somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শরৎচন্দ্রের বৈঠকি গল্প

১০ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যারা অনেক উঁচুমানের গল্পকার, তারা যখন আড্ডায় কোনও গল্প বলেন, সেখানে উপস্থিত সবাই নিমিষেই শ্রোতাতে পরিণত হন। নিজেকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন গল্প বলেছেন আর শ্রোতাদের অনেকেই অমনোযোগী, কেউ বা হাসাহাসি করছেন, ভাবা যায়? অবিশ্বাস করার উপায় নেই, কারণ তাঁর লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ বইতে এরকম একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। এরপর তিনি অনেক পরিশ্রম করে গল্প বলার কৌশল আয়ত্ব করে সফল হয়েছিলেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী যখন কথা বলতেন, তখন নাকি শব্দের ফুলকি ছুটত। তরুণ কবিদের স্বীকারোক্তি আছে, সৈয়দদা’র আড্ডায় হাসতে হাসতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যেত। আমাদের হুমায়ূন আহমেদও ভালরকম গল্প বলতে পারতেন। আর তাঁর রসবোধের উদাহরণ ছড়িয়ে আছে অজস্র লেখায়। সে জন্যই হয়তোবা সুনীল লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় যেসব গল্প বলেন, তা রেকর্ড করে রাখা উচিত। কবিদের মধ্যেও এরকম অনেকেই আছেন। বিশেষ করে শহীদ কাদরীর কথা বলতে হয়। যা-ই হোক, আমার ধারণা (ভুলও হতে পারে) আসর জমিয়ে রাখার এই গুণটাই লেখককে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করে।
সম্প্রতি একটা বই পড়লাম, নাম ‘শরৎচন্দ্রের বৈঠকি গল্প।’ বিভিন্ন আড্ডায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৌখিকভাবে যেসব গল্প বলতেন, এখানে তার লেখ্যরূপ দিয়েছেন গোপালচন্দ্র রায়। শরৎচন্দ্র একই কাহিনী একেকসময় একেকভাবে বলতেন। বইটিতে সেরকম কিছু উদাহরণও আছে। সে থাকুক। বইটি পড়ে মনে হল, ভূতের গল্প বলায় তাঁর সীমাহীন দক্ষতা ছিল।
তাহলে, এবার একটা গল্প বলা যাক্‌।




ভাগলপুরে এক আশ্চর্য সাধু এসে অনেক লোকের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক অদ্ভুত কাণ্ড দেখাচ্ছে। তো, এসব অলৌকিক ঘটনায় শহরজুড়ে হৈ চৈ শুরু হলো। সাধুর অনেক ভক্ত ও শিষ্য জুটে গেলো। একদিন সাধু তার শিষ্যদের বলল হাম গঙ্গামায়ী কো পূজা দেগা। পর দিন সিঁড়ি ঘাটে প্রচুর পূজার উপকরণ হাজির। গঙ্গাতীরে একেবারে জলের কাছে সব সাজানো হলো। এদিকে সাধু পূজায় বসবে এমন সময় নিদারুণ একটা কাণ্ড ঘটে গেলো। এক কোম্পানির বড় স্টিমার রোজই সে সময় সিঁড়ি ঘাট দিয়ে যেত। ওই স্টিমারটির যেমন গর্জন ছিল, তেমনি ঢেউ তুলত। সেই ঢেউ এসে পূজার উপকরণগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। সাধু তো একেবারে ক্ষেপে চিৎকার করে বলল, এত বড় স্পর্ধা জাহাজের! আমার গঙ্গামায়ীকির পূজা ভাসিয়ে দিয়ে যায়! আচ্ছা কাল আয় তুই বেটা জাহাজ। এসে দ্যাখ, কাল তোকে আমি গিলে খাব।

শিষ্যরা তো ভীষণ অবাক, সাধু বলে কী! একজন তো বলেই ফেলল, এ যে জাহাজ! সাধু মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ও আমার এক কথা। কাল ওই জাহাজ আমি গিলে খাবই, ওর আর নিস্তার নেই। এত বড় স্পর্ধা! আমার পূজা ভাসিয়ে দিয়ে যায়! তারা তবুও নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। একটা মানুষ এত বড় জাহাজ গিলে খাবে! তখন একজন জানাল, সাধনার বলে সবই হয়, জাহাজ তো তুচ্ছ!

এদিকে এই ঘটনা চারিদিকে রটে গেলো। পরদিন সকাল থেকেই সিঁড়ি ঘাটে লোক জমতে শুরু করল। জায়গা না পেয়ে অনেকেই গাছের ওপর উঠে বসলেন। কেউ কেউ গঙ্গায় নেমে পড়লেন। লোকে লোকারণ্য অবস্থা। এগারোটা পার হয়ে বারোটাও বেজে যাচ্ছে, সাধুর কোনও সাড়া নেই। তিনি তখন ধুনি জ্বালিয়ে ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন। এমন সময় দূরে আসামীকে দেখা গেল। সবাই হৈ চৈ করে উঠল। ওই যে জাহাজ আসছে, ওই যে জাহাজ আসছে। লোকজনের চিৎকারে সাধুবাবার ধ্যান ভেঙে গেলো। তিনি গম্ভীর মুখে গঙ্গায় কোমরজলে নেমে পড়লেন। তারপর কোমরে দু’হাত রেখে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আর তোর নিস্তার নাই আজ! আয় তুই! তোকে আজ খাই।

গঙ্গার তীরে এ-সময় সমস্ত শব্দ থেমে গেলো। সবার নিশ্বাস বন্ধ হবার অবস্থা! সকলে ভাবছিল, এত বড় জাহাজকে গিলে খাবে কী করে! ভীমগর্জনে এসে পড়ল জাহাজ। ঢেউ আছড়াতে লাগল সিঁড়ি ঘাটে। সাধু হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, এসেছিস? আয় তবে! বলেই বিরাট এক হাঁ করে জাহাজের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। ঠিক এমন সময় অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেলো। দশ-পনেরো জন লোক এসে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জলের মধ্যে নেমে সাধুর পা জড়িয়ে বলল, রক্ষা করুন। রক্ষা করুন গুরুদেব! একটা তুচ্ছ জাহাজের ওপর রাগ করা কি আপনার সাজে? তাছাড়া ওর ভেতর কত নর-নারী-শিশু আছে, তারা তো কোনও অপরাধ করেনি গুরুদেব! কোন অপরাধে আপনি ওদের খাবেন?

এ কথা শুনে সাধু ভ্রু কুঞ্চিত করে কী যেন ভাবল, তারপর দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তা বটে! আচ্ছা ছোড় দেও। তুমহারা বাত রহা বেটা। তারপর জাহাজের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বললেন, যা বেটা, খুব বেঁচে গেলি আজ। তোর পুনর্জন্ম হয়ে গেলো।
জাহাজ ততক্ষণে সাধুকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। সমস্ত সিঁড়িঘাট যেন এরপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আসলে, যারা জাহাজ গিলে না খাবার জন্য অনুরোধ করেছিল, তারা সাধুরই শেখানো লোক।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাগলপুর গেলে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। প্রথম দেখা হওয়ার সেই দিনটিতে বনফুল তাঁকে বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন শরৎচন্দ্র ভাল বৈঠকি গল্প বলতে পারেন, সেই গল্প শোনার লোভে এসেছেন। তখন শরৎচন্দ্র তাঁকে সাধুর এই গল্পটি বলেছিলেন।‘শরৎচন্দ্রের বৈঠকি গল্প’ বইটিতে এরকম বেশ কিছু বৈঠকি গল্প আছে। এতে গল্পকার শরৎচন্দ্রকে অন্যভাবে চেনা যাবে, এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়।

৩.০১.২০১৭

রচনাটি দৈনিক আজাদিতে প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×