somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুঃখ পরী ( ছোট গল্প)

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজ বাসায় ফিরতে ফিরতে বৃষ্টির বেশ রাত হয়ে গেল। আজ অফিসে রাত ৮টা ৩০ পর্যন্ত থাকতে হয়েছে। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে বৃষ্টির। কারন গলির মানুষগুলো যেন কিভাবে তাকায়। খুব খারাপ লাগে ওর কাছে। মেয়ে মানুষ একটু রাত করে ফিরলেই এলাকার মানুষগুলো খারাপ নজরে দেখে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির মরে যেতে ইচ্ছে করে। এই জীবনটা আর ভালো লাগেনা। অন্য দশজন মানুষের মতো ওর জীবনটাও হতে পারত কিন্তু কেন তা হলনা?

বৃষ্টি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। ডিগ্রি পড়ছে বৃষ্টি। এক ভাই আর তিন বোন ওরা। ভাইটা নেশাগ্রস্ত আর ছোট বোন দুটো স্কুলে পড়ে । ওর বাবা কিছু করেনা। ব্যবসার জন্য শুধু মানুষের কাছ থেকে টাকা আনে। আর বৃষ্টি কে চাপ প্রয়োগ করে ওর বন্ধু, পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে টাকে টাকা এনে দিতে।

বৃষ্টিদের অবস্থা এমন ছিল না। খুব আভিজাত্য ছিল তাদের। খুব ভালো ব্যবসা করতেন মঈন সাহেব মানে বৃষ্টির বাবা। অনেক ভালো ভাবে জীবন চলছিল ওদের। কিন্তু বৃষ্টির ভাই বখাটে হয়ে যাওয়াতে একের পর এক ব্যবসায় লস হতে থাকে। ছেলের কেস চালাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে যায়। আর বৃষ্টির ভাই সবুজ টাকা চুরি করে নিত। এভাবেই ওদের পরিবারে ধস নেমে আসে। মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করতে করতে মইন সাহেবের খারাপ অভ্যাস হয়ে গেছে। মেয়ের বন্ধু-বান্ধব এর কাছ থেকেও টাকা চেয়ে আনত। কিন্তু দেয়ার কোন সামর্থ ছিল না। সবাইকে আজ দিবে কাল দিবে বলে বলে ঘুরাতো।

বৃষ্টির মনে পড়ে মাসে প্রায় প্রতি মাসে একসাথে ৭/৮টা করে ড্রেস কিনে দিত বাবা। আর আজ একটা ড্রেস বানাতে অনেক কষ্ট হয়। মনে পড়ে ভাই বোনরা মিলে কত মজা করত। আর এখন শুধু ভাইয়ের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকে। কারন সবুজ কথা শুনে না। প্রায় প্রতিদিন বিচার আসে ওর নামে। বিচার শুনতে শুনতে ক্লান্ত এখন ওরা। মাঝে মাঝে রাগের মাথায় বলে আল্লাহ তুমি আমার ভাইকে তুলে নাও। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।

মইন সাহেব তার পরিচিত মানুষদের কাছে বৃষ্টি কে পাঠাতো টাকা আনতে। আর বৃষ্টিকে সইতে হত অসহনীয় মানুষের লোলুপ চাহনি। বৃষ্টি দেখতে মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর। ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ তার, স্লিম ফিগার। এক নজরেই ছেলেরা ওর প্রেমে পরে যাবে এমন। বৃষ্টির মা আদর করে ওকে পরী বলে। আর বৃষ্টি মায়ের কথা শুনে বলে - হ্যাঁ মা আমি তোমার দুঃখ পরী।

সেদিন ওর বাবার পরিচিত একজনের কাছে গেল টাকা আনতে। যদিও বৃষ্টি যেতে চায়নি। কিন্তু বাবার অত্যাধিক খারাপ ব্যবহারে বাধ্য হয়ে টাকা আনতে গেল। বাবুল সাহেব বেশ ধনী মানুষ। বৃষ্টি তার অফিসে গেল। তার রুমে প্রবেশ করল। দেখল দামী সোফা , দামী কার্পেট বেশ গোছানো একটা রুম। সোফায় বসল ও। টাকা চাইতে খুব লজ্জা লাগছিল বৃষ্টির। কথার এক পর্যায়ে টাকা চাইল।

লোকটা বৃষ্টির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল। মনে হয় ওকে গিলে ফেলবে তখনি।
লোকটা বলছিল তোমার মত মেয়ের টাকার অভাব হয় নাকি?
-মানে আঙ্কেল? বুঝলাম না।
ভালো করে বুঝে দেখ।
-মানে?
-তোমার মত এতো সুন্দর মেয়ের টাকার অভাব হয়?-কত টাকা চাও বল? শুধু রাতে পুষিয়ে দিও। যা লাগবে তাই পাবে।
-বৃষ্টির আর বুঝতে বাকি থাকেনা উনি কি বুঝাতে চাইছেন? লজ্জা ,ঘৃণায় বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে এক দৌড়ে চলে আসে।

বাসায় এসে বৃষ্টি এতো কাঁদতে থাকে ওর মা জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে? বৃষ্টি কি বলবে শুধু মাকে বলে মা আমিতো তোমর দুঃখ পরী তাই কাঁদি। এইদিন দেখার জন্য কি জন্মেছি আমি? বৃষ্টির মা শুধু মেয়েকে ধরে কাঁদে।

সেদিন এক্সিডেন্টে মঈন সাহেব মারা যান। বৃষ্টিদের অভাবের সংসারে আরো দুঃখের কালো ছায়া নেমে আসে। বৃষ্টি কেমন যেন শোকে পাথর হয়ে যায়। একদম নিশ্চুপ থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে ও আত্মহত্যা করবে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় ছোট ছোট বোন আর মা কে কার কাছে রেখে যাবে? জীবনের সাথেই যুদ্ধ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধীরে ধীরে বৃষ্টি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।

রাতে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন মানুষগুলো ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। বৃষ্টি শুধু ভাবে যা ইচ্ছে ভাবুক মানুষজন, কি আসে যায়? আমি না খেয়ে থাকলেতো কেউ এসে আমাকে খাবার দিবে না? আর আমিতো কোন পাপ করছিনা চাকুরী করছি। বাসা থেকে অফিস দূরে হওয়াতে আসতে দেরি হয়। এতে কে কি ভাবল তা মনের মধ্যে আমলে নিলে চলবে না। আমাকে পথ চলতে হবে। হে বিধাতা শক্তি দাও আমাকে।

গরিব হয়ে যাওয়াতে আজকাল মানুষের আসল চেহেরা দেখা যায়। শুধু কি তাই এখনতো ওর বাবাও নেই। যারা কথা বলতে আগে সাহস পেত না, আজকাল তারা বাজে প্রস্তাব দেয়। আর বৃষ্টি খুব অবাক হয় যে, এই মানুষগুলো ভদ্র মুখোশ পরে থাকে। এদের পরিবার যদি জানত এদের মুখে থু থু ফেলত।

এ সমাজের পুরুষ জাতটার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে বৃষ্টির। আজকাল বৃষ্টির কিছু বন্ধুরাও বাজে প্রস্তাব দেয়। কারন ওর অবস্থান আগের মত নেই। ওরা ভাবে অভাবে পরলেতো মানুষের স্বভাবও খারাপ হয়ে যায়। আর এমন দেখতে সুন্দর আকর্ষণীয় মেয়ে হাত ছাড়া করা যাবেনা। বৃষ্টি অনেক কষ্টে মানুষের এসব কু-নজর সহ্য করে জীবন পার করছে।

চোখের জল এখন তার নিত্য সঙ্গী। কত স্বপ্ন ছিল ওর ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখের নীড় গড়বে। কিন্তু সেই আশাও পূরণ হবার নয় এখন। বৃষ্টিদের অবস্থা যখন খারাপ হল তখন বৃষ্টির সাথে বিয়ের কথা ছিল যে ছেলেটির সেই মুহূর্তে টাকা দাবি করল। আসলে সে বৃষ্টির বাবার টাকা কে ভালবেসেছিল বৃষ্টিকে নয়। সে বিয়ে ভেঙ্গে গেল। আসলে টাকাই সব । ভালোবাসার কোন মূল্য নেই মানুষের কাছে। কে বিয়ে করবে এখন বৃষ্টিকে? সবাই শুধু ভোগ করতে চায়, ভালবাসতে চায় না। এমন কেন এই দুনিয়ার মানুষগুলো? কেন এমন?

বৃষ্টির জন্য সামনে আরো দুঃসময়য় অপেক্ষা করছিল। কপাল খারাপ হলে সব জায়গাতেই খারাপ হয়। যাদের কপাল খারাপ থাকে তাদের সহজে ভালো কিছুই হয়না।

আজ অফিসে বৃষ্টির অনেক কাজ ছিল। আজও বাড়ী ফিরতে দেরি হবে। হটাৎ আজ বৃষ্টির মধ্য বয়স্ক বস বলছিল- বৃষ্টি তোমার সাথে কিছু কথা আছে বস। বৃষ্টি ওর রুমে বসে ছিল। বস রুমে ঢুকে হটাৎ বৃষ্টির হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। বৃষ্টি শক্তি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে যায়। আর বলতে থাকে
-স্যার কি করছেন আপনি? আপনি না আমার বাবার বয়সি। ছিঃ! ঘেন্না লাগছে আমার।
- তোমাকে আমার ভালো লাগে বৃষ্টি। আর এসব কিছুনা। আমি অনেকদিন ধরে তোমাকে কাছে পাওয়ার আশায় আছি। প্লীজ বৃষ্টি না করোনা।
- আমি আপনাকে কতটা শ্রদ্ধা করি আপনি জানেন? ছিঃ ছিঃ! আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে আমি আপনার চাকুরী ছেড়ে দিলাম। আপনার না বড় বড় ছেলে মেয়ে আছে? আপনাকে আমি আমার বাবার আসনে বসিয়ে ছিলাম।

ব্যাগ নিয়ে বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টির চোখের জল আর আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল এক হয়ে গেল।

খুব অনিশ্চিত জীবন এখন বৃষ্টির । চাকুরী আবার কবে পাবে তা জানেনা , কি হবে এখন? কিছুই জানেনা বৃষ্টি। পরিবার কে কি বাঁচাতে পারবে বৃষ্টি?



বৃষ্টিদের জীবনে নতুন সূর্য উঠে কিনা জানিনা। তবে তারা স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার, স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের, স্বপ্ন দেখে সুখী হওয়ার, মুক্ত পাখির মত ডানা মেলে উড়ার স্বপ্ন দেখে। খুব ঝড়ের সময় তার মাথার উপর ছাতা ধরার মত হয়ত কেউ-ই আসবেনা, কেউ এসে হয়ত হাতটি ধরে বলবেনা " ভালোবাসি তোমায়"।
তবুও মিথ্যে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে বৃষ্টি-রা। ভাবে হয়ত কোনদিন আসবে সেই প্রিয় মানুষটি। হয়ত জীবনে কোনদিন সুখ আসবে ।


এরকম অনেক বৃষ্টি আছে আমাদের সমাজে, যারা প্রতিনিয়ত জীবন সংসারে যুদ্ধ করে যায়। যাদের মনোবল তীব্র হয়ত তারাই টিকে থাকে অবশেষে। আর অনেকেই হয়ত ভেসে যায় জীবন স্রোতে। জীবনের কঠিন নিয়মের কাছে বৃষ্টিরা বাধা । মায়া, মমতা আর ভালবাসার কারনে হয়ত সে জীবন থেকে ছুটি নিতে চাইলেও তা আর সম্ভব হয় না। আবার অনেকেই ছুটি নেয় চিরকালের জন্য।

সব বৃষ্টিদের প্রতি রইল অনেক শ্রদ্ধা ভালোবাসা। যারা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে নিজের পরিবারকে আঁকড়ে বেঁচে থাকে ,পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করে এবং বাঁচিয়েও রাখে পরিবারকে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:২৪
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×