গত মঙ্গলবা ভোর রাতে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি, হেড অব সিটিজেন এ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর (৪৭) খুনের ঘটনার প্রায় তিনদিন অতিবাহিত হবার পরও রহস্যের জট খোলেনি। কি কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে তা উৎঘাটনে তদন্তের সামনে এসেছে অনেক প্রশ্ন।
খালাফ আল আলী হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ কারণ গুলির মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের বিষয়ঠি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আগামী ১২ মার্চকে সামনে রেখে কোন অশুভ মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে পেশাদার ভাড়াটিয়া খুনীকে ব্যবহার করেছে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন ? কারন জামাত বি.এন.পি’র সবচেয়ে বড় মিত্র হলো সৌদি আরব। তাঁকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার আলামতে প্রমাণ দিচ্ছে, ভাড়াটিয়া পেশাদার খুনী বা দুর্বৃত্ত ছাড়া এ ধরনের হত্যাকান্ড সংঘটিত করতে পারে না। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক কখনই ভালো ছিল না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে সৌদি আর সহজ ভাবে মেনে নেয়নি। তারপরও কৌশলগত কারনে সৌদি আরবের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক খারাপ নয়।কিছুদিন আগে বাংলাদেশে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যা সমধানের জন্য আলোচনা করে ইতিবাচক সারা পেয়েছেন। সৌদি সরকার আকামা ও ভিসা চালু করার বিষয়টি বিবেচনায় আনে। এটা হয়তো কোন মহল রাজনৈতিকভাবে ভাল চোখে দেখেনি তাই দুই দেশের সম্পর্কে বৈরিতা ও দূরত্ব সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তাঁকে হত্যা করানো হতে পারে।
১২ মার্চের সমাবেশ নিবিঘ্নে পালন করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী ও সমর্থকগোষ্ঠী যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল করার জন্য সৌদি আরব দূতাবাস কর্মকর্তাকে খুন করিয়ে থাকতে পারে। সৌদি আরবে নবীজীর জন্মভূমি, পবিত্র কা’বাশরীফ ও ধর্মীয় স্থানসমূহ অবস্থিত হওয়ায় সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তাকে খুন করানো হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা খুবই সহজ হবে। যুদ্ধাপরাধীসহ দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এই বিবেচনায় সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তাকে হত্যা করিয়েছে কি না তাও গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে দেখা উচিত।আর একটি বিষয়কেও উড়িযে দেয়া যায় না, সেটা হলো ভারত কানেকশন ভারতীয়রা সব সময়ই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশীদের ভিন্ন চোখে দেখে।কিছুদিন আগে ভারতে সৌদি রাষ্ট্রদূতের উপর হামলা হবার পর বিষয়টি ততটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হয়নি এখন যতটা হইতেছে। তাছাড়া সৌদি শ্রমবাজার এককভাবে দখলে নিতে ভারতীয়রা এ হত্যাকান্ড ঘটাতে পারে বলে অনেকের ধারনা।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির (বায়রা) মতে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয় সৌদি আরবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ৮০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এর ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবে। বিদেশে বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ লাখ শ্রমিক রয়েছেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় সৌদি আরবে। এ সংখ্যা বাংলাদেশ থেকে মোট প্রেরিত জনশক্তির প্রায় ৩৭ শতাংশ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর সৌদি আরবে গড়ে প্রায় ২ লাখ জনশক্তি রপ্তানি হয়। তবে এ চিত্র পাল্টে যায় ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার কথা বলে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের নাগরিকদের কাজের জন্য নতুন ভিসা, আকামা নবায়ন ও পরিবর্তন বন্ধ করে দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। এরপর চালুর আশ্বাস পাওয়া গেলেও ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতার’ কারণে তা আর হয়নি। বরং আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) পরিবর্তন জটিলতার কারণে সৌদি আরব থেকে প্রতি মাসেই শত শত শ্রমিক ফেরত আসছে অব্যাহতভাবে।
আমার দেখা ও জানা মতে, বাংলাদেশীদের ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন কয়েক বছর ধরে বন্ধ থাকায় দেশটিতে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত অর্ধেক প্রবাসী বাংলাদেশীই এখন অবৈধ। বিদেশীদের জন্য সৌদি আরবে আকামার মেয়াদ থাকে তিন থেকে পাঁচ বছর। এর মধ্যেই আকামা নবায়ন বা পরিবর্তনের সুযোগ আছে। তবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনসহ অন্য সব দেশের জন্যই আকামা নবায়ন বা পরিবর্তনের দরজা খোলা রয়েছে। সেসব দেশের নাগরিকদের কোনো ভোগান্তিও নেই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ ভাবে সৌদি আরবে গেছেন ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১৯৮ জন বাংলাদেশী। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তা সমাধানে অগ্রগতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফরকালে সৌদি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর আকামা পরিবর্তন ও নবায়ন জটিলতা দূর হওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। ঢাকায় সৌদি কূটনীতিক খুনের কারণে শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাতে দেশের অর্থনীতিতে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই অতিদ্রুত খুনীদের শনাক্ত করে প্রবাসী শ্রমবাজার টিকিয়ে রাখার জোর দাবী জানাচ্ছি একজন প্রবাসী হিসাবে। সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের মতো এটাও যেন ধামাচাপা পড়ে না যায় সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার দাবী। সাগর-রুনির খুনী ধরা পড়লে হয়তো এই অনাকাঙিত ঘটনা ঘটত না।কোন খুনের ঘটনা যখন ধামাচাপা পরে যায় তখন খুনীর আরো বেপরোয়া হয়ে পরে।
যদিও এ ঘটনায় সৌদি আরবে কোন নেতিবাচক প্রভাব এখনও পড়েনি তবে রিয়াদ, জেদ্দা, মক্কা, মদিনা, দাম্মামসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রবাসীরা দেশে টেলিফোন করে স্বজনদের কাছে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীরা আশঙ্কা করছেন এ ঘটনার রেশ ধরে নতুন করে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি সৌদি আরবে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং সেই সঙ্গে বর্তমানে যারা রয়েছে তাদেরও সমস্যায় পড়তে হতে পারে এমন কি বাংলাদেশীদের উপর আক্রমন হতে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত কোথায় কোন অঘটনের খবর পাওয়া যায়নি।
একটি স্বার্থাষ্নী মহল গুজব ছড়াচ্ছে যে,
ইতিমধ্যেই সৌদির বিভিন্ন প্রান্তে একটি গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে সৌদি পুলিশ নাকি বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধরপাকড় করছে…এমনকি কোথাও কোথাও নাকি বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলছে…গুজবে মধ্যে অন্যতম হচ্ছে…দাম্মামে ৩ জনকে পিটিয়ে মেরেছে আর জেদ্দাতে ১৪ জনকে পিটিয়ে মেরেছে…আর হাজার হাজার শ্রমিক গ্রেফতার করা হয়েছে…। সকলের কাছে অনুরোধ নিশ্চিত না হয়ে এই রকম কোন সংবাদ কারো কাছে কেউ প্রচার করবেন না…গুজবে কান না দিয়ে সতর্কভাবে নিজের কাজ করুন…দেশে পরিবারের লোকজন হয়তো আপনার জন্য চিন্তা করছে তাই তাদের সাথে ফোন করে সৌদির অবস্থা সব সময় অবগত করুন।
আর নিচের নিদের্শনা গুলি মেনে চলার চেষ্টা করুন অন্যকে করতে বলুন। ধৈর্যসহকারে সার্বিক পরিস্থিতির উপর দৃষ্টি রাখুন।
১. এই সংবাদ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাঘোষা কম করুন…
২. নিজ কাজে মনযোগী হোন…
৩. সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলুন…
৪. সবার সাথে নিজের সর্বোচ্চ ভালো ব্যাবহার করুন…
৫. ইন্ডিয়ান সহকর্মীদের সাথে মনের ভুলেও এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবেন না…
৬. অন্য ন্যাশনালিটির (বিশেষ করে ভারত/পাকিস্থান/শ্রীলংকা) কেউ যদি আপনার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে চায় তবে কৌশলে তা এড়িয়ে চলুন…
৭. সৌদি কোন নাগরিক যদি এই ঘটনা নিয়ে তাদের রাগ প্রকাশ করে যথাসম্ভ্যব নিজের রাগ নিয়ন্ত্রন করে কৌশলে সেই অবস্থান ত্যাগ করুন…ঐ সৌদি নাগরিক যদি গায়ে পরে ঝগড়া করতে চায় তবে তার সাথে ঝগড়ায় না জড়িয়ে আপনার কফিলকে(মালিককে) বলুন…
৮. রেড ক্যাটাগরির শ্রমিকগন পুলিশ খেকে সতর্ক থাকুন…প্রয়োজন না থাকলে অযথা মার্কেটে ঘুরাঘুরি না করে ক্যাম্পে অবস্থান করুন…
৯. ইকামা ছাড়া কেউ কর্মক্ষেত্রে কিংবা বাহিরে কোথাও দয়া করে যাবেননা…
***১০. যাদের ইকামার মেয়াদ শেষ বা পুরোপুরিই অবৈধ তাদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ সৌদি পুলিশ থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করুন… (সৌজন্যে: প্রবাসী আশরাফ )।
প্রবাসীদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন:
১. দ্রুত এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করা হোক। স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে এই ঘটনার তদন্ত করা হোক।
২. এই ঘটনার সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুন না কেন তাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান করা হোক।
৩. সরকারের সর্বচ্চ মহল থেকে সৌদি সরকারকে আশ্বস্ত করা হোক যে কোন মূল্যে এ ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তাদের গ্রেফতারের জোর চেষ্টা চলছে। প্রয়োজনে যাদেরকে এদেশের সরকার ভাল জানে তাদের সম্বনয়ে একটি কমিটি গঠন করে সৌদি আরবে পাঠানো হোক নিহতের পরিবার প্রতি শোক ও সরকারের সাথে এই ব্যাপারে আলাপ করার জন্য। তাহলে এদেশে যেসব হলুদ সাংবাদিকগণ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে তাদের সেই অপচেষ্টা বিফল হবে।
৪. প্রধান মন্ত্রী, পরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবাস কল্যানমন্ত্রী সহ সরকারের উচ্চ মহল যেন সব সময় সৌদি সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখেন। এতে এদেশের সরকার বুঝতে পারবে বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত পেরেশান। ফলে দুদেশের সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশংকা কমবে।
৫. সরকারের কোন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিব যেন এই ঘটনাকে নিয়ে কোন বিভ্রান্তমূলক বক্তব্য না দেন।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোন বিবেকবান সচেতন বাংলাদেশীরা পছন্দ করে না। আমরা যারা সৌদি প্রবাসী আশা করি সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ সরকার সঠিক কাজ করবে। যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সৌদি আরবে আমরা যারা বাংলাদেশী আছি, আমরা এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করছি। গত চার বছর বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কয়েকটি দেশ সে সুযোগ নিয়ে নিয়েছে। সে সব দেশের শ্রমিকরা কম দক্ষ। অথচ তাদের বেতন-ভাতা বেশি। এখন তারা ভাবতে পারে যদি বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক নেয়া হয় তাহলে তাদের চাকরি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
পরিশেষে সরকারের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলতে চাই লক্ষ লক্ষ প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে খুনের রহস্য উৎঘাটন ও খুনী যেই হোক না কেন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
**********************************************
০৮/০৩/২০১২
দাম্মাম, আল-খোবার।