somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে- ১৩

১৮ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এই বাড়ির সালিশ দরবার বিচার আচার যে কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান মানে কোনো কিছুতেই কখনও আমি বড়চাচীকে সামিল হতে দেখিনি। যেমনই খোকাভাই এ বাড়ির বড় ছেলের একমাত্র সন্তান হয়েও কখনও কোনো দাবী খাঁটাতে আসেনি তেমনই চাচীমাও কখনও এ বাড়ির কোনো কিছুতেই অংশ নিতে আসেনি। কিন্তু আজ উনি কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন। তারপর আমাকে পেছনে ঠেলে মায়ের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন। বললেন, ওকে মাফ করে দাও। ছোট মানুষ ভুল করেছে, আমি ওকে বোঝাচ্ছি তুমি শান্ত হও দয়া করে। আর মেরো না। আমি হাত জোড় করছি.....

মা মনে হয় অবাক হলেন তবুও কেনো যেন থেমে গেলেন। মায়ের এ হেন আচরনে দাদীমা ভীষন ক্ষুব্ধ হলেন। এই চিৎকার চেচামেচি মায়ের অমন রণরঙ্গিনী মূরতি এসব দেখে ভীষন রাগে তিনি মাকেই তিরষ্কার করতে শুরু করলেন।
- বৌমা তোমাার সাহস হয় কি করে অতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলার?
মা বারান্দার সিড়ির উপরে বসে হাপাচ্ছিলেন। ঐ ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠে মারধোর আর হঠাৎ নিজের অমন আচরনে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বোধ হয়। দাদীমা তিরষ্কার করেই চললেন। বড় চাচীকে ডেকে বলে দিলেন আজ থেকে নীরু তার সাথেই থাকবে মা যেন তাকে একটাও কথা না বলতে আসেন। বড়চাচীমা তার ঘরে নিয়ে গেলেন আমাকে, আঁচল দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, বাবা মায়ের কথা শুনতে হয়। তারা সন্তানের সবচাইতে ভালোটুকু চান। তুমি জেদ করো না, মন খারাপও করো না। মা যা বলেন তাই শোনো। আজ হয়ত আমার কথা তোমার পছন্দ হবে না তবে একদিন বুঝবে কেনো আমি এই কথা বলেছিলাম। আমি ফোপাচ্ছিলাম, চাচীমা আমার মাথায় চুমু খেয়ে আমার হাত ধরে দাদীমার ঘরে নিয়ে এলেন। আমার ঐ সাত সকালেই ভীষন ক্লান্ত লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি হেরে যাচ্ছি....... ডুবে যাচ্ছি অতলে....আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছিলো....
- দাদীমার জন্য ঘরেই খাবার দেওয়া হয়েছিলো। চাক চাক করে চকচকে সবুজ কাকরোল ভাঁজি আর কাঁচা আটায় বানানো বড় বড় দুখানা রুটি। দাদীমা আমাকে ডাকলেন,
- আয় আমার সঙ্গে খাবি।
আমি কিছু না বলে তার কাছে বসলাম। দাদীমা বড় করে এক টুকরো রুটি ছিড়ে কাকরোল ভাঁজি দিয়ে মুড়িয়ে আমার মুখে দিলেন। কাকরোল ভাঁজির পাশেই ছিলো আরও দুটি ছোট ছোট বাটি। নারকেল দুধে রান্না করা পাখির মাংস আর আরেকটা বাটিতে ছোলার ডালের ডালনা। আমি রুটি দিয়ে ঐ পাখির মাংস আর ছোলাডাল খেয়েছি বটে তবে ঐ সবুজ চকচকে একদম না ভেঙ্গে যাওয়া ঐ অপূর্ব স্বাদের ভাজি আমার জীবনে আর কোনোদিনও এর আগে বা পরেও আর খাইনি।

আমি দাদীমার ঘরেই রয়ে গেলাম। তবে ঐ সব পাত্রী দেখার মেহমানদের আপ্যায়নের সকল তোড়জোড় দাদীমার ঘর থেকেই চলতে লাগলো। সন্ধ্যায় ছোটচাচী বসলেন ফর্দ করতে। মেহমানদেরকে কি কি খাওয়ানো হবে? সেজোচাচা আসলেন দাদীমাকে জানাতে উনাদেরকে কোথায় বসানো হবে। কি কি আয়োজন হবে। পাত্রী দেখানো হবে নাকি আনুষ্ঠানিক ভাবে নাকি যেন হঠাৎ বাড়িতে বেড়াতে আসা মেহমানদের সাথেই ছেলেমেয়েদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে এমন একটা ভাব। এ সকল জল্পনা কল্পনা চলতেই লাগলো বাকী ৫টা দিন ধরে।

দাদু যতই বললেন মেয়ে বিয়ে দেবো কি দেবোনা পরের ব্যপার কিন্তু উনাদের আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না হয় এইদিকেই শুধু খেয়াল রাখতে কিন্তু ওইদিকে মেয়ে দেখানোর সকল বন্দোবস্তই আমার চাচীরা এবং মা দাদীমারা শুরু করলেন তলে তলে। কোন শাড়ি পরানো হবে, কোন গয়না, কেমনে দেখানো হবে যেন কোনোভাবেই আমাদের বাড়ির সন্মান না যায়। আমি নীরব রইলাম। কোনোভাবেই নিজেকে সান্তনা দিতে পারছিলাম না যে এই বিয়ে আসলেও বন্ধ হবে। সকলের আচার আচরণ ও সকল তোড়জোড়ে বুঝাই যাচ্ছিলো তারা প্রস্তুত।

দাদীমার ঘরে থাকায় খোকাভায়ের সাথে যোগাযোগ আরও কমে এলো। একমাত্র উপায় দাদীমার গভীর ঘুমের ঘোর আর রাতের আঁধার। আর সেটাই করলাম আমি। খুব চুপিসারে এর মাঝেই উঠে এলাম ছাদের ঘরে। রাত তখন মনে হয় দুটো পেরিয়েছে। চারিদিক শুনশান। সিড়ির গোড়ায় টিমটিম করে এক বাল্ব জ্বলছিলো। আমি পা টিপে উঠে এলাম ছাদে। নিশুথী রাতের এক ঝলক হিমেল হাওয়া। সেদিন মনে হয় পূর্নিমা ছিলো আকাশ ভেঙ্গে চাঁদের আলো পুরো ছাঁদ ছেয়ে ছিলো। আমি খোকাভায়ের ঘরে না গিয়ে সেই নিশুথী রাতের হিমেল হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলাম। ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছিলো। ভেসে আসছিলো হাসনা হেনার মাতাল গন্ধ। আমার মনের গুমোট আর আর এতক্ষন দাদীমার ঘরের ঐ মশারীর ভেতরের গুমোট মিলে আমি গুমরে মরছিলাম হয়ত আর তাই ঐ নিশুথী রাতের এক ঝলক খোলা হাওয়া আমার প্রাণ জুড়িয়ে দিলো।

ছাদের উপর উঠে থাকা ঝুপসী নিমের গাছের পাতাগুলো ভূতের মত দোল খাচ্ছিলো সেই বাতাসে। আকাশে ভাসছিলো হলুদ রং পূর্নিমা চাঁদের আলোয় আশ্চর্য্য আলোময় রঙ্গের মেঘগুলো। নারকেল গাছের পাতারা যে রাতের শুনশান নীরবতায় বাতাসে অমন ঝিরিঝিরি সূরের মূর্ছনা তোলে তা আমি আগে দেখলেও সেদিন বোধ হয় নতুন করে জানা হলো। আমি ছাঁদে এসেছিলাম লুকিয়ে খোকাভায়ের সাথে দেখা করতে কিন্তু কয়েকদিন ধরে আমার বদ্ধ মনের সকল আবদ্ধতা হঠাৎ ঐ নিশুথ রাতের হিমেল হাওয়া এক নিমিষে কাটিয়ে দিলো। কয়েক মুহুর্ত বা মিনিট কয়েক আমি মনে হয় আনমনা ছিলাম অথবা আমার মনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐ ঝড়ে বিপর্যস্ত আমি
হঠাৎ কিছুক্ষনের জন্য শূন্য হয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ খোকাভাই পিছে এসে দাঁড়ালো, খুব আস্তে ডাক দিলো,
-নীরু
আমি চমকে তাকালাম। অবাক হলাম!
- খোকাভাই তুমি ঘুমাওনি!
- সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি। তুই কি একটাবারও আসার সময় পাস না?
ঐ চাঁদনী রাতের ঝকঝকে আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম খোকাভায়ের চোখের নীচে কালী। আমি ফুপিয়ে উঠলাম।
-খোকাভাই তুমি কি ঘুমাওও না!
খোকাভাই আমাকে জড়িয়ে রাখলো। কতটা সময় মনে নেই আমার।
আমরা গিয়ে বসলাম নীচু পানির ট্যাংকটার উপরেই। আমি বললাম,
-খোকাভাই ! আমাকে ওরা বিয়ে দিয়ে দেবে। তুমি দেখো। ওদের সকল পরিকল্পনাই আসলে শেষ। এখন শুধু অপেক্ষা....
খোকাভাই নিরুত্তর রইলো। আমি উতলা হয়ে বললাম,
-কথা বলছো না কেনো?
খোকাভাই বললো, কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না নীরু।
- যদি আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তোমার কষ্ট হবে না খোকাভাই?
খোকাভাই তবুও নিরুত্তর রইলো। তারপর বললো,
- নাহ।
আমি খুব অবাক হলাম! এক বুক বিস্ময় নিয়ে আবারও প্রশ্ন করলাম,
-নাহ!!
খোকাভাই হাসলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
- আমার আর কোনো কিছুতে কষ্ট হয় না নীরু।
সেই দীর্ঘশ্বাস আর সেই কথাতে কি ছিলো জানিনা কিন্তু আমার বুকটা ফেটে গেলো। কারণ আমি জানি, আমি বুঝতে পারি খোকাভায়ের কষ্টটা। আমি জানি কতটা কষ্ট সহ্য করতে করতে সকল কষ্টই একদিন ভোঁতা হয়ে যায়। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম খোকাভায়ের বুকে। খোকাভাই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে বসে রইলো। তারপর বললো,
- ভেবেছিলাম তুই কখনও আমাকে ছেড়ে যাবি না। কেনো যে এমন বোকার মত ভেবেছিলাম জানিনা। আসলে বাস্তব বা কঠিন সত্যটা জানা সত্ত্বেও আমি নিজেই জানতে চাইনি। নিজের মনের কাছে নিজেকে লুকিয়েছি। তোকে ছাড়া আসলে এখন আর কিছুই ভাবতে পারি না আমি। আমার কেউ ছিলো না শুধু তুই ছিলি। এই পুরো পৃথিবীতেই আমি একলা ছিলাম। তুই এসে জোর করে ঢুকে পড়েছিলি আমার পৃথিবীতে। এখন আমার পৃথিবীটাই তুই। তোকে ছাড়া আমার কষ্ট হবে না। তোকে ছাড়া আমার পৃথিবীটাই মরে যাবে। তুই হয়ত একটা সময় আমাকে ভুলে যাবি।আমি পাষানের মত সব সয়ে যাবো। আমি আরও বেশি জড়িয়ে ধরলাম খোকাভাইকে। তারপর বললাম,
- আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না খোকাভাই। চলো পালিয়ে যাই আমরা?
- কোথায় যাবো?
- যে কোনো কোথাও। প্রদীপদের বাড়ি বা অনেক দূরে। যেখানে কেউ আমাদেরকে চিনতে পারবেনা। জানতেও পারবেনা। সত্যিই চলো খোকাভাই। যাবে বলো? বলো না? আমি একের পর এক প্রশ্নে আর জোরাজুরিতে খোকাভাইকে বিপর্যস্ত করে তুললাম। খোকাভাই বললো,
- আচ্ছা দেখি কি করা যায়?
আমি কিছুটা আশস্ত হলাম খোকাভায়ের কথায়।
তারপর অনেকক্ষন বসে রইলাম আমরা। আজান পড়ার কিছু আগে সকলের অগোচরে ফিরে এলাম নীচে এক বুক আশা নিয়ে।

কিন্তু পরদিন থেকে ফের খোকাভাই নিরুদিষ্ট হয়ে গেলো। কেউ সেটা খেয়ালও করলো না। এমনকি চাচীমাও না। আমি খুব অবাক হলাম! প্রথম যেদিন ফিরলো না সেদিন রাতে আমি আশা করেছিলাম বড় চাচীমা নিশ্চয় দাদীমাকে কিছু বলবেন। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য্য করে দিয়ে চাচীমা কিছুই বললেন না। খোকাভাই ফিরলো না। সেদিনও না, তারপর দিনও না, তার পরের দিনও না। খোকাভায়ের কি হলো এ বাড়ির কারো তাতে মাথা ব্যাথা নেই। এমন কি তার মায়েরও নেই। শুধু আমার এই দুই চোখ তাকে খুঁজে ফিরছিলো। তার পদশব্দ শোনার জন্য দুই কান উদগ্রীব ছিলো। কিন্তু খোকাভাই নামের এত বড় ছেলেটা বাড়ি থেকে সম্পূর্ণরূপে উধাও হয়ে গেলো তবুও কারো কোনো চিন্তাই রইলো না।

ডিসি সাহেবের ফ্যামিলী আসবেন এবং সেই আপ্যায়নে সম্পূর্ণ হলো সকল আয়োজন। শুধু হাতী আর ঘোড়া আর ব্যান্ড পার্টিটা আনাই বুঝি বাকী ছিলো। যাইহোক এই কদিন দাদীমা আমাকে হলুদ চন্দন সর, মাখন আরও আরও কি কি সব সারা গায়ে লাগিয়েছেন। হরতকী আমলা ভিজিয়ে সেই পানি দিয়ে চুল ধুইয়েছেন। আমি আর কিছু বলিনি। কি বলবো! আর কাকেই বা বলবো! খোকাভাইই হারিয়ে গেছে। আর কার কাছে যাবো আমি!

যদিও সেদিন ছোটচাচীর কথায় প্রতিবাদ করেছিলাম আর তাতেই মা আমাকে অত মারধোর করেছিলো সেই আমিই স্বেচ্ছায় সব মেনে নিলাম। এই আমি আর বাগানে যাই না, ছাঁদেও ঊঠি না এমনকি উঠোনেও না। দাদীর ঘর আর বারান্দা এই টুকুই আমার হাঁটা চলার স্থান হয়ে পড়ে। দাদী নিজেই আমার চুল, ত্বক, দাঁত এমনকি চোখের সৌন্দর্য্য বর্ধনেও উদ্যোগী হয়ে উঠলেন। আলু শসা কেটে কেটে চোখের উপর দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেন রোজ দুপুরে। দাঁত যেন সাদা ধবধবে দেখায় তাই দিনে তিনবার নিমপাতা, কাঁচা হলুদ আরও কি যেন দিয়ে কুলি করায়। আমি সব কথা শুনি। দিনে দিনে আমি ঐ ডিসি সাহেবের বৌ এর কাছে পাত্রী দেখাবার জন্য যোগ্য হয়ে উঠি।

আমি আর কোথাও যাই না। কথাও কম কম বলি। সবাই ভাবে মা ওদিন অমন করে মারধোর করাতেই আমি অভিমান করেছি। কথা বলি না। চাচীরা আমাকে বুঝায় মা যা করেন ভালোর জন্যই করেন আমি যেন মন খারাপ না করে থাকি। আমি যেন হাসিখুশি থাকি। আমি কিছুই বলি না। হাসিও না এবং কাঁদিও না। আমি পাষান হয়ে যাই খোকাভাই বলেছিলো পাষান হয়ে সে সব সয়ে যাবে। আমিও খোকাভায়ের মত পাষান হয়ে যাই। সেই পাষানে লিখে রাখি কোনো এক নীরুর জীবনের ইতিহাসগুলি....

এদিকে এসে গেলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন। যথারিতী রোববার চলে এলো। সে ছিলো এক শীতের বিকেল। বিকেলের সেই সোনারোদে এই কদিনের নিরন্তন পরিচর্যায় পুরো বাড়ি ঝলমল করছিলো। ডিসি সাহেবের পরিবারের আগমন উপলক্ষে প্রতিটা কানি ঘুঁচিও ঝকঝকে তকতকে করে তোলা হয়েছিলো। আলমারী থেকে বের হয়েছিলো ঝা চকচকে সোনার মত ঝিলিক দেওয়া কাসা পেতলের ডিনার সেট। পুরো বাড়ি এক অজানা গুরু গম্ভীর ভাব নিয়ে কেতা দূরস্ত হয়ে অপেক্ষা করছিলো উনাদের আগমনের। কালীগঞ্জ থেকে আনানো হয়েছিলো বিখ্যাত বিরিয়ানী পাচক আলাউদ্দিনকে।

যাইহোক গোলাপী রং কাতান শাড়ি আর দাদীমার সিন্দুক থেকে বের করা চওড়া বিছাহার আর কান পাশা পরিয়ে দেওয়া হলো আমাকে। ছোটচাচী তার বিখ্যাত খোঁপা বেঁধে দিলেন আমার চুলে। বাড়ির আর সব ছেলেপুলেরা উঁকিঝুকি মারছিলো এই তামাশা দেখবার জন্য কিন্তু তাদেরকে কড়া শাসনে চোখ রাঙ্গিয়ে এই মহান কার্য্য দর্শন থেকে দূরে রাখা হলো।

সেই বিকেলে কনে দেখা আলোয় বিয়ে দেবে কি দেবেনা এই নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ভোগা দাদুও আমাকে ওদের সামনে নিয়ে যেতে একেবারেই কুন্ঠিত বোধ করেন না। তাদের কাছে ডিসি সাহেব নিজেই যেমন সন্মানীয় লোক ঠিক তেমনই পাত্রও বিদেশ ঘোরা বড় ডাক্তার। পাত্রের বাবাও বাংলাদেশের একজন গন্যমান্য ব্যক্তি। আর ডিসি সাহেবের মোটা সোটা বিশাল লম্বা বউটা আমার হাত ধরে হাসি হাসি মুখে বসে থাকলো। মূলত সেই আমাকে পছন্দ করেছিলো কোথাও কখনও দেখে। আমি কারো দিকেই তাকাই না। মা বলে দিয়েছিলো আমার বেশরমের মত ড্যাব ড্যাব করে সবার দিকে তাকায় থাকবি না। হাসবিও না। এইখানে হাসা বারণ। আমি আমার স্বভাবসুলভ আচরনে বলতে চাচ্ছিলাম তাইলে কি কাঁদবো? কিন্তু জিগাসা করিনি আমি। আমি নিজেই ঠিক করে নিলাম আজ থেকে হাসি কান্না ব্যথা বেদনা অভিমান সব বিসর্জন দিলাম আমি।

পাত্র ও পাত্রের মা দুজনই যে আসবেন এই সম্পর্কে আমার বাড়ির লোকজন ঠিক অবগত ছিলো না। কিন্তু ডিসি সাহেবের বৌ এর সাথে সাথে ডিসি সাহেব স্বয়ং এলেন, সাথে পাত্র, পাত্রের মা ও একজন বন্ধুও এলেন। পাত্র এসেছে নাকি সে দেখতে কেমন ,কানা না খোড়া কিছুই দেখলাম না আমি। মা আর চাচীদের কথা মোতাবেক চোখ নামিয়েই বসে রইলাম। ডিসি সাহেবের বউ তার বড় ননাস অর্থাৎ পাত্রের মাকে বললেন, কি মেজু দেখলে তো মেয়ে দেখতে এক্কেবারে যেন একটা পুতুল! পাত্রের মা কোনো কথা বললো না। আমি এক ঝলক চোখের আড়ালে দেখলাম তাকে। শুকনা চিকন চাকন জলপাই রং কাতান শাড়ি পরনে। কপাল কুচকে রয়েছেন যেন বিরক্তিতে। পাত্র দেখা হলো না আমার আসলে ইচ্ছেই করলো না। পাত্রের মা ব্যাগ থেকে বের করে এক ছড়া সাদা পাথর সেটিং নেকলেস গলায় পরিয়ে দিলেন। সেটা নাকি আমেরিকান ডায়ামন্ড। সত্যিকারের রিয়েল ডায়ামন্ড না দিয়ে আমেরিকান ডায়ামন্ডের সেট দিলো কেনো সে প্রশ্ন আমার মাথায় তখন আসেনি।


যাইহোক তাদের জন্য নানা রকম খানা পিনা মন্ডা মেঠায়ের আয়োজন ছিলো। বাড়ির সকলেই তাদেরকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আমি দাদীমার ঘরে প্রায় একাকীই বসে ছিলাম। হঠাৎ আমাদের বাড়ির বিবিসি সিএনএন রুমা এসে আমার কানে ফিসফিস করে বললো নীরুপা জানিস খোকাভাই নাকি খুব খারাপ সঙ্গে পড়েছে। আমি চমকে উঠলাম! খারাপ সঙ্গে পড়েছে মানে! খারাপ সঙ্গ মানে কি? রুমা আরও ফিস ফিস করে বললো,
- কেনো জানিস না? ইশ নেকী! খোকাভাই যে অনেকদিন হলো বাড়িতে ফেরে না জানিস না তুই?
আমি মনে মনে ভাবলাম তাইলে কেউ এই বাড়িতে খোকাভায়ের খবর রাখে! কই কখনও দেখিনি তো। উপরে বললাম,
- না জানিনা। আমি এখন শুধু আমার নিজের খবর জানি।
রুমা হি হি করে হাসতে লাগলো। হ্যাঁ তা তো জানবিই। এখন তো তুমি নবাব নন্দিনী।রাণী সাহেবান, শাড়ি পাবেন বাড়ি পাবেন গাড়ি পাবেন। কত গয়নাগাটি পরে বউ সাজবেন। এ্যই এই হার কি দাদীমা তোকে দিয়ে দিয়েছে!
আমার এমন রাগ লাগছিলো। কোথায় খোকাভায়ের খবর বলতে এসে শাড়ি গয়নার হিসাব শুরু করেছে কুটনীটা। আমি বললাম,
- খোকাভায়ের কি হয়েছে বলছিলি?
রুনি মুখ বেঁকিয়ে বললো,
- কি আর হবে! তার বাবাও যেমন ছেলেও তো তেমনই হবে। মা বলেছে তার বাবাও নাকি খুব অবাধ্য ছিলো তাই তো কিনা দাদু তাকে তাজ্য করলো।
আমি অধৈর্য্য হয়ে উঠলাম। ওকে ধমক লাগালাম।
- এত মাতবরী করা লাগবে না। খোকাভাই কি করেছে বল।
রুনি যা বললো তা শুনে আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো। রুমি বললো,
- কাল রাতে নাকি কলেজপাড়ায় কিছু নেশা করা ছেলেদেরকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। আমাদের গুনধর খোকাভাই তাদের মধ্যে রয়েছেন। আজ সকালে থানা থেকে ফোন দিয়েছিলো। এত ঝামেলা থাকায় কেউ তাকে আজ বের করে আনতে যায়নি। কাল সকালে সেজোচাচা যাবেন। এর আগেও যখন খোকাভাই নিরুদিষ্ট ছিলো কিছুদিন তখনই নাকি তাকে ঐ নেশাখোর সঙ্গ থেকেই ধরে আনা হয়েছিলো।

আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। খোকাভাই এটা কি করলো! কেনো করলো! তার কিসের এত দুঃখ! কিসের এত অভিমান! তবুও আশা জেগে রইলো কালও যদি সে ফিরে আসে তবুও রক্ষা। যেভাবেই হোক খোকাভাইকে নিয়ে আমি চলে যাবো এ বাড়ি ছেড়ে। অনেক অনেক দূরে। যেই আমাদেরকে আর কেউ কখনও কোথাও খুঁজে পাবে না, কোথাও ধরতে পারবে না সেই তত দূরেই চলে যাবো আমরা। খোকাভাইকে আর কোনো দুঃখ পেতে দেবোনা...... অনেক কষ্ট পেয়েছে সে তার এই এতটুকুন জীবনে। আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো না আমি তাকে.....

আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ৮:২৭
৫০টি মন্তব্য ৫৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

পঁচে যাওয়া বাংলাদেশ আর্মি

লিখেছেন রিয়াজ হান্নান, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:২৫


একটা দেশের আর্মিদের বলা হয় দেশ রক্ষা কবজ,গোটা দেশের অব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বহিরাগত দুশমনদের আতংকের নাম। ছোটবেলা থেকে এই ধারণা নিয়ে কয়েকটা জেনারেশন বড় হয়ে উঠলেও সেই জেনারেশনের কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×