
বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) সম্প্রতি এমন এক গোপন ফোনালাপ ফাঁস করেছে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তীব্র আলোড়ন তুলেছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের ‘ওপেন’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। রেকর্ডকৃত ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “যেখানে পাবে, সোজা গুলি করবে।”
বিক্ষোভ ও গোপন নির্দেশনার পটভূমি
গত বছর বাংলাদেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। আল-জাজিরার তথ্যমতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই আন্দোলনে গুলি চালিয়ে প্রায় ১,৪০০ জনকে হত্যা করে এবং আহত করে ২০,০০০-এরও বেশি মানুষকে।
এই সহিংস দমন নীতির পেছনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনা ছিল কি না—এই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে গোপনে রেকর্ড করা ফোনালাপে, যা আল-জাজিরার হাতে এসেছে। শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি নিজেই ‘লিথাল ওয়েপন’ ব্যবহারের ‘ওপেন অর্ডার’ দেন এবং বলেন, তিনি এতদিন শিক্ষার্থীদের ‘সেফটি’র কথা চিন্তা করে তা আটকে রেখেছিলেন।
ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি একদম। এখন লিথাল ওয়েপনস (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে, সোজা গুলি করবে। ওইটা বলা আছে। আমি এত দিন বাধা দিয়ে রাখছিলাম...ওই যে স্টুডেন্টরা ছিল, ওদের সেফটির (নিরাপত্তার) কথা চিন্তা করে।’
হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশ এবং প্রতিক্রিয়া
অপর এক ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আলোচনা করতে শোনা যায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভ দমনের বিষয়েও। তিনি বলেন, “যেখানেই গ্যাদারিং দেখবে, সেখানে ওপরে থেকে করা হচ্ছে... অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।”
ঢাকায় পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে জানানো হয়, তাঁরা এমন গুলিবিদ্ধ রোগীদের চিকিৎসা করেছেন যাদের শরীর থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসকরা জানান, এসব গুলি লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে এবং তা শরীরে গভীরভাবে প্রবেশ করেছে।
ময়নাতদন্তে কারসাজির অভিযোগ
আন্দোলনে নিহত রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়েও ছলচাতুরির অভিযোগ এসেছে প্রতিবেদনে। শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা আইজিপির মধ্যে ফোনালাপে এই প্রতিবেদন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পাওয়া গেছে। চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তাঁকে পাঁচবার প্রতিবেদন পরিবর্তনে বাধ্য করা হয় যাতে গুলির কথা লুকানো যায়।
ফরেনসিক বিশ্লেষণ ও আইনি অগ্রগতি
আল-জাজিরা জানিয়েছে, তারা এই অডিও রেকর্ডগুলোর কণ্ঠ ও প্রযুক্তিগত সত্যতা যাচাই করতে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা চালিয়েছে। ফলে প্রমাণের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও জোরালো হয়েছে।
এই ফোনালাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলিরা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা ও তাঁর দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে আগামী আগস্টে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা কখনোই ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহারের নির্দিষ্ট অনুমতি দেননি। এই রেকর্ডিং বিকৃত করা হতে পারে বলেও দাবি করা হয়েছে। তবে ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “আমি জানি এটা রেকর্ড করা হচ্ছে; সমস্যা নেই।”
উপসংহার: রাজনীতির ইতিহাসে এক ভয়াবহ অধ্যায়
এই অনুসন্ধান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে, যেখানে শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, এবং জনআন্দোলন এক ভয়াবহ সংঘাতে জড়িয়েছে। ফোনালাপ ও ময়নাতদন্তের কারসাজির অভিযোগ রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতা ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
যদি আল-জাজিরার এই প্রমাণ আদালতে গ্রহণযোগ্য হয়, তবে শেখ হাসিনার শাসনকালকে ঘিরে ইতিহাস পুনর্লিখনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আল-জাজিরা প্রকাশিত ডকুমেন্টরিটি দেখে নিতে পারেন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে-
ইংলিশ ভার্সনঃ
36 Days in July: Sheikh Hasina’s secret orders revealed I Al Jazeera Investigates
বাংলা ভার্সনঃ
জুলাইয়ের ৩৬ দিন: উন্মোচিত হচ্ছে শেখ হাসিনার গোপন আদেশনামা
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




