আমার বন্ধু আসিফ ইকবাল ছোটবেলা থেকেই বর্তমান বয়সের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকে।
তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। কোন এক সকালে দুজন লাস্ট বেঞ্চে বসে আছি। সেদিন হুজুর সমাজ ক্লাস নিচ্ছেন। যিনি সমাজ পড়ান, তিনি আসেন নি। হুজুর ক্লাস নিতে এসেছেন। হুজুরের ক্লাস মানে, একটা কিছু লেখার আদেশ দেবেন। তারপর চেয়ারে বসে কিছুক্ষণের জন্য হালকা ঘুম দেবেন। ছাত্র ছাত্রীরা এ সুযোগে হৈ চৈ করবে, তিনি চোখ খুলে দেখবেন কিন্তু কিছু বলবেন না। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলবেন। ঘণ্টা পড়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পড়া ধরবেন।
শিক্ষকের ঝিমানো দেখে স্বভাবতই ছাত্র-ছাত্রীরা আদেশ পালন করতো না। হুজুর তখন বেত হাতে নিতেন। অনেকের পিঠ তখন বেতের স্পর্শ পেত। সেদিনের সকালে আসিফ ইকবাল শুরু থেকেই ফিসফাস করা শুরু করেছিলো। আগের রাতটিতে সে একটি মহান আবিস্কার করেছে, সেটি আমাকে বলতে চায়। বাক্যটি ছিল এরকম—'জানিস, আমাদের আব্বু আম্মুরা রাতে কী করে?'
অল্প বয়সে বাক্যটির অর্থ ধরতে না পারলেও সেটি যে অর্থবহ তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। এমন অর্থবহ তথ্য জানার মুহূর্তেই হুজুর বেত হাতে নিলেন। বেতের স্বাদ পেয়ে আমি এমন ভাব করলাম যেন আসিফ ইকবালের কারণেই হুজুরের আদেশ পালন করিনি।
কেজি স্কুল শেষে হাই স্কুলেও আমরা একই ঠিকানায়। সে তখন ঐ বয়সেই ওয়ারফেজ শুনছে। ক্লাসের অন্য কেউ এই ব্যান্ডের নাম জানে না। ক্লাস সিক্সে আমরা বেঞ্চে জ্যামিতি বক্সকে ড্রামস বানিয়ে, কলম আর স্কেলকে ড্রামস স্টিক হিসেবে ব্যবহার করে আর্টসেলের 'পথচলা' গাচ্ছি। হঠাৎ আমাদের কেউ একজন বলে উঠল— এগুলা কী গান! রবি চৌধুরীর গান জানিস ? জানলে গাইতে থাক।
এরপর আসিফ ইকবালকে কোনদিন ক্লাসে গান গাইতে দেখিনি। গান গাওয়ার জন্য স্টেজ বদলাতে হলো। স্কুলের পাশেই কলেজ। সেখানে মাঠের পাশেই গ্যালারী আছে। আমরা দুজন প্রায় সময় সেখানে গিয়ে বসে থাকি। সে চিৎকার করে ওয়ারফেজের গান করে, 'হে সমাজ! আমি চাই না তোমার আশ্রয়।' কলেজের মেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্লাস সিক্স-সেভেনেই ওর ব্যান্ড করার ইচ্ছে ছিল। গীটারে হাতেখড়ি নিল। পরে কোন এক কারণে আর ব্যান্ড করা হয়নি। তবুও সে গিটারিস্ট।
কলেজে ওঠে আলাদা হয়ে গেলাম। তবুও দেখা হয়ে যেতো। একদিন কনসার্টে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো। সে আমাকে জানাল, ব্যান্ডগুলো কী কী গান করবে তার তালিকাটা যেন তাকে পাঠিয়ে দেই। কনসার্ট শেষে দায়িত্বটা পালন করলাম। কনসার্টে না গিয়েই সে চমৎকার একটি নিউজ করল। পরের দিন পত্রিকাতে সেটি ছাপাও হয়ে গেলো। বন্ধুর মেধা দেখে আমি বিমুগ্ধ। তবুও বন্ধু আমার সাংবাদিক!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে দেখছি, সে এখন পার্ট টাইম চাকরী করে। টিউশনি করে। পড়ালেখাও চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখলে নিজেকে প্রায়ই বলি, আমি এতো অলস কেন ? আমাদের সমাজে বয়সের চেয়ে এগিয়ে থাকাকে পাকনামো বলে। অন্য চোখে দেখা হয়। যা-কে গোল্লায় যাওয়া বলে। তবুও আসিফ ইকবালের এই এগিয়ে থাকা দেখতে আমার ভালো লাগে।
একটা সময় ওর পিতার সাথে প্রায় দেখা হতো। বাসে কিংবা পথে ঘাটে। ওনি প্রায় জানতে চাইতেন, 'বাবা, ও লেখাপড়া ঠিক মতো করে তো ?' ছোটবেলা থেকে দেখার কারণেই বোধ হয় বলতো। আশা করি তিনি এখন এ ধরণের দুশ্চিন্তা করেন না।
বন্ধু, তোমার জয় হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:০৪