somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ! যা চেয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি দয়া করেছেন আমার পরম প্রিয় রব। যা পাইনি, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই—কারণ জানি, তিনি দেন শুধু কল্যাণই। সিজদাবনত শুকরিয়া।nnপ্রত্যাশার একটি ঘর এখনও কি ফাঁকা পড়ে আছে কি না, জানি না। তবে এটুকু জানি—

ইসলামের দৃষ্টিতে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব

১৯ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ইসলামের দৃষ্টিতে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

ভূমিকা

ভাষা মানুষের আত্মিক ও সামাজিক পরিচয়ের অন্যতম মাধ্যম। ইসলামে ভাষার শুদ্ধতা ও মার্জিত ব্যবহারকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বারংবার সত্যবাদিতা, নম্রতা, ও কল্যাণকর কথনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে মিথ্যা, গীবত, অশ্লীলতা ও কঠোর ভাষাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে কখনও অশুদ্ধ বা অমার্জিত ভাষায় কথা বলেননি, বরং তাঁর সমগ্র জীবন ও বাণী মানবজাতির জন্য ভাষাগত পবিত্রতার সর্বোচ্চ আদর্শ স্থাপন করেছে।

বর্তমান পৃথিবীতে কয়েক হাজার ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। অঞ্চলভেদে মানুষের চেহারায় যেমন ভিন্নতা আছে, আছে ভাষারও ভিন্নতা। এসবই আল্লাহর সৃষ্টিবৈচিত্র্যের অংশ। এ মর্মে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:

وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ

তাঁর আর ও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। -সুরা রূম:২২

ভাষা আল্লাহর নিয়ামত

ভাষা আমাদের জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া বিরাট নিয়ামতও বটে। এটা এতবড় এক নিয়ামত যে, আল্লাহ তাআলা নিজে ভাষার শিক্ষক। তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে ভাষা দান করেছেন। সূরা বালাদে আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি তার দানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন:

وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ

(আর আমি কি তাকে দেইনি) জিহবা ও ওষ্ঠদ্বয়? -সুরা বালাদ: ০৯

অর্থাৎ, তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন জিহ্বা এবং ঠোঁট, যার মাধ্যমে তোমরা কথা বলতে পারো, মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারো, এটা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহসমূহের মধ্য থেকে একটা অনুগ্রহ।

মহানবী (সা.) বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন:

প্রিয় নবিজির জন্মের পর তাঁকে দুধপান করাতে হালিমা সাদিয়ার কাছে তায়েফে পাঠানো হয়। এটা সে যুগে আরবের সাধারণ প্রথা ছিল, কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার পর তার শারীরিক গঠন ও ভাষার শুদ্ধতার জন্য তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হতো। এতে বাচ্চার বেড়ে ওঠা এবং বিশুদ্ধ বাচনভঙ্গির পথ মসৃণ হতো।

হযরত আবু বকর (রাযি.) একদিন রাসূল (সা.)-কে বলেন, আপনি খুবই বিশুদ্ধভাষী। প্রতিউত্তরে নবিজি বলেন, আমি কুরাইশ বংশের আর আমি দুধপান করেছি সাআদ গোত্রে। -সীরাতে মুস্তাফা ৬৯-৭০; বেদায়া নেহায়া ২/২৩৩; আসাহহুস সিয়ার: ০৬

পরবর্তীতে রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতী জীবনে ভাষার শুদ্ধতা ও বাচনভঙ্গির যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এক হাদিসে প্রিয়নবি ইরশাদ করেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ -সহীহ মুসলিম : ৫২৩

সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশুদ্ধ ও সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলা প্রিয় নবিজির সুন্নাত। রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে শুদ্ধ ও মার্জিত ভাষায় কথা বলার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।

রাসুলুলাহ (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতা ও উপযুক্ত শব্দচয়ন ইত্যাদির প্রতি তাগিদ প্রদান করেছেন। একবার কোনো এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আ-আলিজু?’ আরবি ভাষায় এ শব্দের ব্যবহার ‘প্রবেশ’ অর্থে প্রচলিত থাকলেও অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে তা প্রমিত শব্দ নয়। প্রমিত শব্দ হচ্ছে, ‘আ-আদখুলু?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি ‘আ-আদখুলু?’ বোলো। -সুনানে আবুদাউদ : ৫১৩৪; সুনানে নাসাঈ : ৫০১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ২৬১৮৫

এ হাদিসে দেখা যাচ্ছে, রাসূল (সা.) সাহাবীর ভাষা সংশোধন করে দিয়েছেন। কারণ ঘরে প্রবেশ করতে যে মার্জিত ও বিশুদ্ধ ভাষায় অনুমতি চাওয়ার দরকার ছিল তিনি তা করেননি। হাদিসটির মাধ্যমে ইসলামে বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার গুরুত্ব ফুটে ওঠে। রাসূল (সা.) নিজে বিশুদ্ধ ও সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছেন। সাহাবায়ে কেরামকে বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁরাও নবিজির এ আদর্শ গ্রহণ করেছেন। ইমাম বুখারি (রহ.) বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাযি.) তাঁর সন্তানকে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কারণে প্রহার করতেন। -আল-আদাবুল মুফরাদ : ৮৮০

মূসা বিন তলহা বর্ণনা করেন, আমি আয়েশা (রাযি.) থেকে বিশুদ্ধভাষী আর কাউকে দেখিনি। -জামে তিরমিযী ২/২২৭

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, পূর্বসূরীরা ভাষায় ভুল করলে তাদের সন্তানদের শাসন করতেন। -মাজমূউল ফাতাওয়া ৩২/২৫২

ইমাম যুহরী (রহ.) বলেন, আমর মতে বিশুদ্ধ ভাষার চেয়ে বড় আভিজাত্যের বস্তু আর কিছু নেই। -হিলয়াতুল আউলিয়া ৩/৩৬৪

একইরকমভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

لَا تَقُولُوا لِلْعِشَاءِ الْعَتَمَةَ، وَقُولُوا الْعِشَاءَ، وَلَا تَقُولُوا لِلْعِنَبِ الْكَرْمَ، وَقُولُوا الْعِنَبَ

তোমরা এশার নামাজকে আতামা বলবে না, এশা বলবে। আঙুরকে কারাম বলবে না, ইনাব বলবে। এভাবে তিনি মুসলিম সমাজের ভাষাগত সংশোধনে সঠিক শব্দ প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন। -সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫১৭৭

এই নিবন্ধে কুরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে আমরা শুদ্ধ ভাষার গুরুত্ব বিশদভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

১. কুরআনের নির্দেশনা: সত্য ও সুন্দরের প্রতিশ্রুতি

ইসলামে ভাষার শুদ্ধতার প্রথম ও প্রধান উৎস হলো পবিত্র কুরআন। আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে ভাষার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

عَلَّمَهُ الْبَيَانَ

তিনিই তাকে বায়ান তথা ভাবপ্রকাশ শিক্ষা দিয়েছেন। -সূরা আর-রহমান, ৫৫:৪

এর যথাযথ ব্যবহারের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন:

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا

“মানুষের সাথে উত্তম কথা বলো।” -সূরা আল-বাকারা, ২:৮৩

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, “উত্তম কথা” বলতে সত্য, নম্রতা ও সম্মানজনক ভাষাকে বোঝানো হয়েছে। এমনকি অমুসলিমদের সাথেও ইসলাম শিষ্টাচার বজায় রাখতে বলে:

وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

“আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না, তবে উত্তম পন্থায়।” -সূরা আল-আনকাবুত, ২৯:৪৬

পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের ক্ষেত্রে কুরআন অত্যন্ত সূক্ষ্ম নির্দেশনা দিয়েছে:

فَلَا تَقُلْ لَّهُمَآ أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا

“তাদের (মাতা-পিতা) সামনে ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না।” -সূরা আল-ইসরা, ১৭:২৩

এখানে একটি ক্ষুদ্র অসন্তোষ প্রকাশক শব্দও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ভাষার পবিত্রতা রক্ষায় ইসলামের গভীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।

২. নবীজির ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব: আদর্শ ও অলৌকিকতা

নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ভাষার সর্বোচ্চ দক্ষতার অধিকারী। তিনি ঘোষণা করেছেন:

أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ

“আমাকে সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য দেওয়া হয়েছে।” -সহিহ বুখারি, হাদিস ৭২৮২

তাঁর ভাষায় কোনো অশুদ্ধি, অমার্জিত শব্দ বা ব্যাকরণগত ত্রুটি ছিল না। অলৌকিকভাবে তিনি এমন ভাষায় কুরআন প্রচার করেছেন যা আরবের শ্রেষ্ঠ কবি ও ভাষাবিদদের মাথা নত করেছিল। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন:

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْصَحَ النَّاسِ لِسَانًا

“রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাধিক স্পষ্ট ও প্রাঞ্জলভাষী।” -সুনানে তিরমিজি, হাদিস ৩৬৪৩

নবীজি (সা.) কখনও কাউকে গালি দেননি, এমনকি শত্রুর প্রতিও তিনি কঠোর শব্দ ব্যবহার করতেন না। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি কুরাইশ নেতাদের বলেছিলেন:

اذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ

“যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।” -সীরাতু ইবনে হিশাম

৩. হাদিসের শিক্ষা: জবানের জবাবদিহিতা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ

“যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে উত্তম কথা বলুক অথবা চুপ থাকুক।” -সহিহ বুখারি, হাদিস ৬৪৭৫

এই হাদিসে উত্তম কথনকে ঈমানের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে, তিনি সতর্ক করেছেন:

إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللَّهِ مَا يَلْقِي لَهَا بَالًا، يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ

“বান্দা আল্লাহর অসন্তুষ্টিজনক একটি কথা বলে ফেলে, অথচ সে তা গুরুত্ব দেয় না; ফলে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়।” -সহিহ বুখারি, হাদিস ৬৪৭৭

এমনকি হাসি-ঠাট্টার ছলেও মিথ্যা বলা নিষিদ্ধ। নবীজি (সা.) বলেছেন:

وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ، وَيْلٌ لَهُ!

“ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে! ধ্বংস তার জন্য!” -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৯৯০

৪. গীবত ও মিথ্যা: সমাজের জন্য বিষ

ইসলামে গীবত (পরনিন্দা)কে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে:

وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا، أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ

“তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বরং তোমরা তা ঘৃণাই করো।” -সূরা আল-হুজুরাত, ৪৯:১২

মিথ্যাকে ইসলাম কবিরা গুনাহ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন:

إِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ

“মিথ্যা পাপের দিকে পরিচালিত করে, আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।” -সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৬০৭

৫. উত্তম ভাষার সুফল: আত্মিক ও সামাজিক কল্যাণ

শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করে। নবীজি (সা.) বলেছেন:

الكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ

“মিষ্টি কথা বলা একটি সাদাকাহ (দান)।” -সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০০৯

এছাড়া, নম্র ভাষা সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। রাসুল (সা.) শিশুদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলতেন, অসুস্থদের সান্ত্বনা দিতেন এবং দাসদেরও সম্মান করতেন। তিনি বলতেন:

إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ

“নম্রতা কোনো বিষয়ে যুক্ত হলে তা তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।” -সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৫৯৪

৬. আধুনিক যুগে ভাষার অপব্যবহার: চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম, মিম, ও চ্যাটিং প্ল্যাটফর্মে ভাষার অপব্যবহার উদ্বেগজনক। ইসলামের দৃষ্টিতে ডিজিটাল কথোপকথনেও গীবত, মিথ্যা ও অশালীনতা হারাম। আল্লাহ তাআলা সতর্ক করেছেন:

مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ

“মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা রেকর্ড করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।” -সূরা ক্বাফ, ৫০:১৮

অনলাইনে শব্দের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। কুরআনুল হাকিমে ইরশাদ হয়েছে:

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

আর যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে। -সূরা আল-মুমিনুন, ২৩:৩

ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ

আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। -সূরা আন-নাহল, ১৬:১২৫

অত্র আয়াতে বিতর্কেও শালীনতা বজায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

৭. ভাষাজ্ঞান ও ইসলামি সভ্যতার অবদান

ইসলামি সভ্যতা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। কুরআনের অলৌকিক ভাষাগত সৌন্দর্য আরবি ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র ও কাব্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ইমাম আশ-শাফিঈ (রহ.) বলেছেন:

“আরবি ভাষার জ্ঞান ছাড়া কুরআন-হাদিসের গভীর উপলব্ধি অসম্ভব।”

এমনকি ইসলামে বিদেশি ভাষা শেখাকে ইবাদত হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন:

مَنْ تَعَلَّمَ لِسَانَ قَوْمٍ أَمِنَ مِنْ مَكْرِهِمْ

“যে কোনো সম্প্রদায়ের ভাষা শিখল, সে তাদের ধোঁকা থেকে নিরাপদ হলো।” -মুসনাদে আহমাদ

ভাষায় দক্ষতা অর্জনের চারটি উপায়

মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও জ্ঞানের প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের চারটি মূল উপায়ের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন— শোনা, বলা, পড়া ও লেখা। এসব মাধ্যম ব্যবহার করেই মানুষ জ্ঞানার্জন করে এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। নিচে কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রতিটি মাধ্যমের ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১. পড়া (القراءة)

পড়া জ্ঞান অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আল্লাহ সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন:

ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ

"পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।" -সূরা আলাক, আয়াত: ১

এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবী (সা.)-কে তাঁর মাতৃভাষায় পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে, নিজের ভাষায় পড়া শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২. শোনা (الاستماع)

শোনার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে এবং শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারে। আল্লাহ বলেন:

وَإِذَا قُرِئَ ٱلْقُرْءَانُ فَٱسْتَمِعُوا۟ لَهُ وَأَنصِتُوا۟ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

"যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগসহ শুনবে এবং নিশ্চুপ থাকবে, যাতে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়।"
-সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ২০৪

শিশুরা প্রথমে শুনেই ভাষা শেখে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও প্রথমে ওহি শোনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করেন এবং পরে তা প্রচার করেন।

৩. বলা (الكلام)

বক্তব্য প্রকাশ বা কথা বলার মাধ্যমে মানুষ তার জ্ঞান ও চিন্তা অন্যদের কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ বলেন:

خَلَقَ ٱلْإِنسَٰنَ، عَلَّمَهُ ٱلْبَيَانَ

"তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তাকে বায়ান (ভাবপ্রকাশ) শিক্ষা দিয়েছেন।" -সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৩-৪

এখানে ‘বায়ান’ শব্দের অর্থ হলো স্পষ্ট ভাষায় ভাব প্রকাশ করা। শিশু প্রথমে তার মাতৃভাষায় কথা বলা শেখে, এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাষা আয়ত্ত করে।

৪. লেখা (الكتابة)

লেখা হলো মানুষের মনের ভাব প্রকাশের আরেকটি শক্তিশালী মাধ্যম। আল্লাহ বলেন:

ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ

"যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন।" -সূরা আলাক, আয়াত: ৪

রাসুলুল্লাহ (সা.) লেখার গুরুত্ব বোঝাতে বলেছেন:

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: قَيِّدُوا الْعِلْمَ، قُلْنَا: وَمَا تَقْيِيدُهُ؟ قَالَ: كِتَابَتُهُ

"রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জ্ঞানকে সংরক্ষণ করো। আমরা বললাম: কীভাবে সংরক্ষণ করব? তিনি বললেন: তা লিখে রাখার মাধ্যমে।" -সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬৬৬

উপসংহার

ইসলামে ভাষা হলো ঈমানের আয়না। এটি ব্যক্তির অন্তরের পবিত্রতা ও সমাজের নৈতিক অবস্থার প্রতিফলন। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী ও হাদিসের বিশাল ভাণ্ডার প্রমাণ করে যে, শুদ্ধ ভাষা ছাড়া পরিপূর্ণ মুসলিম চরিত্র গঠন সম্ভব নয়। আধুনিক যুগে ডিজিটাল যোগাযোগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসরণই একমাত্র পথ। প্রতিটি মুসলিমের উচিত জবানের হিফাজত করা এবং কথার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।

তথ্যসূত্র:

১. পবিত্র কুরআনুল কারিম
২. সহিহ বুখারি ও মুসলিম
৩. সুনানে আবু দাউদ ও তিরমিজি
৪. সুনানে নাসাঈ
৫. মুসনাদে আহমাদ
৬. সীরাতু ইবনে হিশাম
৭. তাফসিরে ইবনে কাসির
৮. আল-আদাবুল মুফরাদ
৯. হিলয়াতুল আউলিয়া
১০. মাজমূউল ফাতাওয়া
১১. মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা
১২. সীরাতে মুস্তাফা
১৩. আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া
১৪. আসাহহুস সিয়ার
১৫. ইসলামি ব্যাকরণ ও অলংকারশাস্ত্রের গ্রন্থসমূহ
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগ কি শিখিয়েছে?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৬






অপমান, অপদস্থ থেকে বাঁচার উপায় শিখাইনি? ওস্তাদ মগা শ্যামী পাহাড়ে বসেও এসবের সমাধান করতে পারে, আপনি সামান্য অসুস্থতার জন্যও ব্লগে মিলাদ দেননি, দোয়া করেছেন কার জন্য? খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন হাদিসই যদি মানতে হবে তবে আল্লাহ ফিকাহ মানতে বললেন কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৪৬




সূরাঃ ৫ মায়িদা, ৬৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৬৭। হে রাসূল! তোমার রবের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা’ প্রচার কর। যদি না কর তবে তো তুমি তাঁর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক রহমানের হঠাৎ ‘জামায়াত-বিরোধী’ উচ্চারণ: রাজনীতির মাঠে নতুন সংকেত, নাকি পুরোনো সমস্যার মুখোশ?

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৯

তারেক রহমানের হঠাৎ ‘জামায়াত-বিরোধী’ উচ্চারণ: রাজনীতির মাঠে নতুন সংকেত, নাকি পুরোনো সমস্যার মুখোশ?

বিএনপি রাজনীতিতে এক অদ্ভুত মোড়—অনেক বছর পর হঠাৎ করেই তারেক রহমান সরাসরি জামায়াতকে ঘিরে কিছু সমালোচনামূলক কথা বললেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন থাপ্পড় খাবি!

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩৩



ঘটনাঃ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের পতনের সময়।
চৈত্র মাস। সারাদিন প্রচন্ড গরম। জামাই তার বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। সুন্দর গ্রামের রাস্তা। পড়ন্ত বিকেল। বউটা সুন্দর করে সেজেছে। গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×