somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ময়রা গিন্নির ঘর

০২ রা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
সঞ্জীব চৌধুরী


বড় ছেলে কালাকাঁদ। কালাকাঁদ দাস। কষ্টি কালো, আয়তনের বেশিরভাগটাই ভুঁড়ি। বুকে পিঠে থলথলে মেদের ওপর লোমের আধিক্য অসমান। মাথা ভরা টাক, পুরনো বুরুসের মতো খোঁচা গোঁফ। খেটো ধুতি, ময়লা ফতুয়া, বয়স ষাটের ওপরে। কেওরাতলা শ্মশান, পরন্ত বিকেল। ময়রাগিন্নির ভোররাতে রাখা দেহ সাদা চাদরে ঢেকে মাটিতে শোয়ানো। দু’টো সস্তার ধূপকাঠি প্রায় নিভু নিভু। কালাকাঁদ মুখাগ্নির জ্বলন্ত পাঁকাটিকাটা মায়ের ঠোঁটের কাছে আনতেই ময়রাগিন্নি ডিসাইড করলেন, নাঃ, এবার ব্যাপারটা একটু রিকস হয়ে যাচ্চে। আর দেরি করা ঠিক হবেনাকো। শেষমেশ আগুন ফাগুন লেগে গেলে একটা আনথ বাধবে। আর যতক্ষণ না ছাদ্দ ছান্তি হচ্চে কোথায় গিয়ে উটবেন আর কেই বা দেখাশোনা করবে কিছুই পষ্ট হচ্চেনাকো। তার চে’ মানে মানে শরীরটার মায়া ত্যাগ করাই লেজ্জ্য হবে। ভাবা মাত্র গিন্নি হুস করে ডেড বডিটার থেকে বেরিয়ে এসে কালাকাঁদের মুখোমুখি কোমর কষে দাঁড়িয়ে খুব একচোট নিলেন। অপদাত্ত আহাম্মুক। মায়ের মুকে আগুন ঠেকাতে এয়েচিস? নিল্লজ্জ বেহায়া! বোয়ের ধামা ধরে ধরে কি অবনতিটাই না হয়েছে তোর কেলো! ছিঃ ছিঃ। তুই পেটে থাকতে আমার চোঁয়া অম্বলের রোগ ধরেছিল। ঝাড়া ছ’মাস বিশু ডাক্তারের মিকচার খেয়ে তবে তোর জন্মো দিলুম আর এখন প্যাঁকাটি জ্বালিয়ে ভূত তাড়াচ্ছিস? এ নিশ্চি ওই বড় বউয়ের টেনং। রোসো, দু’দিন একটু এদিককার ব্যাপার স্যাপারটা বুঝেনি তারপর এমন উত্তেক্ত করে মারব যে ময়রাবাড়ির বাস উটিয়ে তবে হ্যাঁ। আমারও নাম ওঁ কুসুমলতা দেব্যা। ওঁ শব্দটা এতকাল গিন্নি কত্তার নামের আগে ব্যবহার করতেন। নিজের নামে এই প্রথম। গিন্নি আরও দু’একটা কাঁচা শব্দে কালাকাঁদের ওপর আরও খানিকটা ঝাল মিটিয়ে গ্যাস বেলুনের মতো কয়েক ফুট ওপরে উঠে ভাসতে থাকলেন। কালাকাঁদের কানে গিন্নির কোনও কথাই গেল না। না যাওয়ারই কথা। আগুনটা যাতে হাওয়ায় নিভে না যায় তার জন্যে সাবধানে প্যাঁকাটিকাটা হাত দিয়ে আড়াল করে, তিনবার মায়ের ঠোঁটে ঠেকিয়ে, বডি’র চারপাশে তিন পাক মেরে মনে মনে বললেন, ‘মাগো, যাবার আগে তোমায় একটা কথা বলি। এখন থেকে তুমি ত সগ্যে গিয়ে মেজাজেই থাকবে, দেকো আমি যেন তোমার ঘরটার দখলি পাই। একখানা ঘরে তোমার ন’টা নাতি-নাতনি নিয়ে বড্ড কষ্টে আছি মাগো। তাছাড়া সামনেই নিমকির বে। তোমার নতুন নাতজামাইকে এ বাড়িতে কোথায় শুতে পরতে দোব সে চিন্তায় ঘুম হয়নাকো। দেকো, তোমার মেজ ছেলে যেন ঘরটা ঘুরিয়ে না দেয় মা, ওর বউটা যা কূট কাচালি। সারা জম্মো আমি তোমার দেখভাল করলাম আর বংশের বড় ছেলে হিসেবে ও ত আমারই লেজ্জ্য পাওনা। গিন্নি এমনিতেই কালাকাঁদের ওপর খাপ্পা হয়েছিলেন, এই দেখভাল কথাটায় এক্কেবারে গরম কেয়ায় চিরবিড়িয়ে উঠলেন। ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে বললেন, কী বললি! তুই আমায় দেখভাল করেছিস! হাসালি কেলো, এর চে’ আমার কানে সিসে ঢেলে দিলে আরাম পেতুম। আজ এস্তক কখনও এক কোটো জদ্দা দিয়ে বলেচিস যে মা এটা খেও? উলটে কাল সন্দেবেলা বড় বউয়ের হয়ে সালিশি করতে এয়েছিলি যে এত বড় হেঁসেলে সব্বারই অসুবিধে হচ্চে, এবার থেকে যে যার আলাদা রান্না করাই ভাল। কথাটা যে কার সে কি আমি বুঝিনিকো? কত্তা দেহ রাকবার আগের রাত্তে বিসনায় বলে গেসলেন, গিন্নি আমি চিতেই উঠলে তোমার কেলো তোমায় তিষ্টোতে দেবেনাকো। বাড়ি, দোকান সব লিকিয়ে নেবার চেষ্টা করবে, সাবধানে থেকো। শালা, তোকে আমি চিনিনে! কথাটা বলেই গিন্নির মনে হল যে নিজের ছেলেকে শালা বললে সম্পর্কটা কেমন গোলমেলে ঠেকে। কিন্তু আর কোনও জুতসই শব্দ এই শোকের সময় ঠিক মনে পড়ল না। মনে মনে বললেন, বেশ করেচি বলেচি। এখানে ময়রাগিন্নির পরিচয়ের জন্যে ময়রাবাড়ি সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলা দরকার। খিদিরপুর বাবুবাজার পোষ্টপিসের উলটো দিকে ট্রাম লাউন লাগোয়া পুরনো মিষ্টির দোকান। সাইনবোর্ডে নীলের উপর গোটা সাদা হরফে লেখা,

শ্রী শী গজানন মিষ্টান্ন ভান্ডার

প্রোঃ- ওঁ কৃষ্ণচন্দ্র দাস মোদক

মিষ্টি বলতে গুজিয়া, দরবেশ আর দানাদারটাই বেশি চলে। কিন্তু দিনমানে যে কোনও সময় অন্তত জনা বিশেষ লোক শিঙাড়া, জিলিপি কিংবা কচুরির জন্যে লাইন মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। কচুরির সঙ্গে খোসা শুদ্ধ আলুর তরকারি ফ্রি। একটা হালুইকর সারাদিন শুধু আলু কেটে চলছে। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত যে কোনও সময় দোকানে এলেই কালাকাঁদকে ক্যাশবাস্ক কোলে বসে থাকতে দেখা যায়। কৃষ্ণচন্দ্র দাস বর্ধমান জেলার পালসিট গ্রাম থেকে কর্পদশূন্য অবস্থায় এসে অনেক কষ্ট করে যখন দোকানটা বানিয়েছিলেন তখন জলছানার সের ছিল একটাকা। প্রথম প্রথম তেমন একটা বিক্রি বাট্টা তেমন হতো না বলে কৃষ্ণচন্দ্র অনেকবার ভেবেছিলেন দোকানটা তুলে দেবেন। কিন্তু বাঁকুড়া জেলার হাট আসুরে গ্রামের তের বছরের কুসুমলতা তাঁর জীবনে আসার পর থেকে মা লক্ষ্মীর দয়া উপচে পড়ে এই কচুরি আর আলুর তরকারির সৌজন্যে। সে কারনে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন কচুরি, ডাক নাম আলু। পরের বছর যখন কুসুমলতা দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হলেন, “শোন কুসুম, এবার যদি মেয়ে হয়, তার নাম রাকবো জিলিপি। কারণ শুধু কচুরি আর পড়তায় তেমন পোষাচ্ছেনাকো।” কুসুমলতা হেসে ঘোমটা টেনে বললেন, “তা বেশ তো, তাই হবে অখন।”

জিলিপির জন্মের পর থেকে গজানন মিষ্টান্ন ভান্ডারের সেল দ্বিগুন বেড়ে গেল আর কৃষ্ণচন্দ্রের টাকার লোভও সেই সঙ্গে কয়েকগুন বাড়ল। ফি বছর কুসুমলতা নতুন নতুন সন্তান প্রসব করলে কৃষ্ণচন্দ্র এক একটি নতুন আইটেম বিক্রি শুরু করতেন আর এভাবেই কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবার গজানন মিষ্টান্ন ভান্ডারের শো’কেসের মতো বেড়ে তিন পুত্র ও ছয় কন্যা সহ মোট এগারো জনে দাঁড়ালো। পাড়ার ছেলেরা

মশকরা করে আড়ালে বলত, ময়রাবাড়ির ফুটবল টিম!

আয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র, দাস থেকে দাস মোদক হলেন। গ্রাম থেকে একে একে চার ভাইকে কলতায় এনে নিজের বাড়িতে রাখলেন। ক্রমে তাঁদেরও সংসার বৃদ্ধি হল ও এভাবেই ময়রাবাড়ির জনসংখা নয় নয় করে ঊনপঞ্চাশে দাঁড়াল। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ময়রাবাড়ির লোক সংখ্যা কমার কোনও কারণ ঘটেনি। গিন্নিমাই প্রথম।

কালাকাঁদ ধুতির খুঁটিটা একবার চোখের কোলে ঠেকিয়ে আড়চোখে দেখলেন, কেউ দেখছে না। নামিয়ে নিলেন। ওদিকে আগের বডিটা শুকনো ছিল বলে মিনিট দশেক আগেই চুল্লির দরজাটা খুলে গেল। কালাকাঁদ হাত দু’টো জড়ো করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাড়ার ছেলেরা উচ্চঃস্বরে একবার হরিবোল দিল। পুরুত বির বির করে মন্ত্র আউড়ে গিন্নির বডিতে কয়েকফোঁটা গঙ্গাজল ছেটাল। ময়রাগিন্নি উপর থেকে কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা শুঁটকে ডোম টলতে টলতে বডিটা দুম করে ভিতরে ঢুকিয়ে দম করে দরজাটা বন্ধ করে গঙ্গার দিকে গান গাইতে গাইতে চলে গেল, “লে গয়ে দিল, পাগল মুঝে কর দিয়া...।” এখন অন্তত একঘন্টা বসে থাকা ছাড়া কিসস্যু করা নেই। কালাকাঁদ ছোটভাই গোকুলকে ডেকে বললেন, “পাড়ার ছেলেদের একটু মুকে জল দিয়ে নেয়ায় গে। আমি বরং এখেনটায় একটু একা থাকি, মনটা বড্ড হু হু করচে।” গোকুল বলল, “আমি তো টাকা পয়আ কিসসু আনিনিকো দাদা, ধারে নিচ্ছি। যাবার সময় তুমি মিটিয়ে দিও।” কালাকাঁদ মনে মনে বললেন, শালা সেয়ানাস্যি সেয়ানা, তোর হবে রে গোকলা।

ফাঁকা দেখে পুরুত কালাকাঁদের কাছে এসে হাত পাতল। গজানন মিষ্টান্ন ভান্ডারের সঙ্গে যারা ধার বাকির কারবার করেন তাঁদের কাছে কালাকাঁদের বেশ নাম আছে। লোকে বলে, কালাকাঁদের কাছে পাওনা আদায় করতে নতুন টায়ারের চটিতেও হিল বসাতে হয়। কালাকাঁদ একবার আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, “কিছু বলবে?” “আজ্ঞে , আমায় যদি ছেড়ে দেন।”

“বাব্বা, তুমি তো আচ্ছা বেআক্কেলে পুরুত হে, মাল দেবার আগেই পয়আ চাইছ! আরে আগে তো মড়াটা পুড়ুক, দেকি তোমার মন্ত্রের জোর, তবে তো পয়আ। ঘুরে এসো দিকিনি।”

পুরুত এমন কথা আগে কখনও শোনেনি।

অবাক চোখে কালাকাঁদকে একবার মেপে নিয়ে পরের বডিটার দিকে যেতে যেতে বলে গেল, “মড়া কি আর মন্তরে পোড়ে বাবু, মড়া পোড়ে মনের জ্বালায়।”

বডিটা ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকে যাওয়ার পর থেকেই গিন্নির মনটা খুব ভেঙে গেল। বসতবাড়ি খোয়ালে মানুষের যেমন ফিলিংস হয় আর কি। ভাবলেন, কোথায় যাই, সব জায়গাই অচেনা। ময়রাবাড়ির বাইরে তো বিশেষ কখনও বেরোননি। বাপেরবাড়ির পাটও চুকেবুকে গেছে সেই কত্তা চলে যাবার পর থেকেই । মনে মনে মা গঙ্গাকে স্মরণ করলেন। যেমন ভাবা ওমনি গোঁ করে ঘুড়ির মতো সোজা কালীঘাটের গঙ্গার পাড়ে এসে ল্যান্ড করলেন। চারপাশে নোংরায় বমি এসে গেল। ম্যাগো, নোংরা বলে নোংরা! চারধারে শুধু সকড়ি, মদের বোতল, কিসের না কিসের ন্যাকড়া আর পচা প্লাস্টিক। এখানে আবার কেউ মড়া পোড়ায়? ঘেন্নায় গিন্নি বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পুরো পা ফেলার মতো প্রবৃত্তি হল না। গঙ্গার জলটা তো একেবারে বৈঠকখানা ঘরের টেলিফোনটার মতো কালো। গাছ বলতে কয়েকটা পুরনো বট অশ্বথ আছে বটে তবে ডালে ডালে ভুত একেবারে গিসগিস করছে। মোটে তিল ধারণের জায়গা নেই। চ্যাংড়া ভুত পা দুলিয়ে আড্ডা মারছিল। গিন্নিকে দেখা মাত্র টিটকিরি মেরে বললে, “এই যে দিদিমা, এদ্দিনে আসার টেইম পেলেন। সব যৌবন খচ্চা মচ্চা করে শেষমেশ এখেনে পেনশেন। মালকড়ি কিছু এনেছেন না ছেলেরা ফুটো হাতেই পাট্যে দিলে?”

মগডালে এক সিনিয়র বেক্ষদত্যি নেশা করে পরেছিলেন। গিন্নির প্রতি সদয় হয়ে চ্যাংড়াগুলোকে ধমকে বললেন, “এই ছোঁড়া ইভটিজিং হচ্ছে? শুকনো হাঁটুর হাড় মাথায় এমন ঠুকব না যে সিধে নার্সিং হোম।” লম্বুটা জিভ কেটে, দু’কানে হাত ঠেকিয়ে বলল, “সরি স্যার, এই সন্দেবেলায় একটু রসিকতা করছিলাম আর কি! টেইম পাস।”

বেলা পড়ে আসছে। গিন্নিমা কোথায় কোন দিকে যাবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। একবার মনে হল বাপের বাড়ির পাড়ায় গেলে কেমন হয় । ওখানে বাগানে গাছ অনেক কিন্তু বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেউ দেখে ফেললে ভাইয়ের বউয়ের কাছে ইজ্জত থাকবে না। তাছাড়া ওঁ কৃষ্ণচন্দ্রের বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে সব সময়েই আপত্তি ছিল। ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না মনে করে গিন্নি আরও কয়েক ফুট ওপরে উঠে ভেসে রইলেন।

কালিঘাট মন্দিরের চুড়োটা দেখে হাত তুলে প্রনাম করে বললেন, “মাগো একটু দেকিস ছেলে যেন মায়ের দুঃখটা বুঝে ছাদ্দ ছান্তিটা একটু তাড়াতাড়ি করে। এভাবে মোটে ভাল্লাগচেনাকো।” মনে হল একবার মন্দিরের আশপাশটা ঘুরে এলে হয়। হাজার হোক, মায়ের থান। একটা যা হোক কিছু বন্দোবস্ত হলেও হতে পারে। কাছাকাছি এসে দেখলেন উরেব্বাস। এ তো অষ্টমীর রাতে পঁচিশ পল্লির ভিড়। গাছের ডাল তো ডাল, পাতাতেও ভুত ঝুলছে। একটা অল্পবয়সি ব্রাহ্মন ভুতকে ডেকে বললেন, “শোন বামুনের পো, এখানে ক’দিন থাকার মতো একটা জায়গা খুঁজে দিতে পারো? জলপানি দোবো।”

“কালিঘাটে ভাড়া খুঁজচেন দিদিমা। ও, আপনি বুঝি মাথার দোষেই? ফ্রি খওয়াদাওয়া পেয়ে এখেন থেকে আজ এস্তক কোনও শালা উটেচে? সেই যে সব এসে গেড়ে বসেছে কারও ওঠার নাম পেরযন্ত নেই। আপনি বরং বাইপাসের দিকে চলে যান, সস্তায় বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। তবে বোকার কিমবা সিন্ডিকেটকে কিছু মান ছাড়তে হবে।”

গিন্নি কোথায় বাইপাস, বোকার মানেই বা কি, সিন্ডিকেটই বা কি ধরনের ভুত কিছুই বুঝতে পারলেন না। চোখে জল এসে গেল। ময়রাবাড়ির জন্যে মনটা কেমন আকুলি বিকুলি করতে লাগল। ছাদ্দ ছান্তির পর হয় সগ্য নয় নরক একটা কিছু ব্যবস্থা হবে ঠিকই কিন্তু সে কি আর ওই কুষ্মান্ড ছেলেরা এক মাসের আগে করবে । সব যা বউ ন্যাওটা । এই এক মাস যে কী করবেন, কোথায় উঠবেন ভেবে কুল পেলেন না। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু খিদেও পাচ্ছে। ময়রাবাড়ি হলে এতক্ষণে ছোটবউ পুজোর বাতাসা পেসাদ আর এক গেলাস জল নিশ্চি দিয়ে যেত। গিন্নির ওঁ কৃষ্ণচন্দ্রের কথা মনে পড়ায় ফুঁপিয়ে কান্না পেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, তিনি তো সগ্যে দিব্বি আছেন, এখানে শুধু শুধু খুঁজে কোনও লাভ নেইকো। ছাদ্দর পর সগ্যে গিয়ে খঁজে বের করলেই হবে’খন।

একবার কেদার ঠাকুরের কথা মনে এল। ময়রাবাড়ির হেঁশেলের বহু পুরনো ঠাকুর, কত্তার আমলের বিশ্বেসী লোক। দায় বিদেয়ে গিন্নির অনেক করেছে। তাছাড়া বউদের খবর টবর কাজের ফাঁকে ফাঁকে গিন্নির কানে নিয়ম করে তুলে গেছে। গিন্নির মনে হল কেদারকে একবার ডেকে নিলে হয়। কিন্তু ঠিক ভরসা পেলেন না। বউগুলো যদি আবার ওকে হেঁসেলে না দেখতে পেয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্ন করে? কেদার ছাড়া তো দু’দন্ড চলে না, নিষ্কষ্মার গতর সব। খাচ্ছে আর ফুলছে।

রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠল। গিন্নি এবার ভয় পেলেন। শেষে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে? কোনও গত্যন্তর না দেখে ঠিক করলেন, ময়রাবাড়িতেই ফিরে যাবেন। অন্তত ছাদ্দ পর্যন্ত। তারপর যেমন বিধেন পাবেন, চলে যাবেন সগ্যে কিংবা নরকে। এই তো ক’টা দিন, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। একটু সাবধানে লুকিয়ে থাকতে হবে, এই আর কি। গিন্নি একবার কত্তার নাম নিলেন। বললেন, “ওগো ওঁ কৃষ্ণচন্দ্র, নেরুপায় হয়ে তোমার ভিটেতেই ফিরচি। ক্ষেমা করে অন্তত বাগানে এই একটা মাস একটু আশ্রয় দিও। এভাবে পথেঘাটে ঘুরলে তোমার কুসুম মরে ভুত হয়ে যাবে। ছাদ্দটা হোক তাপ্পরে তোমার চরণেই আসচি।” এই বলে হাত তুলে কত্তাকে একটা পেন্নাম করে গিন্নি সোঁ করে ময়রাবাড়ির বাগানের ওপরে এসে ঠিক করলেন, বাতাবি নেবু গাছের যে ডালটা দোতালার বারান্দার পাশ দিয়ে ডাগর হয়ে বেড়েছে ওটাতেই থাকবেন। ওখানে থেকে নিজের ঘরটা পুরো দেখা যাবে। এমনকী কেলোর ঘরটাতেও উঁকি মারা যাবে। তবে চোখে পড়লেই আবার পথেঘাটে।

নিজের ঘরটা দেখতে পেয়ে গিন্নির মনে বেশ শান্তি এল। সব কিছু যেমন ছেড়ে এসেছেন তেমনি পড়ে আছে ঠিকঠাক। কেদার ঘর ঝাঁট দিচ্ছে সন্ধে দিবে বলে। যেমন রোজ দেয়। ‘কিন্তু কেদারের কোঁচড়ে অত বড় ফোঁড়াটা কবে গজাল? বেশ ফুলো হয়েছে তো। ও হরি, এ তো আমার নতুন জদ্দার কোটোটা। গিন্নি একবার ভাবলেন কেদারের বাঁ কানটা টেনে আনেন। কিন্তু যদি ঘাবরে মাবরে গিয়ে চিৎকার করে বসে তাহলে নিজেরই ক্ষতি। নিজেকে সামলে নিলেন।

কেদার প্রদীপ জ্বালিয়ে লক্ষ্ণীর ঝাঁপির সামনে রাখতেই কতকগুলো রুপোর টাকা চকচক করে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলে বারান্দায় কেউ নেই। ঝপ করে টাকাগুলো তুলে ধুতির খুঁটে বেঁধে ফেলল। গিন্নি চোখের সামনে চুরিটা দেখে রাগ সামলাতে পারলেন না। বাঁ হাতে গাছের ডালটা শক্ত করে ধরে ডান হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে কেদারের ঘাড়ে রাখবেন এমন সময় কোথেকে হুলোটা হঠাৎ গিন্নিকে দেখে বেজায় চিৎকার জুড়ে দিলে। কেদার মশারির ভাঙা ছতরিটা নিয়ে তেড়ে এল। হুলোটা পালাতে গিন্নি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। নিজের মনে বললেন, আরেকটু হলেই সব্বেনাশ হয়েছিল আরকি। য্যাকগে, আমার আর ট্যাকার কী দরকার। তাছাড়া সগ্যে গেলে তো মালক্ষ্ণীর সঙ্গে দেকা হবেই। টাকা ক’টা তখন চে’ নিলেই হবে।

কেদার ঝাঁট শেষ করে গিন্নির ঘরের দরজায় একটা তালা ঝুলিয়ে চাবি হাতে চলে গেল। গিন্নি খুব অবাক হলেন। হঠাৎ আমার ঘরে কেদার চাবি দিয়ে গেল কেন? এ তাহলে কেলোর বুদ্ধি। রাতে সবাই ঘুমুলে একটু নিজের বিছানায় শুতে যাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু কেদারটা দিলে সব মাটি করে।

গিন্নি এবার কালাকাঁদের ঘরের দিকে নজর ঘোরালেন। ঘরের আলোটা নেভানো। টিভিতে ‘শাশুড়ির প্রেম’ সিরিয়ালটা চলছে। এ সময় বড় বউকে কেও রুখতে পারবে না। গিন্নির আপত্তি তো ধর্তবোর মধ্যেই আনে না। নিজে দেকচিস দ্যাক, আবার পাশে কচি মেয়ে দু’টোকে নিয়ে কাঁটাল পাকাচ্চে। নেচি আর বুচি দেকচে দেকো যেন হাঁ করে দানাদার গিলচে। সবে শাউড়ি দেহ রেকেচেন, কাল অশোচ লেগেচে, কেলোর বোয়ের এ সময় সিরিয়াল দেকাটা কি উচিত হচ্ছে? গিন্নির খুব রাগ হল। বেঁচে থাকলে বারান্দায় বেরিয়ে অন্তত ভাববাচ্যে কয়েকটা কথা ছুঁড়ে দিতেন, “বলি, আদিখ্যেতার কি শেষ নেইকো। গেরস্তের সংসার, কাল অশোচ। ভর সন্দেবেলা কোথায় একটু রাম নাম করবে না টিভিতে ভাব ভালবাসার কেচ্ছা দেকছে। ঝ্যাঁয়টা মার অমন সংসারের মুকে। সবই অদেষ্ট, সবই অদেষ্ট... ইত্যাদি।” কিন্তু কথা গুলো বলা গেল না। চেঁচামিচি শুনতে পেয়ে যদি নেচি আর বুচি বারান্দায় এসে ‘ঠাম্মা

এয়েচে, ঠাম্মা এয়েচে’ বলে গোল বাধিয়ে দেয়। মনে মনে বললেন, য্যাকগে।

খিড়কির বাইরে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। মেজ ছেলে ক্ষীরমোহন সপরিবারে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিল। গিন্নির খবর পেয়ে দু’দিনের মাথায় ফিরে আসতে হয়েছে। গিন্নি পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে মেজবউয়ের দিকে নজর দিলেন। মেজর খুব মেজাজ, বাপের বাড়ির পয়সার গরম। বর্ধমান স্টেশনের গায়ে বিশাল চালু, সীতাভোগ মিহিদানার নাম আছে। গিন্নি শুনলেন ট্যাক্সির ভেতরেই মেজবউ ক্ষীরুকে বলছে, “বুড়ি মরবার আর সময় পেলে না। এদ্দিন পর যাওবা একটু বেরুনো হল তাতেও জল ঢেলে দিলে। তিনদিনের মাথায় ওয়াপস। নতুন কার্ডিগানটা সুটকেস থেকে বের করাই হল না। কেনাই সার। আবার সেই বচ্ছর ভোর রোদে দাও আর ন্যাপথলিনের বল গুজে আলমারিতে তোল।”

ক্ষীরমোহনের একটু আধটু লুকিয়ে মাল খাওয়ার অভ্যাস আছে। মেজবউয়ের এ ব্যাপারে আবার ঘোর আপত্তি। তাই কিটব্যাগে গামছা মুড়িয়ে একটা এক লিটারের বোতল নিয়ে গিয়েছিলেন। মালটা খোলা তো হলই না, এখন এটাকে লুকিয়ে রাখাই এক ঝামেলা। গিন্নি দেখলেন, ক্ষীরু ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে উঠতে মেজকে বলছে “দুঃখু কোরও না, ছেরাদ্দের ঝ্যামেলাটা মিটলেই আবার টিকিট কাটবো খন। একেবারে ডাহা লস।” মেজবউ বললে “চিরকাল বুড়িটা সবাইকে জ্বালিয়েছে, মরেও পেছন ছাড়ল না।” ক্ষীরু ঘরের দরজার তালাটা খুলতে খুলতে বলল, “এই, অশোচের সময় জোরে গাল দিওনাকো। ছাদ্দ না হওয়া পেরযন্ত তেনারা সব শুনতে পায়। বলা তো যায় না।” গিন্নি সব শুনে মনে মনে বললেন, “এদ্দিন ভাবতুম ক্ষীরুটা আরগুলোর থেকে আলাদা। মায়ের ওপর মায়া দয়া না থাক অন্তত কত্তব্যি জ্ঞানটা আছে। এখন দেখচি এটাও ইয়ের ওপিঠ।”

মেজবউয়ের সঙ্গে কেদারের সম্পর্কটা বরাবরই একটু মাখো মাখো। দু’জনেরই বাপের বাড়ি বর্ধমান। কেদার যে লুকিয়ে মেজবউয়ের অনেক ফাই ফরমাশ খাটে, গিন্নি সব জেনেও মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন। আজকে তার জন্যে আফসোস হল। গিন্নি দেখলেন, মেজ ঘরে ঢুকতেই কেদার দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে হাতে কি একটা গুঁজে দিয়েই আবার বেরিয়ে গেল। ক্ষীরু বউয়ের হাতে জিনিসটা দেখে মেজর গালে একটা টুস্কি মেরে বললে, “গুড বয়, এই না হলে ওয়াইফ।” গিন্নি সবই দেখলেন বটে কিন্তু কেদার যে জিনিসটা দিয়ে গেল সেটা যে ঠিক কি, ঠাওর করতে পারলেন না। জদ্দার কোটো? কিন্তু মেজর তো জদ্দার নেশা আছে বলে জানতেন না। তবে কি রুপোর ট্যাকাগুনো? কে জানে?

গিন্নির হঠাৎ চোখে পড়ল তিনতলায় ছোট ছেলে গোকুলের ঘরটা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। গোকুলকে তো শ্মশানে ঘুরতে দেখেছেন কিন্তু ছোটবউয়ের তো এ সময় ঘরেই থাকার কথা। একটু খোঁজাখুঁজির পর দেখলেন, যা ভেবেছেন, ঠিক তাই । কেদার কথাটা কয়েকবারই তুলেছিল বটে কিন্তু গিন্নিই তখন আমল দেননি। হাজার হোক নিজের বাড়ির কেচ্ছা। এখন স্বচক্ষে দেখলেন। ছাদের জলের ট্যাঙ্কের দিকটা এমনিতেই একটু অন্ধকার। ছোটবউ ওখানে দাঁড়িয়ে চিকেন রোল চিবোচ্ছে আর কার্নিশের লাগোয়া বোসেদের ছাদের ভাড়াটে ছোঁড়াটা এক গালে হাত রেখে ধিনিকেষ্টটির মতো দাঁড়িয়ে বলছে, “একটু চিলি সস নেবে? এক্সট্রা এনেছি কিন্তু।” ছোটবঊ বললে, “ফ্রিজে রেখে দিও, কাল পরশু খাব। আমার পক্ষে একমাস ঘাসপাতা খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমিও তাহলে ওপরে উঠে যাব।”

ছোঁড়াটা বললে, “সন্দেবেলা এমন অলুক্ষুণে কথা বলে না, আমার তাহলে কি হবে সেটা ভেবে দেখেছ? কাল এ সময় এসো, ভবানী কেবিনের আন্ডা মটন রোল খাওয়াব, মুখ ছেড়ে যাবে।” ছোঁড়াটার আস্পর্ধা দেখে গিন্নির হাত দু’টো নিষপিশিয়ে উঠল। “ছোটবউয়ের ওপর একশানটা আগেই নেওয়া উচিত ছিল, বড্ড লেট হয়ে গেচে। এ অবস্থায় ঘাড় মটকে পুলিশ কেস টেস হলে সগ্যের ব্যাপারটা ঘেঁটে যেতে পারে। তার চে’ যার মুলো সেই কাটুক। আমার বয়ে গেচে।”

গিন্নি ছাদ থেকে নেমে আবার বাতাবি গাছের ডালটায় এসে বসলেন। একটু খিদে খিদে পাচ্ছে । সামনেই একটা পুরুষ্টু নেবু ঝুলছিল। খুব সাবধানে ডাল পাতা না দুলিয়ে এক কোয়া ভেঙে মুখে দিয়ে থু থু করে ফেলে দিলেন। ম্যাগো, বিষ টোকো।

বল হরি, হরি বোল। জনা বিশেক শ্মশানযাত্রী নিয়ে কালাকাঁদ আর গোকুল খিড়কির দরজা দিয়ে এসে বাগানে ঢুকল। গিন্নি পাতার আড়ালে নিজেকে ভালো করে ঢেকে নিলেন। সিরিয়ালটা তখন ক্লাইম্যাক্সে। বড়বউ ‘ধুত্তোর’ বলে টিভিটা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে এলেন। ‘ধুত্তোর’ কথাটা গিন্নির কানে লাগল।

কেদার ঠাকুর আগে থেকেই বড়বউয়ের নির্দেশ মতো নিমপাতা, মোমবাতি, কাঁচা ডাল আর লোহার একটা চিমটে রোয়াকের পাশে জোগাড় করে রেখেছিল। দেশলাইয়ের কথা একবারও বলেনি। এখন মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে দেশলাই না পেয়ে সিরিয়ালের ঝালটা কেদারের ওপর মেটালেন। গিন্নি সব শুনলেন।

শ্মশানযাত্রীর একে একে শুদ্ধি করে রোয়াকের ওপর লাইন করে বসে। কালাকাঁদ বললেন, “একটু বস সবাই, দোকান থেকে গরম বোঁদে এই এসে পড়ল বলে। একটু মুকে দিয়ে যেতে হয়। মা বোঁদে বড় ভালবাসতেন কি না।” গিন্নি ওপর থেকে কথাটা শুনে খুশিই হলেন আর সঙ্গে সঙ্গে খিদেটাও বেড়ে গেল। উপোসের পর মুড়ি বোঁদে ওঁর খুবি প্রিয়, কিন্তু এখন কোনও উপায় দেখলেন না।

শ্মশানযাত্রীরা চলে যাবার পর কালাকাঁদ ওপরে এসে বারান্দা থেকে বডিটা একটু নীচে ঝুলিয়ে ‘কেদার’ বলে ডাকলেন। ডেকেই বুঝতে পারলেন যে ডাকটা অন্য দিনের চেয়ে বেশ ভারীই হয়েছে। আসলে গিন্নির অবর্তমানে তিনিই যে বাড়ির কর্তা এ কথাটা সকলকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। কেদার দৌড়ে এসে এজ্ঞে বলে দাঁড়াল। কালাকাঁদ বললেন, “মায়ের ঘর ঝাঁট হয়েচে?”

“এজ্ঞে, অনেকক্ষণ।”

“সন্দে দিয়েচো?”

“এজ্ঞে।”

“এক কাজ কর, মায়ের ঘরের দরজায় এ তালাটা ঝুলিয়ে চাবিটা দিয়ে যাও। কেউ জিগ্যেস করলে বলবে, গিন্নিমা তোমায় তাই বলে গেচেন।”

কেদার থতমত খেয়ে বললে, “এজ্ঞে মায়ের ঘরে তো তালা পড়ে গেছে অনেক্ষণ।” কালাকাঁদ হতাশ হয়ে জিগ্যেস করলেন, “সে কী? কে দিলে?”

“এজ্ঞে মেজ বাবু।”

ইতিমধ্যে বড়বউ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

কালাকাঁদ ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখলে, আমি ঠিক জানতুম।”

বড়বউ ইশারায় কালাকাদকে চুপ করতে বলে কেদারকে বললেন, “কেদার, তুমি গিয়ে আঁচটা দিয়ে দাও। ছেলেমেয়েদের ভাতেভাত সেদ্ধ হবে। আমি আসচি।”

কালাকাঁদ বউয়ের হাবভাব কিছুই বুঝতে না পেরে বসে পড়লেন। বড়বউ ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে আলমারি থেকে গিন্নির বিশ ভরির মপ চেনটা বের করে একবার কালাকাঁদের মুখের সামনে দুলিয়েই আবার ঢুকিয়ে দিলেন। ঘর থেকে বেরোবার সময় কালাকাদের থুতনিতে একটা টুসকি মেরে বলে গেলেন, “তোমার মতো ঢেঁড়ো ভুশকো’র ভরসায় থাকলে দোকানটাও বেহাত হবে।”

গিন্নির হারের দামটা মনে মনে হিসেব করে কালাকাঁদের হতাশা খানিকটা কমলো বটে তবে ঘরের শোকটা রয়েই গেল। নিজেকে বললেন, খুব সাবধান কালাকাঁদ, চারপাশে শত্তুর গিস গিস করছে। এমনকী তোর মাও যাবার সময় তোর সঙ্গে বেইমানি করে গেল, কাউকে ছাড়বিনাকো। কোনও শালাকে নয়।

বেইমানি কথাটায় গিন্নি ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন। কালাকাঁদের ঘরের দিকে দু’হাত জোড় করে বেশ জোরেই বলে উঠলেন, “ও কেলো, লক্ষ্মী বাবা আমার! অমন করিসিনি বাপ। আমার ছাদ্দটা করবি তো? বল না করবি তোজ! বড্ড কষ্ট পাচ্ছি বাপ আমার! বিশ্বেস কর, আমি ঘরে চাবি দিতে বলিনিকো... ছাদ্দটা করবি তো...।”

গিন্নির কথা কালাকাঁদ শুনতে পেলেন কি না কে জানে, ময়রাবাড়ির হুলোটা কোথা থেকে হঠাৎ খুব জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। মিউ... মিঁউ। ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে কালাকাঁদ দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হুলোর কান্না কারো কানেই গেল না।



।।এক বছর পর।।



ছেলেদের ঝগড়া চরমে উঠতে কেদার তিরিশ দিনের মাথায় কালীঘাটে গিয়ে গিন্নির শ্রাদ্ধ করে আসে । ছোটবউ চুপি চুপি কেদারকে খরচাপাতি দিয়েছিলেন। গিন্নির ঘরের দরজার কড়ায় বহুকাল যাবৎ তিন তিনটে তালা ঝুলে আছে। তিন ছেলের তিন তালা, চাবি যার যার কাছে। গজানন মিষ্টান্ন ভান্ডার বন্ধ। কয়েক জন কর্মচারী দোকানের সামনে তেরপল খাটিয়ে কচুরি ভাজে। সে কোয়ালিটি আর নেই । উনুনের পেছনে একটা লাল শালুতে লেখা, ‘গজানন কর্মচারী সমিতির আন্দোলোন চলছে, চলবে।’ বাতাবি নেবু গাছটা গেল বর্ষায় পড়ে গেছে। হুলোটাকে কেউ কোনওদিন আর দেখতে পায়নি, খোঁজও করেনি।



[সোর্সঃ সানন্দা, ৩০নভেম্বর, ২০১২]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×