ভূমি থেকে ৩১,০০০ ফুট উঁচুতে বিমানটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন ত্রিশ বছর বয়স্ক কর্নেল পল টিব্বেট। গতকালই বি-২৯ বিমানটির নাম পরিবর্তন করেছেন তিনি, নতুন নাম রেখেছেন "ইনোলা গে"। ইনোলা গে কর্নেলের মায়ের নাম।
উত্তর থেকে বেতারে একটি ম্যাসেজ আসলো কর্নেলের কাছে, "...যেকোনো উচ্চতায় মাত্র তিন-দশমাংশ ঢেকে রেখেছে মেঘ। নির্দেশঃ প্রথম শিকারে বোমা নিক্ষেপ।"
সবাইকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দেন কর্নেল। সুদীর্ঘ রাতের অভিযান শেষ হতে যাচ্ছে। মাসের পর মাস কঠোর প্রস্তুতি এবং ইতিহাস রচনা করার রোমাঞ্চ তাদের ভেতর বয়ে আনল নতুন উদগ্রীবতা। ইনোলা গে'র প্রত্যেকেই এসেছেন সুনির্দিষ্ট মিশন নিয়ে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। পঁয়ত্রিশ মিনিট পর, শহরের সীমানার ভেতর, নির্দিষ্ট এলাকার দিকে বিমানের গতিপথ সেট করলেন কর্নেল। ইনোলার খোলের ভেতর থেকে লিটল বয়'কে বের করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে লাগলেন দলের বোমারু, মেজর টম ফেরেবী।
স্থানীয় সময় সকাল ৮:১৫। সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আইওই সেতুটি। ইনোলার ভেতর থেকে লিটল বয়'কে ছেড়ে দিলেন মেজর ফেরেবী, তীক্ষ্ণ নারকীয় চিৎকার দিয়ে পড়তে থাকে লিটল বয়। অক্সিজেন মাস্কের ভেতর চোখের উপর ঘন কালো কাঁচের চশমা পরে নিলেন অভিযাত্রীরা। এ ব্যাপারের তাদের উপর কঠোর নির্দেশ ছিল উপর থেকে, যা খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল তাদের। কিন্তু নির্দেশটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করলেন তারা।
লিটল বয়ের চিৎকার শুনতে পেলেন বলে মনে হলো অভিযাত্রীদের। কিন্তু সেটি ছিল তাদের কল্পনা; আসলে উৎকণ্ঠায় কাঁপতে থাকা তাদেরই হৃদস্পন্দন ছিল সেটি, কারণ বিমানের ভেতর বাইরের শব্দ আসার তেমন কোনো উপায় ছিল না।
ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটার ভেতর দিয়ে মৃত্যুর হিমশীতল বীভৎসতায় পড়তে থাকে লিটল বয়। ১৮৫০ ফুট উঁচুতে অগ্নি সংযোগ হলো তার ফিউজে। পৃথিবীর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীরা অনেক হিসেবনিকেশ করে বের করেছেন এই উচ্চতাটি, যাতে লিটল বয়ের প্রতিক্রিয়া সর্বোচ্চ হয়।
এবং সত্যি সত্যি ফিউজে অগ্নিসংযোগের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভূমি সমতলে প্রতিক্রিয়া ছিল অকল্পনীয় নৃশংস। লিটল বয়ের কেন্দ্রের তাপমাত্রা বেড়ে গেল ১,০০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি, বাইরের দিকে ধাবিত হলো বিদ্যুতায়িত আয়নের চোখ ধাঁধানো আলোক বর্ণালিঃ লাল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি। ঠিক নিচে, ভূমির তাপমাত্রা দাঁড়াল ৩,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এর অর্ধেক তাপমাত্রায় লোহা গলিয়ে ফেলা সম্ভব। নিমেষের মধ্যেই বাষ্প হয়ে উড়ে গেল হাজার হাজার মানুষ, গলে গেল পড়ল আরো হাজার হাজার, যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে থেকেই। এক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে জীবিত ও মৃত পুড়ে গেল সবকিছু, মানুষের শরীর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল পোশাক, কাগজের মোড়কের মতো শরীর থেকে চামড়া উঠে আসলো। পরবর্তীতে ৮৬,২০০ জন মৃত মানুষের কথা জানা যায়, মারাত্মক আহত আরো ৭২,০০০। আর আমরা যদি জীবনের কথাই বলি, তাহলে মানুষ, বিড়াল, কুকুর, পোকামাকড় সব হঠাৎ করে কেমন নাই হয়ে গেল!
বিস্ফোরণ-পরবর্তী ধাক্কাটি এসে পড়ল শীঘ্রইঃ প্রতি বর্গমিটারে ছয় টনের চাপটি ধাবিত হলো ঘন্টায় ৭,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি বেগে। চূর্ণ হয়ে গেল শহরটির কাঠে তৈরি অবকাঠামো, মুহূর্তে এটি হয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক কোনো জনপদের ধ্বংসাবশেষ। সেই সাথে ছড়িয়ে পড়ল প্রাণঘাতী নিউট্রন ও গামা রশ্মি, পরবর্তী বছরগুলিতে যারা চালিয়ে যাবে তাদের নীরব ধ্বংসযজ্ঞ।
তারপর শুরু হলো অগ্নিঝড়। বায়ুর তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে অক্সিজেন টেনে উপরে চলে গেল সেটি, চারপাশ থেকে ধেয়ে আসল ভারী শীতল বাতাস। ভয়ঙ্কর গতিতে বিরতিহীন শোঁ শোঁ বইতে লাগল ঝড়টি, নিষ্ঠুরভাবে ছড়িয়ে দিতে লাগল আগুনের শিখা, ইট পাথর কাঁচের টুকরা, বহুক্ষণ ধরে।
বিমানটি দ্রুত সরিয়ে নিতে নিতে ইনোলা গের অভিযাত্রীরা বিস্ময়ে তাকালেন নিচের দিকেঃ ছয় মাইল উচ্চতার ধোঁয়ার মেঘ গজিয়ে উঠল আকাশে, বিশাল এক ব্যাঙের ছাতার মতো। কী সুন্দর! ভয়ঙ্কর সুন্দর! হঠাৎ সফলতার ক্লান্তি ভীড় করল অভিযাত্রীদের মনে, সামনে আরো ছয় ঘন্টার পথ, মারিয়ানার টিনিয়ান দ্বীপে পৌঁছতে হবে তাদের। ৯০ মিনিট পর প্রায় ৪০০ মাইল দূর থেকে গোলন্দাজ বব ক্যারন একবার তাকালেন পেছন দিকে—মাশরুম মেঘটি তখনও বিরাজ করছে হিরোশিমার আকাশে।
৬ই অগাস্ট, ১৯৪৫ সাল। জাপানের হিরোশিমাতে সময় সকাল ৮টা ১৫। বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ তার সর্বোচ্চ মেধা, জ্ঞান-বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার এক প্রচেষ্টা চালায়। প্রথমবারের মতো তার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


