সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। প্রাচীন মিশরে, নীল নদের সবুজ পানি যেখানে আছড়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির বুকে, বাস করত এক তরুণী—নাম রাদোপেস। জন্ম তার গ্রিসে, কিন্তু শৈশবেই জলদস্যুরা অপহরণ করে তাকে, দাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয় মিশরে। অবশ্য তার মালিক ছিলেন দয়ালু, গাছের ছায়ায় ঘুমিয়েই কাটত যার অধিকাংশ সময়। আর এ কারণে তিনি দেখতে পেতেন না কীভাবে বাড়ির অন্য মেয়েরা, অন্য দাস-দাসীরা সব সময় রাদোপেসকে অপদস্থ করত, কারণ সে দেখতে ছিল অন্যরকম।
তাদের কেশ ছিল সোজা এবং কৃষ্ণকায়, রাদোপেসের সোনালী, কোঁকড়ানো। তাদের বাদামী চোখ, রাদোপেসের সবুজ। উজ্জ্বল তাম্রবর্ণ তাদের গা, কিন্তু রাদোপেসের ফ্যাকাসে, যা রোদে পুড়ে হয়ে উঠত লালচে, ফলে সবাই তাকে ডাকত "গোলাপী রাদোপেস।" তারা তাকে দিয়ে দিয়ে কাজ করাত প্রচুর, চিৎকার করে সারা দিনই বলত, "নদীতে যাও, রাদোপেস, ধুয়ে নিয়ে আস কাপড়গুলি।" "আমার আলখেল্লাটা সেলাই করে দাও," "বাগান থেকে তাড়িয়ে দাও রাজহাঁসগুলি," "রুটি বানাও এক্ষুণি।"
পশুপাখি ছাড়া অন্য কোনো বন্ধু ছিল না রাদোপেসের। পাখিদেরকে সে শিখিয়েছিল তার হাত থেকে খাবার খুঁটে খেতে, বানরটি বসে থাকত তার কাঁধে, আর কাদার ভেতর থেকে মুখ তুলে তার কাছে আসত বৃদ্ধ হিপোপটেমাস। দিন শেষ হয়ে গেলে, যদি সে ক্লান্ত না হত, চলে যেত নদীর তীরে তার পশুপাখি বন্ধুদের কাছে এবং শরীরের খানিক শক্তি থাকলে নাচত তাদের সাথে।
এক বিকেলে রাদোপেস যখন নাচছিল, আর ঘূর্ণিপাক খাচ্ছিল বাতাসের চেয়েও বেশি গতিতে, কোনোমতে মাটিতে পা ছুঁইয়ে, তার মালিক ঘুম থেকে উঠে দেখতে লাগলেন নাচ। মুগ্ধ হলেন তিনি, ভাবলেন, "এত মেধাবী মেয়েটির পা জুতোহীন থাকা মানায় না।" রক্তগোলাপের মতো স্বর্ণখচিত এবং চামড়ার শুকতলা-সম্পন্ন এক জোড়া জুতো চলে আসল তার জন্য। এতে অন্য মেয়েরা ঈর্ষাণ্বিত হয়ে তাকে আরো বেশি অপছন্দ করতে লাগল।
একদিন খবর আসলো ফারাওয়ের সভা বসবে মেমফিস নগরীতে, রাজ্যের সবাই তাতে আমন্ত্রিত। ওহ, রাদোপেসের তীব্র ইচ্ছা হলো অন্য মেয়েদের সাথে সেখানে যেতে। কারণ সে জানত তারা নাচবে সেখানে, গাইবে, আর খাবে মজাদার সব খাবার। অন্য মেয়েরা তাদের সবচেয়ে ভালো পোশাক নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়ে রাদোর উপর আরো কাজ চাপিয়ে দিতে লাগল। তারা তাকে না নিয়েই ভাসিয়ে দিল তাদের ভেলাটি, বিষণ্ণ মেয়েটি পড়ে রইল পেছনে। কাপড় ধুতে ধুতে বিষাদমাখা সুরে সে গাইতে লাগল, "ধুতে হবে কাপড়, বাগানটি করতে হবে পরিষ্কার, আর মাড়াই করতে হবে শস্যদানা।"
ছোট্ট এই সঙ্গীতে ক্লান্ত হয়ে হিপোপটেমাসটি পানি ছিটকে ভেসে উঠল জলের উপর, ভিজিয়ে ফেলল রাদোপেসের জুতা। মেয়েটি দ্রুত ভেজা জুতা আঁকড়ে ধরে, মুছে রোদে শুকাতে দিল। কাজে মগ্ন হয়ে গেল সে, আর আকাশ ঘন কালো হয়ে নেমে আসলো এক ফ্যালকন, ছোঁ মেরে নিয়ে গেল একটি জুতা। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেল রাদোপেস কারণ সে বুঝতে পারল ওসিরিস আর আইসিসের পুত্র হোরাস নিয়ে গেছে তার জুতা। তার এখন একপাটি মাত্র জুতা রইল, যা সে বেঁধে রাখল কামিজের সাথে।
ঠিক এই সময় ফারাও প্রথম আহমোস, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের অধিপতি, সিংহাসনে বসে মানুষের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত বোধ করতে লাগলেন। তার খুব ইচ্ছা করতে লাগল সাহারার বুকে রথ চালনা করতে। হঠাৎ ফ্যালকনটি নিচে নেমে এসে রক্তগোলাপের মতো স্বর্ণখচিত জুতাটি নিক্ষেপ করল তার কোলে, তারপর উড়ে চলে গেল। অবাক হয়ে গেলেন আহমোস, কিন্তু এটি হোরাসের নিদর্শন বুঝতে পেরে রাজ্য জুড়ে এক আদেশ জারি করলেন, "মিশরের সব তরুণীদের এই জুতা পায়ে দিয়ে দেখতে হবে—জুতার মালিক হবে ফারাওয়ের রাণী।" অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে, ফারাও নিজেই তার রথ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সোনালী জুতার মালিককে খুঁজতে। ভূমিতে খোঁজা শেষ হয়ে গেলেও মালিককে খুঁজে পেলেন না ফারাও। তখন তিনি বজরা ভাসালেন নীলের বুকে, আর পাড়ের সব মেয়ে জুতা পরে দেখতে লাগল। এভাবেই এক সময় বজরা এসে এসে থামল রাদোপেসের বাড়ির বাঁকের কাছে। সবাই শুনল তোপধ্বনি, বাদ্যের সুর, দেখল পতপত করে উড়া রেশমের পাল। দাসী মেয়েরা দৌড়ে গেল ঘাটের কাছে জুতা পরার চেষ্টা করতে, রাদোপেস লুকিয়ে রইল ভীড়ের ভেতর। অন্য মেয়েরা বুঝতে পারল এ রাদোর জুতা, কিন্তু কোনো কিছু না বলে তারা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল।
ভীড়ের মধ্যে রাদোর উপর নজর রাখছিলেন ফারাও, এবং এক সময় তাকে চেষ্টা করতে বললেন। রাদোপেস তার ক্ষুদ্র একটি পা সে জুতার ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিল, কামিজের ভেতর থেকে বের করল অন্যটি। ফারাও ঘোষণা করলেন এই মেয়েই হবে তার রাণী। অন্য মেয়েরা চিৎকার করে উঠল, "সে একজন দাসী মাত্র, এমনকি সে মিশরীয়ও নয়!"
ফারাও বললেন, "সে মিশরীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মিশরীয়, কারণ তার নয়ন নীলনদের জলরাশির মতো সবুজ, কেশ প্যাপিরাসের মতো পালকসদৃশ, এবং ত্বক পদ্মফুলের মত গোলাপী।"
[উপরের বর্ণনাটি কিছু সত্য, কিছু কল্পনার মিশেল। মিশরের ফারাও আহমোস (২৬তম রাজবংশ, ৫৭০-৫৩৬ খ্রিস্টপূর্ব) সত্যি সত্যি গ্রিক এক ক্রীতদাসীকে বিয়ে করে তাঁকে রাণীর মর্যাদায় ভূষিত করেন। ঈশপ (Aesop) নামের আরেক স্বদেশী ক্রীতদাস সেই মেয়েটিকে অনেক গল্পও শুনিয়েছিলেন। তবে রাদোপেসের রাণী হয়ে উঠার এই প্রাচীনতম গল্পটি বিশ্বের প্রায় সব দেশে ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে চালু রয়েছে।
পাঠকের বলতে হবে গল্পের রাদোপেস সারা বিশ্বে এখন কোন নামে পরিচিত? ]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


