আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা। পুরুষালি আধিপত্য, বর্বরতা, সহিংসতার বিরুদ্ধে নারীর লড়াই নিরন্তর। নারী দিবস এই লড়াইকে, লড়াইয়ের চেতনাকে আমাদের অধিশ্রয়নে নিয়ে আসে। তাই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত নারীদের জন্য, একইসাথে সহযোদ্ধা পুরুষদের জন্যো। বেশ ক বছর আগে জেন্ডার বিষয়ক এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল এক নারীর সাথে, তিনি বিখ্যাত কেউ নন, তিনি লিপি আপা, প্রান্তিক কলমাকান্দার 'সাধারণ' এক নারী তিনি। মোটামুটি ৩ বার স্বাক্ষাৎ হয়েছিল তার সাথে, ২য় বার মোলাকাতে তার এমন এক সক্রিয়তার হদিশ পেয়েছিলাম যে প্রতিটি ৮ মার্চেই লিপি আপার কথা আমার মনে পড়ে প্রথমেই। অন্য এক কারনেও। শেষে স্পষ্ট হবে সে কথা।
এমনিতে আমাদের দেশে একুশ মানে একুশে ফেব্রুয়ারী আসে। চলে যায়। আমাদের নেতা - নেত্রীরা, বুদ্ধিজীবিরা এবং নগরের নাগরিক মানুষেরা মহাসমারোহে দিনটি উদযাপন করে, নির্বিঘ্নে, কোনধরনের বাঁধার মুখোমুখি না হয়েই। রাষ্ট্র, প্রশাসন যন্ত্র ও পুলিশ বাহিনী সবসময় ব্যস্ত থাকে যেন কোন অনাকাঙ্খখিত সমস্যা না হয় । একুশে ফেব্রুয়ারী পালন করা সম্ভব হবে কি হবেনা এই দোলাচলে, চিন্তায়ও তাই থাকবার প্রয়োজন হয়না তাদের।
কিন্তু এই চিত্র বাংলাদেশের সবজায়গার বাস্তবতা নয়। কোথাও কোথাও, কারো কারো জন্য (বিশেষত নারীদের জন্য) একুশের উদযাপন এখনো অধরাই । জেলা পর্যায়ে হয়তো কিছুটা চোখে পড়ে কিন্তু শতকরা আশিভাগ মানুষের বসবাসের জায়গা গ্রামাঞ্চলে একুশে ফেব্রুয়ারী : প্রথমত, সেভাবে উদযাপিত হয়না বললেই চলে দ্বিতীয়ত, যত জায়গায় যতটুক উদযাপিত হয় তাও বন্দী পুরুষের হাতে, নারীদের নিজেদের সংগঠিত হয়ে উদযাপন চোখেই পড়েনা। নেত্রকোনার কলমাকান্দার চিত্রটাও ছিল এমনই, লিপি আপা বলছিলেন ”কবে কখন যে একবার ছোটবেলায় আমি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা ভরে ফুল দিয়েছিলাম সেটা প্রায় ভূলেই গিয়েছিলাম”, অন্য নারীদের অভিজ্ঞতাও এমনই। তবে সেটা ২০ ফেব্রুয়ারী ২০০৬ পর্যন্ত, কেননা ঐ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারী লিপি আপার নেতৃত্বে কলমাকান্দার 'সাধারন নারীরা' তাদের অসাধারন তৎপরতায় প্রমান করেছিলেন নারীরা জোটবদ্ধ হলে পর্বত সমান বাধাও কত সহজেই বালির বাধের ন্যায় ধ্বসে পড়ে!
লিপি আপা সিদ্ধান্তে পৌছান, না এরকম আর চলতে দেয়া যায়না, নারীদের সমান অধিকার থাকা উচিত ২১ ফেব্রুয়ারী উদযাপনের। নিজেই ২১ ফেব্রুয়ারী উদযাপনের কর্মসূচি হাতে নিলেন। কিন্তু সেটা কিভাবে? নিজ উদ্যোগেই বিভিন্ন সংগঠন এর সাথে কথা বলেন এবং সকলে মিলে এমনভাবে একুশ পালনের সিদ্ধান্তে পৌছান যা ’নারীরা কিছু পারেনা’ এই ধ্যান ধারনাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।
শুরু হল পথচলা। বাড়ী বাড়ী যেয়ে ও বিভিন্ন গ্রামীন সম্পর্ক ব্যবহার করে একুশে ফেব্রুয়ারীর তাৎপর্য্য ও এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন নিয়ে তাদের পরিকল্পনা জানানো শুরু হয়। ব্যপক সাড়া তৈরী হয় পুরো এলাকা জুড়ে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে। তারা যেন এমন একটা কিছুরই অপেক্ষা করছিলেন।
সেই সাথে ছিল প্রতিবন্ধকতা, লিপি আপাকে যেসবের মুখোমুখি হতে হয়েছে সবসময় । তুমি এইসব কি কইরা বেড়াইতেছ? কতবার যে এই কথা শুনতে হয়েছে!! তবু তারা ভেঙ্গে পড়েননি, তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
নারীদের সংগঠিত হবার খবরে কোন কোন মহল আতংকিত হবে এটাই স্বাভাবিক, কলমাকান্দার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে আয়োজন করা হয় ওয়াজ মাহফিলের। ২০ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা লাগবার সাথে সাথে একদিকে শুরু হয়ে যায় ওয়াজ মাহফিলের বয়ান অন্যদিকে নারীরা নিতে থাকেন পরের দিন সকালে যে প্রভাতফেরী অনুষ্ঠিত হবে তার জন্য প্রস্তুতি।
ফুল সংগ্রহ করাটাও কম ঝামেলা ছিলনা। প্রত্যন্ত কলমাকান্দায় ফুলের বাগান এমনিতেই কম তার উপর যেগুলো আছে সেগুলোতেও ২১ ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে অতিরিক্ত পাহারা থাকায় কিভাবে যে এতগুলো মানষের জন্য ফুল সংগ্রহ করা হবে তা নিয়ে ছিল লিপি আপার ঘুম হারামের দশা। এক বাড়ীতে ফুল আনতে যেয়ে সমাধানের চমৎকার বুদ্ধিটা আসে লিপি আপার মাথা থেকেই : এক জন বাগানের মালিকের সাথে কথা বলে গপ্প জমাবে আর এই ফাকে অন্যরা ফুল নিয়ে চম্পট!! গল্প জমানোর কাজটা লিপি অাপা এতই ভালভাবে করতে পেরেছিল যে একুশের প্রভাতে সবার হাতেই গোলাপ না হোক একটা করে গাঁদা অন্তত দেখা গিয়েছিল।
২০ ফেব্রুয়ারী রাতে যখন পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারী উদযাপনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ঘুমানোর জন্য গিয়েছে লিপি আপা ততক্ষনে শুরু হয়ে গিয়েছে ওয়াজে নারীবিদ্ধেষী ও 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বিরোধী কথাবার্তা। রাত যত গভীর হয় নারীবিদ্ধেষী কথাবার্তাও তত বাড়তে থাকে। আর নির্ঘুম লিপি আপা ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে চুপ করে বসে থাকবে নাকি অন্যায় ভাষনের প্রতিবাদ করবে এই ভেবে ভেবে। লিপি আপা হঠাৎ করেই উঠে দাড়ান বিছানা ছেড়ে, জোর কদমে হেটে পৌছান ওয়াজের জমায়েতে এবং প্রথমেই ঈমামকে বলেন 'আপনি এখনই নারীবিদ্ধেষী আপত্তিকর বক্তব্য থামাতে বলেন না হলে কিন্তু আমি মঞ্চে উঠে এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করবো। লিপি আপার এই সক্রিয় বিরোধীতার হুমকির খবর মঞ্চ অবধি পৌছলে অবশেষে থেমে যায় নারীদের নিয়ে গৎবাধা কথাবার্তা। যেভাবে সে ঘটনার সাথে সাথে তাৎক্ষনিক বিরোধীতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা নি:সন্দেহে চিন্তার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধরনের অগ্রসর অবস্থানের ইঙ্গিত বহন করে। নেতৃত্বের একটি বড় সূচক যদি হয় সময়, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিতের সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহন তার বড় প্রমান সময়ের প্রয়োজনে যেভাবে লিপি আপা তার কর্তব্য নির্ধারন করেছে। সমাজের ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতিতে চুপ করে থাকা 'বোবা’ বুদ্ধিজীবিদেরও ’সময়ের দাবী ও সে অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারন’ বিষয়ে শেখবার আছে লিপি আপার মত এই প্রান্তিক নারীদের কাছ থেকে। ।
একটি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ সমাজে ঘুম ভেঙ্গে দাপটশালী পুরুষেরা যদি দেখেন শতশত নারীর জমায়েত কী প্রতিক্রিয়া হবে বা হতে পারে মনস্তত্বের সে নিরীক্ষায় যাচ্ছিনা । ২১ ফেব্রুয়ারীর প্রভাতফেরীতে রীনা সাহা, লিপি আপা, শিপ্রা পাল, নওরোজ, চায়না রায়, সাবিহা আক্তার, সুভাষিনী দেবীরা পাচ শতাধিক মানুষের (সবাই নারী) জোটবদ্ধ পদচারনায় মুখর করে তুলেছিলেন কলমাকান্দার সব অলিগলি পেরিয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত। পর্দার বেড়াজাল বা মাঝরাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির দূর্দমনীয় প্রবাহ কোনকিছুই ঠেকাতে পারেনি এতগুলো নারীর অন্তর থেকে আসা ঢেওয়ের সম্মিলিত শক্তিকে। এ ঘটনা লিপি আপার অর্জন, তারাও যে অনেক কিছু করতে পারে দেখিয়ে দিয়েছে নারীরা , এটি তাই তাদের জন্য সু:খস্মৃতি, সু:খস্মৃতি কখনো কখনো মানুষকে সু:খের কান্নায় ভাসায়, হয়তো সেকারনেই ময়মনসিংহে বসে ঘটনা বর্ননার সময় ডুকরে কেদে উঠেছিলেন, প্রথমে লিপি আক্তার, পরে তার বন্ধু রীনা সাহা।
ট্রাজিক এই তথ্য দিয়ে উপসংহার টানতে চাই যে স্বামী এবং কর্তা স্বামীর পরিবারের অনিচ্ছার কারনে নিজের তীব্র অাকাঙ্খা থাকলেও লিপি আপা প্রশিক্ষনের পরবর্তী ধাপগুলোতেতো অাসতে পারেননিই একই সাথে পরিবারের বাইরে কোন বিষয়ে নাক গলানোর ব্যাপারেো বিধিনিষেধ এর খড়গ দাড় করানো হয়েছে। কর্তার ইচ্ছাই শেষ কথা। এসব কারনে তার কথা কখনো কখনো মনে পড়ে।