এক
বদ্ধ ফ্ল্যাটে কয়েক মাস, বাইরের কিছু দেখা যায় না বা দেখতে দেয়া হয়না। চাঁদের আলো নাসিফের খুব প্রিয়, পূর্ণিমা এলেই দক্ষিণের জানালা খুলে কি যেন খুঁজতে থাকে। ইয়াহিয়া ভাই এসে তাড়া দেন, এই নাসিফ জানালা বন্ধ করো, কুদরত ভাই কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুবই সিরিয়াস, আর তো কিছুদিন না হলে সব ভেস্তে যাবে। আমি রুমের আলো বন্ধ করে জানালা খুলেছি ইয়াহিয়া ভাই, আপনি ব্যস্ত হবেন না। বাইরে থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাবেনা। নাসিফ ইয়াহিয়ার দিকে না তাকিয়ে কথাগুলো বলল। ইয়াহিয়া কিছু না বলে অন্যরুমে চলে গেল। এই নিঃশব্দ চলে যাওয়া ইয়াহিয়ার কাছে যে সুখের হয়নি তা নাসিফ বুঝতে পারে।
নাসিফ এখন তার সেসব বন্ধুদেরকে ঘৃণা করে, যারা তাকে ন্যাস বলে ডাকতো। ভার্সিটি লাইফে সে নিজেও এই জিনিসটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতো না,বরং ভালোই লাগতো। জ্যাক, সৌম্য, সালমান এরা সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, বলা যায় পার্থিব বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যস্ত। নাসিফের মনে করুণা হয় ওদের জন্য। নাসিফ দুই হাত উঁচুতে তুলে চাঁদের আলোয় মোনাজাত ধরে, হে খোদা, আমাদেরকে হেদায়েত দান করুন।
দরজায় খট খট শব্দ হল। হয়তো কুদরত ভাই এসেছেন। চাঁদের আলোর বড় মায়া, নাসিফের খুব ইচ্ছা করছিলো আরেকটু থাকতে। নাসিফ আসো, আমাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আজকে। থাই গ্লাসটা খট করে লাগিয়ে জানালার পর্দা টেনে বৈঠককক্ষে গেল নাসিফ। চারিদিকে বুকশেলফ, তাতে মোটা মোটা বই রাখা, যদিও সব বই নাফিসদেরকে পড়তে দেয়া হয়না। কুদরত ভাই খুব ঠান্ডা মাথায় প্রথম দিন তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে সব বই তোমাদের জন্য না। কুদরত ভাই জ্ঞানী লোক, পদার্থ বিজ্ঞানের উপর উত্তর অ্যামেরিকান ডিগ্রি আছে, ভার্সিটির শিক্ষক। তার মুখটা দেখলে কখনোই মনে হয় না যে কোন দিন তার দাঁড়ি উঠেছিলো। বাচ্চা বাচ্চা চেহারা, কিন্তু চোখটা ধারালো ছুড়ির মত তীক্ষ্ণ, কার মনে কি চিন্তার খেলা চলছে তার সব কথা সে জানে। নাসিফ, হাসান আর কিবরিয়া এই তিনজন হয়তো এই জিনিসটাকেই ভয় পায় অথবা শ্রদ্ধা করে।
বৈঠক কক্ষের মাঝে একটা জলচকি রাখা। তিন পাশে তিনজন বসে আছে; নাসিফ, হাসান আর কিবরিয়া। অন্য পাশটায় একটু দূরে কুদরত ভাই। ইয়াহিয়া রান্না ঘরে আইর মাছ পাক করছে, কুদরত ভাই বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসছেন। কুদরত ভাই ইয়াহিয়াকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিতে বললেন। তিন জোড়া চোখ এখন কুদরত ভাইয়ের উপর, তিনি বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করলেন। মুহম্মদ হাসান কেমন আছেন আপনি? আপনার না শরীর খারাপ ছিল? ওষুধপত্র ঠিক ঠাক নিবেন। ইয়াহিয়া যা যা বলে দিয়েছে আমি এনে রেখেছি। খাওয়া দাওয়ার যেন কমতি না হয়, শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। হাসান সুবোধ বালকের মত মাথা নাড়লো জ্বি ভাইয়া।
মুহম্মদ কিবরিয়া আপনি খুবই মেধাবী, মাশাআল্লাহ। আপনার লেখা খসড়া খাতাটা আমি পড়েছি। আপনার লেখা পড়লে তরুণ প্রজন্ম আমাদের জিহাদের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। এই জিহাদে আমাদের সকলের শরিক হওয়া উচিৎ, আমাদের জ্ঞানের আলো সকলের মাঝে পৌঁছে দিতে হবে। গুটি কয়েক ভাই এই জিহাদ নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা আমাদের এই আলোর পথের পাথেয় হয়ে থাকবেন আজীবন। আমি আপনাকে নতুন কিছু বই দিচ্ছি এগুলো পড়বেন। ব্যাগ থেকে গোটা পাচেক বই বের করে জলচকির উপর রাখলেন। বইয়ের উপর উপন্যাসের মলাট কিন্তু ভেতরে যা থাকা উচিৎ তা আছে। মুহম্মদ কিবরিয়া, আপনি বইগুলো পড়বেন আর যদি পারেন অনুবাদ করবেন। পড়ার কোন বিকল্প নেই। আপনি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছেন, আর তা হল জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া। মানুষের মাথায় ঢুকতে পারলে আমাদের জিহাদ নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই। আমাদের মুসলমান জাতি আজকে সব থেকে নিগৃহীত কেন জানেন? আমরা আমাদের অতীতকে ভুলে গেছি, আমরা লড়াই করতে ভুলে গেছি, আমরা পড়তে ভুলে গেছি। প্রত্যেক বইয়ে রেফারেন্স দেয়া আছে, বইগুলো বুকশেলফ থেকে নামিয়ে পড়বেন। যতটুকু রেফারেন্সে পড়তে বলবে ঠিক ততটুকু পড়বেন। মনে রাখবেন, যারা এই বই লিখেছেন তারা আমাদের থেকে অনেক জ্ঞানী লোক। আল্লাহ্পাক তাদেরকে জ্ঞান দিয়েছেন, সে জ্ঞানের আলো আমাদের মাঝে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
ইয়াহিয়া, ওদের তিনজনকে কাগজি লেবুর শরবত দাও। লেবু আমি গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছি।
মুখ গোমড়া কেন?? আমরা এই পৃথিবীর সব থেকে কঠিন পথ বেঁছে নিয়েছি, মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে, আমরা হাসতে হাসতে মরতে পারি। তিনজনই হাসতে চেস্টা করলো।
প্যান্টের ভিতর থাকা মোবাইল ফোন পাঁচবার বেজেছে, কুদরত ভাই ছয়বারের মাথায় কল কেটে দিয়ে কলব্যাক করলেন। আমি তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি। কখন, কিভাবে? আগে জানাওনি কেন? যা হোক আমি এক ঘন্টা পরে আসছি। পুলিশকে জানাতে হবেনা। কুদরত ভাই যে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলেন তা বোঝা যাচ্ছিলো, বৈঠক কক্ষের নীরবতা কথাগুলো শুনতে আরও সহজ করে দেয়। কুদরত ভাইয়ের ছেলে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে, বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যেতে দেয়া হয়নি বলে আর লকার থেকে লাখ খানেক টাকা উধাও। কুদরত ভাই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, আমাদের সমাজ এখন কলুষিত, আমরা অন্য ধর্মের বজ্র সংস্কৃতি গ্রহণ করে চলেছি। শোভাযাত্রা, ফুল দেয়া, মেলা এগুলো আমাদের না। যেদিন পুরো মুসলমান জাতি এই সত্যি উপলব্ধি করতে পারবে সেদিন আমাদের জিহাদ পূর্ণতা পাবে।
কথাগুলো বলে কুদরত ভাই ঠান্ডা এক গ্লা গলায় ঢেলে দিলেন। তারপর পাঁচ মিনিট ঝিম মেরে বসে থাকলেন। চাতক পাখির মত বাকি তিনজন চেয়ে আছে।
মুহম্মদ নাসিফ আলী। আপনাকে আমাদের জিহাদের সব থেকে সহজ এবং আলোকিত পথের সন্ধান দেয়া হল। আপনি আমাদের পরের ঘটনার নায়ক। কথাটা শুনে নাসিফ শিওরে উঠলো, বিশ্বাস করতে না পারা দৃষ্টিতে কুদরত ভাইয়ের দিকে তাকালো। তার মোটেও ভয় করছেনা। এ জীবনের কোন মানেই হয়না যদি না তা মানব জাতির কল্যাণ বয়ে আনে। আমরা প্রতি নিয়ত পাপের সাগরে অস্তিত্ব হারিয়ে চলেছি। মুহম্মদ নাসিফ, আপনার জন্য কিছু ম্যাটেরিয়ালস এনেছি, একা বসে দেখবেন আর কারো সাথে শেয়ার করবেন না। এই ম্যাটেরিয়ালসই আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে। অপারেশনের দিন আপনাকে সব বুঝিয়ে দেয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকবেন, বাবা মায়ের হেদায়েতের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ্ তার বান্দাকে নাখোশ দেখতে চান না। নাফিস হাসি মুখে তার পুরষ্কার গ্রহণ করলো।
আইর মাছ আমার প্রিয়। ইয়াহিয়া মাছ ভুনা ভালো পাক করতে পারে। আপনারা সবাই পেট ভরে খাবেন। আজ আমি আপনাদের সাথে শরিক হতে পারলাম না। একটু ব্যস্ততা আছে।
দুই
বাবা কৃষক। অবশ্য কৃষক বলা ঠিক হবেনা, দিন মজুরিতে কৃষি কাজ করে। একটা ছোট বোন আছে, অনার্স পড়ে গ্রামের কলেজে। ইমরান এই মুখগুলোর কথা চিন্তা করেই চাকরিতে ঢুকেছিলো। ঢাকা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে একটা কোম্পানিতে চাকরি নেয় সে। কোম্পানির চাকচিক্য তাকে সাময়িক মোহিত করে রেখেছিলো বটে কিন্তু কিছুদিনেই বাস্তবতা বুঝতে পেরে সে হতাশ হয়ে পড়ে। গুলশানে অফিস, ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তে হত যাতে দেরীতে অফিস ঢুকতে না হয় আর সন্ধ্যায় নিস্তেজ হয়ে বাসায় ফিরতে হত। প্রচন্ড মানসিক শক্তি থাকা সত্বেও সে পড়তে পারেনি অন্যকোন পার্মানেন্ট একটা চাকরির জন্য। চাকরি থেকে যা পেত তা থাকা খাওয়াতেই শেষ, বাড়িতে পাঠাবে বলে গোছানোর আগেই তা কোন না কোন কাজে খরচ হয়ে যেত। কোম্পানির আধুনিক ক্রীতদাস প্রথা তাকে অনেকটা বিদ্রোহী করে তোলে। কোন ইনক্রিমেন্ট নাই, পার্মানেন্ট এমপ্লয়িরা কেনা গোলামের মত আচরণ করে। সারাদিন মিটিং নামক গল্প গুজবে ব্যস্ত আর সমস্ত কাজ কন্ট্রাকচুয়ালদের দিয়ে করায়, বেতনের অসীম বৈষম্য। একটা কোম্পানিতে সত্তর ভাগ ইমপ্লয়ি কন্ট্রাকচুয়াল হয় কি করে? ইমরান তার বসকে জিগ্যেস করেছিলো। বস প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উত্তর দিতে থাকে। তোমাদের এখনই সময় পরিশ্রম করার, অনেক কিছু শিখতে হবে, নিজেকে নতুন কিছু করার উদ্যম নিয়ে পরিচালিত করতে হবে। বস আমার প্রশ্ন,একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে এত কন্ট্রাকচুয়াল এমপ্লয়ি কেন? এরা তো আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা আয় করে নিয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে এত ভাগ অস্থায়ী চাকুরিজীবি? অস্থায়ী ভিত্তিতে সাত আট বছর ধরে একেক জন ইমপ্লয়ি কাজ করছেন, ব্যপারটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়? দেখো, এটা কোম্পানি পলিসি সেটা নিয়ে আমরা ইমপ্লয়িরা মাথা ঘামাই না। বস, কোম্পানির পলিসি মেকিং এ আমাদের দেশের লোকই বসে আছে, তাইনা? পুরো কথোপকথনই ইংরেজিতে ছিলো, ম্যাল্টি ন্যাশনাল বলে কথা। বলাই বাহুল্য এরপর থেকে ইমরানকে সে কোম্পানিতে চাকরি করতে হয়নি। সেও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এ গোলামি আমার নয়।
দুই বছরের অস্থায়ী চাকরি শেষে ইমরান সরকারি চাকরির জন্য পড়তে শুরু করে। বিসিএস ছাড়া আর গতি কি? সেই ভর্তি পরীক্ষার এনার্জি এখন কি আর আছে? তবুও কিছু একটা করতেই হবে। টিউশনি করে পেট চলে, বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করেনা লজ্জায়। ছেলে ইউনিভার্সিটির ছাত্র, কত খুশিই না হয়েছিলো বাবা-মা যখন সে অনার্সে ভর্তি হল। কিন্তু সে হাসি এখন আর নেই। তাদের চোখের দিকে তাকানো যায় না, সে মনে মনে বলে, মা আমি তো কারো গোলামি করার জন্য জন্মাইনি, আরেকটু কষ্ট করো। এই একটা ক্ষোভ থেকেই সে খুব পড়ালেখা করতো, এসএসসি এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ। লস্কর বাড়ির ছেলেও এখন তাকে দেখলে সমীহ করে। স্কুলে একদিন লস্কর বাড়ির জামিলকে সে মেরে বসে, তাকে ফকিরের পুত বলার কারণে। আমার বাপ মাঠে খাইটা খায়, ভিক্ষে করেনা।
এই শেষ বিসিএস। সেশন জট আর চাকরি মিলাইয়ে বয়স এখন ত্রিশ’এর দ্বারে। আজিমপুরের এক চিলেকোঠায় ইমরানের বাস। একদিন বাদে টিউশনি করে ঘরে ফেরে আর বাকি সময় পড়া। ইংরেজি, বাংলা সহজ কিন্তু বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক তার মনে থাকেনা কিন্তু তাকে পারতেই হবে। মধ্য গগণের সূর্যের মত এই সময়টা অস্থায়ী।
গ্রাম থেকে মা ফোন দিয়ে বলে, বাজান ভালা আছস? বাড়ি আয়, তোরে দেখবার ইচ্ছা করে। কোন চাকরি বাকরি পাইলি বাজান? এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর ইমরানের কাছে নেই। সে শুধু চোখের পানি ফেলে।
আর এক মাস আছে পরীক্ষার। এক নিঃসঙ্গ জীবন। কত বন্ধুই না ছিলো ভার্সিটি লাইফে। সেই প্রথম প্রেমে পড়া সে তো ভার্সিটিতেই। পড়াও শেষ হল রাজিয়ার বিয়েও হল। ছেলের দেড় লাখ টাকা বেতন, ঢাকায় ফ্ল্যাট, আর কি চায়! রাজিয়া অনেক কেঁদেছিল কিন্তু সেও বাস্তবতা জানতো, আসলে এত কান্নাকাটি ছিল ইমরানের থেকে হ্যা বোধক মতামত নেয়ার জন্য। তারপর থেকে রাজিয়া নামক মেয়েটি তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। সে এখন কোত্থাও নাই। মাঝে মাঝে ইমরান ভাবে স্বপ্নে হয়তো দেখা হয়েছিলো রাজিয়া নামের কোন মেয়ের সাথে।
চারিদিকে বৃষ্টিতে ঝুম হয়ে আছে। চিলেকোঠার সব জানালা খোলা। ইমরানে ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজবে। বৃষ্টির সব থেকে আকর্ষণীয় দিক হল তা অনুভব করতে হয়।
তিন
প্রচন্ড ক্রোধ জমে আছে বুকের ভেতর। কাল সারা রাত ভিডিওগুলো দেখে নাসিফ আসন্য অপারেশনের জন্য প্রস্তুত। যে করেই হোক এই অনইসলামিক শাসন ব্যবস্থায় ভাঙন ধরাতে হবে। এই সিস্টেমেই গলদ আছে। আমরা শুধু পশ্চিমি আইন অনুশাসন মেনে চলছি, নামে আমরা মুসলমানের দেশ। যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার নেশা এখন নাসিফের।
হাসান অসুস্থ, তার মাথায় পানি দেয়া হচ্ছে। সে ঘোরের ভিতর বিলাপ করছে। মা, আমি তোমার কাছে যামু মা। আমারে নিয়া যাও, মা। আর মাদ্রাসা আর পালামু না আমি, আমি তোমার কাছে থাইকাই লেখাপড়া করুম। ইয়াহিয়া হাসানকে চুপ করতে বলে, কিন্তু সে বিলাপ সারা রাতেও থামেনি।
একসময় কিবরিয়ার সাথে নাসিফের গল্প হত বেশ। ইদানীং নাসিফ আর কিবরিয়া বেশ দূরে দূরে থাকে। ভার্সিটির ডানপন্থী ছাত্র রাজনীতিই কিবরিয়াকে এই পথ দেখায়। টিউশনি করে কোন রকম চলতো সে, এক বড় ভাই কিছু বই সহজ সংস্করণের দায়িত্ব দেয় তাকে। বিনিমিয়ে তাকে আর টিউশনি করতে হয়নি কখনো।
নাসিফ নিজেকে অন্যদের থেকে অগ্রগণ্য মনে করছে। কুদরত ভাই এই অপারেশনে তাকে মনোনীত করেছেন, তার উপর গুরু দায়িত্ব। আজে বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করা যাবেনা। এই সময় ইবাদতের সাথে নিজেকে প্রস্তুত রাখাই সাচ্চা ঈমানদারের কাজ।
মানিব্যাগে বাবা আর মায়ের ছবি, নাসিফ এখনো তা সরাতে পারেনি। বাড়ির সাথে এখন তার আর কোন সম্পর্কই নাই। ব্যবসায়ী বাবা, কোনদিন কিছুর অভাব হয়নি। দেশের সব থেকে ব্যয়বহুল ভার্সিটির স্টুডেন্ট সে, এতোদিনে হয়তো ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে গেছে। গিটার বাজিয়ে গান করে বন্ধুদের সাথে কত বিকাল কাটিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। বাবা তেমন সময় দিতে পারতেন না আর মা সারাদিন বান্ধবীদের সাথে পার্টি আর শপিং এ ব্যস্ত। নাসিফ মানুষ হয়েছে দূর সম্পর্কের এক বিধবা ফুফুর কাছে, যার দুই কূলে কেউ নেই। এক রাতে নাসিফ বাবা আর তার মায়ের কথা কাটাকাটি শুনে ফেলে। তুমি যদি ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখো তাহলে আমি নাসিফকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। আমি কার সাথে সম্পর্ক রাখব না সেটা আমাকে ভাবতে দাও, নাসিফকে তুমি সময় দাও? কার টাকায় এত পার্টি আর শপিং করো? নাসিফের মা পাথর হয়ে যায় যখন দেখে নাসিফ দরজায় এক কোণে দাঁড়িয়ে। এরপর থেকে পরিবারের প্রতি নাসিফের আর কোন অনুভূতি কাজ করতো না। কিন্তু জন্মের পর থেকে এই দুইজন মানুষকেই তো সে চিনে আসছে, যদিও তাদের সময়ের দাম অনেক।
চার
সাথে তেমন কিছু নিতে মানা। শুধু বলপয়েন্ট কলম আর প্রবেশপত্র। মা ফোন দিয়ে দোয়া করলেন, আব্বার শরীরটা খারাপ। আগেরমত পরিশ্রম করতে পারেনা। আব্বার শরীর খারাপের খবরটা মা জানাতে চায়নি কিন্তু ইমরান বুঝতে পারে যখন সে তার আব্বার সাথে কথা বলতে চায়। এই অসুস্থতার খবর ইমরানকে আরও মানসিক শক্তি দিলো, আজকে ভালো পরীক্ষা দিতেই হবে। পরীক্ষা শেষে আব্বাকে ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।
চাকরির জীবনে কেনা কয়েকখানা শার্টের দুইখানা এখনো টিকে আছে, শুধু রংটা আগের মত নেই। একটা শার্ট গায়ে গলিয়ে ইমরান রাস্তায় নামলো। পকেটে কলম আছে, এডমিট আছে, মানিব্যাগ নেয়া হয়নি। ইডেন কলেজে পরীক্ষা খুব তো দূরে না, হেটে গেলে পাঁচ মিনিট। ঝকঝকে আকাশে সে এখন রাস্তায়। তার মত অনেক পরীক্ষার্থীর মধ্যে সে এক সময় হারিয়ে গেলো।
ইয়াহিয়া খুব যত্ন সহকারে সুইসাইডাল ভেস্টটা নাসিফকে পড়িয়ে দিলো, তার আফগানিস্থানের ট্রেনিং আছে। নাসিফ চোখ বন্ধ করে আছে, তার জীবনের সব থেকে বড় পরীক্ষা আজকে। স্কুল-কলেজে সে যখন পরীক্ষা দিতো তখন পরী খালা তার সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে মাথায় একটা ফু দিয়ে গাড়িতে তুলে দিতো। নাসিফ ফুঁ টু তে তখন বিশ্বাস করতো না তবুও সে প্রত্যেক পরীক্ষার আগে তার জন্যই মনের অজান্তে অপেক্ষা করতো।
এক্সাক্ট লোকেশান কি সেটা তোমাকে এখনো বলা হয়নি, সাথে ফোন থাকবে, বলে দেয়া হবে। এই পিনটা টান দিলো দুই থেকে তিন সেকেন্ডের ব্লাস্টটা হবে। মনকে শান্ত রাখবা, যে ঈমানদার তার প্রাপ্য সে পাবেই। তোমার জিহাদ বিফলে যাবেনা, শত শত তরুণ তোমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে। তোমাকে আইডেন্টিফাই করতে পারে এমন কিছুই সাথে রাখবেনা, তুমি এখন আলোর পথের যাত্রী, এ পথে কারো ব্যক্তিগত পরিচিতি নেই। ইয়াহিয়া কথাগুলো মুখস্থ বলে পাশের রুমে গেল। রুম থেকে ফিরে তার হাতে একটা মোবাইল ফোন। লোকেশনে পৌঁছানোর পর ফোনটা ড্রেনে ফেলে দিবা, তারপর থেকে তুমি খোদার সম্পত্তি, তিনি যেটা ভালো বুঝেন সেটাই করবেন। সময় হয়ে গেছে বেরিয়ে পড়ো।
মানিব্যাগ থেকে বাবা-মায়ের ছবিটা নিয়ে প্যান্টের পেছনের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলো নাসিফ। অনেক চেষ্টা করেও সে ছবিটা রেখে আসতে পারেনি। সে কি সত্যিই তার বাবা মাকে ভালোবাসে? এতই যদি ভালোবাসে তাহলে সে মারা যাচ্ছে কেন? পরী ফুফু কোথায়? আমার আজকে বড় পরীক্ষা,আমাকে গুছিয়ে দিবেনা, মাথায় ফুঁ দিবেনা? সব শয়তানের কার্যকলাপ। এই সময় মনকে শান্ত রাখতে হবে। শয়তান ঈমানদার বান্দাকে পথভ্রষ্ট করতে চায়।
মোবাইল ফোন ড্রেনে। এখন নাসিফ একা। তাকে বলে দেয়ার কেউ নেই। এটা সম্ভবত কোন পরীক্ষার কেন্দ্র। কোন পরীক্ষা নাসিফ এখনো তা জানেনা, জানার দরকারও নেই। লোকে লোকারণ্য, যে যার সিট খুঁজে নিতে দেয়ালের সামনে ভীর জমিয়েছে। ভিতরে ঢুকতে সে পারবেনা, পুলিশের গার্ড। সব থেকে বড় জটলার কাছে সে দাঁড়িয়ে, এটাই সব থেকে ভালো স্থান। আল্লাহ্, আমার আত্মত্যাগ কবুল করুন।
সিট প্ল্যানটা ওয়েবসাইটে আগের দিন দিয়ে দিলেই ভালো হয়। ইমরান ভীর ঠেলে সিট প্ল্যান সেঁটে দেয়া দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালো। ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের ৩০৫ নাম্বার কক্ষ। যাক বাঁচা গেল। সে এখন চাপমুক্ত। নাসিফ ইমরানের সামনে দাঁড়িয়ে, মিলি সেকেন্ডের জন্য হলেও দুইজন স্থির ছিল। নাসিফ চোখ বন্ধ করে গায়ে জড়ানো ভেস্টের পিন ধরে টান দিলো, মাত্র দুই সেকেন্ড কিন্তু অনন্তকাল। মায়ের মুখটা পরিষ্কার ফুটে উঠলো। পরী ফুফুকে জড়িয়ে ধরে মা কাঁদছে, নাসিফের খুব ইচ্ছা করছে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। মা বলে চিৎকার করে উঠলো নাফিস, ব্লাস্টের প্রচন্ড শব্দে সে চিৎকার হারিয়ে গেলো। শত ইমরান রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো, দুমড়ে মুচড়ে গেল, পুড়ে গেল।
-সমাপ্ত-
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:৫৮