বিগত কয়েকদিন থেকে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ চায়ের দোকানগুলোতে আলোচনা জমে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া গনতন্ত্র বানানই করতে পারবে না’। আমি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষন করতে বসিনি। আমি গনতন্ত্র নিয়ে দু’টি কথা বলতে বসেছি। একটি দেশে গনতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে গেলে সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীন গনতন্ত্রের চর্চা থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়টি দল অভ্যন্তরীন গনতন্ত্রের চর্চা করে থাকে?
আশা করি, এই প্রশ্নের উত্তর আপনি নিচের বক্তব্য পুরোটা পড়লেই পেয়ে যাবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রবীন এবং প্রধানদল হল বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ। স্বাধীনতার পূর্বে এই দলের নাম আওয়ামি মুসলিমলীগ থাকলেও স্বাধীনতার পর পরই এই মুসলিম শব্দটি কেটে বাদ দেয়া হয়। এই প্রবীন রাজনৈতিক দলটি অভ্যন্তরীন গনতন্ত্রের কতটুকু চর্চা করে তার একটি নমুনা পেশ করছি। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে আওয়ামিলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবং এই দায়িত্ব তিনি কোন কাউন্সিলের মাধ্যমে নয় নিজে থেকেই পেয়ে যান। ৭৫ এর হত্যাকান্ডের পর আওয়ামিলীগ একরকম বিলীন প্রায় হয়ে যায়। এরপর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ে বঙ্গুবন্ধুর পরিবারের অবশিষ্ঠ্য দুই সদস্য শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশে ফিরে আসেন। তারা দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই শেখ হাসিনাকে দলের সভানেত্রী ঘোষনা করা হয়। সেইযে হাসিনা দলের সভানেত্রী হলেন তা আমরন থাকবেন তা যে কেউ বলে দিতে পারে।
চলতি সপ্তাহে আওয়ামিলীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। সে উপলক্ষ্যে ঢাকার সোহরাওয়্যারর্দি উদ্দানসহ শহরের প্রধান সড়কগুলোকে আলোক সজ্জিত করা হয়েছে। সেই সাথে দলের এবং দলের নেতাদের ব্যানার ফ্যাষ্টুন শহর ভরিয়ে দেয়া হয়েছে। আওয়ামিলীগের মাঝে একটি সাজ সাজ রব থাকলেও মিডিয়াকে খুব বেশি মাতামাতি করতে দেখা যাচ্ছে না। কারণ কাউন্সিল এর মূল আকর্ষণই থাকে কে হচ্ছেন দলের সভাপতি অথবা সভানেত্রী! মিডিয়া কর্মীরাসহ দেশবাসীও জানে আওয়ামিলীগের ২০ তম কাউন্সিলেও ম্যাডাম শেখ হাসিনাই দলের সভানেত্রী পদটি পাবেন। সেই সাথে ম্যাডামের একমাত্র পুত্রও জয় সাহেবও যে দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে যাচ্ছেন তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। তাহলে আওয়ামিলীগের মাঝে অভ্যন্তরীন গনতন্ত্রের চর্চা কোথায়?
এরপর আসি দেশের আর একটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল বিএনপির দিকে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ইন্তেকালের পর তার সহধর্মীনি ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে অস্থায়ীভাবে দলের সভানেত্রীর পদটি দেয়া হয়। সেই অস্থায়ী পদটি এক সময় স্থায়ী পদে পরিণত হয়। তিনি দলের চেয়ারপার্সন এ পরিণত হন। কিন্তু সেই চেয়ারপার্সন পদকি তিনি ভোটের মাধ্যমে পেয়েছেন? উত্তর হবে, না। তিনি এই পদটি পেয়েছেন পারিবারিক অধিকার বলে।
চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও নতুন কোন চমক ছিল না। ম্যাডাম খালেদা সেই যে চেয়ারপার্সনের আসনে বসেছেন আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি কোন সিরিয়াস অসুস্থতা অথবা মৃত্যু ছাড়া তিনি এই পদটি হারাচ্ছেন না। আর তিনি যাবেন তারপর তার ছেলে আসবে। ডজনখানেক মামলা নিয়ে তারেক রহমান বিদেশে পালিয়ে আছেন। সে কারণে দলের প্রধানের চেয়ারটি যদি তিনি নাও নিতে পারেন তবে সেই আসনে বসবেন তারেকের স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা। কোন ধরনের কাউন্সিল ছাড়াই যদি এই ভাবে দলের প্রধান নির্ধারন করা হয়ে থাকে তাহলে, গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির অভ্যন্তরে গনতন্ত্রের চর্চা কোথায়? তাহলে কি তারাও একবার ক্ষমতায় গেলে গনতন্ত্রকে মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দিবেন!
বিশ্বপ্রেমিক হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ সাহেবের মাজাভাঙ্গা দলের কথা আর নাই বা বললাম ।
এবার বলি, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীকে নিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে ধারা দেখতে পাওয়া যায় সেই ধারাটি জামায়াত নামক দলটিতে একদমই অনুপস্থিত দেখা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দলটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক গোলাম আযম। স্বইচ্ছায় দলের প্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণের ইতিহাস উপমহাদেশে সৃষ্টি করেছিলেন যুদ্ধাপরাধের সাজা প্রাপ্ত এই গোলাম আযম। কিন্তু গোলাম আযমের অব্যাহতির পর সেই আসনে তার ছেলে কিংবা তার পরিবারের কোন সদস্য আসন গ্রহণ করেন নি। এমনকি এটাও জানা যায়, গোলাম আযম এর পরিবারের কোন সদস্যও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত হতে পারে নি।
এরপর ২০০০ সালে সারাদেশের সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে দলের প্রধান নির্বাচিত হন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এরপর প্রতি ছয় বছর পর ব্যালটের মাধ্যমে জামায়াতের আমীর নির্বাচন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের সাজায় ফাঁসির আগ পর্যন্ত তিনি জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। তার ফাঁসি হয়ে যাবার পর দলের প্রধানের আসনটি পূর্ণ করার জন্য জামায়াত সারাদেশে ভোটের আয়োজন করে। মাসব্যাপী এই ভোটিং কার্যক্রম চলতে থাকে। এবং এই ভোর্টি কার্যক্রমের সংবাদ দেশের অনেক প্রধান মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি। আগেই বলেছি, কাউন্সিল এ মিডিয়ার উত্তেজনা তখনই দেখা যায় যখন সেখানে ভিন্ন রেজাল্ট হবার ১০০% সম্ভাবনা থাকে। আজ সারাদিনের পত্রিকাগুলো সেটাই প্রমাণ করেছে। জামায়াতের সদস্যদের প্রত্যক্ষ্য ভোটে জামায়াতের নতুন আমীর নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা মকবুল আহমাদ।
আমরা বই এর পাতায় একটি স্লোগ প্রায়ই পড়ে থাকি। পাপিকে নয় পাপকে ঘৃনা কর। সেই কথানুসারে বলব,আওয়ামিলীগ,বিএনপি আমাদের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। যেখানে যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত তাদের দলের অভ্যন্তরে পূর্ণ গনতন্ত্রের চর্চা করছে সেখানে আমাদের স্বাধীনতাপর স্বপক্ষের দলগুলোর মাঝে গনতন্ত্র অনুপস্থিত। যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল গনতান্ত্রিক মুক্তির জন্য, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য, সেই স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলগুলোর মাঝেই আজ গনতন্ত্র বিলীন হয়ে গেছে। সত্যি এ বড় লজ্জার! এ বড় হতাশার! জামায়াত ইসলাম আবারো স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলগুলোকে লজ্জায় ফেলে দিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:৪২