
কল্পনা করুন—একটি সাধারণ দিন। হঠাৎ খবর এলো, আপনার প্রিয়জন একটি ভবনের ছাদে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পড়েছেন। মুহূর্তের মধ্যে তিন তলা থেকে ধপ করে নিচে আছড়ে পড়লেন তিনি। মেরুদণ্ড ভেঙে গেল, শরীরের নানা হাড় চূর্ণবিচূর্ণ, বিদ্যুতের আগুনে পুড়ে গেল দেহের একাধিক অংশ। এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন—যা দুর্ভাগ্যক্রমে গত সপ্তাহে আমার পরিচিত একজনের জীবনে বাস্তবে রূপ নিল। তাকে দ্রুত নেওয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)—দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল, যেটি সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বলে পরিচিত। কিন্তু সেখানে যা ঘটল, তা কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং আমাদের গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নগ্ন, নৃশংস প্রতিচ্ছবি।
এক দিন অপেক্ষার পরও মেলেনি একটি বেড। মেলেনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা। হতাশ ও দিশেহারা স্বজনদের ঠিক তখনই ঘিরে ধরল একদল দালাল। তারা মধুর ভাষায় প্রলোভন দেখাল— “স্যার, এখানে চিকিৎসা পাবেন না। এখানে থাকলে রোগীকে বাঁচাতে পারবেন না। সময় নষ্ট না করে আমাদের ক্লিনিকে নিয়ে চলুন। আমাদের ওখানে ২৪ ঘন্টা ডাক্তার পাবেন। রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।” মমতার টানে প্রিয়জনের জন্য মরিয়া পরিবার দালালদের ফাঁদে পা দিল। হাসপাতাল থেকে নাম কেটে রোগীকে নেওয়া হলো এক কথিত প্রাইভেট ক্লিনিকে।
তারপরের গল্প? কেবলই অমানিশার ইতিহাস। একটি মাত্র অপারেশনের জন্য গুনতে হলো ৯০ হাজার টাকা! সাথে যোগ হলো সিট ভাড়া, চিকিৎসকের ভিজিট, ওষুধপত্র এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ। হতদরিদ্র ও নিঃস্ব এই পরিবারটিকে সাহায্যের জন্য হাত পাততে হচ্ছে নানানজনের কাছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে অনুনয় বিনয় করে, ধারদেনা করেও পরিশোধ করতে পারছে না বিপুল এই অর্থ। অন্যদিকে, এত সর্বস্ব উজাড় করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্ত সেই চিকিৎসার মানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ক্লিনিকের নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, নেই যথাযথ দক্ষ চিকিৎসক। কিন্তু একবার দালাল সিন্ডিকেটের কবলে পড়লে আর রক্ষা নেই।
এটি শুধু একটি পরিবারের করুণ অভিজ্ঞতা নয়—এটি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, সেখানে বেড সংকট, চিকিৎসকের অভাব এবং দালালদের অবাধ দৌরাত্ম্য মিলিয়ে সেই অধিকার পরিণত হয়েছে এক নির্মম প্রহসনে। ঢামেকের মতো হাসপাতালে রোগী ভর্তির প্রথম মুহূর্ত থেকেই সক্রিয় থাকে দালাল চক্র, যাদের পেছনে থাকে অসাধু হাসপাতাল কর্মচারীদের ছত্রছায়া।
শুধু দুর্ঘটনার রোগী নয়—প্রসব, ডায়ালাইসিস এমনকি সাধারণ জ্বরের রোগীকেও এরা টার্গেট করে। আরও ভয়াবহ হলো অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। জরুরি মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যখন মানুষের শেষ ভরসা, তখন এই চক্র সেই দুর্বলতাকেই ব্যবসায় পরিণত করে। অতিরিক্ত ভাড়া, জোরপূর্বক তাদের গাড়ি ব্যবহার করানো, এমনকি লাশ বহনের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়—সবই তাদের নিত্যকার ‘ট্রেড’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোকাহত পরিবারকে বলা হয়, “অন্য গাড়ি লাশ নেবে না”—এমন হুমকি মানবিকতার সব সীমা অতিক্রম করে।
শরীয়তপুরে সম্প্রতি অক্সিজেনের অভাবে একটি নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখার দায় স্পষ্টভাবে এই সিন্ডিকেটের কাঁধেই যায়। ঢাকা মেডিকেলের চারপাশে অ্যাম্বুলেন্স চালক, কর্মচারী, এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা এই চক্র প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে জিম্মি করে রাখছে। সরকারি বাজেটে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হলেও, বাস্তবে তার সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। বিনামূল্যে চিকিৎসার নামে হাসপাতালের গেটে বড় বড় ব্যানার টানানো হয়, অথচ ভেতরে প্রবেশ করলেই শুরু হয় সিন্ডিকেটের খেলা। সরকার ঘোষণা দেয় “বেড নাই, ডাক্তার নাই”—এমন অজুহাতে রোগীদের ঠেলে দেওয়া হয় দালালদের হাতে।
আমাদের স্বাস্থ্য খাত আজ ভয়ংকর এক দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। এখানে মানবিকতার জায়গা দখল করে নিয়েছে টাকা আর মুনাফার নেশা। দালাল চক্র, ভুয়া ক্লিনিক আর অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তারা প্রতিদিন হাজারো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখছে। যদি এখনই এই দালাল ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ না করা যায়, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা আর মৌলিক অধিকার থাকবে না—বরং ধনী মানুষের জন্য একটি বিলাসবস্তু হয়ে দাঁড়াবে। গরিব মানুষ তখন হাসপাতালের দরজা পর্যন্ত পৌঁছালেও চিকিৎসা পাবে না, শুধু প্রতারণা আর হয়রানির শিকার হবে।
এখন প্রশ্ন খুবই সোজা—এই দেশ কি সত্যিই সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলছে, নাকি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে আছে? সময় এসেছে এই অমানিশার অন্ধকার ভেঙে দেওয়ার। সময় এসেছে দালাল চক্র ও সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনার। স্বাস্থ্যসেবা কোনো ব্যবসা নয়—এটি প্রতিটি মানুষের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে সাধারণ মানুষ চিরকাল এই অমানবিক সিন্ডিকেটের খপ্পরেই বন্দি হয়ে থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১০:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



