somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পবিত্র সিরাত চর্চা: সহস্রাধিক বছরের অনন্য ধারাবাহিকতা

১৮ ই অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মদিনাতুল মুনাওয়ারায় অবস্থিত মসজিদে নববীর অনন্য একটি দৃশ্য, অন্তর্জাল হতে সংগৃহিত।

মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পবিত্র সিরাত চর্চা: সহস্রাধিক বছরের অনন্য ধারাবাহিকতা

বিশ্বের এ যাবতকালের ইতিহাসে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে কার, এ–বিষয়ক কোনো জরিপ হয়েছে বলে জানা যায় না। কখনো যদি হয়, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর নাম যে তালিকায় সর্বপ্রথমেই থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত প্রায় সহস্রাধিক বছরে ধর্ম-বর্ণ-দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে অগণিত লেখক, সাহিত্যিক, কবি, চিন্তক, ভাষাবিদ, শিক্ষক, সমাজনেতা, শিক্ষাবিদ, সমরবিদ, গবেষক, রাষ্ট্রনায়ক, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁর জীবনী রচনা করেছেন। শুধু জীবনী লিখেছেন বললে কম বলা হবে, জগতের জ্ঞানী গুণী এসব লেখক সাহিত্যিকগণ বরং তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে বিপুল প্রশস্তি বর্ণনা করেছেন তাঁর। অকৃপনভাবে তাঁর মহত্ত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং তা কাগজের শুভ্রতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কালি আর কলমের নিখাঁদ প্রেমময় আঁচড়ে। ভিন্ন ধর্মের স্বনামধন্য ব্যক্তিগণ তাঁর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ না করেও তাঁকে মহামানবের স্বীকৃতি দিয়েছেন অকপটে এবং অবলীলায়। বিশ্বের ঘোর দুর্দিনে, মানবজাতির মুক্তির জন্য, বিশ্বের কল্যানের জন্য - তাঁর মতো মহান নেতার পুনরাগমনের স্বপ্ন দেখেছেন তারা। তাঁর আগমনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সশ্রদ্ধচিত্তে।

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন ধরণের জীবনী গ্রন্থ রচিত হয়েছে এ যাবতকাল। প্রচলিত ধারার জীবনীগ্রন্থ থেকে শুরু করে বিশেষায়িত গবেষণাগ্রন্থ - সব ধরণের গ্রন্থই লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে। এসব গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল এবং ব্যাপক। সংখ্যায় গণনা করে তালিকাবদ্ধ করাও রীতিমত দুষ্কর। একজনই মানুষ তিনি, একটিই জীবন তাঁর, একটি জীবনেরই কাহিনী— ঘুরে ফিরে এসেছে হাজারও লেখকের লেখায়, হাজারও সাহিত্যিকের শব্দগাঁথায়, হাজারও কবির কাব্যমালায়, হাজারও দার্শনিকের ছন্দিত স্তবকে; মক্কার নিভৃত সেই কুরাইশ পরিবারে পিতৃহীন অবস্থায় শুভজন্ম, তায়েফের বনূ সাদ গোত্রের বিদূষী নারী হালিমাতুস সা'দিয়া রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার কোলে শৈশবকালের দিনগুলো, চার বছর বয়সে মায়ের কোলে ফিরে আসা অতঃপর মাত্র ছয় বছরে মাতৃবিয়োগ, পরম স্নেহবৎসল দাদার বুকে আশ্রয়লাভ অতঃপর মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে আট বছর বয়সে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের তিরোধান, অতঃপর পিতৃব্য আবু তালিবের স্নেহছাঁয়ায় বেড়ে ওঠা, তাঁর সাথে সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলায় গমন, অলৌকিক চেহারা দর্শনে বুহাইরা পাদ্রীর নবুয়তের সাক্ষ্য প্রদানপূর্বক ভবিষ্যত বাণী প্রদান, মক্কার স্বজাতীয়দের দ্বারা আল-আমিন উপাধিলাভ, সমাজ হিতৈশী সংগঠন হিলফুল ফুজুল গঠন, মক্কার বিদূষী রমনী খাদিজাতুল কুবরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার সাথে প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, হেরা পর্বতের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক ধ্যানমগ্নতা, মক্কার পাথুরে পথে যাতনাময় দাওয়াতের সেই দিনগুলো, তায়েফের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবয়ব, মক্কাবাসীদের সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়নে হিজরতের পথে মদিনায় যাত্রা, প্রতিরোধ এবং আত্মরক্ষামূলক রক্তক্ষয়ী বদর, উহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধ, মিরাজের রজনীতে আল্লাহ তাআলার দিদারলাভে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বজগতে গমন ও পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তন, বিনা রক্তপাতে শান্তিপূর্ণভাবে ঐতিহাসিক মক্কা বিজয় এবং বিশ্বের ইতিহাসে বিরল সাধারণ ক্ষমার ঐতিহাসিক ঘোষনা, লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম সমভিব্যহারে বিদায় হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নকরণ - এই একই কথাগুলো, এই একই ঘটনাপরম্পরা, এই অপার স্নিগ্ধতার মুগ্ধকর অবাক করা কাব্যকথা বহুজনের বহুমুখে বহুভাষায় বহুশতাব্দী ধরে কাগজের বুকে ঠাঁই করে নিচ্ছে ক্রমশঃ, নিত্য নতুন ভিন্নতায়, নিত্য নতুন মাত্রা-পরিমাত্রায়, আজ অবদি ইথারজুড়ে ঘুরে ঘুরে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে রাসূল স্তুতির হৃদয় জুড়ানো কথামালা, তবু যেন অফুরান, তবু যেন অব্যক্ত রয়ে গেছে কত কথা, এ যেন ঠিক কিছু লেখা হলো আর অলিখিত রয়ে গেল আজ অবদি ঢের, কিছু বলা হলো আর অনেক কিছুই হয়নি বলা এখনও, আজও পর্যন্ত।

বিশ্বজনীন সিরাত চর্চার প্রয়োজনীয়তাঃ

বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত, সত্যালোকে উদ্ভাসিত হৃদয়ে ঈমানের অস্তিত্ব নবুওয়তের সূর্যেরই প্রতিবিম্ব ও আলোকরশ্মি। আলোকরশ্মি যেমন সূর্য থেকে বেরিয়ে এসে গোটা জগতকে আলোকিত করে, তেমনি ঈমানের বাণী নবী রাসূলগণের মাধ্যমে বিশ্বাসীদের কাছে পৌঁছে তাদের হৃদয়কে আলোকোদ্ভাসিত করে থাকে। প্রথম মানব এবং প্রথম নবী হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত যুগে যুগে বহু নবী-রাসুল পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁরা সকলেই ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا

‘আমি সকল সম্প্রদায়ের কাছে নবী প্রেরণ করেছি।’ -সুরা নাহল: ৩৬

তারা সবাই এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসী ছিলেন এবং উম্মাহর মাঝে এ বিশ্বাস স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং প্রিয়নবী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যুগের মধ্যবর্তী সময়ে যদিও শত সহস্র বছরের ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু সবার মিশন আর লক্ষ্য ছিলো আল্লাহর একাত্মবাদকে জগতে প্রতিষ্ঠা করা। তাওহিদের শিক্ষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَـٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘তারা আদিষ্ট ছিলো একমাত্র মাবুদের ইবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যা শরীক সাব্যস্ত করে তা থেকে তিনি পবিত্র।’ -সুরা তাওবা: ৩১

বিশ্বাসী ব্যক্তি ঈমানের বৈশিষ্ট্যের গুণে গুণান্বিত। আর ঈমানের এই দাওয়াতের দায়িত্বই যুগে যুগে পালন করেছেন নবী-রাসূলগণ। তাই তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা নিজে নিয়ন্ত্রণ করেছেন নবী-রাসুলগণের সকল ক্রিয়াকর্ম। বরং পৃথিবীর মানুষকে একটি আদর্শ, একটি জীবন দর্শন শিক্ষা দেয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বিশাল কাফেলা। মহান আল্লাহ তাআ'লা ইরশাদ করেন,

وَاجْتَبَيْنَاهُمْ وَهَدَيْنَاهُمْ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

‘তাদের আমি নির্বাচিত করেছি, সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছি।’ -সুরা আনআম: ৮৭

নবী-রাসুলগণ নিজেদের চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি সততা, সৎকর্মপরায়ণতা ও কল্যাণ প্রতিযোগিতায়ও ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। যিনি কল্যাণের বার্তা বয়ে আনেন, তিনিই হলেন সে কল্যাণের মূর্ত প্রতীক। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

وَكُلًّا جَعَلْنَا صَالِحِينَ

‘তাদের সবাইকে বানিয়েছি সৎকর্মপরায়ণ।’ -সুরা আম্বিয়া: ৭২

নবুওয়াত ও রিসালাত ছাড়া মানবতার প্রকৃত বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। মানুষের পক্ষে প্রকৃত পথের সন্ধান প্রাপ্তিরও সুযোগ নেই। এ কারণেই আল্লাহ তাআ'লা মানবজাতির প্রথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তারা চেয়েছেন কেবল বিশ্ব মানবতার কল্যাণ। বিশ্ব মানবতার কল্যান চিন্তায় তাদের অন্তর ব্যথিত হতো। আর এসব গুণের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পবিত্র কুরআনে যেসব আদেশ প্রদান করা হয়েছে, তাতে প্রায়শঃই দেখা যায়, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে। বস্তুতঃ পরোক্ষভাবে মুসলিম উম্মাহ এমনকি, কোন কোন ক্ষেত্রে গোটা মানবজাতিকে সেসব নির্দেশের আওতাভূক্ত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য,

فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَن تَابَ مَعَكَ

‘আপনি সঠিক পথে দৃঢ় থাকুন যেমন আপনাকে আদেশ করা হয়েছে এবং যারা তাওবা করে আপনার সাথী হয়েছে, তারাও যেন সঠিক পথে চলতে পারে।’ -সুরা হুদ: ১১২

তাই সুপথের সন্ধানপ্রার্থী প্রত্যেকের জন্য জরুরি হলো, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাত সম্পর্কে জানা। যেন তাঁর অনুপম আদর্শ অনুসরণ করে নিজের সুপথপ্রাপ্তি সহজ হয় এবং অন্যকে তাঁর দেখানো পথের দিকে আহবান করা যায়।

মহান রাব্বুল আলামিন সুরা হুদ- এ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ববর্তী নবীগণ এবং তাদের জাতিসমূহের দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ও অবস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উম্মাহর হেদায়াতের বর্ণনা। অবশেষে নবী রাসুলদের ঘটনা বর্ণনা করার কারণ ও হেকমত উল্লেখ করেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَكُلًّا نَّقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ ۚ وَجَاءَكَ فِي هَـٰذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ

‘আর আমি রসুলগণের সব বৃত্তান্তই আপনাকে বলছি, যদ্বারা আপনার অন্তরকে মজবুত করছি। আর এভাবে আপনার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসিহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে।’ -সুরা হুদ: ১২০

অর্থাৎ, যেন এসব ঘটনা শোনার মাধ্যমে তোমাদের অন্তরে ঈমানি শক্তি, স্বস্তি ও স্থিরতা সৃষ্টি হয়। তোমাদের অন্তর ঈমানের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং সত্য বিষয়টি তোমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে উদ্ভাসিত হয়। শুধু তাই নয়, অনেক সুরার নামকরণ নবী রাসুলগণের নামে করা হয়েছে এবং তাতে তাদের সিরাত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন: সুরা ইউসুফ, সুরা হুদ, সুরা ইউনুস, সুরা ইবরাহিম ইত্যাদি। এতে বোঝা যায়, নবী-রাসুলের সিরাত বা জীবনী চর্চা করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনচরিত চর্চার দ্বারা প্রিয় নবীজির মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণাঙ্গতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাহাবায়ে কেরামের পরিচয়ও জানা যাবে। আর এর মাধ্যমে ঈমানি শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অসংখ্য আয়াত ও হাদিসের মর্ম বুঝে আসবে।

ইসলামবিদ্বেষী শক্তিও যে সত্যকে অকুন্ঠচিত্ত্বে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেঃ

এই গুরুত্বের কথা অনুভব করে মুসলিম উম্মাহ প্রাথমিক যুগ থেকেই মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাত সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারে অক্লান্ত সাধনা করে এসেছেন। তাদের ঐ সাধনার কথা বিশ্বে অমুসলিম মনীষীরাও অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। মারগোলিয়াথ -এর মত ইসলামবিদ্বেষী প্রাচ্যবিদ বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘মুহাম্মদের জীবনীকারদের দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে। এটা গুণে শেষ করা অসম্ভব। তবে ফিরিস্তিতে নিজের স্থান করে নেয়া গৌরবের ব্যাপার।’ -খুৎবাতে মাদ্রাজ: সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী

ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, রাসূল প্রেমী অসংখ্য মুসলিম সিরাত সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজকে নিজেদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই মহান ব্রত পালন করতে গিয়ে তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। দেশের পর দেশ ভ্রমন করেছেন।

এমন বিপুল আয়োজনে চিরকাল আর কাকে মনে রেখেছে বিশ্ব?

দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী নিজেদের নবী, ধর্ম প্রবর্তকদের জীবনচরিত ও ইতিহাস লিখেছে। এটা বহুকালের প্রচলিত একটি ধারা। তবে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, অধিকাংশের কাছেই তাদের কাছে তাদের আসমানী গ্রন্থ বা সহীফা অবিকল সংরক্ষিত নেই। বরং তাদের এতটুকু জানা নেই যে, ঐ আসমানি গ্রন্থ কার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং কী কী বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। এমনকি তারা যাকে নিজেদের ইমাম, পথপ্রদর্শক ও অনুসরণযোগ্য মনে করেন, সেই অনুসরণীয় ব্যক্তির জীবনের সামান্য তথ্যাদিও তাদের হাতে নেই। সেক্ষেত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত তো দূরর কথা। তারা তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের জীবনের একটি বাক্যও বিশুদ্ধভাবে পেশ করতে ব্যর্থ হন, যা নির্ভরযোগ্য এবং সুস্পষ্ট প্রমাণ ভিত্তিক বা যার বর্ণনার ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের লক্ষ-কোটি শুকরিয়া যে, এই গৌরব, এই মর্যাদা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উম্মতদের তিনি দান করেছেন। তারা তাদের প্রিয়তম রাসূল নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর প্রতিটি কথা, কর্ম ও মুহূর্তের বর্ণনা নির্ভরযোগ্য ধারাবাহিক সনদে সংকলন ও সংরক্ষন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত আগত পৃথিবীবাসীর জন্য পথচলার পাথেয় হয়ে থেকে যাবে।

গোটা বিশ্ববাসীর জন্য তিনি রহমতঃ

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তার আদর্শকে উম্মতের জন্য অনুসরণযোগ্য ঘোষণা করার পর থেকেই তার জীবনচরিত সংরক্ষিত হতে থাকে। এ কাজে তারা এতটা নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন যে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মপ্রবর্তক ও প্রচারকদের জীবন বৃত্তান্ত ও বাণী সংগ্রহ এবং সংকলনের কাজে এমন নিখুঁত সতর্কতা ও বর্ণনাকারীদের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা রক্ষা করার এমন সুনিপূন আয়োজনের দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই।

সিরাত কি?

সিরাত একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ নিয়মাবলী, জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার ব্যবহার, জীবনচরিত ইত্যাদি। সাধারণ অর্থে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর আচার-আচরণ, জীবনযাপন প্রণালী তথা জীবনচরিতকে বোঝায়। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মূল সিরাত হলো, তার বিশাল হাদিস ভান্ডার। তবে প্রাথমিক যুগের মনীষীদের মতে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সরাসরি অংশগ্রহণ করা যুদ্ধসমূহ এবং তাঁর প্রেরিত যুদ্ধাভিযানসমূহের সমষ্টিকে সিরাত বলে। বরং তাদের মতে সিরাত হলো, সিরাত, আদব, তাফসীর, আকাইদ ইত্যাদি আটটি বিদ্যার সমষ্টির নাম। সে হিসেবে সিরাত ইলমে হাদিসের একটি অংশ। তবে এখনকার সময়ের পন্ডিত মনীষীরা সিরাত বলতে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিতকে আখ্যায়িত করেছেন। -সীরাতে মুস্তফা (সা.) : আল্লামা ইদরিস কান্ধলবী (রহ.)

সিরাত চর্চার সূচনা করেন সাহাবায়ে কেরামঃ

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাত সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম ও শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ীগণ রহমাতুল্লাহি আলাইহিম। তারা সাহাবাদের জীবদ্দশাতেই দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের কাছ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর প্রতিটি বাণী, কাজকর্ম এমনকি প্রিয় নবীজী সম্পর্কিত প্রতিটি ঘটনা পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করে পরবর্তীদের জন্য সংরক্ষন করে গেছেন। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর একেবারে সূচনার দিকে হাদিস গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু হলে তখন থেকে বেগবান হয় সিরাতের ব্যাপক অনুসন্ধান ও চর্চা। এ ক্ষেত্রে উমর বিন আবদুল আজিজ রহমাতুল্লাাহি আলাইহি হলেন সিরাত চর্চার অন্যতম একজন সফল রূপকার। সিরাত চর্চার সেই যে সূচনা হয়েছিলো তা অদ্যাবধি চলছে এবং চলবে অনাদিকাল পর্যন্ত। সিরাত চর্চার আলোকধারা বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো ইমাম বোখারি রহমাতুল্লাাহি আলাইহি, ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাাহি আলাইহি, ইমাম তিরমিজি রহমাতুল্লাাহি আলাইহি, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাাহি আলাইহি প্রমুখ মহান হাদিস সংকলকের অনবদ্য এবং বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহ সংকলনের মাধ্যমে।

সিরাত চর্চার ধারাবাহিকতাও অব্যাহত থাকবেঃ

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাত চর্চা তার নবুওয়াতলাভের পর থেকেই অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতে থাকবে। আর নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে, তাঁর সম্পর্কে কোনো প্রকার ভুল ব্যাখ্যা কিংবা অপব্যাখ্যা উপস্থাপন অথবা, সত্যের সামান্য অপলাপ করার সুযোগ আদৌ কারও নেই। মুসলিম সিরাত চর্চাকারীগণ এ সুযোগ কাউকে দিবেন না, বরং প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সীরাত সম্পর্কে লাখো গ্রন্থ মুসলিম লেখকরা রচনা করেছেন এবং করছেন। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সীরাত বিষয়ক প্রতিটি গ্রন্থ অন্যান্য নবীর জীবনচরিত সংক্রান্ত গ্রন্থগুলোর তুলনায় অধিক স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও ঐতিহাসিক। তার জীবনচরিতকে অগণিত মানুষ শুনছে ও পাঠ করছে। এর ধারাবাহিকতাও অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতেই থাকবে।

সিরাত চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাত চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সর্বকালে সর্বযুগে এই জন্য রয়েছে যে, তিনি ছিলেন ইসলামের সর্বশেষ নবী। মানবজাতির কল্যাণের প্রতীক হয়ে আগমন করেন এই ধরণীতে। বিশ্ববাসীকে আহ্বান করেন কল্যাণের পথে, বিরত রাখেন সমূহ অকল্যাণ থেকে। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর বিমূর্ত সত্তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তার অনুসারীদের সরাসরি আল্লাহর অনুসরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এসেছে,

مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ

যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করলো, সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করলো। -সুরা নিসা: ৮০

অন্য আয়াতে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুসরণ ও অনুকরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেই তা হবে কুফরি। কুফরের সঙ্গে জড়িত কাউকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন না। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-

قُلْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ فإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ

‘(হে রাসুল!) আপনি বলে দিন, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ কর। আর যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না।’ -সুরা ইমরান : আয়াত ৩২

আয়াত নাজিলের কারণঃ

সুরা আল-ইমরানের ৩২ নং আয়াতটি শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করেই ঘোষণা করা হয়নি বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকেও সম্বোধন করা হয়েছে।

কেননা আগের আয়াতেই আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।’ -সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১

আয়াত দু'টিতে রয়েছে গভীর সামঞ্জস্য। বিশ্বনবির আনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই আল্লাহ তাআ'লার আনুগত্য শামিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের মাধ্যমেই মহান আল্লাহর আনুগত্য করা যায়। কেননা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নিয়ে বিশ্ব মানবতার সামনে উপস্থিত হয়েছেন।

প্রিয় নবীজী ছিলেন আল কুরআনের অবিকল প্রতিবিম্বঃ

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কুরআনের অবিকল প্রতিবিম্ব। পবিত্র কুরআনের বাস্তব ও সার্থক রূপায়ণ ছিলো তাঁর গোটা সিরাত বা জীবনচরিত। তাঁর ইন্তিকালের পর উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়শা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে জিজ্ঞেস করা হলো, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর চরিত্র কেমন ছিলো? তিনি একবাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, প্রিয় নবীজির চরিত্র ছিলো আল-কুরআন। অর্থাৎ, আল-কুরআনে যে ধরণের উত্তম আচার-আচরণের অধিকারী হতে আদেশ উপদেশ দেয়া হয়েছে এবং যে প্রকারের উন্নত ও প্রশংসনীয় স্বভাব-চরিত্র গঠন করতে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, সেসবের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। এর প্রমান পাওয়া যায় মহাগ্রন্থ আল কুরআনে। মহান রাব্বুল আলামিন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর অনুপম চরিত্র মাধুর্য ও সর্বোত্তম জীবনাদর্শের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

‘আল্লাহর রাসুলের জীবনই হলো তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শের নমুনা।’ -সুরা আহজাব: ২১

শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মানে সিরাতচর্চা অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গঃ

পবিত্র কুরআনে যত সুন্দর, সত্য, সততা, মানবতা ও কল্যাণময় গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে, তার নিখুঁত ও পরিপূর্ণ চিত্রায়ন ঘটেছিলো প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবনাদর্শে। মানব সমাজের উন্নতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও চারিত্রিক সকল ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো অনুসরণীয় আদর্শ। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না। তাই আজকের এই করুণ ও অবক্ষয়ের মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, হারানো গৌরব, অতীতের সম্মান ও মর্যাদা- তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাত বা পবিত্র জীবনচরিত। সুতরাং, সেই আলোকিত পথেই হোক আমাদের যাত্রা। নবুয়তের আলো ঝলমলে পথে চলেই আবার আমরা ফিরে পাব আমাদের বিস্মৃত সোনালী অতীত। শ্রেষ্ঠতম নবীর সর্বোত্তম আদর্শের ছায়াতলে একত্রিত হয়ে আবার আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হব সাম্য, মৈত্রী এবং শান্তির প্রাণবন্ত এক নতুন পৃথিবী। আর এর জন্যই আমাদের অধ্যয়ন করতে হবে সিরাত। সিরাতুন্নাবাবিয়্যাহ তথা নবী জীবনী যদি হয়ে ওঠে আমাদের নিত্যপাঠ্য আর নিত্যচর্চার অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ, তাহলেই কেবল এটা সম্ভব।

প্রিয় নবীজীর সীরাত রচনার প্রাথমিককালঃ

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চরিত্র মাধুর্য্য কেমন ছিল? তাকে জানার, চেনার এবং বুঝার উপায় কি? এ সম্পর্কে তাঁর জীবনসঙ্গী উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা –এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন,

كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ

কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র। -ইমাম বুখারি, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ৩০৮, সুনানে নাসাঈ এবং মুসনাদে হাকিমও তাদের স্ব স্ব গ্রন্থে এই হাদিস বর্ণনা করেছেন

তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানার প্রথম উৎস পবিত্র কুরআনুল কারিম। কুরআনুল কারিমজুড়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই নবী জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির ছায়া প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, যুদ্ধের নানান অনুষঙ্গ, অথবা, নবীর স্ত্রীর নির্দোষিতা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে তখনকার ঘটনার আলোকে। কুরআনের প্রাচীন তাফসির ও কুরআন নাজিলের প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিস এবং হাদিসের বিচ্ছিন্ন সংকলনগুলোতে তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা বিধৃত হয়েছে। সেকালে রচিত ইতিহাসের আধার ও উপাদানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নবীজীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ধারাবাহিক জীবনী রচনার উন্মেষ ঘটেছে তাঁর ইন্তেকালের অন্ততঃ অর্ধ শতাব্দিকাল পরে। কেননা নবীজি তখন নিজেই তাঁদের সামনে ছিলেন। এমনকি দূরে বা কাছের যাঁরা তখনো দেখেননি তাঁকে, তাঁদেরও সবার যেন একবার অন্ততঃ দেখার সুযোগ হয়ে যায়, তাই তিনি বহু আগেই বিদায় হজের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর তিরোধানের পর পরবর্তী প্রজন্মও সাহাবিদের এমন একটি বিরাট দলের সান্নিধ্য পেয়েছেন, যাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ইবাদত ও কাজকর্ম মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর আদর্শ মেনে বাস্তবায়িত হতো। তারপর সময়ের দূরত্ব যত বাড়তে থাকে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জানার কৌতূহল বিশ্ববাসী মানুষের মাঝে ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি কেমন ছিলেন—এই প্রশ্নের আধিক্য মহানবীর জীবনকাহিনী রচনার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রজন্মান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখা ও তাঁকে জানার প্রবল ইচ্ছার কথা কি তিনিও জানতেন? যেমন, তিনি বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ مِنْ أَشَدِّ أُمَّتِي لِي حُبًّا نَاسٌ يَكُونُونَ بَعْدِي يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ رَآنِي بِأَهْلِهِ وَمَالِهِ ‏"‏ ‏.‏

‘তোমাদের পরে উম্মতের মধ্যে আমার প্রতি এতটা ভালোবাসাসম্পন্ন লোক আসবে, যারা তাদের সম্পদ-পরিজনের বিনিময়ে হলেও আমাকে দেখতে চাইবে।’ -মুসলিম, সহিহ, হাদিস: ২৮৩২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৮৮২, ইসলামিক সেন্টার ৬৯৩৯, হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৭০৩৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৮৩২

তো জীবিত সাহাবিগণ নবীজির বিবরণ তুলে ধরা শুরু করলেন, কখনো সংক্ষেপে, কখনো সবিস্তারে, আবার কখনোবা আংশিক। এভাবেই একসময় ধারাবাহিক জীবনী সংকলনের বিষয়টি সামনে চলে আসে।

সিরাতে সরওয়ারে আলমের দুটি দিক : ‘সিরাত’ এবং 'শামায়েল'ঃ

মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনী আলোচনার প্রধানতম দুটি বাহু রয়েছে। একটি হলো ‘সিরাত’; যাকে ‘সিয়ার’ ও ‘মাগাজি’ও বলা হয়। সিরাত মানে জীবনী। আমরা মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনীর যে সাধারণ ধরনটি দেখি, অর্থাৎ, জন্ম থেকে তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ঘটনাবলির বিবরণ সেটিই ‘সিরাত’ নামে পরিচিত এবং এ জাতীয় গ্রন্থকে সাধারণত সিরাতগ্রন্থ বলা হয়।

সিরাত বিষয়ক বিখ্যাত কিছু গ্রন্থঃ

সিরাত বিষয়ক প্রচুর সংখ্যক কিতাব এ পর্যন্ত লেখা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এবং বিখ্যাত কিতাবগুলোর মধ্যে কয়েকটি-

০১। ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হি.) রচিত ‘সিরাতে ইবনে ইসহাক’
০২। ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) লিখিত সিরাতগ্রন্থ ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’
০৩। মুসা ইবনে উকবার (মৃ. ১৪১ হি.) রচিত সুবিশাল সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’
০৪। মুহাম্মাদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল মাগাজি’
০৫। জারির ইবনে তাবারির ( মৃ. ৩১০ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল উমাম’
০৬। ইমাম নববির (মৃ. ৬৭৬ হি.) ‘তাহজিবুস সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’,
০৭। ইমাম জাহাবির (মৃ. ৭৪৮ হি.) ‘আল-মাগাজি’,
০৮। ইবনুল কাইয়্যিম জাওজির (মৃ. ৭৫১ হি.) ‘জাদুল মাআদ’
০৯। ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’
১০। আহমদ ইবনে আলী মাকরিজির (মৃ. ৮৪৫ হি.) ‘ইমতাউল আসমা বিমা লিররসুলি মিনার আবনা’
১১। ইবনে হাজার আসকালানির (মৃ. ৮৫২ হি.) ‘মুখতাসারুস সিয়ার’;
১২। শিহাবুদ্দিন কাসতালানি (মৃ. ৯২৩ হি.) লিখিত ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা’,
১৩। নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’,
১৪। আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’
১৫। সফিউর রহমান মোবারকপুরির (মৃ. ২০০৬ ইং) ‘আর রাহীকুল মাখতুম’
১৬। আল্লামা বুরহানুদ্দিন হালাবির (মৃ. ১০৪৪ হি.) বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ ‘ইনসানুল উয়ুন ফি সিরাতিল আমিনিল মামুন’, যা ‘সিরাতে হালাবিয়া’ নামে পরিচিত।

অপরটিকে বলা হয় শামায়েল। নবীজির দৈহিক গঠন, আকার-আৃকতি, আচার-আচরণ ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা সম্বলিত সংকলনকে বলে ‘শামায়েল’। মূলতঃ সিরাত রচনা যখন থেকে শুরু হয়, শামায়েল রচনার ধারাটা শুরু হয় তারও কিছুটা পরে। প্রাথমিককালের শামায়েল গ্রন্থকারকগণ তাদের গ্রন্থাবলীতে কেবল নবীজির দৈহিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করার মধ্য দিয়ে প্রিয় নবীজীর অবয়ব-প্রকৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। তারা তাদের এ প্রয়াসকে এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তৃত আকারে, বিষয়াবলীর পরিবিস্তৃতিতে এর কলেবর আরও বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালের শামায়েল গ্রন্থাকারদের রচনায় নবীজির আচার-আচরণ, ইবাদত-বন্দেগি, বিনয়-কোমলতা—এভাবে তাঁর ব্যক্তি জীবনের সব দিক ও বিভাগ উল্লেখ করা হতে থাকে।

শামায়েলবিষয়ক বিখ্যাত কিছু গ্রন্থঃ

শামায়েলবিষয়ক অনেক কিতাব এ যাবত লেখা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এবং বিখ্যাত কিতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-

০১। ইমাম তিরমিজির (মৃ. ২৭৯ হি.) ‘শামায়েল তিরিমিজি’,
০২। ইমাম বাগাবির (মৃ. ৫১৬ হি.) ‘আল আনওয়ার ফিশ শামায়েল’,
০৩। ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-ফুসুল ফি সিরাতির রসুল’
০৪। জালালুদ্দিন সুয়ুতির (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘শামায়িলুশ শারিফা’
০৫। ইদানিংকালের সিরিয়ান লেখক সালেহ আহমাদ শামির (জন্ম ১৯৩৪) ‘মিন মায়িনিশ শামায়েল’, যা ইতিমধ্যে আকিক পাবলিকেশনস, ঢাকা থেকে ‘মুহাম্মাদ স.: ব্যক্তি ও নবী’ নামে অনুবাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

প্রথম যুগের রচনাবলিঃ

প্রথম মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনী রচনা করেন কে—এই সময়ে এসে তাঁর নিশ্চিত সন্ধান পাওয়া দুরূহ। ১০৯২ সালে সৌদি আরবের কিং সাউদ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়াহ ফি যাওইল মাসাদিরিল আসলিয়া’ এ-বিষয়ক একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। ড. মাহদি রিজকুল্লাহ আহমাদ তাতে চৌদ্দ শতকের মিসরীয় স্কলার ইবনে হাজার আসকালানির অভিমতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রথম তিনজন রচয়িতার নাম ও রচনার উল্লেখ করেছেন।

এক. সাহল ইবনে হাসমা (রা.)। তাঁর জন্ম তৃতীয় হিজরিতে। কৈশরে তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন এবং উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার আমলে (৪১-৬০ হি.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সেই জীবনীর বিভিন্ন অংশ মৌলিক সূত্র আকারে নবম শতকের ঐতিহাসিক বালাজুরি রচিত ‘আনসাব’, ইবনে সাদ রচিত ‘তাবাকাত’, তাবারি রচিত ‘তারিখে তাবারি’ এবং ওয়াকিদির বিভিন্ন রচনায় পাওয়া যায়।

গত শতকের প্রথম দিকে জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (মৃ. ১৯৩০ খ্রি.) বার্লিনে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের হাদিসবেত্তা ইউসুফ ইবনে কাজি শাহবাহ (মৃ. ১৩৮৭ খ্রি.) সংকলিত মুসা ইবনে উকবা বর্ণিত হাদিসগুলো ও ‘মাগাজি’র ২০টি অধ্যায়–সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং কিছু নির্বাচিত অংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে।

দুই. সাইদ ইবনে সাদ ইবনে উবাদা খাজরাজি। তাঁর রচনা ইবনে হাম্বল ও আবি-ইওয়ানার ‘মুসনাদ’ এবং তাবারির ‘তারিখে তাবারি’তে রয়েছে।

তিন. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (মৃ. ৭৮ হিজরি)। খ্যাতিমান তাফসিরবিশারদ সাহাবি। হাদিস ও সিরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর রচনা পাওয়া যায়। তাঁদের তিনজনের রচিত নবীজীবনী পুস্তকাকারে পাওয়া যায় না এবং পরবর্তী সময়েও সেই রচনাবলি কোথাও একত্রে সংকলিত হয়নি।

এদের পরের ধারাবাহিকতাঃ

তাঁদের পরে রচনাকর্মে হাত দেন উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) (মৃ. ৯২ হি.), সাদ ইবনে মুসাইয়িব মাখজুমি (মৃ. ৯৪ হি.), আবদুল্লাহ ইবনে কাব ইবনে মালেক (মৃ. ৯৭ হি.) ও খলিফা উসমানের (রা.) ছেলে আবান ইবনে উসমান (মৃ.১০৫ হি.), ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহ (মৃ. ১১০ হি.), ইবনে শিহাব জুহরি (মৃ. ১২০ হি.), শুরাহবিল ইবনে সাদ (মৃ. ১২৩ হি.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর ইবনে হাজাম (মৃ. ১৩৫ হি.)। কিন্তু উরওয়া, ওহাব ও জুহরির রচনা ছাড়া সব কটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিছু কিছু অংশমাত্র বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে টিকে আছে।

উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) ছিলেন সাহাবি আবু বকরের (রা.) বড় মেয়ে আসমার ছেলে। তিনি উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ও আল ওয়ালিদের সময়ে নবীযুগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে জানতে চাওয়া চিঠির জবাব লিখতেন। তাঁকে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর ‘প্রথম জীবনীকার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের খ্যাতিমান স্কলার ড. মুহাম্মাদ মুস্তফা আজমি (মৃ. ২০১৭ খ্রি.) তাঁর রচিত পুস্তিকাটির কেবল শেষভাগটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন—যা আবুল আসওয়াদ মিসরির বর্ণনায় পাওয়া যায় এবং ‘মাগাজি রসুলিল্লাহ স. লি-উরওয়াহ ইবনি জুবাইর বি-রিওয়াতি আবিল আসওয়াদ’ শিরোনামে রিয়াদ (সৌদি আরব) থেকে ১৯৮১ সালে প্রকাশ করেন। ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহর রচনার একটি অংশ বর্তমানে জার্মানির হাইডেলবার্গে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। আর ইবনে শিহাব জুহরির রচনা বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে কুড়িয়ে এনে ২ হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আওয়াজি এবং তা দুই খণ্ডে ‘মারাউইয়্যাত আল ইমাম জুহরি ফিল মাগাজি’ শিরোনামে ২০০৪ সালে মদিনা থেকে প্রকাশিত হয়।

সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থঃ

প্রাচীন সিরাত গ্রন্থের কথা উঠলেই সবাই এক নামে ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হি.) রচিত ‘সিরাতে ইবনে ইসহাক’কে চেনেন; যার ভিত্তিতে আবদুল মালিক ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) জনপ্রিয় সিরাতগ্রন্থ ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’ রচনা করেছেন। অথচ এর অন্তত এক যুগ আগে রচিত হয়েছে মুসা ইবনে উকবার (মৃ. ১৪১ হি.) সুবিশাল সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’ এবং তা এখনো অক্ষত আছে। একটি বর্ণনা অনুযায়ী ‘মুআম্মার ইবনে রাশেদ’র (মৃ. ১৫১ হি.) সিরাতগ্রন্থ ‘আল-মাগাজি’ও সিরাতে ইবনে ইসহাকের পূর্বে রচিত এবং তার কপিও দুর্লভ নয়। লেখকদের জীবনকালের তারতম্য থেকেও প্রাচীনত্বের বিষয়টি পরিষ্কার হয়। ইবনে ইসহাকের জন্ম ৮৫ হিজরি এবং মৃত্যু ১৫১ হিজরি। আর মুসা ইবনে উকবার জন্ম ৬৮ হিজরি এবং মৃত্যু ১৪১ হিজরি। সুতরাং অস্তিত্বের বিচারে ইবনে ইসহাক রচিত ‘সিরাত’ নয়—মুসা ইবনে উকবার ‘আল-মাগাজি’ সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থ।

গত শতকের প্রথম দিকে জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (মৃ. ১৯৩০ খ্রি.) বার্লিনে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের হাদিসবেত্তা ইউসুফ ইবনে কাজি শাহবাহ (মৃ. ১৩৮৭ খ্রি.) সংকলিত মুসা ইবনে উকবা বর্ণিত হাদিসগুলো ও ‘মাগাজি’র ২০টি অধ্যায়–সংবলিত একটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং কিছু নির্বাচিত অংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সময়ে প্রথমবারের মতো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে। এরপর মরক্কোর ইবনে জুহর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু মালিক মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন বাকিশিশ দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে বিভিন্ন প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে আরবি মূলপাঠ উদ্ধারে সক্ষম হন, এরপর প্রয়োজনীয় টিকা-ভাষ্য যুক্ত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক অনুষদ থেকে ১৯৯৪ সালে মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।

পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ সিরাতগ্রন্থঃ

হিজরি প্রথম ও দ্বিতীয় শতক ছিল নবী জীবনী রচনার প্রথম যুগ। তৃতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় যুগের সূচনা হয়। এই যুগই হলো নবীজীবনী রচনার স্বর্ণযুগ এবং ইতিহাসের ধুলোর আস্তর কঠিন হওয়ার আগেই ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ বিরাট বিরাট কলেবরের জীবনী ও ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেছেন। তৃতীয় শতকের শ্রেষ্ঠ রচনা হলো ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’, যার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ আলফ্রেড গিলিয়াম অনূদিত ইংরেজি সংস্করণ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হলে তা আধুনিক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষায়ও এর বেশ কয়েকটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই রয়েছে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল মাগাজি’ গ্রন্থটি। লেখক ‘ওয়াকিদি’ নামেই সমধিক পরিচিত, তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর এই গ্রন্থটির বিভিন্ন বর্ণনার ব্যাপারে ইসলামবেত্তা পণ্ডিতগণ বেশ ‘আপত্তি’ তুলেছেন। চতুর্থ হিজরি শতকে রচিত হয় ঐতিহাসিক জারির ইবনে তাবারির ( মৃ. ৩১০ হি.) ‘আত-তারিখ ওয়াল উমাম’ এবং আলী ইবনে হুসাইন মাসউদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) ‘মুরুজু আজ-জাহাব’, পঞ্চম হিজরি শতকে ইবনে হাজমের (মৃ. ৪৫৬ হি.) ‘জাওয়ামিউস সিরাহ’, ষষ্ঠ শতকে আবদুর রহমান সুহাইলি আন্দালুসির (মৃ. ৫৮১ হি.) ‘রওজুল উনফ’, সপ্তম শতকে প্রকাশিত হয় ইমাম নববির (মৃ. ৬৭৬ হি.) ‘তাহজিবুস সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’, অষ্টম শতকে তিনটি গ্রন্থ বিখ্যাত হয়—ইমাম জাহাবির (মৃ. ৭৪৮ হি.) ‘আল-মাগাজি’, ইবনুল কাইয়্যিম জাওজির (মৃ. ৭৫১ হি.) ‘জাদুল মাআদ’ ও ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’। এর মধ্যে ‘জাদুল মাআদ’ গ্রন্থটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ৬ খণ্ডে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নবম হিজরি শতকের দুটি বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ হলো ঐতিহাসিক আহমদ ইবনে আলী মাকরিজির (মৃ. ৮৪৫ হি.) ‘ইমতাউল আসমা বিমা লিররসুলি মিনার আবনা’ ও প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ইবনে হাজার আসকালানির (মৃ. ৮৫২ হি.) ‘মুখতাসারুস সিয়ার’; দশম শতকে শিহাবুদ্দিন কাসতালানি (মৃ. ৯২৩ হি.) লেখেন ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা’, এগারো শতকে রচিত হয় আল্লামা বুরহানুদ্দিন হালাবির (মৃ. ১০৪৪ হি.) বিখ্যাত সিরাতগ্রন্থ ‘ইনসানুল উয়ুন ফি সিরাতিল আমিনিল মামুন’, যা ‘সিরাতে হালাবিয়া’ নামে সমধিক পরিচিত।

এ যুগের রচনার সিংহভাগ রচিত হয়েছে আরবি ভাষায়, যদিও লেখকদের সবাই আরব ছিলেন, তা নয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের লেখা ও শেখার মাধ্যম আরবি হওয়ায় রচয়িতাগণ আরবি ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

আধুনিক যুগের বিষয়বৈচিত্রে অনন্য সিরাত রচনাসম্ভারঃ

ইসলামের ইতিহাসের এমন কোনো পণ্ডিত খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি নবীজীবনের ওপরে কলম ধরেননি। কারও কারও রচনা কলেবরে এতটাই বিরাট আকার ধারণ করেছে যে তা কয়েক হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে ‘সিরাত বিশ্বকোষ’ রচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ নবীজীবনের ওপর আরবি ভাষায় বিরাট কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবদ্দশাতেও তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশস্তিমূলক কাব্য রচিত হয়েছে বটে, তবে তা জীবনী আকারে ছিল না। ১২ হিজরি শতকে মাসউদ ইবনে মুহাম্মাহ আল-ফাসি (মৃ. ১১১৯ হি.) প্রথম কাব্যজীবনী রচনা করেন। গ্রন্থের নাম দেন ‘নাফাইসুদ দুরার ফি আখবারি সাইয়িদিল বাশার’। এরপর একইভাবে আহমদ বুখারি দিময়াতি (মৃ. ১৮৯২ ইং) রচিত ‘সাআদাতুত দারাইন’ এবং ইউসুফ ইসমাইল নাবহানি (মৃ. ১৯৩২ ইং) লেখেন ‘আন-নাজমুল বাদি ফি মাওলিদিশি শাফি’। বাংলা ভাষায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মরুভাস্কর’ লিখেছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনী নিয়ে চারটি পর্বে ১৮টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে রচিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ।

আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম কয়েকটি সিরাতগ্রন্থঃ

আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাতগ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’, ভারতের বিখ্যাত দায়ি আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সফিউর রহমান মোবারকপুরির (মৃ. ২০০৬ ইং) ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ আরবি বইটি ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামি আয়োজিত প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতায় ১১৮৭টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এটিকে সিরাতসংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহশালার একটি নির্যাসগ্রন্থ বলা যায়। মিসরীয় চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ আল গাজালি (মৃ. ১৯৯৬ ইং) রচনা করেন সিরাতবিষয়ক একটি বিশ্লেষণগ্রন্থ ‘ফিকহুস সিরাহ’। একই নামে সিরিয়ান শায়খ রামাদান আল-বুতিরও (মৃ. ১৯৯৬ ইং) একটি রচনা রয়েছে। এ ছাড়া আরবি ভাষায় লিখিত সিরাতের মধ্যে সাইয়েদ সোলাইমান নদভির ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়া’, শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ ‘খুলুকুন আজিম’ ও আলী সাল্লাবির ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়া আরজু ওয়াকায়ি ওয়া তাহলিলিল আহদাস’ উল্লেখযোগ্য।

উর্দু ভাষায় সিরাতচর্চাঃ

উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আরেকটি হলো স্বামী লক্ষ্মণ প্রসাদ লিখিত ‘আরব কা চান্দ’। গ্রন্থটির ভূমিকায় লেখকের পরিচয়ে বলা হয়েছে, লেখক একজন হিন্দু সাহিত্যানুরাগী যুবক; সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বাইরে এসে সত্যপ্রিয়তায় প্রাণিত হয়ে শেষ নবীর জীবনী লিখেছেন। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ফতেহাবাদ জেলার তোহানায় থাকতেন তিনি। ১৯৩৯ সালে ২৬ বছর বয়সে মারা যান। গ্রন্থটি পরে পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়।

উর্দু ভাষায় রয়েছে ভারতের শিক্ষাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘রসুলে রহমত’ ও শিবলী নুমানির ‘সিরাতুন নাবী’।

ইংরেজি ভাষার আলোচিত সিরাতগ্রন্থঃ

ইংরেজি ভাষার আলোচিত সিরাতগ্রন্থগুলো মধ্যে মার্টিন লিংগসের ‘Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources’, জামাল বাদাবির ‘Muhammad A Blessing For Mankind’, ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘Prophet of Revolution’, হোসাইন হায়কলের ‘Muhammad Rasulallah’, মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘Muhammad Rasulullah: A concise survey of the life and work of the founder of Islam’, সাইয়েদ হোসাইন নাসেরের ‘Muhammad, Man of God’, আদিল সালাহির ‘Muhammad: man and prophet, a complete study of the life of the Prophet of Islam’, ফেতুল্লাহ গুলেনের ‘The Messenger of God: Muhammad’ ও তারিক রামাদানের ‘The Messenger: the Meanings of the Life of Muhammad’ এবং ১৯৪২ সালে দ্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত মার্কিন অধ্যাপক নাবিয়া অ্যাবট এর ‘Aishah: the beloved of Mohammed’ উল্লেখযোগ্য।

অমুসলিম লেখকবৃন্দের সিরাতরচনাবলিঃ

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্রাচ্যবিদদের রচনায় বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থের নাম উঠে আসে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাতে মহানবী (সা.)–কে উপস্থাপন করার চেয়ে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে বেশি। ফিলিপ কে হিট্টি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। তাঁর রচিত ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন ‘ইসলাম ইন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার’। তিনি দেখিয়েছেন, ১৬৪৯ সালে সিউর ডিউ রায়ার কোরআনের ফারসি তরজমা প্রকাশ করেন। তার সঙ্গে মহানবী (সা.)–এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য যুক্ত করে Alcoran of Mahomet নামে প্রকাশ করেন। এই Mahomet হলো মুহাম্মদ (সা.)–এর বিকৃত রূপ। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে একই নামের ৪১টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৭৩৬ সালে ভলতেয়ার ‘মাহোমেত’ নামে একটি পাঁচ অঙ্কের প্রহসন রচনা করেন; যার পুরো শিরোনাম: Le fanatisme, ou Mahomet le Prophete (ধর্মান্ধতা বা মাহোমেত নবী)। নাটকের মাহোমেত [মুহাম্মদ (সা.)] চরিত্রটি ধর্মান্ধ, যে তাঁর সমালোচকদের হত্যার আদেশ দেয় এবং ‘পালমিরা’ নামে এক মেয়ের প্রেমে মত্ত হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেন্ট হেলেনাতে বন্দী থাকাকালে এই নাটকের কঠোর সমালোচনা করেন। ভলতেয়ার তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করেন এবং বলেন, ‘তিনি [মুহাম্মদ (সা.)] অবশ্যই খুব মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি মহান মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ছিলেন বিজয়ী বিধানদাতা, প্রজ্ঞাবান ও নেতা। সাধারণ মানুষের চোখে তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন।’

সিরাত চর্চায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পূর্বপুরুষ রেভারেন্ড জর্জ বুশঃ

১৮৩০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একজন পূর্বপুরুষ রেভারেন্ড জর্জ বুশ এ এম (১৭৯৬-১৮৫৯) লেখেন ‘The Life of Mohammed : Founder of the Religion of Islam and of the Empire of the Saracens’। কিসিঞ্জার লিগেছি রিপ্রিন্ট ১৮৩৩ সালে তা পুনঃপ্রকাশ করে এবং নতুন করে ২০০২ সালে লন্ডনে আবার ছাপা হয়। ১৮৪৩ সালে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাফ ওয়েইল লেখেন ‘Mohammed der Prophet, sein Leben und seine Lehre’, ১৮৫১ সালে অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ স্প্রেঙ্গার লেখেন ‘Aloys Sprenger, The Life of Mohammad, from Original Sources’, ১৮৫৮ সালে স্কটিশ লেখক উইলিয়াম মুর ৪ খণ্ডে লিখেছেন ‘The Life of Muhammad and History of Islam to the Era of the Hegira’। তবে ১৯৪৭ সালে আর ভি সি বোদলে লিখিত বিখ্যাত ‘The Messenger: the Life of Mohammed’ গ্রন্থটি বেশ প্রশংসা অর্জন করে, খ্যাতিমান স্কলার আলী নদভিসহ পরবর্তীকালের সিরাত গ্রন্থকারগণ এই গ্রন্থের রেফারেন্স ব্যবহার করেন। এমন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো উইলিয়াম মন্টোগোমেরি ওয়াট রচিত Muhammad at Mecca ও Muhammad at Medina.

আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকায় সিরাত চর্চাঃ

দুঃখজনক হলেও সত্য যে সভ্যতা ও আধুনিকতার দাবিদার ইউরোপের কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের অধিকাংশই মন ও মননে বড় হতে পারেননি সেদিনও। এই তো মাত্র কয়েকশো বছর আগের কথা। কালের কাটায় তখন ষোল শতক। ইসলাম ধর্মের মহান প্রবর্তক জগতের শ্রেষ্ঠ মানব মহানবীর 'মুহাম্মাদ' নামটি পর্যন্ত তারা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে কার্পন্য করতেন না। নবীজীর নামোচ্চারণের ক্ষেত্রে চরম বিকৃতি আর দৃষ্টিকটুপূর্ণ কটাক্ষ রীতিমত অভ্যাসে পরিনত হয়েছিল তাদের। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে সতেরো শতকের শুরুর দিকে। তখনকার একদল ইউরোপীয় লেখক নবীজীবন চর্চায় উন্মুক্ত মন এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য, ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা না থাকায় ওই সময়ও নবী চরিত্রে কালিমালেপনের বিষয়টি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন যে, তাদের এই মনোবৈকল্য এবং অন্য ধর্মের প্রবর্তকের প্রতি নিচ মানসিকতাপূর্ণ ঘৃণ্যতার ধারাবাহিকতার এক প্রকার পরিসমাপ্তি হয়েছে মূলতঃ আঠার শতকের শেষের দিকে এসে। বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে অব্যহত এবং অনবরত মিথ্যাচার, দুর্নাম আর অব্যাহত অপবাদের প্রতিবাদে তাদের ভেতর থেকেই উঠে আসেন একদল কবি-সাহিত্যিক এবং লেখক। তারা আত্মনিয়োগ করেন মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বন্দনায়।

বস্তুতঃ এ সময় থেকেই আধুনিক ইউরোপে উম্মুক্ত সিরাত চর্চার সূচনা হয়; যার পরিবিস্তৃতি পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে আমেরিকাতেও ঘটে। এই সময়ে ইউরোপ আমেরিকার অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব সিরাত চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন এবং এই ক্ষেত্রে সফলতায় অসামান্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। সতেরো শতকের পরের সময়কালকে ইউরোপ-আমেরিকার সিরাতচর্চার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা চলে। উচ্চ শিক্ষিতরা মাতৃভাষা ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষার ওপরও দক্ষতা অর্জন করেন। তারা আরবি গ্রন্থগুলো অনুবাদ করে মানুষের সামনে ইসলাম এবং বিশুদ্ধ নবীজীবন তুলে ধরেন। এ সময়ে ইউরোপে ইসলাম এবং ইসলামী সাহিত্যের জাগরণ এত বেশি পরিমাণে হয়েছে যে, ১৮৮০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত মাত্র ক’বছরেই ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৬০ হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচিত হয়। শুধু আমেরিকাতেই অর্ধশতকেরও বেশি ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আলহামদুলিল্লাহ, শত প্রতিকূলতার মাঝেও সেই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে; দিনকে দিন বরং বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে সিরাতের উপরে অসংখ্য কবিতা-প্রবন্ধ-বই এবং গবেষণাকর্মঃ

পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষায় আরবি গ্রন্থ অনুবাদের পাশাপাশি খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকরা রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর বন্দনায় রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা-প্রবন্ধ-বই এবং গবেষণাকর্ম। পশ্চিমা বিশ্বের মহাকবি খ্যাত দান্তে, গ্যাটে, পুশকিন নিজ নিজ কবিতায় মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আধুনিক ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট লেখেন- ‘মুহাম্মাদ কেবল আজীবন দানই করে গেছেন, কারো দান গ্রহণ করেননি।’

মহাকবি গ্যাটে তার কবিতায় মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘পাহাড়ের ঝর্ণা’ বলে উল্লেখ করেছেন। রুশ কবি পুশকিন রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন, যার শিরোনাম দিয়েছেন- ‘দ্য প্রফেট’। স্কটল্যান্ডের জনপ্রিয় সাহিত্যিক টমাস কার্লাইল ১৮৪০ সালের ৮ মে এক ভাষণে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেন, ‘একটি জাতি। নাম আরব জাতি। একজন মানুষ। নাম মুহাম্মাদ। যার শিক্ষা এবং সংস্কার আরবের গণ্ডি পেরিয়ে দিল্লি থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত জয় করেছে প্রতিটি দেশ ও জাতিকে।’

বহুবিবাহের অপত্তিতে ডেভেনের দাঁতভাঙ্গা জবাবঃ

ইউরোপীয় সাহিত্যসমালোচক ও প্রখ্যাত লেখক ডেভেন পোর্ট সিরাতের ওপর লেখা তার রচনায় বলেন, ‘পবিত্র বাইবেলে উল্লিখিত প্রতিশ্রুত ‘পারাক্লিত’ বা শান্তিদূত হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।’ পশ্চিমা লেখকরা রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর বহুবিবাহের রেশ টেনে তাকে ‘নারীলোলুপ’ অপবাদ দিলে ডেভেন পোর্ট কঠিন ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। তিনি যুক্তির আলোকে পশ্চিমাদের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, ‘২৫ বছরের যুবক মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছরের বিবাহিত নারী খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহাকে বিয়ে করেছেন। খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা -এর সাথে দীর্ঘ ২৫ বছর দাম্পত্য জীবনে তিনি আর কোনো নারীকে গ্রহণ করেননি। ৬৫ বছর বয়সে খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা যখন ইন্তেকাল করেন তখন রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর বয়স ছিল ৫০। ৫০-এর পর তিনি অন্যান্য স্ত্রীদের গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে সবাই ছিলেন বয়স্কা অথবা বিবাহিতা। একমাত্র আয়শা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা ছিলেন কুমারী। তাহলে একজন ‘নারীলোলুপ’ ব্যক্তির পক্ষে ৫০ বছর পর্যন্ত এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকার পর বয়স্কা এবং বৃদ্ধা মহিলাদের বিয়ে করা কী করে সম্ভব হয়? এরপর ডেভেন রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর বহু বিবাহের কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং সমালোচনার দাঁতভাঙা জবাব দেন।

‘চেম্বার এনসাইক্লোপিডিয়া’র অনন্য স্বীকৃতিঃ

পশ্চিমা বিশ্বের জনপ্রিয় একটি এনসাইক্লোপিডিয়ার নাম ‘চেম্বার এনসাইক্লোপিডিয়া’। সেখানে সিরাতের ওপর একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন করা হয়। প্রবন্ধের নাম ‘মিরাকল অব মুহাম্মদ’। প্রবন্ধে বলা হয়, ‘মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা, সংস্কৃতি-সভ্যতার যে সুবিশাল অট্টালিকার ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, তার সুফল এখন আধুনিক বাগদাদ, সিরিয়া, স্পেন, ইউরোপসহ পুরো বিশ্ব ভোগ করছে।’

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের অসাধারণ গবেষণা প্রতিবেদনঃ

১৯৭৪ সালের ১৫ জুলাই বিখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘একজন নেতার তিনটি গুণ থাকতে হয়। যেমন-

১. অনুসারীদের কল্যাণ কামনা করা।
২. একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা, যাতে করে অনুসারীরা সমাজবদ্ধ নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারে।
৩. অনুসারীদের জন্য সুনির্ধারিত বিশ্বাসমালা তৈরি করা, যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা জীবন পরিচালনা করে সফলতার স্বর্ণসিঁড়ি পার হবে।

দার্শনিক ও নেতাদের মধ্যে পাস্তর, সালক ছিলেন প্রথম গুণের অধিকারী। গান্ধী, কনফুসিয়াস, আলেকজান্ডার, সিজার, হিটলার ছিলেন প্রথম ও দ্বিতীয় গুণের অধিকারী। একমাত্র মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই ছিলেন তিনটি গুণের সফল সমন্বয়কারী আশ্চর্য মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ মহান নেতা এবং মানবতার ত্রাণকর্তা।’

মাইকেল এইচ হার্টের ‘দ্য হান্ড্রেড’ এ সর্বশীর্ষে মহানবীর নামঃ

সিরাত বা জীবনীকারদের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বে মাইকেল এইচ হার্টের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আধুনিককালে সিরাত চর্চায় তিনি বিশ্বখ্যাতদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ। বিশ্বের সেরা এক শ’ ব্যক্তির জীবনী নিয়ে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত বই ‘দ্য হান্ড্রেড’। এখানে তিনি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামটিকে সর্বশীর্ষে রাখেন এবং নিজের ধর্মের প্রবর্তক নবী ঈসা আলাইহিস সালামকে রাখেন দ্বিতীয় স্থানে। ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রথম এবং ঈসা আলাইহিস সালামকে দ্বিতীয় স্থানে দেখে অনেকেই আশ্চর্য হতে পারেন। সত্যি বলতে ইতিহাসে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও বৈষয়িক দুটো ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সফলতা লাভ করেছেন।’

‘মুহাম্মাদ : অ্যা বায়োগ্রাফি অব প্রফেট’; ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর অনবদ্য সিরাত গ্রন্থঃ

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ধর্মীয় বিষয়ের প্রধান ভাষ্যকার ক্যারেন আর্মস্ট্রং অতি সম্প্রতি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সিরাতের ওপর এক অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ‘মুহাম্মাদ : অ্যা বায়োগ্রাফি অব প্রফেট’। এ গ্রন্থে ক্যারেন আর্মস্ট্রং রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো বাস্তবতা এবং যুক্তির কষ্টিপাথরে খণ্ডন করে প্রমাণ করেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন অনুপম চরিত্রের অধিকারী অনন্য মানুষ।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকার নিবন্ধকার মার্টিন লিংসের ‘মুহাম্মাদ : হিজ লাইফ বেসড অন আর্লিয়েস্ট সোর্স’ চমৎকার একটি সিরাতগ্রন্থঃ

ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং ভাষাগত দিক থেকে উৎকর্ষ মানের সিরাত গ্রন্থের মধ্যে মার্টিন লিংসের ‘মুহাম্মাদ : হিজ লাইফ বেসড অন আর্লিয়েস্ট সোর্স’ প্রথম সারির অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৩ সালে লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বইটি পশ্চিমা বিশ্বে সিরাত চর্চায় নতুন অধ্যায় সূচনা করে। লেখক লিংস এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকাসহ একাধিক এনসাইক্লোপিডিয়ার নিবন্ধকার। ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তিনি মার্টিন লিংসের পরিবর্তে ‘আবু বকর সিরাজ’ নাম ধারণ করেন।

সিরাতচর্চায় পাশ্চাত্যের প্রাতঃস্বরণীয় আরও ক'জনঃ

পাশ্চাত্যের আরো অনেক লেখকই সিরাত চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- হাঙ্গেরির ড. জুলিয়াস জার্মান, স্যার টমাস আর্নল্ড, এডুইন আর্নল্ড; ফ্রান্সের লা মার্টিন, ড. এ বার্থারেন্ড, ডব্লিউ হুকিং, এডওয়ার্ড হেমিল্টন; ওলন্দাজের কবি ভ্যান মিল্টন, গাট সিমিপি; মার্কিন লেখক ও গবেষক জর্জ সারটেন, ড. মরিস এবং ড. স্টংগাচ প্রমুখ।

বাংলা ভাষার সিরাতচর্চাঃ

বাংলা ভাষায় সীরাত চর্চা ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। হযরত ওমর রা. এর যুগে আরব মুসলিম বণিকগণ এ দেশে আসেন। ১২০০ খৃষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক রাজা লক্ষন সেনকে পরাজিত করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকারের পর মুসলমানদের পৃষ্টপোষকাতায় বাংলা ভাষা স্ফিত হয়ে উঠে।

বাংলা ভাষাকে তিন যুগে ভাগ করা হয়। প্রচীন যুগ: ১০-১৩ শতাব্দী, মধ্যযুগ: ১৩-১৮ শতাব্দী, আধুনিক যুগ: ১৮- বর্তমান কাল।

প্রাচীন যুগে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরাতন বই রামাই পন্ডিতের “শূণ্য পুরাণ”। তিনি “নিরঞ্জন উস্মা” কবিতায় সর্বপ্রথম “মুহাম্মাদ” শব্দ উল্লেখ করেন।

মধ্যযুগে মুসলিম কবিগণ রাসূল প্রশান্তি মূলক কাব্য ও পূঁথি সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মাদ সগীরের “ইউসুফ জুলেখা” কাব্যে নবী বন্দনার অস্তিত্ব গৌরব দীপ্ত হয়ে উঠে। এরপর কবি সাইয়েদ সুলতান “নবী বংশ” নামে একখানা মহাকাব্য রচনা করেন। তখন ছিল কাব্য সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। কাব্যকেই সাহিত্যের মূল ধারা হিসেবে বিবেচিত করা হতো। তখনও গদ্য সাহিত্যের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা পায়নি।

আধুনিক যুগে বাংলা গদ্য সাহিত্য সমৃদ্ধশীল হয়। তখন রচিত হয় সীরাত বিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো, শেখ আব্দুর রহিম রচিত “হযরত মুহাম্মাদ”, রিয়াজুদ্দিন রচিত “হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সা.”, তসলিমুদ্দিন রচিত “সম্রাট পয়গাম”, মুন্সি বুরহানুল্লাহ ওরফে চেরাগ আলী রচিত “হায়াতুন্নবী”, শেখ ফজলুল করিম রচিত “নবীজীর যুদ্ধাবলী”, ড. মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ রচিত “শেষ নবীর সন্ধানে”, কবি গোলাম মোস্তফা রচিত “বিশ^নবী”, মাও: আকরাম খাঁ রচিত “মুস্তফা চরিত” ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালে বড় কাটরা মাদরাসার সাবেক শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা তফাজ্জল হোসাইন রচিত ও ড. মুজতবা হোসাইন সম্পাদিত “মুহাম্মাদ সা. : সমকালিন পরিবেশ ও জীবন” বইটি সীরাতের উপর এক অনবদ্য গ্রন্থ। বইটি জাতীয় সীরাত কমিটি কর্তৃক পুরুস্কৃত হয়।

বর্তমানে (বিভিন্ন ভাষা থেকে) অনুবাদ কর্ম সীরাত চর্চাকে আরো অনেক উর্ধে তুলে ধরেছে। বাংলায় প্রথম অনুদিত সীরাত গ্রন্থের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা কঠিন। তবে সীরাত অনুবাদ কর্মের জগতে মাওলানা মহিউদ্দিন খান রহ. ছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক চরিত্র। এক জরিপে জানা যায়, উর্দূ ভাষায় রচিত “সীরাতে মুস্তফা” গ্রন্থটি বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি কিতাব। ৩ খন্ডে সমাপ্ত এ সুবিশাল বইটি সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন খতীব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ.। বর্তমানে তার অনুদিত বইটি বাজারে পাওয়া না গেলেও “মদীনা পাবলিকেন্স” থেকে প্রকাশিত সীরাতে মুস্তফা বাজারে বিদ্যমান রয়েছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষক নাসির হেলাল রচিত “বাংলা ভাষায় সীরাত বিষয়ক প্রন্থপুঞ্জি” নামে একটি ১২০ পৃষ্ঠার বই রচনা করেছেন। এতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত ১০২৮টি সীরাত বিষয়ক বইয়ের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

বাংলা ভাষার সিরাতচর্চায় পিছিয়ে নেই অমুসলিমগণওঃ

বাংলা ভাষায় যাঁরা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনীগ্রন্থ লেখেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনই ইসলামের অনুসারী নন, তবু ভক্তি ও ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদনে তাঁরা মুসলিমদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। যদিও ১৮০২ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জনৈক লেখকের ‘মহম্মদের বিবরণ’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, কিন্তু তা ছিল কুৎসায় ভরপুর। তবে বাংলায় প্রথম যাঁর পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ সামনে আসে, তিনি হলেন রেভারেন্ড জেমস লং। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন খ্রিষ্টান, পরে মুসলিম হন। ১৮৮৫ সালে তা কলকাতার সত্যার্ণব প্রকাশনী থেকে ‘মুহাম্মদের জীবনচরিত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। একই বছর অতুল কৃষ্ণমিত্র লেখেন ‘ধর্মবীর মুহাম্মদ’ নামে একটি নাট্যজীবনী। ১৮৮৬ সালে কৃষ্ণ কুমার মিত্রের ‘মুহাম্মদ চরিত্র ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ প্রকাশিত হয় শ্যামা প্রেস, কলকাতা থেকে এবং গিরিশ চন্দ্র সেন লেখেন ৩ খণ্ডে ‘মহাপুরুষ মুহাম্মদের জীবনচরিত’। এরপর ১৯০৪ সালে রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেছেন ‘হযরত মুহাম্মদ ও হযরত আবু বকর’।

বাংলা সাহিত্যে নবীজিকে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন শেখ আবদুর রহীম (১৮৫৯-১৯৩১)। গ্রন্থটির নাম ‘হযরত মুহম্মদের স. জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’, ১৮৮৭ সালে ৪০৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ সিরাতগ্রন্থ হলো কলকাতা থেকে ১৯০৮ সালে ডা. সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত ‘মোসলেম পতাকা’, ১৯১৫ সালে কলকাতা থেকে শেখ মোহাম্মদ জমীর উদ্দীন রচিত ‘মাসুম মোস্তফা (সা.)’, ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে এয়াকুব আলী চৌধুরী রচিত ‘মানব মুকুট’, ১৯২৫ সালে মোবিনুদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর নগরী রচিত ‘নবীশ্রেষ্ঠ’, ১৯২৫ সালে কলকাতা থেকে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচিত ‘মরু ভাস্কর’, ১৯৪২ সালে চুঁচুড়া থেকে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’, ১৯৪৯ সালে ঢাকা থেকে খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ রচিত ‘শেষ নবী’, ১৯৫১ সালে ঢাকা থেকে মাওলানা আবদুল খালেক রচিত দুই খণ্ডের ‘ছাইয়েদুল মুরছালীন’, ঢাকা থেকে ১৯৬০ সালে মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচিত ‘নবী গৃহ সংবাদ’, ১৯৬৮ সালে শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন রচিত ‘হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন’। এ ছাড়া কবি আল মাহমুদ রচিত ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা রচিত ‘মহানবী’ ও ২০০২ সালে প্রকাশিত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ রচিত ‘বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’ অনন্য জীবনীগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।

নারী সিরাত রচয়ীতাদের অম্লান কৃতিঃ

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনীগ্রন্থ রচনার কাজটি ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে পুরুষদের হাতেই পরিপুষ্ট হয়েছে। তবে আধুনিক সময়ে বেশ কয়েকজন নারীর লিখিত গ্রন্থ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সবার ওপরে থাকবেন ক্যারেন আর্মস্ট্রং। তিনি ইংল্যান্ডের ওয়ারসেস্টারশায়ারের উইল্ডমুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন গির্জার নান। ১৯৯১ সালে তাঁর ‘Muhammad: A Biography of the Prophet’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনের যেসব ঘটনা নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনা ছিল, সেগুলোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে তাদের সমাজের উপমা উল্লেখ করেন। ২০০৬ সালে ‘Muhammad: A Prophet For Our Time’ নামে আরও একটি ননফিকশন গ্রন্থ প্রকাশ করেন।

তবে এর আগে ১৯৪২ সালে দ্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘Aishah: the beloved of Mohammed’। এই গ্রন্থের লেখক নাবিয়া অ্যাবট ছিলেন আমেরিকার একজন প্যাপিওরোলজিস্ট ও পুস্তিকাবিদ। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে প্রথম মহিলা অধ্যাপক নির্বাচিত হন। আরবি লিপি ও ইসলামের প্রাচীনতম লিখিত দলিলগুলোর উত্থানের বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর সহধর্মিণী আয়েশা (রা.)–কে কেন্দ্র করে লেখা হলেও এটি মূলত একটি সিরাতগ্রন্থ, যাতে হিজরতের পূর্ব থেকে আয়েশা (রা.)–এর মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসও সুনিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় প্রভাবশালী জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যানেমারি শিমেলের ৩৬৭ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ। শিরোনাম ‘And Muhammad Is His Messenger: The Veneration of the Prophet in Islamic Piety’। লেখক দীর্ঘদিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ লেখক লেসলি হাজলেটন (জন্ম ১৯৪৫) রচিত ‘The First Muslim: The Story of Muhammad’ নিউইয়র্ক টাইমস এডিটর্স বাছাইয়ে নির্বাচিত হয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালে ফরাসি লেখক হেলা ওয়ার্দি মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর জীবনের শেষের দিনগুলো নিয়ে রচনা করেন ‘Les Derniers Jours De Muhammad’ গ্রন্থটি, যা ইতিমধ্যে ‘মুহাম্মাদ ফি আইয়্যামিল আখিরাহ’ শিরোনামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

বাংলা ভাষায় নারী সিরাতগ্রন্থকারঃ

বাংলা ভাষায় নারী সিরাতগ্রন্থকারদের মধ্যে প্রথমে জায়গা করে নিয়েছেন সারা তাইফুর (জ. ১৮৯৩)। তাঁর লিখিত ‘স্বর্গের জ্যোতি’ গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৩৭১ বাংলা সনে বাংলা একাডেমি এর একটি সংস্করণ প্রকাশ করে। তাঁর পুরো নাম হুরায়ুন্নিসা সারা খাতুন। কাব্যিক গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের ভাষা সাবলীল। লেখিকা অত্যন্ত দরদ দিয়ে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। উল্লেখ্য, এ গ্রন্থ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি দিয়ে লেখিকাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। এরপর খাদিজা আক্তার রেজায়ি লেখেন ‘তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর’। তিনি ‘আর-রাহিকুল মাখতুম’র মতো কয়েকটি প্রাচীন ও মৌলিক সিরাতগ্রন্থ অনুবাদের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। ২০০৯ সালে মাসুদা সুলতানা রুমির সিরাতগ্রন্থ ‘আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি’ প্রকাশিত হয় ঢাকার রিমঝিম প্রকাশনী থেকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রবাসী লেখিকা মাজিদা রিফার ‘মহানবী’ প্রকাশিত হয় রাহবার প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। অসাধারণ গদ্যে রচিত তাঁর গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

একনজরে বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত কিছু সিরাতগ্রন্থঃ

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সিরাতর্চায় সহায়ক হবে বলে বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত উল্লেখযোগ্য কিছু সিরাতগ্রন্থের নাম এখানে তুলে ধরছি-

০১. সীরাতে খাতিমুল আম্বিয়া (সাঃ), হযরত মাও মুহা. মুফতি শফী প্রকাশক: এমদাদিয়া পুস্তকালয়।
০২. ওসওয়ায়ে রসূলে আকরাম (সা.), আরেফ বিল্লাহ ডা. মো আবদুল হাই রহ. অনুবাদ: আল্লামা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ., মদিনা পাবলিকেশন্স।
০৩. আর রাহীকুল মাখতূম, আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, অনুবাদ: খাদিজা আখতার রেজয়ী, প্রকাশক: আল কোরআন একাডেমী লন্ডন।
০৪. শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সা.), হযরত মাও: মুফতী শফী (র.), প্রকাশক: মাকতাবাতুল আখতার।
০৫. সীরাতে মুস্তফা, আল্লামা ইদ্রীস কান্দলভী রহ., প্রকাশক: মদীনা পাবলিকেশান্স।
০৬. সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
০৭. বাংলা ভাষায় সীরাত চর্চা, মুহাম্মদ আব্দুর রব, প্রকাশক: বশির ফাউন্ডেশন।
০৮. সীরাত বিশ্বকোষ, প্রকাশক: ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
০৯. শিশু-কিশোর সীরাতুন্নবী স. সিরিজঃ ১-১০ খন্ড, ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, প্রকাশক: মাকতাবাতুল আশরাফ।
১০. রাসুল (স.) এর ২৪ ঘন্টা, মুফতী আবুল কাসেম গাজী, প্রকাশক: পিস পাবলিকেশন।
১১. ছোটদের বিশ্ব নবী, হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ, প্রকাশক: আল কোরআন একাডেমী পাবলিকেশন্স
১২. বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা, প্রকাশক: আহমদ পাবলিশিং হাউজ।
১৩. তিনি চাঁদের চেয়ে সুন্দর, খাদিজা আখতার রেজায়ী, প্রকাশক: আল কোরআন একাডেমী পাবলিকেশন্স।
১৪. ছোটদের বিশ্বনবী, মোশাররফ হোসেন খান, প্রকাশক: আহসান পাবলিকেশন।
১৫. বিশ্বনবী (সা.)-এর সিরাত, এ কিউ এম ছিফাতুল্লাহ, প্রকাশক: প্রফেসর’স বুক কর্ণার।
১৬. মহানবী, সৈয়দ আলী আহসান, প্রকাশক অনির্বাণ।
১৭. সবুজ গম্বুজের ছায়া, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ, প্রকাশক: মাকতাবাতুল আযহার।
১৮. হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই পৃথিবীকে কী দিয়েছেন, আল্লামা সা. আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.), মদীনা পাবলিকেশান্স।
১৯. বাংলা ভাষায় মুহাম্মদ (সাঃ) চরিত, নাসির হেলাল, প্রকাশক: সুহৃদ।
২০. মহানবীর (সা.) জীবন চরিত, ড. মুহাম্মদ হোসাইন হায়কল, প্রকাশক: ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
২১ মহানবীর (স.) বিবাহ, মোহাম্মদ সা’দাত আলী, প্রকাশক: আহমদ পাবলিশিং হাউস।
২২. মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (সা), নঈম সিদ্দিকী, প্রকাশক: শতাব্দী।
২৩. মহানবীর (সা) অর্থনৈতিক শিক্ষা, অধ্যাপক মুহাম্মদ আকরাম খান, প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
২৪. কেমন ছিলেন রাসূল (সা.), সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী, ইসলামিয়া কুতুবখানা।
২৫. আদর্শ শিক্ষক রাসূল (সা.), শায়খ আ ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ., প্রকাশক: ইসলামিয়া কুতুবখানা।
২৬. মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ, মুহাম্মদ আমীমুল এহসান, প্রকাশক: মম প্রকাশ।
২৭. রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) এর মুযেজা, হারুন ইয়াহিয়া, প্রকাশক: খোশরোজ কিতাবমহল।
২৮. মরু ভাস্কর, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী।
২৯. বৈজ্ঞানিক মুহাম্মদ (দঃ), মুহাম্মদ নুরল ইসলাম, প্রকাশক: মম প্রকাশ।
৩০. মুহাম্মদ : মহানবীর (স.) জীবনী, ক্যারেন আর্মস্ট্রং, প্রকাশক: সন্দেশ।
৩১. বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মাদ, হিশাম আল আওয়াদি , মাসুদ শরীফ, প্রকাশক গার্ডিয়ান।
৩২. মুহাম্মদ (স), তওফিকুল হাকীম মিশরী, প্রকাশক: আল কোরআন একা: পাবলিকেশন্স।

বারংবার মনে পড়ে কবিতার সেই লাইনক'টিঃ

নবীজীবনী, সিরাতের গ্রন্থ- কত কত ভাষায়, কত কত ছন্দে, কতইনা বিচিত্র ভালোবাসার মায়াময় ছান্দসিকতা আর নিপুনতা নিয়ে অক্ষরের পরে অক্ষর, শব্দের পরে শব্দের বুননে চিত্রিত হয়েছে প্রিয় নবীজীর প্রতি ভক্তি-অর্ঘ্য-মুহাব্বতের নজরানা! যতই পড়ি আগ্রহ কখনো শেষ হয় না, উদ্দীপনা কখনও ফুরোয় না, প্রেমময়তায় ভাটা পড়ে না একটুও, বারংবারের পুনরাবৃত্তি আর পৌনঃপুনিক পাঠের পরেও হৃদয়ের অমলিন টান বেড়েই চলে কেন যেন, বারংবারই মনে পড়ে কবিতার সেই অনবদ্য লাইনক'টি-

সপ্ত সাগর হইতো কালি,
বৃক্ষজগত আর কলম।
লিখতো যদি অনন্তকাল,
হইতো না তাঁর গুণ খতম।

গুণ তাঁর খতম হওয়ার নয় যে! কবি তার কবিতায়, কাব্যময়তায় এই মহান মনীষী, জগতের শ্রেষ্ঠতম মহামানবের অনন্য গুণাবলীর কতটুকুই বা প্রকাশ করবেন! সাহিত্যিক কতটুকু ফুটিয়ে তুলবেন তার সাহিত্যকর্মে! দার্শনিক কতখানিই বা তুলে ধরতে সক্ষম হবেন তাঁকে! সহস্রাধিক বছর ধরে তাঁর সিরাত রচনার অবিরাম যে ধারা চলে এসেছে, তা নিশ্চয় চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে। চলতে থাকবে মহাকালের সর্বশেষ মুহূর্তকাল পর্যন্ত। এই ধারা রুদ্ধ হওয়ার নয়। কারণ, মহান আল্লাহ তাআ'লার ইচ্ছে যে এমনই। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মহানত্বের অনিঃশেষ কথামালা ইহ-পরকালে নিত্য আলোচিত হবে, এটাই তো মহামহিয়ান প্রতিপালকের অমোঘ ইচ্ছে। দরূদে, সালাত ও সালামে, আজানে, ইকামাতে, সর্বোপরি সিরাতের আলোচনায় লক্ষ-কোটি কন্ঠে প্রতিনিয়তঃ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে-ইথারে-আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে, হতেই থাকবে, এর অনন্ত ধারাবাহিকতার ঘোষনা তিনি তো আগেই দিয়ে রেখেছেন-

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

And raised high the esteem (in which) thou (art held).

আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি, সমুন্নত করেছি। -সূরাহ আল ইনশিরাহ, আয়াত ০৪

তাঁর চরিত্রের গভীরতা পরিমাপ করা অসম্ভবঃ

বক্ষমান নিবন্ধে সহস্রাধিক বছরের সিরাতচর্চার ধারাবাহিকতার যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো তা হতে আঁচ করা সম্ভব যে, তাঁর পূর্ণাঙ্গ ও মহাগুণে গুণান্বিত চরিত্রের পরিপূর্ণ চিত্র অঙ্কণ করা মানবের সাধ্যের বাইরে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাবী এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এ মহামানবের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চরিত্রের রূপরেখা চিত্রায়ণ কোন সাধারণ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়- তা তিনি এ বিষয়ে যতই বিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ হোন না কেন, যেমনটা অসম্ভব এর তলদেশ পরিমাপ করা।

বস্তুতঃ ঐ মহামানবের পূর্ণত্বের উচ্চ শিখরে আরোহণ করে তাকে সঠিকভাবে যথাযথরূপে পরিমাপ করা এ পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়; কারণ, তিনি এমনই এক মহামানব যার মর্যাদা ও আসন মানবত্বের সর্বোচ্চ শিখরে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এবং আপন প্রভু পরোয়ার দেগারের নূরে নূরান্বিত হয়ে অসামান্য কিতাব আল কুরআনের অবিকল ছাঁচে নিজ চরিত্রকে তৈরি করে নিয়েছেন।

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ.

‘হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমন রহমত বর্ষণ করেছেন ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর বংশধরের উপর, নিশ্চয় আপনি প্রশংসনীয় ও মহাসম্মানিত। হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর বংশধরের ওপর বরকত নাযিল করুন যেমন বরকত নাযিল করেছেন ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর বংশধরের উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসনীয় ও মহাসম্মানিত।’
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২১ সকাল ৯:৫৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×