(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
ছন্দা আপা, নির্মল ছন্দ নিয়ে যিনি কিনা সবসময় মাতিয়ে রাখতেন আমাকে, আমার চারপাশকে । যার ছন্দময় আহ্লাদ আর প্রশ্রয় মাখানো মমতা ছিল আমার প্রতিদিনের আনন্দের বিষয় । আমি নিজেও যার কাছে নিজেকে মন খুলে প্রকাশ করতে পারতাম , কোন ভণিতার চাদর কিংবা কোন প্রকার মেকী আচরণকে পাত্তা না দিয়ে যার কাছে আমি হয়ে যেতে পারতাম শুদ্ধ আমি , সেই ছন্দা আপা ।
সেই ছন্দা আপা এখন ছন্দ হারিয়ে কেমন যেন নির্লীপ্ত হয়ে গেছেন । উচ্ছল উর্মীতে ভরা নদী যখন তার রূপ হারিয়ে মলিন হয়ে যায় তখন যেমন এক নির্জীব প্রাণের স্পর্শ অনুভব করা যায় নদীর বাঁকে ঠিক তেমনই জড়তার আঁচ অনুভূত হয় আপার মধ্যে। আজকাল তাকে দেখলে মনে হয় চুপিসারে ওত পেতে থাকা যে ঝড়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল তার মননারণ্য, তা তার সজীবতাকে ছড়িয়ে আর বেড়ে উঠেনি । কী নির্মম এক স্থবিরতাকে বয়ে চলছে আমার ছন্দা আপা , আমার মনপ্রাচীরের গায়ে লেগে থাকা আমারই রহস্য, ছন্দা আপা !
আমি নিজেও বলতে পারছি না কতটা ঝড় বুকে বয়ে বেরাচ্ছি আর সেই ঝড়ের কতটা বেগ বেড়ে যায় যথন দেখি ছন্দা আপার মুখে আর সেই উচ্ছ্বল হাসিটুকু নেই ! ভেঙে যাই আমি , যে নৈরাশ্যতা আমাকে শক্তি যোগাতো সবকিছুকে এড়িয়ে যাবার সেই নৈরাশ্যতাও যেন অপর্যাপ্ত আমার এই ভঙ্গুরতাকে সামাল দিতে । আমি যেন দিশেহারা এক জাহাজ , মাস্তুল হারিয়ে ভেসে চলছি সময়ের সাগরে !!
১.¬¬
ক্যাম্পাসের দর্শন সমিতির আয়োজন করা এক আড্ডাতে আমি প্রথম ছন্দা আপাকে দেখেছিলাম । সেরকম আড্ডাতে সেইবার আমার প্রথম যাওয়া । তাহসিন ভাইয়ের আমন্ত্রণে আমি সেখানে গিয়েছিলাম । দর্শনের প্রতি আমার যে অনুরাগ তার চেয়ে বেশি বোধহয় তাহসিন ভাইয়ের ছিল কিংবা আছে । তাই কোথায় দর্শন নিয়ে কী আলোচনা হত তার সব খবরাখবর তিনি রাখতেন । চলেও যেতেন । মাঝে মাঝে আমাকে এক প্রকার বাধ্যই করতেন তার সাথে যেতে । আমিও তার ন্যাওটা ছিলাম বলা যায় যদিও তার প্লেটোপ্রীতির বিরোধীতা করে এসেছি সর্বদা এবং বিদ্রুপ করে তাকে প্লেটোসিন ডেকেছি হাজারবার তবুও তার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দৃঢ় ছিল ততোদিন অব্দি যতদিন পর্যন্ত না সত্য এসে সব মিথ্যে করে দিয়েছিল এতদিনের জ্ঞাত সবকিছুকে !!
সেদিনও একপ্রকার জোর করে তাসিন ভাই আমাকে সেই আড্ডায় নিয়ে গিয়েছিলেন । রুমের ভেতরে সবাই মেঝেতে বসে আছে । বসবার জন্য মেঝেতে তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না বলে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকে। আমাকে আর তাসিন ভাইকেও দাঁড়িয়ে থাকবার দলে ভিড়তে হয়েছিল ! তখনও আড্ডার প্রধান অথিতি আসেননি , সেই ক্ষণে দেখা গেল ভিড় ঠেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে ।মাঝারি গড়ন একদম চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রং, চাঁছাছোলা চেহারা , কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা মিশমিশে কালো তবে পাতলা চুল এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো আদুরে নাক আর ডাগর চোখ । সব মিলিয়ে এক অপ্সরা যেন এসে যোগ দিয়েছে এই আড্ডায় । বাসন্তি রঙা কাবুলি পোশাক আর মুক্তোর কানের দুলের কারণে তাকে অনন্যা বলে মনে হচ্ছিল !
তাসিন ভাইকে দেখলাম মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে উঁচু করে হাত নাড়তে। তাসিন ভাইকে দেখতে পেয়ে মেয়েটির পাতলা ঠোঁটে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল । আর আমি আবিষ্কার করলাম যতটা না এই মেয়ে সুন্দরী তার চেয়ে বেশি সুন্দরী তার হাসি । তাহসিন ভাইকেও দেখলাম ঠোঁটে একটা বিশ্বপ্রেমিক হাসি ঝুলিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যেতে । আর আমি হয়ে পড়লাম একা ।
ওদিকে দুজনে আলাপ চালালো হাসি হাসি মুখে আর আমি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার অবস্থা দেখছিলাম । এর মধ্যে চলে এলেন প্রধান অথিতি । আমার চেনা তিনি, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। প্রভাষক অ্যালবার্ট শহীদ । আমি জানতাম না যে তিনিও দর্শন চর্চা করেন । আড্ডায় যখন তার বক্তৃতা শুরু হলো তখন বুঝতে পারলাম তিনি ফ্রয়েডের একনিষ্ঠ ভক্ত ! যেখানে সেখানে তিনি ফ্রয়েডকে টেনে আনছেন , সেটা হোক সাহিত্য কিংবা নারী পুরুষের সম্পর্ক ! যদিও আড্ডাটা শুরু হয়েছিল সাহিত্যের দর্শন নিয়ে কিন্তু সেটা ক্রমেই গিয়ে পৌঁছাল নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ।
এই বিষয়টা এমনিতেই খুব স্পর্শকাতর তার ওপর বক্তা যেখানে সেখানে ফ্রয়েডকে টেনে আনছেন । যেটা অনেকটাই বিরক্তিকর । ফ্রয়েড আমার কাছেও প্রিয় তবুও এই প্রসঙ্গে ফ্রয়েডের মতকে আমার কোন কালেই সমর্থনযোগ্য বলে মনে হয়নি । কিন্তু দেখলাম পুরো রুম জুড়ে সবাই হা করে গিলছে ওনার কথা । কেবল তাসিন ভাইয়ের সাথে থাকা মেয়েটি বাদে । বিরক্তি আর অস্বস্তিতে তার মুখ কুঁচকে গেছে , কিন্তু তাহসিন ভাই মগ্নমুগ্ধ হয়ে এইসব শুনছেন ।
বক্তা বলে চলেছেন , “ এই যে নারী দেহের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঙ্গ স্তনের প্রতি পুরুষের এত আগ্রহ এর কারণ নিহিত আছে সেই শিশু সময়ে স্তন্যপানের অভিজ্ঞতার মধ্যে । মূলত সেই অভিজ্ঞতা নির্জ্ঞানে থেকে যায় যা তাকে অনুপ্রাণিত করে তাড়িত করে !”
ঠিক এই জায়গায় আমি বাঁ হাতটা ঢুকালাম, “ তা নারীর বেলায় কী বলবেন ?”
অথিতি সমেত পুরো রুমের সবাই আমার দিকে ঘাঁড় ফিরিয়ে তাকালো । তাহসিন ভাইকেও দেখলাম ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । অথিতি বলে উঠলেন ,
“ নারীর বেলায় বলতে ?”
“ পুরুষের বেলায় নাহয় শিশুকালে স্তন্যপানের অভিজ্ঞতার যে উপলব্ধি তা নির্জ্ঞানে থেকে যায় বলে এই ক্ষেত্রে তাকে তাড়িত করে । নারীও তো শিশুকালে একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় তবুও কেন তাকে পরবর্তীতে এই উপলব্ধি পেতে হয় না ? বুঝলাম ঈদিপাস কমপ্লেক্স নারীর ক্ষেত্রে আলাদাভাবে কাজ করে কিন্তু শিশু অবস্থায় তার চরম উপলব্ধি তো পুরুষের মতই থাকে তবে নারী কেন স্তনের প্রতি আকৃষ্ট হয় না ?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আড্ডায় থাকা নেতা গোছের একজন বলে উঠলো, “ আপনাকে আড্ডায় থাকতে হলে আড্ডার প্রশাসনিক নিয়ম কানুন মানতে হবে এভাবে আপনি কথা বলতে পারেন না !”
“ তবে তো এটা কোন দার্শনিক আলোচনার আড্ডা হলো না টিপিক্যাল ওয়াজ মাহফিলের মতো হয়ে গেল না ? আপনারা থাকুন আপনাদের এইসব ওয়াজ নিয়ে । দেখুন ফ্রয়েড নিয়ে কোন গতি হয় কিনা !”
আমি আর তর্কে গেলাম না বসে থাকা মুরিদগুলোর কাঁধের ওপর দিয়ে গিয়ে আমি দরজা পর্যন্ত এগোলাম । দেখলাম তাহসিন ভাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর তার পাশের মেয়েটি অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখছে ! আমি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একদম গটগটিয়ে বেরিয়ে এলাম । এরপর জানলাম আমাকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই সমিতির সকল আড্ডা থেকে । যদিও আমি কোনকালেই এদের সদস্য ছিলাম না !
এরপর কেটে গেল কয়েকদিন ........................
সেদিন আমি করিডরে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ তানিম নওশাদের বই পড়ছিলাম । আচমকা ভাঙা গলায় একটা প্রশ্ন শুনতে পেলাম ।
“ কেমন আছো তুমি ?”
বইয়ের থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেদিন আড্ডায় দেখা মেয়েটি । মুখে সেদিনের দেখা অনবদ্য হাসিটা লেগে আছে ।
“ এই আছি বেশ , শুরু থেকে শেষ !”
“ তুমি করে ডেকেছি বলে কিছু মনে করো না । তাসিনের কাছ থেকে জানলাম তুমি আমাদের থেকে জুনিয়র হবে তাই তুমি করে বললাম । কিছু মনে করোনি তো ? ”
“ একদমই না ! মনে করার কী আছে । একজন সুন্দরী মেয়ে আমাকে তুমি করে বলছে বয়সে বড় বলে এটা মেনে নেয়াতে কোন আপত্তি থাকতে পারে কী ? আপত্তি করে আফসোস করবো নাকি ?”
খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, “ তুমি তো অনেক দুষ্টু !”
“ হ্যাঁ সে নিয়ে অনেক খ্যাতি আছে আমার । তবে তা সুখ্যাতি না কুখ্যাতি তা আমার জানা নেই । কোন মেয়েও বলেনি এর আগে যে খ্যাতিটা আসলে কী!” আমিও এক গাল হাসলাম !
“ ও হ্যাঁ , আমি ছন্দা রেহমানী ! অর্থনীতি থেকে এবার মাস্টার্স করছি !”
“ আমি নীরোদ আমিন , হিসাববিজ্ঞান থেকে অনার্স ফাইনাল !” আমিও জবাব ছুঁড়ে দিলাম !
“ বাহ্ , তা নীরোদ অর্থ কী ?”
“ যা রোদকে রোধ করে দেয় , মানে মেঘ !”
“ বাহ্ সুন্দর তো ! সেদিন আড্ডায় তোমার কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল ।যিনি বলছিলেন তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক , তবুও তার কথাগুলো সেদিন ভালো লাগেনি । অবশ্য কিছু বলতেও পারছিলাম না এদিকে তুমি আমার হয়ে কথাগুলো বললে তাও আবার আমার থেকে অনেক ভালো করে গুছিয়ে । আর এমন ভরা মজলিসে যেভাবে সাহস দেখিয়েছিলে তারও তারিফ করতেই হয় !”
গরবর করে বলে যাওয়া কথা শেষ হতেই বললাম , “ আচ্ছা আজকের পত্রিকায় রাশিচক্রে কী বলা ছিল বলুন তো ? এতটা সৌভাগ্য এলো কী করে ? সারা ক্যাম্পাস যাকে বিরক্তির চোখে দেখে তাকেই কিনা প্রশংসা করছেন একজন সুন্দরী আপা ! ”
আবার একচোট হেসে ছন্দা আপা বললেন, “ আসলেই খুব দুষ্টু তুমি , তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে । আড্ডা দেবার ইচ্ছে ছিল তবে জরুরী ক্লাস আছে যেতে হবে । আজ তবে যাই ? ”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই উনি করিডোর ধরে হাঁটতে শুরু করলেন । আমি পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম, “ ছন্দা’পা আপনার নাম ছন্দা কে রেখেছিল বলুন তো ? যিনি রেখেছিলেন তিনি কী করে জেনেছিলেন যে এই মেয়ে সত্যিই হাসিতে সবকিছু ছন্দময় করবে ?”
উত্তর দিলেন না তিনি হাসতে হাসতে হারিয়ে গেলেন করিডোরের শেষ প্রান্তে ।
চলে যাবার পর মনে হলো আশ্চর্য এক ছন্দে এতক্ষণ চনমনে ছিলাম আমি। এখন চারদিকে কেমন যেন এক খাঁ খাঁময় অবস্থা । অদ্ভূত তো !
আমি ভাবতেই পারিনি ঐদিন থেকে আমার ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি জন্ম নিয়েছিল আমারই অজান্তে !!
(চলবে....)
রচনাকারী: নিবর্হণ নির্ঘোষ ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৪৪