৪৬০০ বছর আগেকার চীনদেশের কথা। কৃষিজীবি হানদের সাথে যাযাবর জাতিগোষ্ঠির মারামারি লেগেই আছে সারাক্ষণ, সেই হুয়াং ডি তথা পীত রাজাদের আমল থেকেই। উত্তর থেকে ধেয়ে এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে চলে যায় যাযাবরের দল, পথে পথে পড়ে থাকে রক্তের দাগ। এভাবেই কেটে যায় শত শত বছর।
তারপর একদিন, ২৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, কীন প্রদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন চতুর, সক্ষম কিন্তু ক্রূঢ় একজন মানুষ, নাম ঈং যেং (২৫৯-২১০ খ্রিস্টপূর্ব)। একদিন বাকী প্রদেশগুলিকেও পরাস্ত করবেন তিনি, গড়ে তুলবেন বিশাল এক সাম্রাজ্য, স্বপ্ন দেখেন যেং। ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পূরণও হয় তার স্বপ্ন।
"কীনের প্রথম সম্রাট (কীন শি হুয়াং ডি)" উপাধি গ্রহণ করেন যেং, গড়ে তোলেন প্রতাপান্বিত কীন রাজবংশ। এ সময় যাযাবর গোষ্ঠিরাও উত্তরে সুসংহত করে তোলে নিজেদের, বিবাদ তুঙ্গে উঠে দুদলের। মাঝে মাঝে কীন সেনাবাহিনী যাযাবরদের তাড়িয়ে দেয় মরুভূমিতে, কিন্তু ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসতেই থাকে আক্রমণ।
"পূর্বে বোহাই সাগর থেকে পশ্চিমে গোবি মরুভূমি পর্যন্ত গড়ে তোল সৃদৃঢ় দেয়াল," ২১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কীন শি হুয়াং ডি নির্দেশ জারি করেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত সেনাপতি মেং তিয়ানের প্রতি। হাজার হাজার মানুষকে তাড়িয়ে উত্তর সীমান্তে নিয়ে যান দোর্দ্যণ্ডপ্রতাপ সেনাপতি, গহন পাহাড়, বিজন বন, আর রুক্ষ্ম মরুর ভেতর দিয়ে। উত্তরের হাড় কাঁপানো শীত, ক্রমাগত ক্ষুধা আর নিষ্ঠুর তদারকিতে মারা যেতে থাকে অগণিত মানুষ—ছেঁড়া কাপড় পরা, হাড্ডিসার দেহ।
সে সময় চীনদেশে ছিল মেং যীয়াং নু নামের পরমাসুন্দরী এক মেয়ে, যে ভালবেসে বিয়ে করে ওয়ান যী লিয়াং নামের চমৎকার এক ছেলেকে। কিন্তু বিয়ের তৃতীয় রাতে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে যায় কীন সেনাবাহিনী, মহাপ্রাচীরের কাজে।
বিষাদমাখা নয়ন আর কষ্টমথিত হৃদয়ে প্রতীক্ষায় থাকে মেয়েটি, চেয়ে থাকে পথের পানে, যে পথ ধরে দূরদূরান্তে চলে যায় পথিকের দল—প্রিয় স্বামীর একটু খবর যদি পাওয়া যায়। দিন পেরিয়ে রাত আসে, আবার আসে নতুন দিন, কেটে যায় সপ্তাহ পক্ষ মাস। না কোনো খবর নেই ওয়ান যী লিয়াং-এর। শুধু একদিন খবর আসে বেশ এগিয়ে গেছে মহাপ্রাচীরের কাজ, কিন্তু হাড় কাঁপানো শীত আর ক্ষুধার তাড়নায় দলের পর দল মারা গেছে পুরুষরা।
স্বামীর জন্য নকশিকাঁথার উষ্ণ জামা তৈরি করে মেং যীয়াং নু, তৈরি করে এক জোড়া শক্ত বুট। কিন্তু মহাপ্রাচীরে সেগুলো নিয়ে যাবার জন্য কাউকে পায় না সে। সুদীর্ঘ পথ উত্তরের, এঁকেবেঁকে চলে গেছে নাম না জানা কত জনপদ, কত অরণ্য প্রান্তর পেরিয়ে। প্রিয়তম স্বামীর চিন্তার শুধু বিভোর থাকে মেয়েটি, বাড়তে থাকে বুকের কষ্ট। আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন নিজেই একাকি উত্তরের দুর্গম পথ ধরে সে।
জনপদের পর জনপদ পেরিয়ে যায় মেয়েটি, অতিক্রম করে পর্বতের পর পর্বত, পাড়ি দেয় নদী-নালা খাল-বিল। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ভার হয় তার বুক, পায়ে দগদগে ফোস্কা পড়ে, কনকনে শীত জীর্ণ পোশাকের ভেতর কামড় বসায় তার শরীরে, কিন্তু অমানুষিক শক্তিতে কী এক চিন্তায় বিলীন মেয়েটি একগুঁয়ের মতো এগুতে থাকে মহাপ্রাচীরের দিকে।
এক সময় পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সর্পিল চেহারার দৈত্যকায় মহাপ্রাচীরটি ভেসে উঠে দিগন্তে। দ্রুত এগিয়ে যায় মেয়েটি, আনন্দ তার পরিণত হয় উদ্বিগ্নতায়। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে তার স্বামীকে, কিন্তু হাজার হাজার দুঃখী মানুষের ভেতর কে-ই বা আলাদা করে খবর রাখবে অখ্যাত, ভাগ্যাহত এক যুবকের? না, কেউ জানে না! তবু প্রতিদিন নব উদ্যমে মহাপ্রাচীর ধরে হেঁটে যায় সে, দিন শেষে ফিরে আসে ভগ্ন মনোরথ হয়ে।
এভাবেই মেয়েটি একদিন পৌঁছে যায় শানহাইগুয়ান গিরিখাতের পাদদেশে। শুনতে পায় প্রাচীরের এ অংশে এক সময় কাজ করেছে চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগত এক যুবক, নাম ওয়ান যী লিয়াং, যে সব সময় মেং যীয়াং নু নামের অসাধারণ এক মেয়ের কথা বলত। কিন্তু বিরামহীন কাজ করতে করতে মারা যায় শান্ত অমায়িক যুবক, কেবল মৃত্যুর পূর্বে একবার তার স্ত্রী মেং যীয়াং নু'কে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল সে। কবর দেয়া হয়েছে তাকে মহাপ্রাচীরের নীচে। ভগ্নহৃদয় মেয়েটিকে সেখানে নিয়ে যায় একদল শ্রমিক।
বুক ফেটে কান্না আসে মেয়েটির, অবিরল কাঁদতে থাকে সে দিনের পর দিন। করুণাময় স্রষ্টাও মেয়েটির প্রতি তার করুণা বর্ষণ করেন। শুরু হয় তুষার ঝড়, ধ্বসে পড়ে ৪০০ কিলোমিটার জুড়ে মহাপ্রাচীরের বিশাল অংশ, বেরিয়ে আসে ওয়ান যী লীয়াং-এর দেহ।
"ভেঙে পড়েছে মহাপ্রাচীর, ভেঙে পড়েছে মেন যীয়াং নু'র কান্নায়!" দ্রুত দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ে চীনদেশের প্রান্তে প্রান্তে।
রাজ দরবারে প্রচণ্ড বিস্ময় অবিশ্বাসে মহাপ্রাচীর ধ্বংসের খবর শোনেন সম্রাট ঈং যেং। অভূতপূর্ব এ দৃশ্য দেখার জন্য নিজেই চলে যান উত্তরে—কে সেই মেয়ে যার কান্নায় ভেঙে পড়ে অদম্য দেয়াল!
সাধারণ চীনা নারীর অতুলনীয় সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সম্রাটের, হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন, তিনি কোনো কথা সরে না তার মুখ থেকে। সবশেষে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলেন,
"এত সুন্দর তুমি মেয়ে,
পরীর মতো,
রাণী হবে তুমি আমার।"
গভীর চিন্তামগ্ন হয় মেন যীয়াং নু, আরো ব্যথাতুর হয় তার মুখ। ধীরে ধীরে মুখ তুলে সে, তিনটি কাজ করতে হবে সম্রাটকে
"লানমু বৃক্ষের কফিনে শয়ান করাতে হবে তার স্বামীর মরদেহ, রাজকীয় মর্যাদায় পালন করতে হবে তার শেষকৃত্য, এবং সবশেষে রাজা ও তার সভাসদ শোকপ্রকাশ করবেন রাজ্যে জুড়ে তার স্বামীর জন্য।"
বিরক্ত হলেও সম্রাট রাজী হন শর্তে। মেন যীয়াং যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই পালন হয় স্বামীর শেষকৃত্য। কফিনের পেছন পেছন হাঁটতে থাকেন সম্রাট ও তার সভাসদ। এক সময় সবাই পৌঁছেন খরস্রোতা এক নদীর তীরে খাঁড়া পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে শেষবারের মতো চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হবে ওয়ান যী লিয়াংকে।
কবরে শোয়ানো হচ্ছে স্বামীকে, কান্না বন্ধ করে দেখে মেন যীয়াং নু। গভীর ভালবাসায় চুমু খায় সে কফিনে। কবরে শোয়ানো হয় ওয়ান যী লিয়াংকে, ফুলে ফুলে ভরে উঠে কবরের মাটি।
হাসিমুখে সম্রাট তাকান মেন যীয়াং নু'র দিকে। হাসি ফুটে উঠে দুঃখী মেয়েটির মুখেও। তারপর হঠাৎই পাহাড় চূড়া থেকে আলতো করে বাতাসে ভাসিয়ে দেয় সে নিজের দেহ। নীচে গর্জনশীল বোহাই সাগর যখন গভীর মমতায় গ্রহণ করে মেয়েটির মৃতদেহ, তখনও তার মুখে হাসি লগে ছিল।
[চীনা লোককথা]
ছবিঃ মেং যীয়াং নু'র ভাস্কর্য

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


