somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মি. বিকেল
আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়: পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ও প্রভাব

২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। মরক্কোর ফেজ শহরে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে একজন মুসলিম নারী ফাতিমা আল-ফিহরি কতৃক প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হচ্ছে আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। বৌদ্ধদের দ্বারা ৬ষ্ঠ খ্রিস্টীয় শতাব্দীর মধ্যে গড়ে তোলা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ১১৯৭ সাল পর্যন্ত সচল ছিলো। কিন্তু আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় আজ পর্যন্ত সচল আছে।

শুরুর দিকে আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত ইসলামিক ধর্মীয় ও আইনি বিজ্ঞান, ক্লাসিকাল আরবি ব্যাকরণ এবং ভাষাতত্ত্ব পড়ানো হত। এছাড়াও গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ইতিহাসের মতো বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো বেশ কিছু বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। সেসবের মধ্যে প্রধান প্রধান বিষয় হলো, ইসলামিক ধর্মীয় ও আইনি বিজ্ঞান, ক্লাসিকাল আরবি ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব, মালিকি আইন, ফরাসি ভাষা ও ইংরেজি ভাষা।

১৯৬৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো বেশি আধুনিকীকরণ করে মরক্কোর রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপ দান করা হয় এবং বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান প্রক্রিয়া সচল আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির মিল পাওয়া যায়। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ভাষাতত্ত্বের মতো বিষয়গুলো পড়ানো হত।

প্রশ্ন হলো, কে এই ফাতিমা আল-ফিহরি? ফাতিমা আল-ফিহরি এর পুরো নাম ফাতিমা বিনতে মোহাম্মদ আল-ফিহরি আল-কুরাইশিয়া। আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফাতিমা আল-ফিহরি তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ফাতিমা আল-ফিহরি এর পরিবার খুবই দরিদ্র ছিলো। পরবর্তীতে তার বাবা মোহাম্মদ আল-ফিহরি মরক্কোর ফেজ শহরে এসে কাপড় আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসা করে একজন সফল ব্যবসায়ীতে রুপান্তরিত হোন।

ফাতিমা এবং তার বোন মারিয়াম ক্লাসিকাল আরবি ভাষা, ইসলামিক ফিক্‌হ ও হাদিস শাস্ত্রের উপর পড়াশোনা করেন। তার বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি দিয়ে ফাতিমা আল-ফিহরি আল-কারাওইন মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রী কে পৃথিবীর প্রধান ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ফাতিমা আল-ফিহরি শুধু একটি নাম নয়। তিনি এমন এক সময়ে মুসলিম নারীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন যে সময় মুসলিম নারীদের শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় বা কম প্রয়োজনীয় বিবেচনায় দেখা হত। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন বিশেষ করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা অতিক্রম করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।

এছাড়াও প্রধান ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে অনেক মুসলিমও এই ফাতিমা আল-ফিহরি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বর্তমানের সংকীর্ণ এই মুসলিম সমাজে দেখা যায় না ফাতিমা আল-ফিহরি সম্পর্কে আলোচিত দুটো প্রবন্ধ। তার বোন মারিয়াম আল-ফিহরি ফেজ শহরে আল-আন্দালুস মসজিদ স্থাপন করেন যা আজ পর্যন্ত চলমান। কিন্তু আমরা সেটাও জানি না।

আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোতে বিভিন্ন সময়ের মরোক্কান এবং ইসলামিক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো,

১. মসজিদ: আল-কারাওইন মসজিদটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দু। এটি একটি বৃহৎ প্রার্থনা হল এবং এর সাথে সংযুক্ত একটি মিনার রয়েছে।
২. আঙ্গিনা: মসজিদের চারপাশে একটি প্রশস্ত আঙ্গিনা রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
৩. ক্লাসরুম: ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে নির্মিত ক্লাসরুমগুলোতে শিক্ষার্থীরা শায়খের আশেপাশে অর্ধবৃত্তাকারে বসে পাঠ গ্রহণ করেন।
৪. গ্রন্থাগার: আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রাচীন গ্রন্থাগার রয়েছে, যেখানে বহু মূল্যবান পাণ্ডুলিপি এবং বই সংরক্ষিত আছে।
৫. স্থাপত্যিক শৈলী: বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যে বিভিন্ন সময়ের মরোক্কান এবং ইসলামিক শৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়, যেমন মোজাইক, খোদাই করা কাঠ এবং জ্যামিতিক নকশা।

উলেখ্য, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। শুরুর দিকে একাধিক অঞ্চল থেকে অনেক শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতেন। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৮১২০+ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠদান করেছেন এমন বিখ্যাত ১২ জন ব্যক্তির নাম শুনলে মুসলিম সমাজের হুঁশ না উড়ে যায়!

আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন বিখ্যাত শিক্ষার্থীর নাম এবং তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:

১. ইবনে খালদুন - বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী, যিনি তার কাজ ‘মুকাদ্দিমা’ এর জন্য পরিচিত।
২. আল-ইদ্রিসি - বিখ্যাত ভূগোলবিদ এবং মানচিত্রকার, যিনি তার মানচিত্র ‘তাবুলা রজারিয়ানা’ এর জন্য পরিচিত।
৩. আল-কারাওয়ানি - বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত এবং বিচারক।
৪. আল-বাকরি - বিখ্যাত ভূগোলবিদ এবং ঐতিহাসিক।
৫. ইবনে আরাফা - বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত এবং ধর্মতত্ত্ববিদ।
৬. আল-জাহিজ - বিখ্যাত লেখক এবং প্রাণীবিজ্ঞানী।
৭. ইবনে বাজ্জা - বিখ্যাত দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী।
৮. ইবনে তুমার্ত - ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদ এবং আলমোহাদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।
৯. আল-ফারাবি - বিখ্যাত দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী।
১০. ইবনে রুশদ - বিখ্যাত দার্শনিক এবং চিকিৎসক।
১১. আল-কারাওয়ানি - বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত এবং বিচারক।
১২. ইবনে বতুতা - বিখ্যাত পর্যটক এবং ভ্রমণকারী, যিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘রিহলা’ এর জন্য পরিচিত।

এই তালিকা অসম্পূর্ণ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান রয়েছে নানান শাখায় এবং বিশাল। বর্তমানে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সমস্ত বিষয় অনুলিপি করেছে,

১. ডিগ্রি প্রদান
২. বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা
৩. গ্রন্থাগার
৪. আঙিনা ও ক্লাসরুম
৫. শিক্ষাদানের পদ্ধতি: আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ে শায়খের সামনে অর্ধবৃত্তাকার হয়ে ক্লাসের অনুলিপি পাওয়া যায় আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেমিনার ও লেকচারে।

আজ এই পর্যন্তই। খোদা হাফেজ!
Also Read It On: আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়: পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ও প্রভাব
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:৫৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×