্য থাকে? যদি সেটা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হয়? আমি এই পর্বে মোটাদাগে ৫টি কারণ দেখাচ্ছি,
১. যুব সমাজকে নৈতিক ভাবে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়া।
২. প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও সংস্কৃতির উপর জোর প্রভাব ফেলা এবং এসবের পরিবর্তে নতুন সংস্কৃতি (পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি) প্রতিস্থাপন করা।
৩. নারীদের পণ্য হিসেবে দেখানো। ওদের আইটেম গানগুলোতে আগে বোধহয় কিছু সুর-তাল দেখতাম, এখন পুরো নোংরামি চলছে।
৪. ধর্মীয় বিশ্বাস পুরোপুরি শেষ করে দেওয়া এবং নাস্তিকতা প্রোমোট করা।
৫. সর্বশেষ, LGBTQIA+ মুভমেন্ট চালিয়ে যাওয়া।
উঁহু, সবচেয়ে বড় যে বিষয় আমি লিখতে ভুলে গেছি তাহলো, আপনার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। আপনাকে একজন বাজে ভোক্তায় পরিণত করার জন্য বলিউড একাই যথেষ্ট। আমার এক প্রিয় শিক্ষক একদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “বলিউড মাফিয়া কি বা কারা?” আমি উত্তরে, অর্ণব গোস্বামীর মত করে খান আর কাপুর বংশের নাম নিয়েছিলাম। খুব সম্ভবত উনি জানতেন আমার কাছে এর উত্তর আছে।
কারণ আমরা এমন প্রশ্ন কখনোই কাউকে করি না, যে সেই প্রশ্নের উত্তর থেকে বহুদূরে!