তিথি নামটা কেন তার মা রেখেছিল তা সে জানে না । শুধু জানে ভূমিষ্ঠ হবার পর প্রথম যখন তাকে তার মা কোলে নিয়েছিল তখনই তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল তার নাম হবে তিথি । তার মা কেন চট করে তার নাম তিথি রেখেছিল সেই নিয়ে পরে তিথি অনেক প্রশ্ন করেছিল কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিতে পারেনি । পরে তিথি বুঝে নিয়েছিল , তিথি নামটা একদম উদ্দেশ্যহীনভাবে চট করে তার সাথে জুড়ে গিয়েছিল । আর এই উদ্দেশ্যহীন জুড়ে যাবার জন্যই হয়তো আর কেউ তাকে এই নামে ডাকেই না !
তিথি’র পৃথিবীটা নেহাত বড় নয় । সোজাসাপ্টা বললে আর দশটা ঘরকন্যার যেমন ঘরোয়া এক পৃথিবী থাকে তিথিরও তাই । সব কিছুকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবার এক অনিন্দ্য প্রয়াস নিয়ে সে বেঁচে থাকে । জীবনের সবকিছুকে মায়ায় বাঁধতে চাওয়ার একটা নেশা তার আছে । আর এই নেশার বিপরীতে সে তার আশেপাশের সবাইকে নিয়ে এক কল্পনার জগত ফেঁদে বসে । সেই জগতে সে তার আশেপাশের বাস্তব চরিত্রগুলোকে বুনে চলে নিজের মত করে । আর ভাবে সে যতটা মায়া তার আশেপাশের মানুষদের ছড়িয়ে দিচ্ছে তাতে করে আর কিছু না হোক অন্তত একটু প্রশংসাও যদি বা তাঁদের চোখ মুখে সে দেখতে পায় !
কিন্তু দিনশেষে দেখা যায় তার মায়া কেউ বুঝতে পারেনি । দৈনন্দিন ব্যস্ততা আর নিজের প্রতি আবিষ্ট থাকা মানুষগুলো তার মায়াকেও মনে করে খুব নিছক কিছু কিংবা ব্যস্ততার তুলনায় পাত্তা দেবার মত কিছু নয় ! কল্পনায় চিত্রিত মানুষগুলোকে যেমন ভেবেছিল বাস্তবে যখন তেমন দেখতে পায় না তখন এক নিকষ বিষাদ তাকে পেয়ে বসে । বিষাদে বিষন্ন হয়ে সে ভাবে , দোষটা কার তার নিজের নাকি তার মায়ার ? নাকি এইসব ব্যস্ত মানুষদের যারা নিজেকে নিয়ে এতটাই ডুবে থাকে যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আবেগকে দলিত মথিত করে চলে । ভাবনারা গন্তব্যে পৌঁছায় না আর তিথিও বিষাদ সাগরে কুল পায় না ।
আমার রুমের পশ্চিমের জানালায় তিথিদের বারান্দা , একটা সরু রাস্তা, রাস্তার পাশে এক কোণে তিথিদের বাসা থেকে কিছুটা দুরে একটা জাম গাছ সহ ছোটখাটো একটা দৃশ্য সব সময় এঁটে থাকতো । কী গ্রীষ্ম কী বর্ষা অথবা হেমন্ত-পৌষ সময়ের সাথে দৃশ্যের রং বদলালেও দৃশ্যের রূপের কোন পরিবর্তন হত না , আর পরিবর্তন দেখা যেত না বারান্দায় দাঁড়ানো তিথির মুখের বিষাদের ছাপটি !
বিকেলে যখন আমি জানালার ধারে এসে নিজেকে ভুলবার চেষ্টা করতাম । তখন চোখে পড়ত তিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে । বিকেলে বারান্দার গরাদ ধরে শূণ্য দৃষ্টিতে দূরের দালানগুলোর গায়ে রোদের খেলা দেখা ছিল তার এক মাত্র কাজ । কখনও কখনও যদি খুব বেশি ঠাওরালে দেখতে পেতাম তার কপোল বেয়ে ক্ষীণ জলধারা বেয়ে পড়ছে ! বুঝতাম অভিমান আর বিষাদে মেয়েটি হয়তো কোনদিন বিমূঢ় হয়ে যাবে । অথবা প্রাচীন ক্ষয়া মূর্তির মত ধীরে ধীরে ঝড়ে যাবে এই ধরা থেকে ।
সেদিন ছিল বর্ষাকাল, ঝুম বৃষ্টি নেমেছে পুরো শহর জুড়ে । টানা বৃষ্টির কারণে এ গলি ও গলিকে মনে হচ্ছে ছোট খাটো কোন খাল । সেদিন তেমনই এক খালের মধ্য দিয়ে পানি কেটে মাথায় ছাতা নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমার আস্তানার পানে । গলির রাস্তাতে পানি হাঁটু ছাড়িয়ে একেবারে কোমর ছুঁবে বলে মনে হচ্ছে । খুব দ্রুত আস্তানায় না ফিরলে আপদের হাত থেকে রেহাই মিলবে না । তাই যতটা সম্ভব নিজের পাদুটোকে দ্রুত চালালাম ।
পানি কেটে কেটে যখন তিথিদের বাসার সামনে এসে পৌঁছালাম দেখলাম রোগা ত্যালঢ্যাঙা চেহারার, লম্বা, কোঁকড়া চুলের এক যুবক তিথিদের চারতলা দালানের নিচে দাঁড়িয়ে আছে । গেটের ওপরে যে কার্নিশ থাকে তার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে সে । কিন্তু চেষ্টায় কোনভাবে সফল হতে পারছে না সে । এদিকে ঠান্ডা বৃষ্টির কারণে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর । যুবককে আমি চিনি , কামাল নামেই চিনি । এলাকাতেই থাকে । পরিবার বলতে তার কিচ্ছু নেই । এতিমখানাতেই মানুষ হয়েছে । এলাকার একটি বাসার চিলেকোঠাতে সে থাকে একটা ছাপোষা চাকরি আর কোনমতে তদবির করে চালিয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা নিয়েই সে বেঁচে আছে । খুব একটা মানুষের সাথে কথা বলে না । মানুষও তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না । তাকেও বলা চলে অবহেলিত ।
তার এমন অবস্থা দেখে ভাবলাম আমার ছাতার নিচে তাকে জায়গা দিই বেচারা কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজবে , বৃষ্টি তো ক্রমেই চরমপন্থি হয়ে উঠছে ।
তাই আরও দ্রুত পা চালাতে যাচ্ছিলাম দেখলাম গেট খুলে তিখি বেরিয়ে এসেছে । হাতে তার একটি তোয়ালে , তার নীল রঙের চাদর আর একটি ছাতা । আমি থমকে গেলাম তিথিকে দেখে । এইসময় এই বেহাল পরিবেশে সে কেন বেরিয়ে এল ? তিথি তো এমন সময় খুব একটা বেরোয় না । ব্যাপারটা বোঝার জন্য কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আমি লক্ষ্য রাখছিলাম ।
দেখি ছাতা মেলে তিথি কামালের কাছে এগিয়ে গেল । তাকে ছাতার নিচে রেখে হেসে বলল , “ এভাবে কেউ বৃষ্টিতে ভেজে ? নিউমোনিয়া হয়ে যাবে না ! আপনি দেখছি ঠান্ডায় খুব কাঁপছেন । নিন তোয়ালে দিয়ে আগে মাথাটা মুছে নিন তো । এরপর এই চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিন ।”
কামাল অপলক দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকিয়ে থাকে । জন্মের পর থেকে এতিম খানায় মানুষ হওয়া কামালের সাথে এভাবে বোধহয় তিথিই প্রথম কথা বলল । এতটা মায়া আর এতটা আন্তরিকতা নিয়ে তিথির এই ব্যবহারে কামাল স্তব্ধ হয়ে যায় । কোন কথা তার মুখ দিয়ে বেরোয় না কোন প্রতিক্রিয়ার ছাপ তার চেহারায় দেখা যায় না কেবল ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে তিথির দিকে ।
তিথি তাগাদা দেয় , “কই নিন মাথাটা মুছে নিন তাড়াতাড়ি । বৃষ্টি তো আরও বাড়বে এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজবেন ?”
তিথির তাগাদাতে কামালের হাত সচল হয় সুবোধ বালকের মত তোয়ালে নিয়ে মাথাটা মুছে নেয় । মোছা শেষে তোয়ালেটা এগিয়ে দেয় সে । তিথি হাসিমুখে চাদরটা বাড়িয়ে দেয় । কামাল সেটাও সুবোধ বালকের মত গায়ে জড়িয়ে নেয় । কোন কথা বলে না । চাদর জড়িয়ে নিলে তিথি এবার ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে , “ নিন ছাতাটা নিয়ে বাড়ি যান । সংকোচ করবেন না আপনি তো এই এলাকাতেই থাকেন , আপনাকে আমি চিনি জানি না হয়তো তাতে কী ! আপনি সময় করে নাহয় এসব ফেরত দিয়ে যাবেন ! ”
কামাল ছাতাটা হাত বাড়িয়ে নেয় । ছাতা অর্পন শেষে তিথি তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে ঘুরে গেট গলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় দৃশ্যপট থেকে । আর হতভম্ব করে দিয়ে যায় কামালকে আর আমাকে দিয়ে যায় একটা প্রশান্তি , যাক মেয়েটার মায়াটা আজও বেঁচে আছে তবে !!
সেদিন আমি আর কামাল গলির পানি কেটে যে যার আবাসে ফিরে যাই !
তার কিছুদিন পরের ঘটনা । সেই একই রাস্তা দিয়ে আমি ফিরছি । সেদিন আকাশে মেঘ ছিল না , বৃষ্টিও ছিল না আর গলিটাও কোন ছোটখাটো খাল ছিল না । শুকনো ধুলো ভরা গলির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন তিথির বাসার সামনে আসলাম , ঠিক সেই জাম গাছটার নিচে আমি কামালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । বিকেলের কিছুটা সহ্যশীল কিন্তু তপ্ত আবহাওয়াতেও সে তিথির দেয়া চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে । কি হলো তার ? চাদরটা খুলতে মন চাইছে না নাকি সে অসুস্থ ! হাঁটতে হাঁটতে না থেমে যখন তাকে অতিক্রম করতে যাচ্ছিলাম , এক ঝলক তার দিকে তাকালাম । দেখলাম জ্বরের কারণে তার চোখ লাল হয়ে আছে । দেখে মনে হচ্ছে জ্বর ভালোই আছে তবুও এই জাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কেন সে ? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলেও আমি জিজ্ঞেস করিনি । সোজা হেঁটে চলে আসলাম । নাগরিক জীবনে সবকিছুতে মাথা ঘামাতে নেই, বলা কওয়া নেই এমন মানুষের ক্ষেত্রে তো মাথাটাই তাক করতে নেই । এলাকার আর দশটা নির্লিপ্ত মানুষের মত আমি হেঁটে চলে আসলাম !
এর কিছুদিন পর আমি আমার নিত্তনৈমিত্তিক বৈকালিক নিজেকে খুঁজবার প্রয়াসে জানালার সামনে দাঁড়ালাম । বিকেলটা স্নিগ্ধ হলেও , চারপাশে মানুষের উচ্ছাস আড্ডার কলরব থাকলেও , রোদের বর্ণিল কারুকাজ থাকলেও একদম বিবর্ণ আর একঘেয়েঁ দৃশ্যপট ঝুলে থাকে তিথিদের বারান্দায় । কিন্তু সেদিন দেখলাম শুধু তিথিদের বারান্দা নয় । তিথিদের বাসা থেকে কিছুটা সামনে যে জাম গাছ তার নিচের দৃশ্যটাও অনেকটা তিথির মত নিয়মিত একটা দৃশ্য জন্ম নিচ্ছে ।
গাছের নিচে সেদিনও কামালকে দেখলাম তিথির চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে । আর সেদিনও সে তাকিয়ে আছে তিথিদের বারান্দার দিকে !
এরপর থেকে প্রতিদিন আমার জানালার ওধারে দৃশ্যের বর্ণের ও প্রায় সবটুকু চিত্রের পরিবর্তন থাকলেও এই দুটি দৃশ্যের কোন পরিবর্তন আমি দেখতাম না । এভাবে এক সপ্তাহ চলল । একদিন বিকেলে আমি এই নিয়ে ভাবনায় পড়লাম । কেন কামাল প্রতিদিন তিথিদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ? আমার তো চোখে পড়েছে তিথির পড়েনি ? অবশ্য ওর মত মূর্তমান স্থবির মেয়ের পক্ষে চারদিকে নজর দেয়াটা তেমন সম্ভবের না বটে । তবুও একদিনও কী চোখে পড়েনি তার ? নাকি বিষাদের কারণে বিষিয়ে যাওয়া মন আর কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না !
তিথিরটা না হয় বাদ দিলাম , কামালের ব্যাপারটা কী ? ও কী তিথির প্রতি দুর্বল ?
হওয়াটা অস্বাভাবিক না , হতেই পারে ।
তাই কী সে দাঁড়িয়ে থাকে এমন পাথরের মত নিরেট ধৈর্য নিয়ে ?
হতেও পারে ।
কিন্তু তার এই প্রেমে পড়ার কারণ কী ? তিথির মায়া ?
এটাও হতে পারে !
মায়ার প্রতি প্রেম কার না থাকে তাই বলে প্রতিদিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে ? আচ্ছা সে কী আবার মায়া পেতে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে ?
এটাও হতে পারে ।
তবে কী সে তিথির মায়াতে আসক্ত হয়ে গেছে ?
হতেও পারে !
আচ্ছা , এটাকে কী মায়ার বিপরীতে সাড়া দেয়া বলা যায় না ?
এটাকে হতে পারে বলা যায় না এটা হবেই হবে বলা যায় । হ্যাঁ তাই ! কামাল তিথির মায়াতে সাড়া দিয়েছে , সব ফেলে সে তিথির মায়াকে স্বীকৃতি দিতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে ।
ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমার অস্থিরতা বেড়ে গেল । নাহ্ , এই মেয়েটি শেষমেশ তার মায়ার স্বীকৃতি পেয়েছে । আর তাকে বিষাদে ডুবে থাকতে হবে না । আর তাকে ভাবতে হবে না দোষটা কার! হ্যাঁ এটা ঠিক যে তার কল্পনায় চিত্রিত মানুষগুলোর মত কামাল নয় ! কিন্তু তাতে কী, মায়ার বিপরীতে মায়ার প্রতি প্রশংসা তো সে পাচ্ছে । সেই প্রশংসার রং যেমনই হোক এর গন্ধ তো আলাদা নয় ! বরঞ্চ এর গন্ধ অন্যান্য প্রশংসার গন্ধের মত । একই আবদেন মিশে আছে এই প্রশংসায় !
আমার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে যে তিথির খুব কাছেই আছে তার কাঙ্খিত বিষয়টি । কিন্তু বলতে পারছি না কেন যেন । কোথায় যেন আটকে আছি আমি । তাই অনুরোধ করছি আপনাকে , একবার চিৎকার করে বলবেন তাকে ! বলবেন ? যে “ তিথি একবার ঘাড় কাত করে নিচের দিকে তাকাও দেখতে পাবে তোমার কাঙ্খিত বস্তু স্থির হয়ে আছে এক যুবকের অবহেলিত চোখে ! ”
বলুন না দয়া করে । তাতে বিকেলকে অন্তত একটি মেয়ের কান্না আর বিষাদ মুখ দেখতে হবে না ! কী ? বলবেন তো ?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:০৪