একটু সহানুভূতি
জীবন চলার পথে প্রতিদিনই আমরা সবাই কম বেশি বিপদ-আপদ, বালা- মুসিবত বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হই । এই দুঃসময়ে টাকা পয়সা দিয়ে না হোক (সব সমস্যায় টাকা পয়সার দরকার হয় না) আপনার মুখের একটু সহানুভূতি, একটু মায়া মমতাপূর্ণ কথায় সমস্যাগ্রস্থ ব্যাক্তির সমস্যার সমাধান না হলেও তার মনে এনে দিতে পারে প্রশান্তির সুবাতাস I সে মনে সাহস পায়, উৎসাহ পায়। সব শেষ হয়ে যাবার পরেও আবার নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন দেখতে পারে। আপনার এই একটু সহানুভূতি, একটু মায়া,মমতাপূর্ণ কথা কোনো একজন সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তি আজীবন মনে রাখে পারে আপনার অজান্তেই।
অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে ভিন্নচিত্রও দেখা যায় I কারো সমস্যায় ভাল পরামর্শ দিলেও শুনতে হয়, এসেছে বিনে পয়সায় উপদেশ বিলাতে ! বিপদে সহানুভূতি দেখালে শুনতে হয় আসছে করুনা করতে, নিজের উপর এই বিপদ আসলে বুঝতে পারত। এই ধরনের নানা কথাই মানুষ বলে।
কয়েক বছর আগে এরকম একটা বড় বিপদ আমাদের ফ্যামিলিতেও এসেছিলো কাউকে এতটুকু না জানিয়েই I হঠাৎ করেই আমার আম্মুর ক্যানসার ধরা পরে I ডাক্তাররা রিপোর্ট দেখে বলেই দেয় আম্মু আর বড় জোর একমাস বাঁচবেন I তারপর আল্লাহর ইচ্ছা। সন্তানের কাছে এর চেয়ে বড় দু:সংবাদ তো আর কিছু হতে পারে না । খবর শুনার পর কয়েকদিন ধরেই স্কুলে যাচ্ছি না I হঠাৎ করেই দেশে যেতে হবে ঠিক হলো I স্কুল থেকে ছুটি নেওয়ার জন্য ক্লাস টিচারের সাথে কথা বলতে গেলাম।
টিচারের রুমে ঢুকে হেই! বলতেই উনি আমার দিকে তাকিয়েই বললে
“ডু ছের ব্লেক উত” ( ইউ লুক পেল )?
“নগত প্রব্লেম” (এনি প্রব্লেম )?
- 'সমস্যা তেমন কিচ্চু না',এত সমস্যার মাঝেও আমি ধীরে ধীরে বললাম, 'কিন্ত এই মূহুর্তে আমাকে দেশে যেতে হচ্ছে ।'
-টিচার : 'বছরের এই সময়ে দেশে যাবে ! কি কারন?'
-'আমার আম্মুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে, তার অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল' বলতেই আমার চোখ দিয়ে এতোক্ষনের আটকে রাখা পানিগুলো বাধা না মেনেই বেরিয়ে এলো ।
- টিচার আমার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বল্লেন,’ দেখ পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা এমন কোন সমস্যা দেন নি যার কোন সমাধান নেই', সমস্যা যত বড়ই হোক তার সমাধান আছে । কখনো হয়ত সমাধানের সঠিক পথটা খুঁজে পেতে আমাদের দেরী হয়।কিন্ত এই মূহুর্তে তোমার সমস্যার সঠিক পথ আমার জানা নেই I আমার সান্তনার কথাও তোমার মনকে শান্ত করবে না I তবু বলি,আমি রিলিজিয়াস না তবে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা করেছি I তুমি রিলিজিয়াস আর তোমার ধর্মে তো এটাই বলা আছে মৃত্যুর পর আবার কোন একসময় সবাইকে জীবিত করা হবে। সেখানে তো সবার সাথে আবার দেখা হবে' I
আমি এক দৃষ্টিতে আমার টিচারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষন আর প্রানপনে চেষ্টা করছি আমার কান্নার পানি যেন চোখ দিয়ে বাঁধ না ভাঙা জোয়ারের মতো না বেড়িয়ে আসে I
টিচার আমার উদাস, কষ্টের দৃষ্টি দেখেই মনে হয় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আরো বল্লেন, 'তুমি মনে কর তোমার আম্মু অন্য কোন দেশে সেটেল্ড হওয়ার জন্য যাচ্ছে কিছুদিন বা কয়েক বছর পর তুমিও সেখানে যাবে, তুমি এটাকে এভাবে ভাবতে পারো না ? মানুষ তো মরবেই I সবাই মরবে কেউ আগে কেউ পরে।মৃত্যুকে তো মানুষ এখনো জয় করতে পারেনি। কিন্ত তোমরা যারা মৃত্যুর পরের জীবনকে বিশ্বাস কর তাদেরতো একটা আশা আছে যে তারা মায়া মমতার বন্ধনের পরিবারের সবাই আবার একদিন একত্রিত হবে । যাদের এই বিশ্বাস নেই তাদের তো সেই আশাও নেই'।
তুমি দেশে যাও যতটুকু সময় পাও আম্মুর পাশে থাক, স্কুল নিয়ে চিন্তা কর না , তোমার যে ক্লাস গুলো মিস হবে সেই সময়ের প্রবগুলো তুমি ফিরে এলে আমি নিয়ে নেবো।
“ লিকা থিল” (গুড লাক) I
সেদিন আমার টিচারের কথা আমার তেমন ভাল লাগেনি I সেই সময় এমন করে চিন্তা করার মেন্টালিটিও আমার ছিল না। কিন্ত যে দিন আমার আম্মু সত্যি সত্যি মারা গেলেন প্রথমে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম I কিন্তু হঠাৎ করেই আমার টিচারের কথা গুলো মনে পরল I আমি জানি না কেমন করে যেন আমি শান্ত হয়ে গেলাম I যদিও আমার চোখ দিয়ে পানি পরছিল কিন্ত আমি আর চিৎকার করে কাঁদিনি I আমাদের আত্বীয় স্বজনেরা বলাবলি করছিল ছোট মেয়েটাতো খুব শক্ত !
আমার আপু, দুই ভাইয়া আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় সবারই ফ্যামিলি আছে,বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে তাদের আলাদা একটা জগত আছে। আম্মুর জন্য তাদের খারাপ লাগে না তাও বলছিনা তবে আম্মু মারা যাওয়াতে যদিও আমি আম্মুর কাছে ছিলাম না নয় বছর বয়স থেকেই কিন্ত প্রতিদিন স্কাইপিতে এক, দেড় ঘন্টা করে কথা হত,দেখা হত তাই আমার খারাপ লাগাটা তাদের চেয়ে আমার মনে হয় একটু বেশী I আম্মুকে আমার একটু বেশী মনে পরে I আম্মুর জন্য মন খারাপ লাগে খুবই I কিন্ত তখনই আমি সব সময় টিচারের কথা গুলো মনে করি I আমার মনে শান্তি শান্তি লাগে, আমি স্বপ্ন দেখি, আশা রাখি আবার একদিন দেখা হবে আম্মুর সাথে I আম্মুকে জরিয়ে ধরব, আম্মুর বুকে মাথা রাখব। আম্মু আমাকে ছোট বেলায় মাথায় হাত বুলিয়ে যেমন গল্প বলতেন তেমন করে গল্প বলবেন !
এ ছারা ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের ফ্যামেলিতে বিভিন্ন সময় ছোট খাট সমস্যা দেখা দিলেও আমি ফ্যামিলির সবার ছোট হওয়াতে আমাকে কখনো সেগুলো ফেস করতে হয়নি। যদিও এখন আমি বেশ বড় হয়েছি, কিন্ত তবু আমি সবার কাছে ছোটই রয়ে গেছি, কথায় কথায় শুনতে হয় তুমি কি বুঝ ছোট মানুষ!!
তবে ছোট হলে এটাও সত্যি যে আমি কখনো কোন কিছু নিয়ে সহজে ভেংগে পরি না বা বিচলিত হই না I আমি সহজে ধৈর্য হারাই না। এজন্য অনেকেই বলে, আমার নিজের কাছেও মনে হয়, আমি অনেক শক্ত মনের মেয়ে
কিন্ত সামু ব্লগে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একটা মিথ্যাকে পুঁজির করে আমাকে এত অশ্লীল ভাষায় গালি দেওয়া হয়েছে যে সব ভাষা আমার পরিবারের কারো মুখে কখনো শুনিনি তাই আমার জানাও ছিল না তেমন একটা বুঝিও নাই এগুলোর মেনিং কি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পেয়েছি I মন খারাপ হয়েছে খুব ।
সেই মূহুর্তে সহ ব্লগারদের সহাভূতিপূর্ন কমেন্টে আমার মনে শান্তির প্রলেপ দিয়েছে I তাদের দেয়া উৎসাহে আমি অনুপ্রানিত হয়েছি I আমি টিকে থাকার দৃঢতা পেয়েছি তাদের সহানুভূতিপূর্ণ কমেন্টে । হয়ত আমি ব্লগে এখনো তাই টিকেও আছি তাদের কারনেই ব্লগ ছেড়ে যাইনি। নাম বলতে গেলে অনেকের নামই বলতে হবে তাই কারো নামই বলছি না তবে সময়ের নিষ্ঠুরতায় জীবনের বাস্তবতায় হয়ত ব্লগে থাকা হবে না কিন্ত অদেখা অজানা কিছু মানুষের নাম রয়ে যাবে আমার মনের মনিকোঠায় আজীবন।
আমি আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ ও সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। ”Utan min vapu”।
ফটো ক্রেডিট : আমার আই ফোন ক্যামেরা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:১৮