মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনন্য সীরাত : কোন গ্রন্থটি পড়ব?
আরবি শব্দ 'সিরাত' এর অর্থ- জীবনচরিত, চালচলন, গতি, জীবনপদ্ধতি। বিস্তারিত অর্থে অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় কোনো মানুষের চালচলন, ওঠা-বসা, আচার-আচরণসহ তাঁর জীবনের যাবতীয় বিষয়াদির আলোচনাকে সিরাত বলে। পরিভাষায়, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সার্বিক জীবনচরিতকে সিরাত নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অবশ্য, অন্যান্যদের জীবনচরিত আলোচনার ক্ষেত্রেও এই সিরাত শব্দটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সিরাতুন্নাবাবিয়্যাহ অর্থাৎ, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সিরাত গ্রন্থের প্রথম রচয়িতা ছিলেন উরওয়াহ ইবনুজ জুবাইর ইবনুল আওয়াম, আব্বান ইবনে উসমান, ওয়াহহাব ইবনে মুনাব্বিহ, ইবনে সাদ প্রমুখ। -সিরাত ইবনে হিশাম : ১০
ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে খ্যাত উমর ইবনে আব্দুল আজিজের পরামর্শক্রমে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ইনতিকালের ৮৫ বছর পর ইবনে শিহাব আজ জুহরি একটি সংক্ষিপ্ত সিরাত গ্রন্থ রচনা করেন। এটি ইতিহাসের প্রথম আনুষ্ঠানিক সিরাত গ্রন্থ। তাঁদের রচিত প্রায় সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইতিহাসে ইবনে ইসহাকের ‘আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ লি ইবনে ইসহাক’ হলো প্রথম সিরাত গ্রন্থ। তিনি সিরাত শাস্ত্রের জনক।
সিরাতে ইবনে ইসহাকঃ
‘আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ লি ইবনে ইসহাক’ বা সিরাত ইবনে ইসহাক ইতিহাসের প্রথম সিরাত বা রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনী গ্রন্থ। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ইনতিকালের পর লেখা এটিই তাঁর প্রথম বিশদ জীবনী। ৭২ বছর গত হলো তিনি মারা গেছেন। হিজরি প্রথম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়। সাহাবিরাও আর কেউ বেঁচে নেই। সাহাবিদের দেখেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। হৃদয়ের ধর্ম ইসলাম ও মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিদের আদর্শ, তাঁদের সত্য ও সততার গুঞ্জন তখনো চতুর্দিকে আতর আতর সুভাস ছড়াচ্ছে। মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর ধর্মের ইতিহাস পৃথিবীর পটভূমিতে নতুন নতুন ছবি আঁকছে। মানুষের মুখে ধ্বনিত হচ্ছে পবিত্র বিশুদ্ধ মানুষ ও ধর্মের কথা। এই আলোর প্রদীপ্ত মশালে আলোকিত হচ্ছে অন্ধকারের পাড়া-মহল্লা। সব মহলে চর্চা হচ্ছে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর অভূতপূর্ব সাফল্যের পবিত্র জীবনী। সেই সময় ইবনে ইসহাক লেখেন মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনী।
সবচেয়ে প্রাচীন, প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ সিরাত ইবনে ইসহাক। ভাষার প্রাঞ্জলতা, শব্দের বুনন ও তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা গ্রন্থকে করেছে অনন্য। ইসলাম ও মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবন সম্পর্কে অন্যতম প্রধান উৎস এই বই। ইসলাম ধর্ম, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সে সময়ের আরবের ইতিহাস জানার জন্য সারা পৃথিবীর নিবেদিতপ্রাণ ধর্মানুসারী থেকে নিষ্ঠাবান গবেষক পর্যন্ত এই বইয়ের কাছে ফিরে ফিরে এসেছেন। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনীসংবলিত এটিই ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থ। এর আগে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনী লেখা হয়নি। পরবর্তী সময়ের সব সিরাত গ্রন্থই সিরাত ইবনে ইসহাকের পোষ্য। আদম (আ.) থেকে শুরু করে নবী ও রাসুলদের জীবনী এবং ইতিহাস একত্র করা হয়েছে এই গ্রন্থে। কালের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে তিনি এই কাজ করেছেন। তবে তাঁর সব বক্তব্যে বিশুদ্ধতা নিরূপণ করা হয়নি।
বাংলা ভাষায় সিরাতে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বইটি প্রথম প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। কথাসাহিত্যিক শহীদ আখন্দ অনুবাদ করেছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সেই অনুবাদটি একটা সময় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সম্ভবত ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও অন্য কেউ আর বইটি প্রকাশ করেনি। ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করে। তবে অভিজ্ঞমহল মনে করে, এই অনুবাদ প্রশ্নাতীত নয়।
সিরাতে ইবনে হিশামঃ
আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালেক ইবনে হিশাম ইবনে আইয়ুব হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে ‘সিরাত ইবনে হিশাম’ লিপিবদ্ধ করেন। ইবনে হিশাম বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর ছেলেবেলা কাটে। পরে তিনি মিসর গমন করেন। সেখানে ইমাম শাফি (রহ.)-এর সঙ্গে মিলিত হন। উভয়ে প্রচুর আরব কাব্য চর্চা করেন। ২১৮ হিজরিতে তিনি ফুসতাত নগরীতে ইন্তেকাল করেন।
সিরাত ইবনে হিশাম তাঁর অমর কীর্তি। বইটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও প্রচারিত। এ বই তাঁকে আজও পৃথিবীর মঞ্চে জাগিয়ে রেখেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি সিরাতে ইবনে ইসহাককে সংক্ষিপ্ত করেন। জিয়াদ আল বুখারি নামে মাত্র এক ব্যক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করেছিলেন। ইবনে ইসহাক রচনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এ বই লেখা হয়। তখন আব্বাসীয় খেলাফতের বিকাশকাল চলছে। এ সময় মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও বিকাশ ঘটে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, নগরায়ণ প্রতিষ্ঠায় মুসলিমরা অনেক এগিয়ে যায়।
ইবনে হিশাম পূর্ণ সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বইটি সংকলন করেন।
আল্লামা ইবনে কাসির রচিত আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াঃ
আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া বইটি লেখেন আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসির আদ-দামেশকি (রহ.)। ৭০১ হিজরিতে জন্ম। বসরার অন্তর্গত মিজদাল নামক জনপদে এই মহামনীষী জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টম শতাব্দীর মামলুক সুলতানের শাসনামলে তিনি যৌবনকাল অতিবাহিত করেন। যৌবনের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন সুলতানের শাসনকাল। ৭৭৪ হিজরির এক বৃহস্পতিবার মহান মালিকের ডাকে তিনি সাড়া দেন।
অষ্টম শতাব্দীতে ইবনে কাসির ছিলেন সুপণ্ডিত। তৎকালীন সেরা জ্ঞানী। তিনি ফতোয়া দিতেন। শিক্ষকতা করেছেন। তর্কযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ফিকাহ, তাফসির ও ব্যাকরণ শাস্ত্রে এক নতুন রচনাশৈলী উদ্ভাবন করেছেন। হাদিস বর্ণনাকারী ও হাদিসের সত্যাসত্য বিচারের ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন ভাষাবিদ। সাহিত্যিক। যুগশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবেত্তা। ইতিহাস শাস্ত্রে তিনি সিরিয়ার ইতিহাসবিদ কাসিম ইবনে মুহাম্মদ বিরযানি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া তাঁর অমর কীর্তি। আরবি ভাষায় রচিত। ১৪ খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে বইটি। উচ্চস্তরের ভাষা ও সাহিত্যিক মানে আরবি সাহিত্যিকদের কাছে এটি ব্যাপক প্রশংসিত।
বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন বইটির অনুবাদ ১৪ খণ্ড প্রকাশ করে। বাংলা নামকরণ করা হয় ‘ইসলামের ইতিহাস : আদি-অন্ত’।
ইমাম তিরমিজি রচিত শামায়েলে তিরমিজিঃ
শামায়েলে তিরমিজি রচনা করেন ইমাম হাফেজ আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা। হাদিস শাস্ত্রের বিখ্যাত সহিহ ছয় কিতাবের মধ্যে সুনানে তিরমিজির লেখক তিনি। তিনি ইমাম বুখারির প্রিয় ছাত্র। হাদিস শাস্ত্রে পণ্ডিত, খ্যাতনামা আলোচক, তীক্ষ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও প্রচণ্ড মেধাবী মনীষী ছিলেন। তিনি ২০৯ হিজরি মোতাবেক ৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তিরমিজ শহরের যুগ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ২৭১ হিজরির রজব মাসের শেষের দিকে পরলোকগত হন।
তাঁর রচিত শামায়েলে তিরমিজির মধ্যে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর দৈহিক অবয়ব, পোশাক-পরিচ্ছদ, হাসি-কান্না, আদব-আখলাক ও দৈনন্দিন আমলের বর্ণনা তুলে ধরেন। মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নূরানি রূপ, অনুপম সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেন। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ব্যবহৃত আসবাবেরও বর্ণনা করেন। বেশির ভাগ হাদিসের শুরুতে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রসিদ্ধ কিতাবের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। ইমাম তিরমিজি (রহ.) তাঁর গ্রন্থে ৫৮টি বিষয়কে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে ৪০০টি হাদিস সংকলন করেন।
শামায়েলে তিরমিজির প্রথম অনুবাদ প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। অনুবাদ করেন আল্লামা আবুল বারাকাত মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ। সম্পাদনা করেন প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী এম পি ও ড. আবুল আলা মুহাম্মদ হোজামুদ্দিন।
আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত আর-রাহীকুল মাখতুমঃ
আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’ প্রাণের নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনী গ্রন্থ। তিনি ভারতের আজমগড় জেলার হোসাইনবাদের মোবারকপুরে জন্মেছেন। আরবি ভাষা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ, তাফসির ও হাদিস বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে শরিয়াহ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা আর লেখালেখি করতেন। ১৯৮৮ সালে মদিনায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়ক গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর তাঁর ইন্তেকাল হয়।
আধুনিক যুগে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনী নিয়ে লেখা অন্যতম একটি সিরাত গ্রন্থ ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’। ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলম ইসলামী কর্তৃক মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনীর ওপর প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে এক হাজার ১৮৭ টি পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে। আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরীর সিরাত রচনাটি প্রথম স্থান অধিকার করে।
১৯৯৯ সালে খাদিজা আখতার রেজায়ী বইটির বাংলা অনুবাদ করেন এবং আল কোরআন একাডেমি লন্ডন বইটি প্রকাশ করে। বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া মেলে। মাত্র ৫৫ দিনের মাথায় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। এখন বইটির ২১ তম কিংবা তারও পরবর্তী সংস্করণ চলছে।
আল্লামা ইদরিস কান্ধলভীর সিরাতে মোস্তফাঃ
আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী (রহ.) লিখিত সিরাতে মোস্তফা উর্দু ভাষায় রচিত, একটি তথ্যবহুল সিরাত গ্রন্থ। আল্লাহর রাসুলের জিহাদ জীবন, দাওয়াতের ক্ষেত্রে আপসহীনতা ও মুজিজার আলোচনা করেন। হাদিস ও তাফসিরের মূল গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত সিরাতবিষয়ক অনেক রেওয়ায়েত তুলে ধরেছেন। সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যাগুলো অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। ইদরিস কান্ধলভী (রহ.) বলেন, ‘যদ্দুর সম্ভব সংগ্রহ এবং রেওয়ায়েতগুলো গ্রহণযোগ্য ও সনদযুক্ত হওয়ার দাবি করে। কিছু গুপ্ত রহস্য এবং আহকামও সন্নিবেশ করা হয়েছে। যা ইনশাআল্লাহ উপকারী ও লাভজনক প্রমাণিত করে।’
কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবীঃ
বিশ্বনবী বাংলা সাহিত্যের প্রথম সিরাত গ্রন্থ। লিখেছেন কবি গোলাম মোস্তফা। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গীতিকবিতা, শিশুতোষ কবিতা, মহাকাব্য, গান, অনুবাদ, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গল্প লিখেছেন। মুসলিম জাগরণের কবি হিসেবে বিশেষ সমাদৃত। বিশ্বনবী কবির শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৯৪২ সালের অক্টোবরে বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় ও ১৯৬৩ সালে অষ্টম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অষ্টম সংস্করণে বইটি ৫৮৭ পৃষ্ঠায় দাঁড়িয়েছে।
কবি পূর্ববর্তী বিখ্যাত অনেক সিরাত গ্রন্থ পাঠ করে বইটি লেখেন। মনের আবেগ, ভালোবাসা ও প্রেম উজাড় করে দিয়েছেন কলমের আঁখরে। কবির কলম এখানে প্রেম আর বিপুল আবেগের তরঙ্গে ঢেউ খেলেছে। অনুভূতির সব দরজা খুলে বসেছেন মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যাপিত জীবনের কাছে। প্রাচীন সিরাত গ্রন্থের সহযোগিতা নিয়েছেন। করেছেন ফুটনোট। কিছু কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন। আবেগ বিশ্বাস আর যুক্তি এ গ্রন্থের সবখানে বিরাজমান। বিশ্বনবী সাধারণ পাঠকের চেয়ে বিদগ্ধ পাঠককে বেশি মুগ্ধ করবে। বেশি আলোড়িত এবং আন্দোলিত করবে।
বাংলা ভাষার আরও কিছু সিরাতগ্রন্থঃ
বাংলা ভাষায় যাঁরা মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনীগ্রন্থ লেখেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনই ইসলামের অনুসারী নন, তবু ভক্তি ও ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদনে তাঁরা মুসলিমদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। বাংলা ভাষায় প্রথম যাঁর পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ সামনে আসে, তিনি হলেন রেভারেন্ড জেমস লং। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন খ্রিষ্টান, পরে মুসলিম হন। ১৮৮৫ সালে তা কলকাতার সত্যার্ণব প্রকাশনী থেকে ‘মুহাম্মদের জীবনচরিত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। একই বছর অতুল কৃষ্ণমিত্র লেখেন ‘ধর্মবীর মুহাম্মদ’ নামে একটি নাট্যজীবনী। ১৮৮৬ সালে কৃষ্ণ কুমার মিত্রের ‘মুহাম্মদ চরিত্র ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ প্রকাশিত হয় শ্যামা প্রেস, কলকাতা থেকে এবং গিরিশ চন্দ্র সেন লেখেন ৩ খণ্ডে ‘মহাপুরুষ মুহাম্মদের জীবনচরিত’। এরপর ১৯০৪ সালে রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেছেন ‘হজরত মুহাম্মদ ও হজরত আবু বকর’।
বাংলা সাহিত্যে নবীজিকে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন শেখ আবদুর রহীম (১৮৫৯-১৯৩১)। গ্রন্থটির নাম ‘হযরত মুহম্মদের স. জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’, ১৮৮৭ সালে ৪০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ সিরাতগ্রন্থ হলো কলকাতা থেকে ১৯০৮ সালে ডা. সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত ‘মোসলেম পতাকা’, ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে শেখ মোহাম্মদ জমীর উদ্দীন রচিত ‘মাসুম মোস্তফা (সা.)’, ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে এয়াকুব আলী চৌধুরী রচিত ‘মানব মুকুট’, ১৯২৫ সালে মোবিনুদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর নগরী রচিত ‘নবীশ্রেষ্ঠ’, ১৯২৫ সালে কলকাতা থেকে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচিত ‘মরু ভাস্কর’, ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ রচিত ‘শেষ নবী’, ১৯৫১ সালে ঢাকা থেকে মাওলানা আবদুল খালেক রচিত দুই খণ্ডের ‘ছাইয়েদুল মুরছালীন’, ঢাকা থেকে ১৯৬০ সালে মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচিত ‘নবী গৃহ সংবাদ’, ১৯৬৮ সালে শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন রচিত ‘হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন’। এ ছাড়া কবি আল মাহমুদ রচিত ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা রচিত ‘মহানবী’ ও ২০০২ সালে প্রকাশিত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ রচিত ‘বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’ অনন্য জীবনীগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষক নাসির হেলাল তাঁর গবেষণায় মধ্যযুগ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় রচিত মোট ১০২৮টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১০:৩২