somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে-১

২৩ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৪:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খোকাভাই! তুমি আমার জীবনের এক অবাক বিস্ময়! এক আশ্চর্য্য ভালো লাগা এবং খুব খুব হাহাকার আর এক বুক অতৃপ্তির পরেও প্রিয় এক ভালোবাসার নাম। তুমি আসলে এমনই এক ভালোবাসা যা বাংলাদেশের সকল কিশোরীমনেই চাপা থেকে যায় আজন্মকাল। আসলে আমি কখনই কাউকেই বলে বুঝাতে পারবোনা তুমি আমার কাছে ঠিক কি ছিলে! তুমি আমার কাছে কি ছিলে, কতখানি ছিলে সে শুধু আমিই জানি! তোমাকে আমি যতটা জানতাম তুমিও হয়ত তোমার নিজেকেও ততখানি জানোনি কখনও। যাইহোক এই তোমাকে জানাজানি নিয়ে এত করে যে একদিন ভাববো তাও কখনও ভাবিনি আমি। তোমাকে আমি নিশুতি রাতের অগোচরে নিশ্চুপে ঝরে পড়া বকুলের মত সর্বদা অগোচরেই রেখেছিলাম। তুমি ছিলে আমার একার সম্পত্তি। এক অমূল্য রতন! সবচেয়ে মজার ব্যপারটা হলো এক বাড়ি মানুষের মাঝে থেকেও খুব সযতনে খুব গোপনে তোমার আর আমার সেই ভালোবাসার কাহিনী কখনও কোথাও যেন প্রকাশ না পায় সেই চেষ্টাই করেছি আজীবন। কখনও ভুল করেও কোথাও প্রকাশ করে ফেলতে পারবো স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। যাইহোক মানুষ ভাবে এক আর সময়ের বিবর্তনে হয় আরেক আর মানুষের দেহ বা শরীরের সাথে সাথে বদলায় মনও। সে যতই আমরা অস্বীকার করি না কেনো। মানুষ আসলে এক একজন রুপান্তরিত হৃদয়, রুপান্তরিত মানুষ...... যাইহোক গল্পটা শুরু হোক তাহলে......

সেদিনটার কথা, আমার খুব মনে পড়ে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, দাদুর বিছানার পাশের বড় চেয়ারটায় বসে আছে এক উদাসী বালক। যদিও আমাদের যশোরের বাড়িটা ছিলো একান্নবর্তী পরিবার আর এ বাড়ির মেজো সেজো ত, ন সব মিলিয়ে পাঁচ ছেলে আর তিন মেয়ের তেরো জন ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি দিয়ে সারাবাড়ী গম গম করতো সারাটাক্ষন। তবুও দাদুর ঘরটার আশেপাশে থাকতো এক থমথমে গাম্ভীর্য্যের নীরবতা। দাদু হই হট্টগোল একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাই সকলেরই কড়া নির্দেশ ছিলো দাদু যেন বিরক্ত হয় এমন কিছু না করার।

শুনেছি দাদুর বাবা নাকি জমিদার ছিলেন। ও বাড়ির বসার ঘরটার দেওয়ালে ঝুলানো ছিলো তার শিকারী জীবনের বীরত্বের সাক্ষী মৃত হরিনের মাথা, মৃত পাখির পালকের মধ্যে খড় টড় পুরে অবিকল জীবন্ত কিন্তু নট নড়ন চড়ন পাখি বানিয়ে রাখা আশ্চর্য্য সব আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট। এসবই ছিলো সেই অদেখা বিষম মেজাজী বদরাগী লোকটার শিকারের নানা নিদর্শন এবং সাথে তার কারুকার্য্যময় হাতল বিশিষ্ঠ চাবুক আর তার বাপ দাদার আমলের দুইখানা বিশাল জং ধরা তলোয়ার। ঐ তলোয়ার সিলগালা দিয়ে বন্ধ করা ছিলো। চাইলেই কেউ ইয়াহু করে সেই তলোয়ার খাপ থেকে বের করে এনে লাফ দিয়ে পড়তে পারতো না।

সে যাইহোক দাদুর জন্মের বহু আগেই তার বাবার জমিদারী চলে গিয়েছিলো কিন্তু দাদু কি করে যেন সেই জমিদারী মেজাজ ধরে রেখেছিলেন। সেই সব কথা ভাবলে এখন আমার অবাক লাগে! ঐ বাড়ির মানুষগুলোও তখন কেমন ছিলো ভাবলে আমি শিউরে উঠি মাঝে মাঝে! জমিদারীহীন দাদু সেই আমলের অন্যায়কারী জমিদারদের মত অনেক অন্যায়ই করেছিলেন উনার বংশ গৌরবে বা অকারণ দম্ভে। বিশেষ করে তার সেই সব অকারন অহমিকার বলি ছিলো ঐ বাড়ির কাজের লোকজন আর আমার চাচীমারা এবং স্বয়ং দাদীমা। আমার আজ সেসব কিছু ঘটনাবলী ভাবলে মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমার ফুপু, বাবা এবং চাচাদের মাঝেও আমি দেখেছি সেই অকারণ আত্ম অহমিকার প্রকট প্রকোপ।

যাইহোক বলছিলাম সেদিনের কথা। স্কুল থেকে ফিরে দাদুর ঘরে উঁকি দিতেই দেখলাম এক উস্কোখুস্কো চুলের উদাসী বালক দাদুর খাঁটের মাথার কাছের চেয়ারে বসে আর দাদু সেই অকারণ দম্ভ আর অহমিকার মিশেলে মুখ বানিয়ে উনার বিশাল সাবেকী আমলের পালঙ্কের উপর নতমুখে বসে। পা দুটি নীচে ঝুলানো। দু হাত দু পাশে বিছানার উপর রাখা। ঠিক তার সামনেই মেঝের উপরে বসে ঘোমটা মাথায় একজন দীর্ঘাকায়া মহিলা। উল্টোদিক করে থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। কিন্তু উনার পরণে ছিলো মলিন সাদা শাড়ি। নিচুস্বরে কিছু বলছিলেন তিনি। বোঝা যাচ্ছিলো না।

কিন্তু এক পলকেই আমার বুঝতে বাকী রইলো না যে উনি কে? উনি আমার বড় চাচীমা। যাকে কখনও কোনোদিন জন্মের পর হতে দেখিনি আমি। তবুও আমার সহজাত বুদ্ধিতেই এক নিমিষে চিনে ফেললাম তাকে। পর্দার ফাঁক দিয়ে চুপিসারে দেখছিলাম আমি। দাদু বা চাচীমা কেউ আমাকে না দেখলেও ঐ উদাসী বালক ঠিকই চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।

সেই খোকাভাইকে আমার প্রথম দেখা। যদিও তাদের গল্প অনেক শুনেছি আমি। জন্মের পর থেকেই ও বাড়িতে কানাঘুষোয় কিন্তু বহুল প্রচলিত এবং গোপনে বলা গল্প ছিলো সে আমার বড় চাচার অবাধ্যতার গল্প, পালিয়ে বিয়ে করার গল্প। বড়চাচা দাদুর কড়া অমত সত্তেও প্রেমে পড়েছিলেন দরিদ্র প্রতিবেশি আদালতের সেরেস্তাদারের মেয়ের প্রেমে এবং দাদু রাজী না হওয়ায় রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়েছিলেন ঐ মেয়েকে নিয়ে বহুদূরে অজানায়। তারপর তার খবরও কেউ নেইনি। সেও তার নিজের খবরও কখনও দেয়নি কাউকেই এ বাড়ির। দাদু জেদ করেছিলেন তবে বড় চাচাও তার বাবার মতই সেই জেদ নিজেও রেখেছিলেন। ফেরেননি কখনও কোনোদিন।

তবে ফিরেছিলো তার রক্তের অংকুরিত বীজ আর তার প্রিয়তমা। আমার খোকাভাই, আমার বিধবা চাচীমা। ও বাড়ির কেউ তাদেরকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। এতটুকু সন্মানও করেনি। বড়চাচা ছিলেন দাদুর তাজ্যপুত্র আর তাই তার বংশধর ও ও বাড়ির বড় বৌ ছিলো ও বাড়িতে শুধুই দাদুর দয়ায় আশ্রিত পরাশ্রয়ী পরগাছা। তাদের কোনো দাবী দাওয়া ছিলো না। ও বাড়ির বংশধর হওয়া স্বত্ত্বেও উত্তরাধিকারের অধিকার দেওয়া হয়নি তাদেরকে কখনও।

আর তাই তো মনে হয় খোকাভাই অত অভিমানী ছিলো। হ্যাঁ খোকাভাই কখনও কাউকেই বলেনি তার অভিমানের কথা। কখনও কোনো অভিযোগও করেনি কারো বিরুদ্ধেই তবুও আমি তার শান্ত, গভীর, বড়বড় চোখজোড়াতে দেখেছিলাম এক সমুদ্র কষ্ট আর অভিমান। খোকাভায়ের সেই একটু এলোমেলো চুলের মুখটা আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই আজও আর দেখতে পাই সেই প্রথম দিনের প্রথম দেখার ক্ষনটা। দাদুর খাটের পাশে বসে থাকা,আত্মপ্রত্যয়ী অজানা অচেনা ছেলেটাকে।

যাইহোক আমার চির দাম্ভিক আর হার না মানা দাদু সব কিছু শোনার পর আর ফিরিয়ে দিতে পারেননি সেদিন আমার বড় চাচীমা আর তার একমাত্র ছেলে আমার খোকাভাইকে। তবে এরপরেও তাদের আশ্রয় হলো ও বাড়িতে বড় অবহেলায়। এতগুলো বছর পর বড় চাচীমার প্রত্যাবর্তন তাও আবার এক ছেলে সহ এটা মনে হয় মনে মনে মেনে নিতে পারলো না ও বাড়ির কেউই। শুধু দাদুর নির্দেশে মেনে নিতে বাধ্য হলো। অতো বড় বিশাল বাড়ি তবুও মা ছেলের জন্য কোনো ভালো ঘরের ব্যবস্থা করা হলো না। চাচীকে আশ্রয় নিতে হলো ও বাড়ির বিশাল হেসেলের কাছাকাছি এক অব্যবহৃত ভাঁড়ার ঘরে। ঝেড়ে মুছে সাফ করে সেখানেই উঠলেন চাচীমা।

কিন্তু খোকাভাই? তার তো সেখানেও থাকবার অনুমতি হলো না। খোকাভাইকে থাকতে হলো ছাঁদের ঘরের চিলেকোঠার এক রুমের ছোট্ট একটা এক জানালার ঘরে। ঐ ঘরটায় একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছিলো। সিমেন্ট বালি দিয়ে নতুন ঢালাই এর পর এক অদ্ভুত চাপা গন্ধ। চুপ করে চোখ বুজে থাকলেই কয়েক সেকেন্ডেই সেই গন্ধটা আজও পাই আমি। এক আশ্চর্য্য মাদকতার গন্ধ। আমার কিশোরীকাল, আমার খোকাভায়ের স্মৃতিময় সেই গন্ধে বিভোর হই আমি।

খুব ছোট থেকেই বড় কৌতুহলী ছিলাম আমি। হোক সে বাগানের ঘাসে এক রতি ছোট্ট গুবরে পোকা বা কাঁটাওয়ালা শুয়োপোকা বা বিশাল কালো ভুতুড়ে প্রজাপতির মথ। সব কিছুতেই বড় কৌতুহল ছিলো আমার। আমাদের ঐ বাড়ির বিশাল বাগানে যে কত রকমের গাছ ছিলো। ছেলেবেলা থেকেই আমি তাই পুস্প বিশারদ। সাথে পোকা মাকড় শামুক ঝিনুকও ছিলো আমার কৌতুহলের কারনগুলো। আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে আশ্চর্য্য সুন্দর গাছেদের কথা ভাবি যখন আমি আমার চোখে ভাসে ফুলে ভরা বাবলা গাছের হলুদ সৌন্দর্য্য আর এক বিশেষ ভালোলাগা কুঁচফল এ ছেয়ে থাকা কুঁচ গাছের তলা। শিউলী কুড়ানো ভোর এবং স্থলপদ্মের অন্যরকম পাতলা ফিনফিনে সৌন্দর্য্যের পাপড়িগুলি আমার বুকে আজও বইয়ে দেয় এক অনাবিল চাপা আনন্দ। সে যাই হোক আমার তখন সদ্য কৈশোর পেরুনো বেলা। সব কিছুতেই অকারণ আনন্দে ভেসে যাবার ক্ষন। মায়ের কড়া শাসন আর সারাক্ষন নজরে নজরে রাখার ব্যাপারগুলি মোটেও ভালো লাগতো না আমার। কিন্তু ঐ যে মা থাকতেন ডালে ডালে আর আমি পাতায় পাতায়।

সে যাইহোক আমার তখন সকল কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু খোকাভাই আর আমার বিধবা চাচীমা। মা লুকিয়ে বললেন খবরদার ওদের আশেপাশে যাবিনা। দুনিয়ার হাভাতে সব এত যুগ পরে এসেছে হাড় জ্বালাতে। আর ঐ ছেলে যেন ভুলেও নীচে না আসে। কি না কি আবার চুরি টুরি করে পালায় কে জানে! আমার কৌতুহল তো তখন তুঙ্গে! কারা এরা? চির পরিচিত আমাদের বাড়ির সকল বাসিন্দা থেকে আলাদা করে দেওয়া এই নতুন বাসিন্দারাই তখন আমার গবেষনার বিষয়বস্তু। আমি কারণে অকারণে চাচীমার ঘরে উঁকি দিতাম। কি চাদর পেতে রেখেছে সে, কেমন তার শাড়ি কাপড় আলনা, কেমন তার বাক্স পেটরা এসব আমাকে নতুন কৌতুক আর আনন্দ এনে দিলো জীবনে। সাথে খোকাভায়ের ঘর। কিন্তু ঐ দুই ঘরেই উঁকিঝুকি দেওয়া নিষেধ ছিলো আমার। তবুও আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তাদের আছে! কারোই আছে!

খুব কদিনের মধ্যেই চাচীমা ঐ বাড়ির রাঁধাবাড়ার কাজ সব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। আর তাতে আমার পাঁচ চাচার বউ মানে আমার মা সহ অন্য চাচীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। চাচীমা সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাঁটাখাটনী করে তার ও তার ছেলের ভরন পোষনের মূল্য দিতে শুরু করলেন। কিন্তু সকলের খাবার সময় বা কোনো আনন্দে তাদের ডাকা হত না। চাচীমা থাকতেন রান্নাঘরে আর খোকাভাই যথারীতি তার ছাঁদের ঘরটাতে। খোকাভাই ভীষন চুপচাপ আর একটু যেন একগুয়ে ছিলো। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। কারো সাথে তেমন কথাই বলতো না। তাদের উপরে মনে মনে সকলেই যেমন অসন্তুষ্ট ছিলো খোকাভাইও ঠিক তেমনই। এ বাড়ির আর কারো সাথে কখনও সখ্যতা হয়নি তার। শুধু আমার কাছে খোকাভাই হয়ে উঠেছিলো আমার খেলার সবচেয়ে প্রিয় পুতুলটা।

ঠিক এমনই এক বিকেলে। সেজোচাচার ছোট ছেলেটার এক বছরের জন্মদিন ছিলো সেদিন। বিশাল বড় দুই তলা কেক কাটা হলো সেজোচাচীর ঘরে। আমাদের ঐ মফস্বল শহরের চাইনীজ থেকে আমাদের পরম আরাধ্য ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ফ্রাই আরও কি কি সব আনা হয়েছিলো। সবাই হাপুস হুপুস খাচ্ছিলো। কিন্তু কেউ ডাকলোনা আমার খোকাভাইকে। বড় চাচীমার তো সেখানে থাকার কোনো প্রশ্নই ছিলো না। এমনকি কারোরই মনে পড়লো না একটাবারও যে ছাদের ঘরে একাকী নিরজনে এ বাড়ির সব চেয়ে বড় ছেলেটার একমাত্র পুত্র একাকী অবহেলায় দিন কাটাচ্ছে। এ আয়োজনে তারও কিছু দাবী আছে।

সন্ধ্যার আরও কিছু পরে সকলেই হই হই করে যে যার ঘরে ফিরে গেছে। ছোটরা পড়তে বসেছে। বড়রা গেছে তাস পাশা বা তাদের প্রতিদিনের সান্ধ্য আড্ডায়। আমি চুপি চুপি এক টুকরো কেক আর একটা ছোট কাঁচের বোতলে পেপসি নিয়ে উঠে গেলাম ছাঁদের ঐ ঘরে।
খোকাভাই তখন ঐ রুমের কম পাওয়ারের মিটমিটে একটা মাত্র বাল্বের আলোয় বিছানার উপরে বসে ঝুঁকে পড়ে কি যেন ঠিক করছিলো। সামনে ছড়িয়ে ছিলো ছোট ছোট যন্ত্রাংশ। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেও খেয়াল করলো না একটুও। দেখলাম পুরোনো দেওয়াল ঘড়ি খুলে বোধ হয় ঠিক করার চেষ্টা করছে। এত কাছে দাঁড়িয়ে আমি কিন্তু খোকাভাই মাথা তুলে তাকালোও না। আসলে তার সেই ছাঁদের ঘরের ঐ অবহেলিত আবাসে কেউ তার কাছে কখনও আসতে পারে স্বপ্নেও ভাবেনি হয়ত।

আমার খুব মায়া হলো। কিসের মায়া আর কেনো জানিনা আমি। কিন্তু এখন জানি। এখন আমি সেই মায়ার কারনগুলি হয়ত জানি। সেই ১৪ বছরের এক কিশোরীর মনে ১৬ বছরের এক কিশোরের জন্য কি মায়া জাগে তা জেনেছি আমি আজ এতদিনে। কিন্তু তখন জানতাম না শুধুই এক অকারণ মায়ায় মন ভরে থাকতো। খোকাভাইকে খুশি করার জন্য আমার ছিলো আপ্রাণ চেষ্টা। মনে হত তার জগতে সব আনন্দের আলো নিভে গেছে। আমাকে আবার জ্বালিয়ে দিতে হবে তার সেই নিভে যাওয়া আলোখানি।

জানিনা কি দ্বিধা বা দ্বন্দে ডাকিনি আমি সেদিন খোকাভাইকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম সামনে। বেশ খানিকটা সময় হবে। হঠাৎ বুঝি আমার পায়ের পাতায় নজর পড়লো তার। খোকাভাই মুখ তুলে চাইলো। ভ্রু কুঁচকে উঠলো তার। অস্ফুটে জানতে চাইলো,
-কি?
দিন রাত ২৪ ঘন্টাই বক বক করা রিতীমত বাঁচাল উপাধি পাওয়া আমি হঠাৎ কথা খুঁজে পেলাম না। কিন্তু সামলে নিলাম। বললাম,
-কেক
- কেক! কিসের কেক?
- কেনো জানোনা বুঝি? আজকে আমাদের সেজোচাচার ছেলে রনির জন্মদিন ছিলো।
ধপ করে বসে পড়লাম খোকাভায়ের সামনে। খোকাভাই বললো,
- কি করে জানবো? আমি কি এ বাড়ির কিছু জানি?
একটু বিরক্তি তার কন্ঠে।
- কেনো তুমি কি এ বাড়ির কেউ না?
- না আমি এ বাড়ির কেউ না।
গম্ভীর এবং বিষন্ন গলায় বললো খোকাভাই। আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। আমি বললাম,
- ঠিক আছে কেক খাও।
- না
- না!!!
বিস্মিত হলাম আমি!
- কেনো তুমি কেক খাওনা ?
- খাই। কিন্তু খাবো না।
-কেনো! ( এক রাশ বিস্ময়ে জানতে চাইলাম আমি) খোকাভাই কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর বললো,
- ঘেন্না লাগে। ( ক্রোধ আর ঘৃনা ঝরে পড়লো খোকাভায়ের চোখে। আমার ভয় লাগছিলো। তবুও অনুনয় করলাম। বললাম,
- আমি এনেছি। আজকে খাও।
খোকাভাই হেসে ফেললো। আমি মুগ্ধ হলাম। হাসলে কি সুন্দর লাগে তাকে। বললাম,
- হাসলে তোমাকে অনেক ভালো লাগে। সারাক্ষন মুখ গোমড়া করে থাকো কেনো?
খোকাভাই অবাক হলো। সাথে সাথে গম্ভীর হয়ে গেলো আবারও।
- সারাক্ষম মুখ গোমড়া করে থাকি! তুমি জানো কেমনে!
- আমি তো সারাক্ষনই তোমাকে নজরে রাখি খোকাভাই। তুমি জানোনা।
খোকাভাই আবারও হেসে ফেললো। বললো,
- তাই! আমাকে নজরে রাখার কি? আমাকে লুকিয়েই বা দেখার কি হলো? আশ্চর্য্য তো!
- এমনি! আমার ভালো লাগে তাই?
অবাক হলো খোকাভাই!
- ভালো লাগে! আমাকে দেখতে!
চিন্তায় পড়লো বুঝি সে.....
আমি লজ্জায় চুপ হয়ে রইলাম। দুষ্টুমি করে নিজের চোখ ঢেকে রাখলাম ওড়না পেঁচিয়ে লম্বা দড়ি করে। খোকাভাই জোর করে সেই দড়ি পাকানো ওড়না ধরা আমার দুই হাত নামিয়ে দিয়ে বললো,
- আর লজ্জা পেতে হবে না।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
-সত্যি!
খোকাভাই বললো
-হুম! আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাও লাগবেনা আমাকে........

এমন সময় নীচে থেকে ভেসে এলো মায়ের গলা-
- নীরু!!!!!!!!!!!!!!! ঐ নীরা!!!!! কোথায় তুই!!!!!!!!!!!!!!!
আমি চমকে উঠে এক দৌড়ে পড়িমড়ি করে সিড়ি ভেঙ্গে নীচে চলে এলাম এক্কেবারে সোজা আমার দাদীমার ঘরে। ছোট থেকেই মায়ের হাত থেকে মার বকা সব কিছু খাওয়ার থেকে বাঁচার নিরাপদ স্থানে। তারপর সেখান থেকে চেঁচিয়ে বললাম,
এই তো এখানে মা!! আসছি!!!!!!!!!!!!!!!!!

কিন্তু দাদীমা তখন ঝিমাচ্ছিলো তার সান্ধ্যকালীন অবসরে। আমার চিল চিৎকারে দাদীমার সন্ধ্যার ঝিমানী ছুটে গেলো। রাগ করে বললেন,
- ঐ ছুটকী এমন গাক গাক করে চিল্লাছিস কেনো এখানে এসে!!!
আমি দাদীমার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম।
- এমনি এমনি আনন্দে!!!!!!!!!!
দাদীমা বললো,
- ঢং দেখে বাঁচিনা! যা পড়তে বস......... :P


চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২২
৫২টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×