somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবহেলিত ভিখারিনী..

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সুনামগঞ্জী লোকাল বাস থেকে এই মাত্র নামলাম । সিলেট গিয়েছিলাম বন্ধুর বিয়েতে । ভালো মতোই বিয়ে হলো এবং আমিও আমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । দুইদিন থেকে সজাগ থাকায় বাসের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম । ২ ঘন্টার পথ সুনামগঞ্জ । মাথার উপরে কুলিং ফ্যান ভনভন করে ঘুরায় ঘুম আসতে তেমন একটা দেরী হলো না । কন্টাক্টররের ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গলো, -“ভাই ভাড়া দেন” । আমি চোখ কচলে পকেটে হাত দিলাম । পকেটে হাত দেওয়া মাত্রই আমার ঘুম চোখ থেকে চলে গিয়ে চড়ক গাছে উঠলো । “আরেহ, একি! আমার মানিব্যাগ কোথায়! এখানেই তো আমার পকেটে ছিলো ।” কন্টাক্টার আমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,- “ভাই, নেমে টাকা দিয়েন ” | আমিও তার কথায় “আচ্ছা” সম্মতি দিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম সিটে । মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো । আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার মানিব্যাগ কে নিতে পারে । আমার সাথেই বাসে উঠেছিলো মহিবুল নামে এক ছেলে । ওর সাথে নাম জানা ছাড়া আর কোনো কথা হয়নাই । কন্টাক্টারকে ডাক দিলাম,- “এ ভাই এদিকে একটু আসেন তো... আচ্ছা আমার পাশে যেই ছেলেটি বসেছিলো সেই ছেলেটি কোথায় নেমেছে কিছু জানেন কি? ওহ জানেন না..ওহ আচ্ছা, এখন তাহলে আর কি করার । আসলেই আমার ভাগ্যটা খারাপ” । আমার মোবাইলে চার্জ ছিলো না বলে আগেই ব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম, তাই চোরটা মোবাইলের হদিস পায়নি, পেলে আমার মোবাইল নেওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারতো না । ভাবতে লাগলাম হারানো ব্যাগের কথা । ওতে ছিলো আমার প্রয়োজনীয় একটা কার্ড যা আমি চিরতরে হারিয়ে ফেললাম । মন খারাপ নিয়েই বসে আছি ।
-
এই মাত্র বাস থামলো সুনামগঞ্জের বাস স্টেশনে । বাস ভাড়া দেওয়ার জন্য এক পরিচিত ব্যক্তির থেকে টাকা ধার নিয়ে কন্টাক্টারকে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম । আমার মনটা এখনো খুব খারাপ মানিব্যাগটার জন্য তাই ধীরে ধীরে হাঁটতেছি । বাড়ি যাওয়ার পথে তিন রাস্তার মোড়ে একটা ফ্লেক্সির দোকান আছে । সবসময় ভীড় থাকে সেই দোকানে । নিত্যদিনের মতো আজকেও দোকানে অনেক ভীড় । আর তার পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে হাত পাতিয়ে । আমি ধীরে ধীরে দোকানের দিকে এগোলাম । যাওয়ার পর বাড়ি না গিয়ে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে আমি বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম । উনার বয়স আনুমানিক ৬০ এর কাছাকাছি হবে । কুড়ো হয়ে গেছেন, মুখ ও হাতের চামড়া মনে হচ্ছে খসে পড়তেছে । হাত ও গলার হাড় দেখা যাচ্ছে । এমনভাবেই দেখা যাচ্ছে যে কোনো এক্সে ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি অনায়াসেই বলে দিতে পারবে কয়টা হাড় রয়েছে গলায় ও হাতে । হাতের সবগুলো রগ ফুলে উঠেছে । দেখে মনে হচ্ছে যে, এই বুধয় ফাটলো । বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন আর কাঁপছেন । উনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে , মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতে তিনি কনকন করে কাঁপছেন । পড়নে ময়লা একটা কাপড়, শেষ কবে ধুয়েছিলেন হয়তো তাঁর নিজের-ই মনে নেই । ধুবেন-ই-বা কীভাবে, তাঁর হাতে আর শরীরে তো পর্যাপ্ত শক্তি-ই নেই ।
-
আমি অনেকক্ষন থেকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম-ই । দোকানের মানুষগুলো মোবাইলে টাকা ভরে আবার চলে যাচ্ছে; তারপর আবার নতুন নতুন মানুষ আসছে টাকা ডুকানোর জন্য । কিন্তু কারো চোখ যাচ্ছে না এই অসহায় বৃদ্ধার দিকে । কেউ কেউ টাকা ডুকিয়ে খুশি মনেই চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ পুরাতন বন্ধুকে অনেকদিন পর পেয়ে চা খেতে বসে গেছে পাশের স্টলটায়, আবার কেউ কেউ তার বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে দিব্যি হেসে হেসে আড্ডা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে । তখনো কিন্তু তাদের চোখে আসতে পারেন নি এই দাঁড়ানো বৃদ্ধা । তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একনাগারে বলে যাচ্ছেন, - “বাবা দুইটা টাকা ভিক্ষা দেন” । কে শুনে তাঁর কথা । না, কেউ-ই শুনছে না । মানুষদের এমন আচরণে আমার কাছে ওদেরকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না । কারণ মানুষের বিবেক-বুদ্ধি আছে বলেই তারা অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা । কিন্তু এদের দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছে নাযে, এদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলতে কিছু আছে কি না । আমার খুব দুঃখ হচ্ছিলো বৃদ্ধাকে দেরে, কারণ তিনি সবার কাছে ডানহাত পেতে টাকা চাচ্ছেন কিন্তু কেউ তাঁকে এক পয়সা ও দিচ্ছে না । আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না । আমার মানিব্যাগ হাইজ্যাক হওয়ার কারণে আমার কাছে এক কানাকড়িও ছিলো না । তাই আমি দোকানীর কাছে গিয়ে ১০০ টাকা ধার চাইলাম এই বলে যে, - “দাদা আমাকে ১০০ টাকা ধার দেন, আমি কাজল ড্রাইভারের বাড়িতে ভাড়া থাকি । আমি আপনার টাকা একটু পরেই দিয়ে দিব বাসা থেকে নিয়ে” । নাহ, লোকটি আমাকে টাকা দিলো না । টাকা না দেওয়ার পিছনে একটা সত্য কারণ আছে আর সেটি হলো,- আমরা গরীব মানুষ তাই আমাদের এখনো শহরে কোনো জায়গা-জমি নেই যে বাসা করে থাকব, তাই আমরা পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি । এই ৪/৫ দিন হলো আমরা নতুন বাসা চেঞ্জ করেছি তাই এই এলাকার কেউ-ই আমাদের ঠিকমতো ছিনে না । আমি মুখে করুণা নিয়ে আবারো লোকটিকে বললাম,- “আরে দাদা দেন না ১০০ টা-টাকা, দেখতে পাচ্ছেন না এই বৃদ্ধা কেমন করে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন । দেখে মনে হচ্ছে যে উনি এখন পর্যন্ত কিচ্ছুটি খান নি । উনার জায়গায় যদি আজ আপনার মা দাঁড়িয়ে থাকতেন তাহলে কি আপনি হাত-পা-মুখ বন্ধ করে বসে থাকতেন? কীই থাকতেন না তো! তাহলে কেন আমাকে ১০০ টা-টাকা ধার দিতে পারছেন না । আমি তো আর আপনার ১০০ টাকা নিয়ে বড়লোক হতে পারব না । আপনি একবার উনার কথা ভেবে দেখুন, কীভাবে দাঁড়িয়ে আছেন দুইহাত পেতে” । উনি আমার কথায় রেগে তেলে-বেগুনে এক হয়ে উনার কিচ্ছা বলা শুরু করলেন । সংক্ষেপে বলছি,- “কি বালের মা, আমার মা তো আমাকে জন্ম দিয়ে আমাকে রেখে আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছে । আমার কথা একটুও ভাবেন নি । তারপর থেকে আমি অনেক কষ্টে এর দোকানে একদিন, ওর দোকানে আরেকদিন কাজ করে কষ্ঠ করে বড় হয়েছি এবং এই ছোট্ট টি-স্টল দিয়েছি নিজেই ” । দোকানে এক কর্ণারে ঝুলন্ত ফলক দেখিয়ে বললো, - “আমার এই দোকানে আজ পর্যন্ত কাউকে বাকী দেইনি, এমনকি দয়া করেও কাউকে টাকা দেইনি” । আমি আর লোকটির সাথে তর্ক না করে দোকানের সামনে থেকে সরে আসলাম, ততক্ষণে যে ওই বৃদ্ধা এখান থেকে চলেই গিয়েছেন তা আমার লক্ষ্যই ছিলো না । আমার খুব খারাপ লাগল উনার জন্য এবং কষ্টও হলো । দোকানীর সাথে বকবকানীর জন্য অনেক দেরী হয়ে গেল তাই আমি বৃদ্ধাকে খোঁজতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম । আমার বাসায় না গিয়ে উনার পিছনেই দৌড়াতে লাগলাম । একসময় আমি উনার দেখা পেলাম । দেখলাম যে এখন বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে উনার ছেলে ও নাতির বয়সী ছেলেদের কাছে ডান হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন করুণ দৃষ্টিতে । কেউ একটা কানাকড়িও দিচ্ছে না, তা দেখা সত্বেও তিনি হাত বাড়িয়েই বসে আছেন এই ভেবে যে, কেউ-না-কেউ তো দিবেই । না কেউ-ই দিচ্ছে না একটা পয়সাও । আমার খুব ঘৃণা হলো এই মানুষগুলোর উপর । আমি বাস স্ট্যান্ডে নতুন, বাস স্ট্যান্ড-ই বা কেন; আমি তো এই এলাকাতেই নতুন । এমন কাউকে ছিনিনা যে তার কাছ থেকে টাকা ধারে নিয়ে বৃদ্ধাকে দিব । মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যে,- “একটু আগে যেই পরিচিত লোকটিকে যদি পেতাম তাহলে উনার থেকে টাকা চাইতাম বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে” ।
...
একসময় যে বৃদ্ধাটির হাত ছিল তার সন্তানের শরীরের সেবা-যতœ করার জন্য, সেই হাত আজ বাড়িয়েছি দুটো ভিক্ষের জন্য । বিধির কি নির্মম পরিহাস । কাকে কোন গোলকধাঁধাঁয় ফেলেন তা হয়তো কেঊ-ই জানেনা । আমি কাছে একটা টাকা ছিলোনা বলে আমি উনাকে সাহায্য করতে পারলাম না । মনে মনে চোরব্যাটাকে বেদম গালাগালি দিতে লাগলাম । যদি আমার মানিব্যাগটা আজ ছিনতাই না হতো তাহলে আমি উনাকে তাঁর এই নির্মম পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে পারতাম ।
-
আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে টাকা-পয়সা খরচ করি । কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন যে, এই দুঃখিনী মানুষদের জন্য এক দু টাকাও থাকেনা আমাদের কাছে ।
খাবার টেবিলে বসে আমরা প্রতিদিনই নিজেদের প্রিয় খাবারটি আগে খুঁজি, কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন, এই মানুষগুলো পেটপুরে দুমুঠো ভাত-ই পাচ্ছে না পেট ঠান্ডা করার জন্য ।
নানা পূজা-পার্বণে আমরা আমাদের জন্য নানা রকমের কাপড়-চোপড় কিনি, কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন যে, এই মানুষগুলো তাদের তাদের শরীর ঢাকার জন্য আমাদের মানুষদের কাছে একটা কাপড় চাইলে আমরা বলি যে, - “নষ্ট কাপড় নেই, এখন চলে যাও” । অথচ, আমাদের ভালো কাপড়-ই অনেকসময় আমাদের মেঝের জন্য পাপোশ হিসেবে ব্যবহার করি ।
একবার কি ভেবে দেখেছেন আমাদের দেশের মানুষদের বিবেক?
-
আপনি যদি আমার উপরোক্ত লেখাটি ভালোভাবে ও মনযোগ সহকারে পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার মনে ইতিমধ্যে একটি প্রশ্ন জেগেছে যে, - “আমার মনে যদি মনুষ্যত্ব এতোই আেেছ তাহলে আমি কেন বৃদ্ধাকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম না? এত সময় নষ্ট করে বাসায় গিয়ে টাকাটা আনতে পারতাম ।”
...
প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আমার একটাই উত্তর যে, আমার বাসা আরও প্রায় অনেক দূরেই ছিল । যেতে আসতে আমি উনাকে হারিয়ে ফেলতাম । আর উনাকে সাথে নিয়ে বাসায় ও যেতে পারতাম কিন্তু উনার যা অবস্থা ছিল, তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না হেঁটে যাওয়া । ঘটনাটি যখন আমার সাথে ঘটে বা বৃদ্ধার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন আমার কাছে টাকা না থাকা সত্বেও আমি চেষ্টা করেছি উনাকে সাহায্য করার, কিন্তু সাহায্য করতে দেয়নি মানুষরুপী জানোয়ার-রা । এই ধরেন ১০/১৫ দিন আগের ঘটনা আর তখন আমি বেকার ছিলাম । এখন আমি একজন ছোট একটা চাকরী করি । এখন প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার আগে আমি উনাকে খুঁজি । কারণ এখন আমার কাছে উনার সাহায্যের জন্য পর্যাপ্ত টাকা থাকে । কিন্তু উনিই থাকেন না । এখনো বৃদ্ধাকে আমি খুঁজে যাই । আপনারা সবাই আশির্বাদ/ দোয়া করবেন যাতে আমি উনাকে পাই এবং মার সমতুল্য শ্রদ্ধা এবং সাহায্য করতে পারি ।সুনামগঞ্জী লোকাল বাস থেকে এই মাত্র নামলাম । সিলেট গিয়েছিলাম বন্ধুর বিয়েতে । ভালো মতোই বিয়ে হলো এবং আমিও আমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । দুইদিন থেকে সজাগ থাকায় বাসের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম । ২ ঘন্টার পথ সুনামগঞ্জ । মাথার উপরে কুলিং ফ্যান ভনভন করে ঘুরায় ঘুম আসতে তেমন একটা দেরী হলো না । কন্টাক্টররের ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গলো, -“ভাই ভাড়া দেন” । আমি চোখ কচলে পকেটে হাত দিলাম । পকেটে হাত দেওয়া মাত্রই আমার ঘুম চোখ থেকে চলে গিয়ে চড়ক গাছে উঠলো । “আরেহ, একি! আমার মানিব্যাগ কোথায়! এখানেই তো আমার পকেটে ছিলো ।” কন্টাক্টার আমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,- “ভাই, নেমে টাকা দিয়েন ” | আমিও তার কথায় “আচ্ছা” সম্মতি দিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম সিটে । মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো । আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার মানিব্যাগ কে নিতে পারে । আমার সাথেই বাসে উঠেছিলো মহিবুল নামে এক ছেলে । ওর সাথে নাম জানা ছাড়া আর কোনো কথা হয়নাই । কন্টাক্টারকে ডাক দিলাম,- “এ ভাই এদিকে একটু আসেন তো... আচ্ছা আমার পাশে যেই ছেলেটি বসেছিলো সেই ছেলেটি কোথায় নেমেছে কিছু জানেন কি? ওহ জানেন না..ওহ আচ্ছা, এখন তাহলে আর কি করার । আসলেই আমার ভাগ্যটা খারাপ” । আমার মোবাইলে চার্জ ছিলো না বলে আগেই ব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম, তাই চোরটা মোবাইলের হদিস পায়নি, পেলে আমার মোবাইল নেওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারতো না । ভাবতে লাগলাম হারানো ব্যাগের কথা । ওতে ছিলো আমার প্রয়োজনীয় একটা কার্ড যা আমি চিরতরে হারিয়ে ফেললাম । মন খারাপ নিয়েই বসে আছি ।
-
এই মাত্র বাস থামলো সুনামগঞ্জের বাস স্টেশনে । বাস ভাড়া দেওয়ার জন্য এক পরিচিত ব্যক্তির থেকে টাকা ধার নিয়ে কন্টাক্টারকে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম । আমার মনটা এখনো খুব খারাপ মানিব্যাগটার জন্য তাই ধীরে ধীরে হাঁটতেছি । বাড়ি যাওয়ার পথে তিন রাস্তার মোড়ে একটা ফ্লেক্সির দোকান আছে । সবসময় ভীড় থাকে সেই দোকানে । নিত্যদিনের মতো আজকেও দোকানে অনেক ভীড় । আর তার পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে হাত পাতিয়ে । আমি ধীরে ধীরে দোকানের দিকে এগোলাম । যাওয়ার পর বাড়ি না গিয়ে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে আমি বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম । উনার বয়স আনুমানিক ৬০ এর কাছাকাছি হবে । কুড়ো হয়ে গেছেন, মুখ ও হাতের চামড়া মনে হচ্ছে খসে পড়তেছে । হাত ও গলার হাড় দেখা যাচ্ছে । এমনভাবেই দেখা যাচ্ছে যে কোনো এক্সে ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি অনায়াসেই বলে দিতে পারবে কয়টা হাড় রয়েছে গলায় ও হাতে । হাতের সবগুলো রগ ফুলে উঠেছে । দেখে মনে হচ্ছে যে, এই বুধয় ফাটলো । বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন আর কাঁপছেন । উনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে , মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতে তিনি কনকন করে কাঁপছেন । পড়নে ময়লা একটা কাপড়, শেষ কবে ধুয়েছিলেন হয়তো তাঁর নিজের-ই মনে নেই । ধুবেন-ই-বা কীভাবে, তাঁর হাতে আর শরীরে তো পর্যাপ্ত শক্তি-ই নেই ।
-
আমি অনেকক্ষন থেকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম-ই । দোকানের মানুষগুলো মোবাইলে টাকা ভরে আবার চলে যাচ্ছে; তারপর আবার নতুন নতুন মানুষ আসছে টাকা ডুকানোর জন্য । কিন্তু কারো চোখ যাচ্ছে না এই অসহায় বৃদ্ধার দিকে । কেউ কেউ টাকা ডুকিয়ে খুশি মনেই চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ পুরাতন বন্ধুকে অনেকদিন পর পেয়ে চা খেতে বসে গেছে পাশের স্টলটায়, আবার কেউ কেউ তার বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে দিব্যি হেসে হেসে আড্ডা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে । তখনো কিন্তু তাদের চোখে আসতে পারেন নি এই দাঁড়ানো বৃদ্ধা । তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একনাগারে বলে যাচ্ছেন, - “বাবা দুইটা টাকা ভিক্ষা দেন” । কে শুনে তাঁর কথা । না, কেউ-ই শুনছে না । মানুষদের এমন আচরণে আমার কাছে ওদেরকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না । কারণ মানুষের বিবেক-বুদ্ধি আছে বলেই তারা অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা । কিন্তু এদের দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছে নাযে, এদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলতে কিছু আছে কি না । আমার খুব দুঃখ হচ্ছিলো বৃদ্ধাকে দেরে, কারণ তিনি সবার কাছে ডানহাত পেতে টাকা চাচ্ছেন কিন্তু কেউ তাঁকে এক পয়সা ও দিচ্ছে না । আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না । আমার মানিব্যাগ হাইজ্যাক হওয়ার কারণে আমার কাছে এক কানাকড়িও ছিলো না । তাই আমি দোকানীর কাছে গিয়ে ১০০ টাকা ধার চাইলাম এই বলে যে, - “দাদা আমাকে ১০০ টাকা ধার দেন, আমি কাজল ড্রাইভারের বাড়িতে ভাড়া থাকি । আমি আপনার টাকা একটু পরেই দিয়ে দিব বাসা থেকে নিয়ে” । নাহ, লোকটি আমাকে টাকা দিলো না । টাকা না দেওয়ার পিছনে একটা সত্য কারণ আছে আর সেটি হলো,- আমরা গরীব মানুষ তাই আমাদের এখনো শহরে কোনো জায়গা-জমি নেই যে বাসা করে থাকব, তাই আমরা পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি । এই ৪/৫ দিন হলো আমরা নতুন বাসা চেঞ্জ করেছি তাই এই এলাকার কেউ-ই আমাদের ঠিকমতো ছিনে না । আমি মুখে করুণা নিয়ে আবারো লোকটিকে বললাম,- “আরে দাদা দেন না ১০০ টা-টাকা, দেখতে পাচ্ছেন না এই বৃদ্ধা কেমন করে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন । দেখে মনে হচ্ছে যে উনি এখন পর্যন্ত কিচ্ছুটি খান নি । উনার জায়গায় যদি আজ আপনার মা দাঁড়িয়ে থাকতেন তাহলে কি আপনি হাত-পা-মুখ বন্ধ করে বসে থাকতেন? কীই থাকতেন না তো! তাহলে কেন আমাকে ১০০ টা-টাকা ধার দিতে পারছেন না । আমি তো আর আপনার ১০০ টাকা নিয়ে বড়লোক হতে পারব না । আপনি একবার উনার কথা ভেবে দেখুন, কীভাবে দাঁড়িয়ে আছেন দুইহাত পেতে” । উনি আমার কথায় রেগে তেলে-বেগুনে এক হয়ে উনার কিচ্ছা বলা শুরু করলেন । সংক্ষেপে বলছি,- “কি বালের মা, আমার মা তো আমাকে জন্ম দিয়ে আমাকে রেখে আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছে । আমার কথা একটুও ভাবেন নি । তারপর থেকে আমি অনেক কষ্টে এর দোকানে একদিন, ওর দোকানে আরেকদিন কাজ করে কষ্ঠ করে বড় হয়েছি এবং এই ছোট্ট টি-স্টল দিয়েছি নিজেই ” । দোকানে এক কর্ণারে ঝুলন্ত ফলক দেখিয়ে বললো, - “আমার এই দোকানে আজ পর্যন্ত কাউকে বাকী দেইনি, এমনকি দয়া করেও কাউকে টাকা দেইনি” । আমি আর লোকটির সাথে তর্ক না করে দোকানের সামনে থেকে সরে আসলাম, ততক্ষণে যে ওই বৃদ্ধা এখান থেকে চলেই গিয়েছেন তা আমার লক্ষ্যই ছিলো না । আমার খুব খারাপ লাগল উনার জন্য এবং কষ্টও হলো । দোকানীর সাথে বকবকানীর জন্য অনেক দেরী হয়ে গেল তাই আমি বৃদ্ধাকে খোঁজতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম । আমার বাসায় না গিয়ে উনার পিছনেই দৌড়াতে লাগলাম । একসময় আমি উনার দেখা পেলাম । দেখলাম যে এখন বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে উনার ছেলে ও নাতির বয়সী ছেলেদের কাছে ডান হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন করুণ দৃষ্টিতে । কেউ একটা কানাকড়িও দিচ্ছে না, তা দেখা সত্বেও তিনি হাত বাড়িয়েই বসে আছেন এই ভেবে যে, কেউ-না-কেউ তো দিবেই । না কেউ-ই দিচ্ছে না একটা পয়সাও । আমার খুব ঘৃণা হলো এই মানুষগুলোর উপর । আমি বাস স্ট্যান্ডে নতুন, বাস স্ট্যান্ড-ই বা কেন; আমি তো এই এলাকাতেই নতুন । এমন কাউকে ছিনিনা যে তার কাছ থেকে টাকা ধারে নিয়ে বৃদ্ধাকে দিব । মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যে,- “একটু আগে যেই পরিচিত লোকটিকে যদি পেতাম তাহলে উনার থেকে টাকা চাইতাম বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে” ।
...
একসময় যে বৃদ্ধাটির হাত ছিল তার সন্তানের শরীরের সেবা-যতœ করার জন্য, সেই হাত আজ বাড়িয়েছি দুটো ভিক্ষের জন্য । বিধির কি নির্মম পরিহাস । কাকে কোন গোলকধাঁধাঁয় ফেলেন তা হয়তো কেঊ-ই জানেনা । আমি কাছে একটা টাকা ছিলোনা বলে আমি উনাকে সাহায্য করতে পারলাম না । মনে মনে চোরব্যাটাকে বেদম গালাগালি দিতে লাগলাম । যদি আমার মানিব্যাগটা আজ ছিনতাই না হতো তাহলে আমি উনাকে তাঁর এই নির্মম পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে পারতাম ।
-
আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে টাকা-পয়সা খরচ করি । কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন যে, এই দুঃখিনী মানুষদের জন্য এক দু টাকাও থাকেনা আমাদের কাছে ।
খাবার টেবিলে বসে আমরা প্রতিদিনই নিজেদের প্রিয় খাবারটি আগে খুঁজি, কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন, এই মানুষগুলো পেটপুরে দুমুঠো ভাত-ই পাচ্ছে না পেট ঠান্ডা করার জন্য ।
নানা পূজা-পার্বণে আমরা আমাদের জন্য নানা রকমের কাপড়-চোপড় কিনি, কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন যে, এই মানুষগুলো তাদের তাদের শরীর ঢাকার জন্য আমাদের মানুষদের কাছে একটা কাপড় চাইলে আমরা বলি যে, - “নষ্ট কাপড় নেই, এখন চলে যাও” । অথচ, আমাদের ভালো কাপড়-ই অনেকসময় আমাদের মেঝের জন্য পাপোশ হিসেবে ব্যবহার করি ।
একবার কি ভেবে দেখেছেন আমাদের দেশের মানুষদের বিবেক?
-
আপনি যদি আমার উপরোক্ত লেখাটি ভালোভাবে ও মনযোগ সহকারে পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার মনে ইতিমধ্যে একটি প্রশ্ন জেগেছে যে, - “আমার মনে যদি মনুষ্যত্ব এতোই আেেছ তাহলে আমি কেন বৃদ্ধাকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম না? এত সময় নষ্ট করে বাসায় গিয়ে টাকাটা আনতে পারতাম ।”
...
প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আমার একটাই উত্তর যে, আমার বাসা আরও প্রায় অনেক দূরেই ছিল । যেতে আসতে আমি উনাকে হারিয়ে ফেলতাম । আর উনাকে সাথে নিয়ে বাসায় ও যেতে পারতাম কিন্তু উনার যা অবস্থা ছিল, তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না হেঁটে যাওয়া । ঘটনাটি যখন আমার সাথে ঘটে বা বৃদ্ধার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন আমার কাছে টাকা না থাকা সত্বেও আমি চেষ্টা করেছি উনাকে সাহায্য করার, কিন্তু সাহায্য করতে দেয়নি মানুষরুপী জানোয়ার-রা । এই ধরেন ১০/১৫ দিন আগের ঘটনা আর তখন আমি বেকার ছিলাম । এখন আমি একজন ছোট একটা চাকরী করি । এখন প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার আগে আমি উনাকে খুঁজি । কারণ এখন আমার কাছে উনার সাহায্যের জন্য পর্যাপ্ত টাকা থাকে । কিন্তু উনিই থাকেন না । এখনো বৃদ্ধাকে আমি খুঁজে যাই । আপনারা সবাই আশির্বাদ/ দোয়া করবেন যাতে আমি উনাকে পাই এবং মার সমতুল্য শ্রদ্ধা এবং সাহায্য করতে পারি ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১:১৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×