আমি নাসিফ।(সবাই জানে)। কিন্তু সমস্যাটা হল আমার এই নামটা একবারে কোন অপরিচিত লোক ধরতে পারে না। তাদের মতে আমার নাম হয় নাফিস,নাসির অথবা নাসিম। যাই হোক, আমার জন্ম হয় হোসেনপুরে(কিশোরগঞ্জ জেলায়), ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চে। দিনটি ছিল একদিকে যেমন শুক্রবার অন্যদিকে ১৭ রমজান। মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ১৭ রমজানের মাহাত্ম্য জানেন। এটি বদর দিবস। আমি যখন জন্মগ্রহণ করি, তখন আমার একভাই ও একবোন ছিলেন। এখন আমরা পাঁচ ভাই ও এক বোন।
আজকে আমার এ লেখাটা পরিবার নিয়ে নয়। বন্ধুদের নিয়ে। যাদের সাথে আমার জীবনের সোনালী দিনগুলো কেটেছে। অর্থাৎ আমার স্কুল জীবনে যাদের সাথে দিন কেটেছে। প্রথমেই বলে রাখি, আমার লেখা কোন মানের না, শিল্প তো বহু দূর, আমি লেখায় ব্যকরণই ঠিক রাখতে পারে না। ঠিক রাখতে পারে বন্ধু তানভীর। তার লেখা পড়লে আমি সম্মোহিত হয়ে যাই। অনেক সময় বিভ্রান্তও। যাই হোক তানভীরের কথা যখন চলেই আসলো তখন তাকে দিয়েই শুরু করা যাক। অবশ্য শুরু না করেই বা কি করি। আজ আমার বয়স ২৩ হল। সম্ভবত ৫ কিংবা ৬ বছর বয়স থেকে আমি তানভীরকে চিনি। আমার কিছুটা মনে পড়ছে ছোট্টবেলায় যখন লেখাপড়ার পাট শুরু করিনি তখন তানভীরকে আমি ডাকতাম ‘বন্ধু’ বলে। ছোটবেলা থেকেই তানভীর ছিল ভাবুক টাইপের। এবং দারুণ প্রতিভাবান। আমার মনে পড়ে অনেক আগেকার কথা, আমি তখন দেয়াল ঘড়ির কাঁটাগুলই ঠিকমত জানি না; দেখি একদিন তানভীর কি করে জানি গড়গড় করে কয়টা বাজে বলে দিচ্ছে!! আজব! হিংসা হওয়ার মত। যে বয়সে আমরা খালি পত্রিকার ছবি দেখতাম সে বয়সে তানভীরকে দেখতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ছে। ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত আমরা একসাথে পড়েছি। হোসেনপুর ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দু’ একদিন ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা প্রায় প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যেতাম। এখন আমি কয়েকটা ঘটনার কথা স্মরণ করছি, যেগুলো তানভীরের মনে আছে কিনা কে জানে। এক বৃষ্টির দিন। আমরা বৃষ্টির পর গার্লস স্কুলের চিপা গলি দিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। দেখি যাওয়ার কোন উপায় নেই । বৃষ্টির পানি জমে একাকার। আমরা বুদ্ধি করলাম পানি সরাব। কিছু একটা দিয়ে নালা কেটে আবর্জনা সরিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে আমরা স্কুলে চলে গেলাম। স্কুল থেকে ফেরার সময় তো আমরা অবাক। এ যে শুকনো খটখটে রাস্তা। আমাদের খুশী আর দেখে কে। রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলেছি। ‘আমি বড়লোতের উফরেরটা’ কিংবা ‘কিল দ্যায়া ডাবায়ালবাম’ এইসমস্ত উক্তিগুলো কখন কোথায় শুনেছিলাম তানভীর কি এগুলো মনে করতে পারবে? আমরা খুব ক্রিকেট খেলতাম, ফুটবল তেমন একটা না। তবে আমরা খুব বড় মাঠে খেলতাম না। বর্ষার মৌসুমে আমরা খেলতাম তানভীরদের বাসার উঠানে। আর শুকনো সময়ে খেলতাম কানুনগো’র মাঠে। তবে খেলোয়াড় ভিন্ন হতো। আমরা যখন খুব ছোট,তখন খেলোয়াড় ছিলাম আমি, তানভীর, আমার ভাই গালিব(সবার কাছে যিনি ভাইয়া), জাহাঙ্গীর ভাই(তানভীরের ভাই), মোস্তাক ভাই, ফারুক(অনেক আগে আমাদের প্রতিবেশি), ইমরান ভাই, জুয়েল-রুবেল(দুই ভাই), আক্তার এবং আর দু একজন যাদের নাম এ মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না। এরপর আরেকটু বড় হওয়ার পর আমাদের গন্ডিও একটু বাড়লো। তখন আমাদের সাথে ছিল তানজীম মামা, তাসনিম, নাজমুল, মোস্তাকিম,নাকিব, মনির মামা, ফারহান সহ আরো কয়েকজন। আর আমরা কখনো ব্যাট কিনেছি বলে মনে পড়ে না। নারিকেলের ডাল কিংবা অন্য কোন মানানসই একটা কাঠ সাইজ করে আমরা ব্যাট বানাতাম। তবে বল কিনতাম। কর্কের বল। প্রথম যখন কিনতাম তখন দাম ছিল ৪ টাকা, পরে ৫, আরো পরে ৬, সর্বশেষ ৮ টাকায় আমরা বল কিনেছি। এরপর অবশ্য টেপ টেনিস দিয়েও অনেক দিন খেলেছি। খেলেছি কেনা ব্যাট দিয়েও। আমাদের স্কুল যখন খোলা থাকতো তখন আমি, তানভীর,সোহেল,সুমন এবং আরো কয়েকজন মিলে অফিসারদের কোয়ার্টারে যেতাম। মাঝে মাঝে নারিকেল,ডাব ইত্যাদি পেড়ে খাওয়া হতো। কি দারুণ রোমাঞ্চকর সেই দিনগুলো। স্কুল জীবনের কথা যখন হচ্ছে, তখন আর একজনের কথা না বললেই নয়। সে হচ্ছে গোলাম সারোয়ার রাতুল। ক্লাস ফোরে প্রথম দিন ক্লাস করতে আসলাম। শোনলাম আলম স্যারের ভাগ্নে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি নগর স্কুলের সামনে। বাহ! অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমি,তানভীর, রাতুল কি ভালই না বন্ধু হয়ে গেলাম। একটা কথা বলে রাখা ভাল ঐ সময় পর্যন্ত আমি কোনদিন কোন বন্ধুকে ‘তুই’ করে বলতাম না। সবাইকে ‘তুমি’। নতুন আর একটা ছেলে এসেছিল। জিহাদ। আমরা তিনজন তাকে ব্যাপক আকারে জ্বালাতাম। মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। আমাদের কাছে এক রহস্যের নাম ছিল ‘গাডিপাড়া’, ‘বৈৎপাড়া, ‘মাছছোয়া পাড়া’, ‘জালোপাড়া’। নাম শুনতাম যাইনি ঐ সময়টাতে। পরে অবশ্য গিয়েছি। প্রাইমারি স্কুলে আমাদেরকে বিনোদন দিত শরিফ নামে এক ছেলে। নিশাদের বন্ধু। চোখটা একটু ট্যারামত ছিল। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে যায়। তানভীর চলে যায় মাদ্রাসায়। ঐ সময়ের অনেকেই তখন পড়ালেখা ছেড়ে কাজ শুরু করে। আমি,রাতুল চলে আসি ষষ্ঠ শ্রেণিতে হোসেনপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। আসলে আমার এই স্বল্প লেখায় আমি আমার সব বন্ধুদের সাথে ঘটে যাওয়া ইতিহাস মনে করতে পারছিনা। সুতরাং কেউ বাদ পড়ে গেলে নিজগুণে…..। যা বলছিলাম। প্রথম দিন মাত্র স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেছি। একটা ছেলে পথ আটকে বললো, এই তোমার নাম নাসিফ না?- হঁ্যা, আমি নাসিফ, তুমি সাদ্দাম না? ব্যস এটুকু কথা দিয়েই হয়ে গেল সাদ্দামের সাথে আমার বন্ধুত্ব। ক্লাসে ঢুকলাম। দেখি সেইরাম স্মার্ট একটা ছেলে বসে আছে। নাম নাঈম। মাহমুদুল হাসান নাঈম। এরপর একে একে দিনকে দিন চিনলাম নুরুজ্জামান নাঈম, আবু নাঈম, শরীফ, কফিল, তানজীদ, মাসুম সহ আরো অনেককে। নাঈমকে দিয়েই শুরু করা যাক। ক্লাস থ্রি, ফোর পর্যন্ত আমার বা নাঈমের নামডাক তেমন ছিল না হোসেনপুরে। ক্লাস সিক্সের কোন একদিন নাঈম দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললো,‘নাসিফ,নাসিফ! আমি ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পাইসি।” আরেসসালা ‘সারা’ ‘তাশা’র দিন শেষ। আমি, নাঈম এবং আরো কয়েকজন ‘অন্তরা’ কোচিংয়ে পড়তাম। সেখানে বিভিন্ন লেভেলের ফাইজলামি হত। আমি অবশ্য ততদিনে একটু একটু করে ফাইজলামি শিখছি। নাঈমের মনে আছে কিনা, ক্লাস এইটে আরিফ ভাই আসলো নতুন। সে কি মেধা তার। সব পারে। আমরা একটু কাহিনী করেছিলাম। তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। ক্লাস সেভেনে অবশ্য আর একজন এসেছিল নতুন। নাম শাহ সুবায়েল বিন সানাপ। টাঙ্গাইলের শাহীন কোচিং ফেরৎ। ইংরেজিতে সেইরাম। একদিন মনে আছে, থানা মসজিদের উন্নয়ন কর্মকান্ড উদ্বোধন করতে এসেছেন মির্জা আব্বাস। পুরো স্কুল চলে গেছে সেখানে। স্কুলে শুধুমাত্র তিনটি প্রানী আমরা- আমি, নাঈম, সানাপ। কত কি নিয়ে যে আমাদের আড্ডা হয় সেদিন। একদিনের ঘটনা, আমরা ক্লাস এইটে পড়ি তখন। নাঈম আসছে না। একটু পরে দেখি নাঈম হাজির। কিন্তু এ কি! পুরো ক্লিন শেভড। আমরা তো পুরাই থ! অবশ্য নাঈম ক্লাস এইটের পর আর আদর্শ তে থাকেনি। তখন আমরা ছিলাম কয়েকজন। আমি, রাতুল, সানাপ, সাদ্দাম, শরীফ, নাঈম, সোহেল, তানিম, হৃদয়, রাজিব, মাজহার, রুবেল, তোতা মিয়া। আরও ছিল রাজু, ছোটন, আল-আমিন, শফিকুল, টিটু, আশরাফুল। কতজন! আমি, রাতুল, সানাপ, নাঈম, সাদ্দাম আলী স্যারের কাছে কোচিং করতাম। সেখানে অবশ্য অন্য কারণও ছিল। আমরা জানি। বলব না। সানাপের একটা সাইকেল ছিল। স্টাইলিশ। আমরা বন্ধুরা মাঝে মাঝেই সাইকেলে চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। পীতলগঞ্জ, গড়বিশুদিয়া, সিদলা, ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ, মনসুরভাইদের বাড়ি( গাভী শিমুল ), কাইসমা, মাধখলা এবং আরো অনেক জায়গায়। তবে পীতল গঞ্জের প্রতি সবারই একটা আলাদা টান ছিল। কেন? বলা যাবে না। আমার সাইকেল শেখার হাতেখড়িও ঐ সানাপের কাছে। সে পেছনে বসে ব্রেক ধরতো আর আমি সামনে বসে প্যাডেল মারতাম। আহা! কি ছিল সেই দিনগুলি। মনে পড়ে, ক্লাস টেনের একটা সময়ে আমরা কিশোরগঞ্জ চলে যাই। আমি, সাদ্দাম, সানাপ ও নাঈম; সাইফুল ভাইয়ের মেসে। ক্যাম্ব্রীজে কোচিং করেছিলাম। মনে আছে? আমরা একদিন স্কুল থেকে পিকনিকে গিয়েছিলাম; শফিপুরের আনসার একাডেমিতে। ওহ! আরেকজনের কথা বলতে একদম ভুলে গেছি। আমাদের দাদা এ এইচ এম রাফসান জানি পিয়াস। বদের বদ। আমাদের সকল কাজের সহযোগী, অকৃত্রিম বন্ধু। তবে বন্ধুরা আমার সাথে একমত হবে কি না জানি না, আমরা আমাদের সোনালী সময়টা কাটিয়েছি ক্লাস নাইনে। মনে পড়ে? বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতার আগের রাতের কথা। সারারাত আমাদের জেগে থাকা। রাস্তায় লেখালেখি, কাগজ কেটে দড়িতে লাগানো, সবাই মিলে ভুনা খিচুড়ি খাওয়া। ভোলা যায় না, তাইনা।।
মনে হচ্ছে লেখাটা একটু বড় হয়ে যাচ্ছে। আমার এই ফালতু লেখা পড়ার ধৈর্য্য কারোর থাকবেনা। কোন লাইন টেনে সমাপ্ত করলাম না। আজকের মত এখানেই শেষ করলাম। ভাল দিনক্ষণ দেখে আরও কিছু স্মৃতি আওড়ানোর ইচ্ছা আছে।