লেনিন মানে অতীন নয়, ভবিষ্যৎ - জর্জ বার্নার্ড শ’
আমি নিজে লেনিনের মতো। আমি একজন বিপ্লববাদী। আমার মনে হয় আমি একজন বিপ্লববাদী হিসাবেই জন্মেছি। ১৯১৭’র আগে আমি লেনিনের নাম কখনও শুনিনি। তখন আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম। ওখান থেকেই আমি এসেছি। ওখানকার মানুষের অবস্থাও আমারই মতো। এরপরও লেনিন সম্পের্কে ব্যক্তিগতভাবে আমরা খুব বেশি কিছু জানিনি।
লেনিনের পড়াশুনা, আবিষ্কার, মৌলিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে এই সন্ধ্যায় আপনাদের কাছে অন্যান্য বক্তারা বললেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, রাশিয়াতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে ছাপ ফেলেছেন, অন্যান্য যে সমস্ত দেশ তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানে না বা তাঁকে দেখেওনি সেখানেও তিনি একইরকম গভীর ছাপ ফেলেছেন।
আপনাদের আমি একথা বোঝাতে পারব না। কেন এমন ঘটেছিল আমি জানি না। এর যেন এক অদ্ভূত চুম্বকীয় শক্তি আছে। এরকম ঘটনা কীভাবে ঘটে বিজ্ঞান এখনও তা বিশ্লেষণ করে বলতে পারেনি। তবুও এই রাশিয়ায় মতোই এ কথা সর্বত্রই সত্য। তিনি তাঁর সমিতির (সংগঠনের) সভ্যদের মধ্যেএকজন ছিলেন। এই সমিতিতে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, দৃঢ়চিত্ত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন বহু মানুষ ছিলেন। এঁদের অনেকেই লেনিনের থেকে নানা বিষয়ে এগিয়ে ছিলেন। বিরাট কর্মযজ্ঞে এঁদের সহায়তার জন্য লেনিন এঁদের কাছে ঋণী। তা সত্ত্বেও অসাধারণ বিশিষ্ট মানুষগুলির মধ্যেও তিনি অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি যা বলছি তা আপনাদের বোঝাতে পারব না। আমি আপনাদের এক অদ্ভূত ঘটনার কথা বলতে পারি। রাশিয়াতে যেখানে বহু মানুষ গভীরভাবে লেনিনকে জানে সেখানে তিনি যেমন সকলকে ছাপিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, ইংল্যান্ডে যেখানে তাঁকে প্রায় কেউই জানে না, সেখানেও তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন।
লেনিন মারা গেছেন বলে আপনারা একটিবারও ভাববেন না যে লেনিনের গুরুত্ব, লেনিনের বিরাট প্রয়োজনীয়তা অতীতের বিষয়। ভবিষ্যতের দিকে আপনাদের দৃষ্টি দিতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য তাঁর গুরুত্ব কোথায়? হ্যাঁ, তাঁর প্রয়োজনীয়তা আছে। লেনিন যে পরীক্ষা করেছেন,যার প্রধান কারিগর তিনি, আমাদের কাছে তিনি যার মূর্ত রূপ, সামাজিক সংগঠন নিয়ে তাঁর সেই পরীক্ষার পরাজয় ঘটলে সভ্যতা ভেঙে পড়বে, যেভাবে আগে বহু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক ইতিহাস গবেষণা থেকে আমরা জেনেছি পৃথিবীতে বহু সভ্যতা ছিল। আমাদের মতোই সেই সব সভ্যতার ইতিহাস। পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক সভ্যতা আজ যেখানে পৌঁছেছে ওই সব সভ্যতাও যখন সেখানে পৌঁছায় তখন তাদেরও দ্রুত অবক্ষয় শুরু হয়েছে। যার ফলে গোটা ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। আর মানবজাতি প্রায় বর্বর যুগের কাছাকাছি ফিরে গেছে। মানবসভ্যতা বারবার ওই বিশেষ স্তরটা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে এবং বারবার তার পরাজয় ঘটছে।
এখনওই বিশেষ স্তর পার হওয়ার পদ্ধতি লেনিন সংগঠিত করেছেন। তাঁর এই পরীক্ষা শেষপর্যন্ত ক্রিয়া করলে, অন্যান্য দেশগুলি তাঁর এই পথ এবং শিক্ষাগুলি অনুসরণ করলে এবং সারা পৃথিবীতে কমিউনিজমের এই মহান পরীক্ষা ছড়িয়ে পড়লে আমরা ইতিহাসের এক নতুন যুগে প্রবেশ করব। আগে যেমন পরাজয় বরণ করেছি, ধ্বংস হয়ে গেছি, আবার নতুনভাবে শুরু করে, আবার সেই দুর্দশার মধ্য দিয়ে হেঁটে সেই একই দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছেছি, সেই ঘটনা আরঘটবে না। মানব ইতিহাসের এমন এক যুগে আমরা পৌঁছাব যার সম্পর্কে বর্তমানে আমাদের কোনও ধারণা নেই।
আর ঠিক এখানেই আমাদের কাছে লেনিনের তাৎপর্য।
লেনিনের দূরদৃষ্টি যেভাবে ভবিষ্যতকে দেখতে পেয়েছে, যদি ভবিষ্যৎ সত্যিই তাই হয়, তাহলে আমরা সকলেই সুখী হব। নির্ভয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব। কিন্তু যদি এই পরীক্ষা বিফল হয়, গৃহীত না হয়, পৃথিবী যদি পুঁজিবাদের পথেই চলতে চায়, তাহলে আপনাদের কাছ থেকে বিষণ্ণ হৃদয়ে আমি বিদায় নেব বন্ধু।
(‘লেনিন ইন প্রোফাইল’ রচনাসংগ্রহ থেকে)
[বিখ্যাত ইংরজে সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ জর্জ বার্নাড শ’ ১৯৩১ সালে রাশিয়া ভ্রমণকালে এক অনুষ্ঠানে এ বক্তৃতাটি করেন। এটি অনুবাদ ও প্রকাশ করেছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক গণদাবী ( ৬৬ বর্ষ ২১ সংখ্যা, ৩-৯জানুয়ারি ২০১৪)।]
২১ জানুয়ারি কমরেড লেনিনের মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে তাঁর সংগ্রামী স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
লেনিন মানে অতীন নয়, ভবিষ্যৎ - জর্জ বার্নার্ড শ’
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছবির গল্প, গল্পের ছবি
সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!
কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন