somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিপাইবাঁধ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ ও ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার - ৫/শেষ পর্ব

৩০ শে জুলাই, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব : Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব : Click This Link
তৃতীয় পর্ব : Click This Link
চতুর্থ পর্ব : Click This Link

ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে আমি ভারতে পুঁজি গড়ে ওঠার ইতিহাস, তার লগ্নীপুঁজির বা একচেটিয়া পুঁজির স্তরে উপনীত হওয়ার ইতিহাসটুকু সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরেছি। এ কথা বলব না যে এ লেখার সীমাবদ্ধতা নেই। অনেক কথা সংক্ষেপে সারতে গিয়ে হয়ত যা বলতে চেয়েছি, পাঠকের কাছে তার উল্টো অর্থ প্রতিভাত হয়েছে। কোনো একটি বিষয়ের তথ্য হয়ত আরো তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল, আবার কোথাও হয়ত তথ্যের বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কিন্তু যাই হোক, আমার ধারণা, আমি কিঞ্চিৎ হলেও সফল হয়েছি।

এখন আমাদের শেষ প্রতিপাদ্য : ভারত কি সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে না হয়নি? নাকি আমাদের প্রপদের বন্ধুদের মতে, ভারত এখনো সম্প্রসারণবাদী (যদিও আমার কাছে সম্প্রসারণবাদী কথাটার মানে পরিস্কার নয়)? নাকি ভারত এমন দেশ যা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর প্রতিবেশী বলে বন্ধুও হতে পারে? অর্থাৎ ভারত সাম্রাজ্যবাদ হলেও হতে পারে, কিন্তু সে নখদন্তহীন, সুকুমার রায় বর্ণিত সেই সাপ যার শিং-নখ কিছু নেই, কাউকে কাটে না!

১৯১৬ সালে লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেন, যা সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের পূর্ববর্তী স্তর অর্থাৎ অবাধ প্রতিযোগিতা ও বাজারের আপেক্ষিক ক্রমসম্প্রসারণের যুগ থেকে আলাদা করে। লেনিন বলেন, সাম্রাজ্যবাদের যুগে -
১। উৎপাদন ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন এমন একটা উচ্চ স্তরে পৌঁছায় যা একচেটিয়ার জন্ম দেয় এবং একচেটিয়া পুঁজি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করে।
২। ব্যাংক পুঁজি ও শিল্পপুঁজির মিলনের মধ্য দিয়ে লগ্নীপুঁজির জন্ম হয়, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ধনকুবের গোষ্ঠী।
৩। পণ্য-রপ্তানির থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুঁজি-রপ্তানি অতিমাত্রায় গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়।
৪। একচেটিয়া গোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক এসোসিয়েশন গড়ে ওঠে, যারা বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
৫। বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীগুলি গোটা দুনিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে দখল করে।

এই পুসিত্মকাতেই লেনিন পুঁজিবাদের বিকাশের স্তরগুলি ভেঙে ভেঙে দেখান যে -
(১) ১৮৬০-৭০ সালে অবাধ প্রতিযোগিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং একচেটিয়া পুঁজি ভ্রূণাকারে জন্ম নেয়।
(২) ১৮৭৩-এর পুঁজিবাদের সঙ্কটের পর, দীর্ঘ সময় ধরে একচেটিয়া জোট (কার্টেল) গড়ে উঠলেও তা ছিল খুবই নগণ্য। সেগুলির স্থায়িত্ব ছিল না এবং ভাঙাগড়ার পর্যায় চলছিল।
(৩) উনিশ শতকের শেষদিকের তেজিভাব শেষ হওয়ার পর ১৯০০-১৯০৩ এর তীব্র মন্দার সময়েই একচেটিয়া জোটগুলি গোটা অর্থনীতির অন্যতম সত্মম্ভে পরিণত হয়। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে প্রবেশ করে।

বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদের স্তরে প্রবেশ করে, সেই সময় ভারতে পুঁজিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বড় মোড়লদের অধীনে, তাদের ছোট শরিক হয়েই চলেছে। কিন্তু যতই দিন গিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, খেয়োখেয়ী, টানাপোড়েনে কেউ এগিয়েছে, কেউ পিছিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত এগিয়েছে। এর একটা বড় কারণ ছিল তার নিজের দেশের বিশাল বাজার।

১৯৯১ সালে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে যে মুক্তবাজার নীতি গ্রহণ করা হয়, তা ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। এ তথ্যও আমি আগে উল্লেখ করেছি যে ওই সময়টাতে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০টিতে যার মধ্যে ৩৪৫টি গড়ে উঠেছে ১৯৯১-৯৩ এ তিন বছরে, যার মূল্যমান ১১.৬৫ বিলিয়ন রুপি। এর পর থেকে ভারতীয় পুঁজিপতিদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন বিশ্বের ধনীদের তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ভারতীয়দের নাম পাওয়া যায়।
২০০৯ সালে এসে আমরা যখন ভারতের পুঁজির চরিত্র এবং রাষ্ট্রচরিত্র বিচার করছি, তখন উইকিপিডিয়াতে বলা হচ্ছে, "The economy of India is the fourth largest in the world by GDP measured on a purchasing power parity (PPP) basis[5] and the twelfth largest in the world by market exchange rates." শুধু তাই নয়, বিশ্লেষকদের মতে, "In 2009, India had prominently established itself as the world's second-fastest growing major economy. According to one estimate, India is expected to overtake China as the world's fastest growing major economy in 2010."
দেখুন : http://en.wikipedia.org/wiki/Economy_of_India

ভারতের পুঁজি খাটছে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে। এবং এ পুঁজি শুধু পণ্য-রপ্তানি নয়, লেনিন বর্ণিত পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুঁজি-রপ্তানি (প্রযুক্তি, পরামর্শক, নো-হাউ ইত্যাদি, এ বিষয়টিও গর্ব পর্বে নাগেশকুমারের লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছি) অতিমাত্রায় গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়। আগস্ট ১৯৯১ থেকে হিসাব ধরে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত ভারতের ক্রমবর্ধমান এফডিআই-এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩৫৫ কোটি রুপি।
তথ্যসূত্র : Click This Link

এতো গেল ভারতীয় পুঁজির একচেটিয়া হয়ে ওঠার ইতিহাস যা ভারত রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের স্তরে উন্নীত করেছে। ভারত তার দেশের অভ্যন্তরে যে নীতি নিয়ে চলছে, সেখানকার জনগণকে যে শোষণ-নিপীড়নের মধ্যে ফেলেছে সেটা এই একচেটিয়া পুঁজিরই স্বার্থে, ওখানকার ধনকুবের গোষ্ঠীর স্বার্থে। ওই একই নিপীড়ন এবং আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে আশেপাশের দেশের মানুষ।
১৯৭১ সালে ভারত যখন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করছে, তখনও তার পেছনে কাজ করছে তার সাম্রাজ্যবাদী দূরভিসন্ধী। ভারতের জনগণ বিশেষত পশ্চিম বাংলার জনগণও বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে অবশ্যই প্রভেদ ছিল।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার কয়েকটি নজির টেনেই আমি আপাতত আমার লেখা শেষ করব।
সিকিম ছিল একটি স্বাধীন দেশ, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। দেশটি 'ল্যান্ডলক' হওয়ায় অর্থাৎ চর্তুদিকে ভূমি বা অন্যদেশ পরিবেষ্টিত হওয়ায় নানা কারণে দেশটি ছিল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৭৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করে সিকিম-কে ভারতের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে এক অভ্যুত্থানে মালদ্বীপের প্রসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুম ক্ষমতাচ্যুত হলে ভারত ছত্রিসেনা পাঠিয়ে মামুনকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে আসে। শ্রীলঙ্কার জাতি-সমস্যাকে ব্যবহার করেও ভারত দেশটির ওপর আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। ১৯৮৭ সালের জুনে তামিলদের ওপর শ্রীলঙ্কান সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক সাহায্যের ধুয়া তুলে শ্রীলঙ্কার আকাশ-সীমা লঙ্ঘন করে জাফনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ নিক্ষেপ করে। এবং তারপর শান্তি রক্ষার নামে সেখানে সৈন্য প্রেরণ করে। শ্রীলঙ্কান সরকারকে বাধ্য করে একটা চুক্তিতে উপনীত হতে। ১৯৮৭ সালের ২৯ জুলাই তামিল বিদ্রোহ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভারত-শ্রীলঙ্কার চুক্তির আড়ালে মূলত একটি গোপন সমঝোতায় উপনীত হয় যার আসল লক্ষ্য ছিল ভারত মহাসাগরে এবং এ অঞ্চলে মার্কিন বা অন্য কোনো পরাশক্তির অনুপ্রেবশ রোধ করা। কারণ ওই সমঝোতায় বলা হয়েছিল --
(১) ভারতের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হলে অন্য কোনো রাষ্ট্রকে শ্রীলঙ্কার ত্রিঙ্কোমালি বা অন্য কোনো বন্দর সামরিক কাজে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
(২) সামরিক বা গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, ভারতীয়দের এমন আশঙ্কার ভিত্তিতে, একটি বিদেশী রেডিও কর্পোরেশনকে প্রচারকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকার যে চুক্তি করেছিল, সেটি পুনর্বিবেচনা করা।
(৩) পাকিস্তান, ইসরায়েল, ব্রিটেন ও আমেরিকার সামরিক বা গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা শ্রীলঙ্কায় আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ভারত সরকারের সঙ্গে একটি যৌথ 'কনসালটেনটিভ মেশিনারি' গঠন করা এবং শ্রীলঙ্কার যাবতীয় সামরিক প্রয়োজন -- সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সবই ভারত সরকারের কাছ থেকে নেওয়া।
নেপালের সঙ্গে আচরণেও ভারতের এ সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যকামী চরিত্র ফুটে ওঠে। ১৯৫০ সালে নেপাল-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত 'শান্তি ও মৈত্রী' চুক্তির আওতায় ১৯৬৫ সালে ভারত নেপালকে আরো একটি চুক্তি করতে বাধ্য করে। সেখানে বলা হয়, নেপালের সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ভারতে থেকে কিনতে হবে। আর যদি কোনো অস্ত্র ভারত সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে তা আমেরিকা-ব্রিটেন থেকে কেনা যাবে কিন্তু তা স্থলপথে ভারতের ভিতর দিয়ে নেপালে যেতে হবে। ভারত নেপালের সেনাবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দেবে, এমনকি তাদের পোষাক-পরিচ্ছদও সরবরাহ করবে। তথাকথিত এ 'শান্তি-মৈত্রী' চুক্তি লঙ্ঘন করে ১৯৮৯ সালে নেপাল চীন থেকে একটি এন্টি এয়ারক্রাফট গান কেনে এবং তিব্বতের মধ্য দিয়ে সড়ক পথে নেপালে নিয়ে আসে। এর বিনিময়ে শাস্তি হিসাবে ভারত ১৯৮৯ সালের ২৩ মার্চ ভারত-নেপালের ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভারত ট্রানজিট পয়েন্ট বন্ধ করে দিয়ে নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। নেপাল বহুদিন ধরে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করার জন্য ভারতের কাছে ১৮ কিমি ট্রানজিট চাইছে, আজ পর্যন্ত পায়নি। আর এসব টানাপোড়েনে নেপালি বুর্জোয়াদের ভারত ঘনিষ্ঠ অংশের সহযোগিতায় ভারত-বিরোধী হিসাবে খ্যাত রাজা জ্ঞানেন্দ্র খুন হয়ে গেছেন।
স্থানীয় মোড়ল হিসাবে ভারতের ভূমিকা মার্কিন-ব্রিটিশ সাম্রজ্যবাদী শক্তি আরো আগেই স্বীকার করে নিয়েছে :
“The US governments approval of Indian action in Sri Lanka & Maldives, said Dr. William Richer, Head of the Dept of Political Science, Kansas State University, in Culcutta on Monday, is recognition of regional role that Washington expect New Delhi to play in the Indian sub-continent and its neighborhood. After all, India is the strongest & largest military power in the region. The Indian action in the Maldives, according to Dr. Richter, has reinforced its image of being the policeman of the region.” (The Statesman, 22.11.88)
এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোও এ সম্পর্কে সচেতন : ১৯৮৮ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনে রোমের দৈনিক 'লা রিপাবলিকা'তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, "আমি ভারতকে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি মনে করি। এটা অস্বীকার্য সত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সমেত বিশ্বের সকল বৃহৎ শক্তিই এটা স্বীকার করেছে। ... আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভারতের সাথে পরামর্শ না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করতে কোনো উদ্যোগই নেবে না। (আনন্দবাজার, ১৩.০৮.৮৭)
আর আজকের পরিস্থিতি তো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে। ভারতের মূল্য বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিনীদের কাছে বহু গুণ বেড়ে গেছে। (কেন সে আলোচনায় এখন আর খুব বেশি ঢুকব না।) ভারতের সাথে পরমাণু চুক্তি করার জন্য আমেরিকা তার নিজ দেশের আইন পর্যন্ত পাল্টে ফেলছে। দু'দেশের মিলিত সামরিক মহড়া হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক অক্ষ বলা হচ্ছে 'মার্কিন-ইসরায়েল-ভারত' জোটকে।
বাংলাদেশের সাথে ভারতের আচরণ নিয়ে আলাদা একটা লেখা হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে সে চেষ্টা অবশ্যই করব। শুধু কয়েকটি বিষয় উল্লখ করে লেখাটি শেষ করব। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পন না করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশের বুকে অবস্থান এবং লুটপাট, বাংলাদেশের সাথে চুক্তি যাতে ভারতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা, ফারাক্কা সমস্যা, তিনবিঘা সমস্যা, ছিটমহল বিনিময়, মুহুরীর চর দক্ষিণ তালপট্টি দখল, সমুদ্রসীমা নির্ধারণসহ ছোট-বড় নানা ঘটনায় ভারত তার 'দাদাগিরি' ফলিয়ে চলেছে। এ দাদাগিরি নিছক বড়ভাই সুলভ আচরণ নয়, সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যকামী চরিত্র।
আমাদের শাসকরা কি এ সম্পর্কে জানেন না? তারাও জানেন। কিন্তু এটাকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে সচেতন করে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনার বিকাশে কাজে লাগানোর পরিবর্তে সকলেই সুবিধা নিতে সচেষ্ট। কেউ মুখে ভারত-বিরোধিতা করছেন, কেউ ভারত-বাংলাদেশ বন্ধু বলে গলায় মধুর সুর ফুটিয়ে তুলে চলেছেন। যেমন, জিয়াউর রহমান ভারত-বিরোধিতার জিকির তুলেছেন, কিন্তু তলে তলে ভারতের স্বার্থেই 'সার্ক' গঠনের কাজ করেছেন। এরশাদও তাই। জামাত ভারত-বিরোধিতার কথা বলে, আর ভারতের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীর দল বিজেপির সঙ্গে গিয়ে বৈঠক করে (২১ মে ১৯৯৩, তথ্য ২৫ মে আনন্দ বাজার)।
তাহলে জনগণের ভরসা কোথায়? একমাত্র ভরসা বামপন্থী শক্তি। বামপন্থী শক্তি নিজেদের বিভ্রান্তি-বিচ্যুতি কাটিয়ে যত সংহত হবে, ভারত-বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা, শান্তিপ্রিয় জনগণের ঐক্য যখন গড়ে ওঠবে -- ভারতের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে মোকাবেলা করা তখনই সম্ভব হবে। জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত, জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের বিজয় অনিবার্য।ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে আমি ভারতে পুঁজি গড়ে ওঠার ইতিহাস, তার লগ্নীপুঁজির বা একচেটিয়া পুঁজির স্তরে উপনীত হওয়ার ইতিহাসটুকু সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরেছি। এ কথা বলব না যে এ লেখার সীমাবদ্ধতা নেই। অনেক কথা সংক্ষেপে সারতে গিয়ে হয়ত যা বলতে চেয়েছি, পাঠকের কাছে তার উল্টো অর্থ প্রতিভাত হয়েছে। কোনো একটি বিষয়ের তথ্য হয়ত আরো তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল, আবার কোথাও হয়ত তথ্যের বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কিন্তু যাই হোক, আমার ধারণা, আমি কিঞ্চিৎ হলেও সফল হয়েছি।

এখন আমাদের শেষ প্রতিপাদ্য : ভারত কি সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে না হয়নি? নাকি আমাদের প্রপদের বন্ধুদের মতে, ভারত এখনো সম্প্রসারণবাদী (যদিও আমার কাছে সম্প্রসারণবাদী কথাটার মানে পরিস্কার নয়)? নাকি ভারত এমন দেশ যা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর প্রতিবেশী বলে বন্ধুও হতে পারে? অর্থাৎ ভারত সাম্রাজ্যবাদ হলেও হতে পারে, কিন্তু সে নখদন্তহীন, সুকুমার রায় বর্ণিত সেই সাপ যার শিং-নখ কিছু নেই, কাউকে কাটে না!

১৯১৬ সালে লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেন, যা সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের পূর্ববর্তী স্তর অর্থাৎ অবাধ প্রতিযোগিতা ও বাজারের আপেক্ষিক ক্রমসম্প্রসারণের যুগ থেকে আলাদা করে। লেনিন বলেন, সাম্রাজ্যবাদের যুগে -
১। উৎপাদন ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন এমন একটা উচ্চ স্তরে পৌঁছায় যা একচেটিয়ার জন্ম দেয় এবং একচেটিয়া পুঁজি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করে।
২। ব্যাংক পুঁজি ও শিল্পপুঁজির মিলনের মধ্য দিয়ে লগ্নীপুঁজির জন্ম হয়, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ধনকুবের গোষ্ঠী।
৩। পণ্য-রপ্তানির থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুঁজি-রপ্তানি অতিমাত্রায় গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়।
৪। একচেটিয়া গোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক এসোসিয়েশন গড়ে ওঠে, যারা বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
৫। বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীগুলি গোটা দুনিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে দখল করে।

এই পুসিত্মকাতেই লেনিন পুঁজিবাদের বিকাশের স্তরগুলি ভেঙে ভেঙে দেখান যে -
(১) ১৮৬০-৭০ সালে অবাধ প্রতিযোগিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং একচেটিয়া পুঁজি ভ্রূণাকারে জন্ম নেয়।
(২) ১৮৭৩-এর পুঁজিবাদের সঙ্কটের পর, দীর্ঘ সময় ধরে একচেটিয়া জোট (কার্টেল) গড়ে উঠলেও তা ছিল খুবই নগণ্য। সেগুলির স্থায়িত্ব ছিল না এবং ভাঙাগড়ার পর্যায় চলছিল।
(৩) উনিশ শতকের শেষদিকের তেজিভাব শেষ হওয়ার পর ১৯০০-১৯০৩ এর তীব্র মন্দার সময়েই একচেটিয়া জোটগুলি গোটা অর্থনীতির অন্যতম সত্মম্ভে পরিণত হয়। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে প্রবেশ করে।

বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদের স্তরে প্রবেশ করে, সেই সময় ভারতে পুঁজিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বড় মোড়লদের অধীনে, তাদের ছোট শরিক হয়েই চলেছে। কিন্তু যতই দিন গিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, খেয়োখেয়ী, টানাপোড়েনে কেউ এগিয়েছে, কেউ পিছিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত এগিয়েছে। এর একটা বড় কারণ ছিল তার নিজের দেশের বিশাল বাজার।

১৯৯১ সালে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে যে মুক্তবাজার নীতি গ্রহণ করা হয়, তা ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। এ তথ্যও আমি আগে উল্লেখ করেছি যে ওই সময়টাতে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০টিতে যার মধ্যে ৩৪৫টি গড়ে উঠেছে ১৯৯১-৯৩ এ তিন বছরে, যার মূল্যমান ১১.৬৫ বিলিয়ন রুপি। এর পর থেকে ভারতীয় পুঁজিপতিদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন বিশ্বের ধনীদের তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ভারতীয়দের নাম পাওয়া যায়।
২০০৯ সালে এসে আমরা যখন ভারতের পুঁজির চরিত্র এবং রাষ্ট্রচরিত্র বিচার করছি, তখন উইকিপিডিয়াতে বলা হচ্ছে, "The economy of India is the fourth largest in the world by GDP measured on a purchasing power parity (PPP) basis[5] and the twelfth largest in the world by market exchange rates." শুধু তাই নয়, বিশ্লেষকদের মতে, "In 2009, India had prominently established itself as the world's second-fastest growing major economy. According to one estimate, India is expected to overtake China as the world's fastest growing major economy in 2010."
দেখুন : http://en.wikipedia.org/wiki/Economy_of_India

ভারতের পুঁজি খাটছে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে। এবং এ পুঁজি শুধু পণ্য-রপ্তানি নয়, লেনিন বর্ণিত পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুঁজি-রপ্তানি (প্রযুক্তি, পরামর্শক, নো-হাউ ইত্যাদি, এ বিষয়টিও গর্ব পর্বে নাগেশকুমারের লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছি) অতিমাত্রায় গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়। আগস্ট ১৯৯১ থেকে হিসাব ধরে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত ভারতের ক্রমবর্ধমান এফডিআই-এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩৫৫ কোটি রুপি।
তথ্যসূত্র : Click This Link

এতো গেল ভারতীয় পুঁজির একচেটিয়া হয়ে ওঠার ইতিহাস যা ভারত রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের স্তরে উন্নীত করেছে। ভারত তার দেশের অভ্যন্তরে যে নীতি নিয়ে চলছে, সেখানকার জনগণকে যে শোষণ-নিপীড়নের মধ্যে ফেলেছে সেটা এই একচেটিয়া পুঁজিরই স্বার্থে, ওখানকার ধনকুবের গোষ্ঠীর স্বার্থে। ওই একই নিপীড়ন এবং আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে আশেপাশের দেশের মানুষ।
১৯৭১ সালে ভারত যখন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করছে, তখনও তার পেছনে কাজ করছে তার সাম্রাজ্যবাদী দূরভিসন্ধী। ভারতের জনগণ বিশেষত পশ্চিম বাংলার জনগণও বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে অবশ্যই প্রভেদ ছিল।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার কয়েকটি নজির টেনেই আমি আপাতত আমার লেখা শেষ করব।
সিকিম ছিল একটি স্বাধীন দেশ, ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। দেশটি 'ল্যান্ডলক' হওয়ায় অর্থাৎ চর্তুদিকে ভূমি বা অন্যদেশ পরিবেষ্টিত হওয়ায় নানা কারণে দেশটি ছিল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৭৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করে সিকিম-কে ভারতের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে এক অভ্যুত্থানে মালদ্বীপের প্রসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুম ক্ষমতাচ্যুত হলে ভারত ছত্রিসেনা পাঠিয়ে মামুনকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে আসে। শ্রীলঙ্কার জাতি-সমস্যাকে ব্যবহার করেও ভারত দেশটির ওপর আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। ১৯৮৭ সালের জুনে তামিলদের ওপর শ্রীলঙ্কান সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক সাহায্যের ধুয়া তুলে শ্রীলঙ্কার আকাশ-সীমা লঙ্ঘন করে জাফনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ নিক্ষেপ করে। এবং তারপর শান্তি রক্ষার নামে সেখানে সৈন্য প্রেরণ করে। শ্রীলঙ্কান সরকারকে বাধ্য করে একটা চুক্তিতে উপনীত হতে। ১৯৮৭ সালের ২৯ জুলাই তামিল বিদ্রোহ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভারত-শ্রীলঙ্কার চুক্তির আড়ালে মূলত একটি গোপন সমঝোতায় উপনীত হয় যার আসল লক্ষ্য ছিল ভারত মহাসাগরে এবং এ অঞ্চলে মার্কিন বা অন্য কোনো পরাশক্তির অনুপ্রেবশ রোধ করা। কারণ ওই সমঝোতায় বলা হয়েছিল --
(১) ভারতের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হলে অন্য কোনো রাষ্ট্রকে শ্রীলঙ্কার ত্রিঙ্কোমালি বা অন্য কোনো বন্দর সামরিক কাজে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
(২) সামরিক বা গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, ভারতীয়দের এমন আশঙ্কার ভিত্তিতে, একটি বিদেশী রেডিও কর্পোরেশনকে প্রচারকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকার যে চুক্তি করেছিল, সেটি পুনর্বিবেচনা করা।
(৩) পাকিস্তান, ইসরায়েল, ব্রিটেন ও আমেরিকার সামরিক বা গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা শ্রীলঙ্কায় আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ভারত সরকারের সঙ্গে একটি যৌথ 'কনসালটেনটিভ মেশিনারি' গঠন করা এবং শ্রীলঙ্কার যাবতীয় সামরিক প্রয়োজন -- সৈন্যবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সবই ভারত সরকারের কাছ থেকে নেওয়া।
নেপালের সঙ্গে আচরণেও ভারতের এ সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যকামী চরিত্র ফুটে ওঠে। ১৯৫০ সালে নেপাল-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত 'শান্তি ও মৈত্রী' চুক্তির আওতায় ১৯৬৫ সালে ভারত নেপালকে আরো একটি চুক্তি করতে বাধ্য করে। সেখানে বলা হয়, নেপালের সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ভারতে থেকে কিনতে হবে। আর যদি কোনো অস্ত্র ভারত সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে তা আমেরিকা-ব্রিটেন থেকে কেনা যাবে কিন্তু তা স্থলপথে ভারতের ভিতর দিয়ে নেপালে যেতে হবে। ভারত নেপালের সেনাবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দেবে, এমনকি তাদের পোষাক-পরিচ্ছদও সরবরাহ করবে। তথাকথিত এ 'শান্তি-মৈত্রী' চুক্তি লঙ্ঘন করে ১৯৮৯ সালে নেপাল চীন থেকে একটি এন্টি এয়ারক্রাফট গান কেনে এবং তিব্বতের মধ্য দিয়ে সড়ক পথে নেপালে নিয়ে আসে। এর বিনিময়ে শাস্তি হিসাবে ভারত ১৯৮৯ সালের ২৩ মার্চ ভারত-নেপালের ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভারত ট্রানজিট পয়েন্ট বন্ধ করে দিয়ে নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। নেপাল বহুদিন ধরে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করার জন্য ভারতের কাছে ১৮ কিমি ট্রানজিট চাইছে, আজ পর্যন্ত পায়নি। আর এসব টানাপোড়েনে নেপালি বুর্জোয়াদের ভারত ঘনিষ্ঠ অংশের সহযোগিতায় ভারত-বিরোধী হিসাবে খ্যাত রাজা জ্ঞানেন্দ্র খুন হয়ে গেছেন।
স্থানীয় মোড়ল হিসাবে ভারতের ভূমিকা মার্কিন-ব্রিটিশ সাম্রজ্যবাদী শক্তি আরো আগেই স্বীকার করে নিয়েছে :
“The US governments approval of Indian action in Sri Lanka & Maldives, said Dr. William Richer, Head of the Dept of Political Science, Kansas State University, in Culcutta on Monday, is recognition of regional role that Washington expect New Delhi to play in the Indian sub-continent and its neighborhood. After all, India is the strongest & largest military power in the region. The Indian action in the Maldives, according to Dr. Richter, has reinforced its image of being the policeman of the region.” (The Statesman, 22.11.88)
এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোও এ সম্পর্কে সচেতন : ১৯৮৮ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনে রোমের দৈনিক 'লা রিপাবলিকা'তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, "আমি ভারতকে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি মনে করি। এটা অস্বীকার্য সত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সমেত বিশ্বের সকল বৃহৎ শক্তিই এটা স্বীকার করেছে। ... আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভারতের সাথে পরামর্শ না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করতে কোনো উদ্যোগই নেবে না। (আনন্দবাজার, ১৩.০৮.৮৭)
আর আজকের পরিস্থিতি তো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে। ভারতের মূল্য বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিনীদের কাছে বহু গুণ বেড়ে গেছে। (কেন সে আলোচনায় এখন আর খুব বেশি ঢুকব না।) ভারতের সাথে পরমাণু চুক্তি করার জন্য আমেরিকা তার নিজ দেশের আইন পর্যন্ত পাল্টে ফেলছে। দু'দেশের মিলিত সামরিক মহড়া হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক অক্ষ বলা হচ্ছে 'মার্কিন-ইসরায়েল-ভারত' জোটকে।
বাংলাদেশের সাথে ভারতের আচরণ নিয়ে আলাদা একটা লেখা হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে সে চেষ্টা অবশ্যই করব। শুধু কয়েকটি বিষয় উল্লখ করে লেখাটি শেষ করব। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পন না করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশের বুকে অবস্থান এবং লুটপাট, বাংলাদেশের সাথে চুক্তি যাতে ভারতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা, ফারাক্কা সমস্যা, তিনবিঘা সমস্যা, ছিটমহল বিনিময়, মুহুরীর চর দক্ষিণ তালপট্টি দখল, সমুদ্রসীমা নির্ধারণসহ ছোট-বড় নানা ঘটনায় ভারত তার 'দাদাগিরি' ফলিয়ে চলেছে। এ দাদাগিরি নিছক বড়ভাই সুলভ আচরণ নয়, সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যকামী চরিত্র।
আমাদের শাসকরা কি এ সম্পর্কে জানেন না? তারাও জানেন। কিন্তু এটাকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে সচেতন করে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনার বিকাশে কাজে লাগানোর পরিবর্তে সকলেই সুবিধা নিতে সচেষ্ট। কেউ মুখে ভারত-বিরোধিতা করছেন, কেউ ভারত-বাংলাদেশ বন্ধু বলে গলায় মধুর সুর ফুটিয়ে তুলে চলেছেন। যেমন, জিয়াউর রহমান ভারত-বিরোধিতার জিকির তুলেছেন, কিন্তু তলে তলে ভারতের স্বার্থেই 'সার্ক' গঠনের কাজ করেছেন। এরশাদও তাই। জামাত ভারত-বিরোধিতার কথা বলে, আর ভারতের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীর দল বিজেপির সঙ্গে গিয়ে বৈঠক করে (২১ মে ১৯৯৩, তথ্য ২৫ মে আনন্দ বাজার)।
সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে কোনো মোহ নিয়ে থাকার সুযোগ নেই। সেটা ভারতই হোক আর মার্কিনিই হোক। আর সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন একজন, সাম্রাজ্যবাদ যখন ফুল নিয়ে বন্ধুত্ব দেখাতে আসে তখনও সে তার হীন সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য চরিতর্থ করার জন্যেই আসে।
তাহলে জনগণের ভরসা কোথায়? একমাত্র ভরসা বামপন্থী শক্তি। বামপন্থী শক্তি নিজেদের বিভ্রান্তি-বিচ্যুতি কাটিয়ে যত সংহত হবে, ভারত-বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা, শান্তিপ্রিয় জনগণের ঐক্য যখন গড়ে ওঠবে -- ভারতের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে মোকাবেলা করা তখনই সম্ভব হবে। জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত, জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের বিজয় অনিবার্য।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৪৫
১৯টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×