চৌধুরী সাহেব একজন স্বঘোষিত নাস্তিক। তিনি একসময় কু’রআনের ‘ভুল’ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। নবীদেরকে নিয়ে অনেক অপমানজনক কৌতুক করেছেন। তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, মানুষকে সস্তা আনন্দ দেওয়া এবং ফেইসবুকে লাইক পাওয়ার জন্য অনেক উক্তি দিয়েছেন। কিন্তু একসময় গিয়ে চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন: তার যুক্তি এবং চিন্তা ভাবনায় বেশ কিছু ভুল আছে। তিনি কু’রআন নিয়ে যতই পড়াশুনা করেন, ততই ধাক্কা খান। তিনি এখন আর আগের মতো “কু’রআন মানুষের বানানো বই”, “স্রস্টা বলে আসলে কেউ নেই”, “নবীরা সব মানসিক ভারসাম্যহীন হেলুসিনেশনে ভোগা মানুষ” — এইসব উলটোপালটা কথা নিজেকে ঠিক আর মানাতে পারছেন না। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি যদি তার কথাবার্তা এবং লেখায় এইসব প্রকাশ করে ফেলেন, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার নাস্তিক বন্ধুরা, যাদের সাথে তিনি ওঠা বসা করেন, যারা তাকে তার ‘জ্ঞানের’ জন্য অনেক সন্মান করে, যারা তার কথা শোনার জন্য তাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে ফ্রি কফি খাওয়ায় —তারা তখন তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করবে। ফেইসবুকে তার এত বিখ্যাত একাউন্ট, তিন হাজার মুরিদ (ফলোয়ার) তাকে থুথু দিবে। না, এটা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। তিনি নিজেকে বোঝান: “না! আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। কু’রআন সম্পর্কে কিছু ভালো ভালো কথা পড়ে আমি আমার অবস্থান থেকে নড়তে পারি না। আজকে থেকে এই সব বই পড়া বন্ধ। রিচারড ডকিন্স, এন্থনি ফ্লিউ, রবার্ট ব্রাউন এদের বই আবার রিভিশন দিতে হবে। মনের জোর ফিরে পাওয়া দরকার।”
এই ধরনের চরম অবাধ্যদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন—
আমি অবশ্যই তোমাকে একদম পরিষ্কার বাণী দিয়েছিলাম। একমাত্র চরম অবাধ্যরাই এটা অস্বীকার করবে। [আল-বাক্বারাহ ৯৯]
আল্লাহ বলেছেন, তিনি ءَايَٰتٍۭ بَيِّنَٰتٍ দিয়েছেন, যার অর্থ একদম পরিষ্কার বাণী।[১] এই বাণীতে কোনো সন্দেহ নেই, কোনো গোঁজামিল নেই, কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। কু’রআন কোনো মেটাফিজিক্স বা ফিলসফির উপর বই নয় যে, এখানে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মানুষের অনুমান এবং যুক্তির উপর নির্ভর করে থিওরির পর থিওরি লেখা আছে এবং যার ভূমিকাতে লেখক আগেভাগেই বলে দেন, “আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।” কু’রআন এমন একটি বই, যার লেখক এই পৃথিবীর কেউ নন। তিনি মহাবিশ্বের সকল জ্ঞানের অধিকারী, সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান সত্তা। তাঁর কথা কোনো থিওরি নয়, কোনো অনুমান নয়। তাঁর কথা হচ্ছে অকাট্য সত্য। তাঁর বাণীর ৭০-৮০% অংশ আধুনিক বিজ্ঞান সত্যি প্রমাণ করেছে। বাকি ২০-৩০% নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। কিন্তু কু’রআনে এমন কোনো বাণী নেই, যেটা আধুনিক বিজ্ঞান সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণ করেছে যে, তা ভুল এবং তার স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পেরেছে।
আধুনিক মানুষদের অনেকের ধর্মের অনেক কিছু মানতে কষ্ট হয়। তারা সবকিছুতেই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খোঁজেন। যেটাই তাদের কাছে আজকের যুগের বিজ্ঞান অনুসারে ‘অবৈজ্ঞানিক’ মনে হয়, সেটাই তাদের মেনে নিতে কষ্ট হয় এবং সারা জীবন মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে থাকে। সেক্ষেত্রে তারা প্রোবাবিলিটি ব্যবহার করে দেখতে পারেন। যদি কোনো কিছুর ৭০-৮০% সম্পূর্ণ ১০০% সত্য হয়, বাকি ২০-৩০% মিথ্যা না হয়, তাহলে সেই ২০-৩০% সত্য হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই ফরমুলা কাজে লাগালে আশা করি কু’রআনের যে সব ব্যাপার বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাবে মেনে নিতে পারছেন না, সেগুলোতে বিশ্বাস করতে সমস্যা হবে না।
বনী ইসরাইলরা দাবি করেছিল, যদি মুহাম্মাদ ( সা: ) সত্যিই আল্লাহর প্রেরিত কোনো বিশেষ মানুষ হন, তাহলে তো তার অনেক অলৌকিক ক্ষমতা থাকার কথা, যেরকম কিনা মুসা, ঈসা নবীদের ছিল। কিন্তু তার তো কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না? বরং সে দাবি করছে যে, সে যে বাণী শোনাচ্ছে, সেটাই তার অলৌকিকতা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট।
বনী ইসরাইলের এই সমস্যাটা খুবই কমন সমস্যা, যেটা অনেক মুসলিমের মধ্যেও আছে। আল্লাহ যে সত্যিই আছেন এবং কু’রআন যে সত্যিই তাঁর বাণী—তা নিয়ে অনেকেই মাঝে মধ্যেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন; বিশেষ করে যখন তার জীবনে কোনো বড় ধরনের সমস্যা শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর পর থেকে এই সমস্যাটা ইন্টারনেটের কারণে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের কিশোর-তরুণরা পাশ্চাত্যের কার্টুন, চলচ্চিত্র আর ইন্টারনেটের বদৌলতে এমন সব লেখালেখি পড়ছে যেগুলো ধর্মীয় শিক্ষাকে ব্যঙ্গ করে; আল্লাহ অস্তিত্বকে যুক্তির গোলকধাঁধাঁয় হারিয়ে দিতে চায়। এগুলো পড়ে প্রথমত ধর্ম, নবী এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যেমন পুরোপুরি চলে যাচ্ছে, একই সাথে তারা ডিসেন্সিটাইজড বা অনুভূতিহীন, ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে তখন যথেষ্ট যুক্তি দেখালেও কোনো লাভ হয় না। তারা তাদের বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতেই থাকে।
অলৌকিক ঘটনা দেখানোর একটি সমস্যা হলো: ঘটনাটি যারা নিজের চোখে দেখে, তাদের উপরে ঠিকই বিরাট প্রভাব পড়ে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা—যারা শুধু তাদের পূর্বপুরুষের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে—তাদের খুব একটা গায়ে লাগে না। ধরুন, আপনি একদিন কক্সবাজারে সমুদ্রের তীরে হাঁটছেন। এমন সময় প্রচণ্ড বাতাস শুরু হলো, আর দেখলেন বঙ্গোপসাগরের পানি দুইভাগ হয়ে গিয়ে সাগরের মধ্য দিয়ে একটা রাস্তা হয়ে গেল। তারপর সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে পার হয়ে এল বার্মার অত্যাচারিত মুসলিম। এটা দেখে আপনার ওপর একটা বিরাট প্রভাব পড়বে। আপনি হয়তো পরের মাসেই উমরাহ করতে চলে যাবেন। কিন্তু আপনি যদি একদিন আপনার ছেলেমেয়েদের চোখ বড় বড় করে গল্পটা বলেন, “জানো? একদিন আমি দেখলাম: বঙ্গোপসাগরের পানি সরে গিয়ে সাগরের মধ্যে দিয়ে একটা শুকনা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল, আর বার্মার গরিব মুসলিমরা হেঁটে বাংলাদেশে চলে এল!”—তাদের উপরে কাহিনিটার সেরকম কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ তাদের কাছে সেটা একটা গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। তারা সেই ঘটনা শোনার পর দিন থেকেই ভিডিও গেম খেলা, মুভি বা হিন্দি সিরিয়াল দেখা, বিয়েতে সেজেগুজে অর্ধ নগ্ন হয়ে যাওয়া —সব বন্ধ করে আদর্শ মুসলিম হয়ে যাবে না।
ধরুন, কেউ দাবি করল যে, “ভাই, আমাকে সমুদ্র দুই ভাগ করে দেখাতে হবে না। আমি যদি ছোটোখাটো একটা অলৌকিক কিছু দেখি, তাহলেই হবে। যেমন ধরুন, আকাশ থেকে গম্ভীর স্বরে যদি কেউ কথা বলে, বা ধরুন আলোর তৈরি মানুষের মতো দেখতে কেউ যদি আমার সামনে এসে বলে, ‘হ্যা, কু’রআন সত্যিই আল্লাহর ﷻ বাণী, কোনো সন্দেহ নেই। তোমাকে এর পুরোটাই মানতে হবে’—তাহলে আমি সত্যি বলছি, কালকে থেকে আমি একদম পুরোপুরি ঈমানদার হয়ে যাব—আল্লাহর কসম।”
অথচ এই একই লোকই যখন একদিন গাড়ি চালানোর সময় রেডিওতে শুনে, “কারওয়ান বাজারে আগুন লেগেছে। সেখানে বিরাট যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানবাহনকে অনুরোধ করা হচ্ছে সেদিকে না যেতে”—কারওয়ানে বাজারে জরুরি মিটিং থাকা সত্ত্বেও সে এটা শোনা মাত্র গাড়ি ঘুরিয়ে মগবাজারের দিকে চলে যাবে। তার মনে কোনোই সন্দেহ থাকবে না যে, কারওয়ান বাজারে সত্যি সত্যি আগুন লেগেছে। সে দাবি করবে না, “আমাকে যদি একটা আলোর তৈরি প্রাণী এসে বলে কারওয়ান বাজারে আগুন লেগেছে, তাহলেই আমি শুধু বিশ্বাস করব। নাহলে আমি মানতে পারছি না রেডিওর খবরটা সত্যি কি না।”—কেন এরকম হয়?
কারণ সে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সে রেডিওকে বিশ্বাস করবে। যেই রেডিওর সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের মদদে ভুল তথ্য প্রচার করে, সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেয়, পশ্চিমা ব্যান্ডগুলোর সুড়সুড়ি দেওয়া গান চালায়—সেই একই রেডিওর সাংবাদিককে তার বিশ্বাস করতে কোনোই আপত্তি নেই, যখন সে কোনো আগুন লাগার খবর প্রচার করে। সে এই ব্যাপারে তার বিচার-বুদ্ধি ঠিকই ব্যবহার করতে রাজি, কিন্তু যখন সেটা কু’রআনের কোনো কথা হয়, তা সে বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করে মানতে রাজি নয়।
যেই কু’রআন তাকে কোনো ধরনের অন্যায় করতে বলে না, কোনো ভুল তথ্য দেয় না, তার ক্ষতি হবে এমন কিছু করতে কখনও বলে না— সেই কু’রআন যখন তাকে বলে নামায পড়তে, রোজা রাখতে, যাকাত দিতে, সুদ না খেতে, ঘুষ না দিতে, রাস্তাঘাটে মাথা-ঘাড়-হাত বের করে অর্ধ-নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা না করতে—তখন সে আর সেটাকে মেনে নিতে পারে না। তখনি তার একটা অলৌকিক কিছু দেখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এধরনের মানুষের সমস্যাটা আসলে অলৌকিক কিছু দেখা নয়, এইধরনের মানুষের সমস্যা হচ্ছে: পক্ষপাতহীনভাবে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজেকে পরিবর্তন করার সদিচ্ছার অভাব। এদের যদি সত্যিই ইচ্ছা থাকত, তাহলে এরা চিন্তা ভাবনা করে নিজেরাই বুঝতে পারত যে, কু’রআন সত্যিই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার বাণী এবং একে আমাদের অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। তাদের তখন আর অলৌকিক কিছু দেখে নিজেকে বিশ্বাস করানোর প্রয়োজন থাকত না। শুধুই প্রয়োজন কু’রআনকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।
যারা এখনও আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে ঠিক পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, একধরনের দোটানার মধ্যে ঝুলে আছে, তাদেরকে আপনি যদি প্রশ্ন করেন, “আপনি কেন বিশ্বাস করেন না যে, আল্লাহ সত্যিই আছেন?”—তাহলে আপনি নিচের কোনো একটা উত্তর পাবেন:
১) আল্লাহ থাকতেও পারে, আবার নাও পারে, আমি ঠিক জানি না। যেহেতু আমি জানি না সে সত্যিই আছে কি না, তাই আমি ধরে নিচ্ছি যে সে নেই এবং আমি আমার ইচ্ছা মতো জীবন যাপন করব।
২) আল্লাহ আছে কি নেই, সেটা বিজ্ঞান কখনই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে পারবে না। যেহেতু আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব না, তাই আমি ধরে নিচ্ছি যে সে নেই, এবং আমি আমার মতো করে জীবন যাপন করব।
উপরের উত্তর দুটি লক্ষ করলে দেখবেন, সে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিচ্ছে ‘আল্লাহ নেই’-কে। সে কিন্তু ‘আল্লাহ আছেন’—এটা ধরে নিতে রাজি হচ্ছে না। সে যদি সত্যিই নিরপেক্ষ হয়, তাহলে সে কেন নিচের উত্তরগুলোর একটা দিচ্ছে না?
১) আল্লাহ থাকতেও পারে, আবার নাও পারে, আমি ঠিক জানি না। যেহেতু আমি জানি না তিনি সত্যিই আছেন কিনা, তাই আমি ধরে নিচ্ছি তিনি আছেন এবং আমি তাঁর আদেশ মতো জীবন পার করব।
২) আল্লাহ আছেন কি নেই, সেটা বিজ্ঞান কখনই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে পারবে না। তাই আমি ধরে নিচ্ছি তিনি আছেন এবং আমি তাঁর আদেশ মতো জীবন পার করব।
কিন্তু এই ধরনের উত্তর আপনি পাবেন না। বেশিরভাগ মানুষ ধরে নিবে আল্লাহ নেই, কারণ আল্লাহ আছেন ধরে নিলেই নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে: নামায পড়তে হবে, রোযা রাখতে হবে, যাকাত দিতে হবে, হিন্দি সিরিয়াল এবং পর্ণ দেখা বন্ধ করতে হবে, ফেইসবুকে হাঁ করে অন্যের বেপর্দা ছবি দেখা বন্ধ করতে হবে—এগুলো করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। তাহলে তাদের সাথে তর্ক করে শেষ পর্যন্ত কী লাভটা হচ্ছে?
ধরুন আপনি এদের কাউকে বললেন, “ভাই, আপনার কথা যদি সত্যি হয় যে, আল্লাহর অস্তিত্ব নেই, মৃত্যুর পরে কোনো জগত নেই, তাহলে আপনি যখন মারা যাবেন, তখন আপনার অস্তিত্ব শেষ। আপনি কোনোদিন জানতে পারবেন না যে, আপনার ধারণাটা সঠিক ছিল কিনা। কিন্তু ধরুন আপনি ভুল, আর মারা যাওয়ার পর দেখলেন, আল্লাহ সত্যিই আছেন। জাহান্নামের যেসব ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা পড়ে আপনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেগুলো সব সত্যি ঘটনা। তখন কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন?”
এই অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষের প্রতিক্রিয়া হবে, “এরকম যুক্তি তো অনেক কিছুর বেলায়ই দেখানো যায়। তাই বলে কি ‘আল্লাহ আছেন’ ধরে নিয়ে আমাকে ইসলাম মানতে হবে নাকি? এটা কী রকম যুক্তি হলো?”
অথচ ‘আল্লাহ নেই’, এটা ধরে নেওয়াটা তাদের জন্য ঠিকই যুক্তিযুক্ত। তাদেরই যুক্তি অনুসারে: আল্লাহ আছেন, নাকি নেই–সেটা ৫০-৫০ সম্ভাবনা। তারপরেও তারা ‘আল্লাহ নেই’ এটা ঠিকই মেনে নিতে রাজি, কিন্তু ‘আল্লাহ আছেন’ এটা মেনে নিতে রাজি না।
যারা অলৌকিক প্রমাণ দেখতে চায়, ধরুন তাদেরকে একটা অলৌকিক প্রমাণ দেখানো হলো। একদিন সে সকাল বেলা ঘুমের থেকে উঠে দেখল: তার সামনে আলোর তৈরি এক মধবয়স্ক প্রবীণ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। সেই অলৌকিক পুরুষ গম্ভীর স্বরে তাকে বলল, “বৎস, আমি আল্লাহর কাছ থেকে প্রেরিত দুত। তুমি কালকে থেকে কু’রআন মানতে পারো। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি কু’রআন সত্যিই আল্লাহর বাণী।”—এখন সে প্রমাণ করবে কী করে যে, সেটা তার কোনো হেলুসিনেশন বা মতিবিভ্রম ছিল না? আবার ধরুন: আগামীকাল থেকে সে আকাশ থেকে গম্ভীর স্বরে এক ঐশ্বরিক বাণী শোনা শুরু করল। সে কীভাবে প্রমাণ করবে যে, সেটা তার কোনো মানসিক সমস্যা নয়?
তর্কের খাতিরে ধরুন: আপনি এদের কাউকে একদিন প্রমাণ করে দেখালেন যে, আল্লাহ সত্যিই আছেন। আপনি এমন এক কঠিন প্রমাণ দেখালেন, যার বিপক্ষে সে কোনো কিছুই উপস্থাপন করতে পারল না। আপনার প্রমাণ দেখার পর, সে কি পরদিন থেকেই একদম আদর্শ মুসলিম হয়ে যাবে, কারণ সে আপনার যুক্তি খণ্ডন করতে পারেনি? সে কি তার লাইফ স্টাইল একদম পালটিয়ে ফেলবে এবং ইসলামের নিয়ম অনুসারে সবকিছু করা শুরু করবে?
বেশিরভাগ মানুষই সেটা করবে না। মানুষ আল্লাহকে তখনি বিশ্বাস করে, যখন সে নিজে থেকে ‘উপলব্ধি’ করতে পারে যে, তিনি সত্যিই আছেন। তাদেরকে কিছু যুক্তি-প্রমাণ দেখালেই তারা আল্লাহর উপর পুরোপুরি বিশ্বাস করা শুরু করে দেয় না এবং তাদের জীবনকে পালটিয়ে ফেলে না। ঈমান একটি দীর্ঘ সফর, যার গন্তব্যে শুধু তর্ক করে পৌঁছা যায় না।
আল্লাহর অস্তিত্ব যে রয়েছে, তার পক্ষে হাজার হাজার প্রমাণ মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। তাঁর অস্তিত্বের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এই সৃষ্টিজগত। আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস না করা মানে হলো এটাই বিশ্বাস করা যে, এই পুরো সৃষ্টিজগত এসেছে শূন্য থেকে, কোনো কারণ বা ঘটক ছাড়া—যা একটি অবৈজ্ঞানিক দাবি। যাদের বিজ্ঞান নিয়ে যথেষ্ট পড়াশুনা আছে, তারা এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক দাবি করেন না। শুধুই উঠতি ‘বিজ্ঞানীদের’ মধ্যে এই ধরনের হাস্যকর দাবি করতে দেখা যায়, যাদের পড়াশুনা বিজ্ঞানের দুই-একটি শাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
যারা নিরপেক্ষভাবে, আন্তরিক জানার আগ্রহ থেকে আল্লাহকে খুঁজে বেড়ান, শুধু তাদের পক্ষেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। তাঁকে খুঁজে পাওয়াটা একটা বিরাট সন্মান। এই সন্মান মানুষকে অর্জন করতে হয়।
নাস্তিক এবং অধার্মিকদের দেখানো জনপ্রিয় সব যুক্তি এবং প্রমাণগুলোর মধ্যে যে আসলে কত ফাঁকফোকর আছে, সেটা জানার জন্য এই তিনটি বই বেশ কাজের– ১) গণিতবিদ, ফিলসফার এবং বেস্ট সেলার ড: ডেভিড বারলিন্সকি-এর লেখা The Devil’s Delusion, ২) ‘আধুনিক নাস্তিকতার জনক’ নামে কুখ্যাত নাস্তিক ফিলসফার এনথনি ফ্লিউ-এর ৭০ বছর পর আস্তিক হয়ে যাওয়ার পরে লেখা There is a God, ৩) The Human Genome প্রজেক্টের প্রধান, বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা বিজ্ঞানীদের একজন: ড: ফ্রান্সিস কলিন্স-এর লেখা The Language of God।
শূন্য থেকে সৃষ্টিজগত তৈরি হওয়াটা যে যৌক্তিকভাবে হাস্যকর একটা তত্ত্ব, সেটা নিয়ে ড: ডেভিড বিস্তারিত যৌক্তিক প্রমাণ দিয়েছেন। এমনকি মাল্টিভারস তত্ত্ব যে আসলে একটা পলিটিকাল কৌশল, যেখানে দুর্বোধ্য গণিতের আড়ালে নাস্তিকরা লুকিয়ে থেকে তাদের সেক্যুলার মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে–সেটা তিনি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। DNA-তে ৩০০ কোটি অক্ষরে যে এক প্রচণ্ড সৃজনশীল এবং অকল্পনীয় জ্ঞানী সত্তার স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে লেখা আছে, সেটা ড: ফ্রান্সিস সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, যা আধুনিক নাস্তিকতার জনক এনথনি ফ্লিউকেও আস্তিক হতে বাধ্য করেছে।
যারা রিচার্ড ডকিন্স নামে একজন বায়োলজিস্ট-এর লেখা The God Delusion বইয়ের সস্তা কথাবার্তা পড়ে ভক্তিতে গদগদ হয়ে গেছেন, তারা কয়েকজন সত্যিকারের বিজ্ঞানী এবং অ্যাকাডেমিকের লেখা পড়ে দেখুন। বুঝতে পারবেন যে, রিচার্ড ডকিন্স আসলে একজন ফার্মগেটের রাস্তার ওষুধ বিক্রেতার মতো হাস্যকর কথাবার্তা বলে মানুষকে একধরনের উত্তেজক ড্রাগ দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং তার মাজারের সাগরেদ কিছু উঠতি ‘বিজ্ঞানীরা’, পলিটিশিয়ানদের সাথে হাত মিলিয়ে, তাকে একজন সেলিব্রিটি বানিয়ে ব্যাপক ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে। এদের প্ররোচনায় পড়ে লক্ষ লক্ষ বোকা মানুষ তাদের মাজারের মুরিদ হয়ে যাচ্ছে এবং ডকিন্স এবং তার মাজারের সাগরেদদের বিরাট বড়লোক বানিয়ে দিচ্ছে।
যাদের ভিতরে ঈমান আনার সদিচ্ছা রয়েছে, তাদের আল্লাহকে দেখার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। তারা পক্ষপাতহীনভাবে, বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে সৃষ্টিজগতকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলেই, সেই সৃষ্টিজগতের স্রস্টার প্রতি শ্রদ্ধায় মুগ্ধ হয়ে ঈমান আনতে পারে। আর যাদের ঈমান একদম নড়বড়ে বা ঈমান আনার ইচ্ছা একেবারেই নেই, তাদেরকে অলৌকিক কিছু দেখালেও যে লাভ হয় না, তার উদাহরণ এই বনি ইসরাইল জাতি, যাদেরকে নবী মুসা ﷺ ভয়ংকর সব অলৌকিক ঘটনা দেখিয়েছিলেন: সমুদ্র দুইভাগ করে দেওয়া, নীল নদের পানি রক্তাক্ত করে দেওয়া, লক্ষ লক্ষ কীটপতঙ্গ এবং ব্যাঙ দিয়ে আক্রমণ; নবী সালিহ ﷺ-এর জাতি: যাদেরকে একটি অলৌকিক উট দেওয়া হয়েছিল; নবী ঈসা ﷺ যিনি জন্ম নিয়েই কথা বলা শুরু করেছিলেন, একদিন মৃত পাখিকে জীবিত করে দেখিয়েছিলেন; নবী ইব্রাহিম ﷺ এর জাতি: যারা তাঁকে এক বিশাল আগুনে ফেলার পরেও তিনি অক্ষত অবস্থায় আগুন থেকে বের হয়ে এসেছিলেন ইত্যাদি। ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষকে সাংঘাতিক সব অলৌকিক ঘটনা দেখানো হয়েছে, কিন্তু তারপরেও অনেক মানুষ হয় বিশ্বাস করেনি, না হয় বিশ্বাস করেও কয়েকদিন পর আবার শিরকে ডুবে গেছে, শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে পারেনি।
যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে, তাদেরকে অলৌকিক কিছু দেখিয়ে কোনো লাভ হয় না, তারা বদলায় না। আর যাদের অন্তরে অসুখ নেই, তারা চেষ্টা করলেই আল্লাহর ইচ্ছায় ঈমানদার হয়ে যেতে পারে, তাদের জন্য অলৌকিক কিছুর দরকার হয় না। একই বাবা-মায়ের কাছে জন্মগ্রহন করা, একই পরিবার ও সমাজে বড় হওয়া, একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন বিখ্যাত আলেম এবং দাঈ হয়েছে, আর অন্যজন পপ স্টার হয়েছে। এখানে শিক্ষা, পরিবেশ ও পরিবার কোনো প্রভাব ফেলে না, ফেলে সত্যকে গ্রহণ করার ইচ্ছা। একই জিনিসের মধ্যে কেউ ঈমান, আবার কেউ কুফর খুঁজে পেতে পারে। মহাকাশ ভ্রমণ করে সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গেগারিন ঈশ্বরকে কোথাও খুঁজে পাননি, কিন্তু নভোচারী সৌদি যুবরাজ সব জায়গায় পেয়েছেন স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বাক্ষর।
সূত্র: http://quranerkotha.com/baqarah-99/

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



