শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ একটা মানব শিশুকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলার জন্য যে শ্রম দিয়ে থাকেন তেমন শ্রম আর কোন স্তরের শিক্ষকগণকে দিতে হয় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যেসকল শিক্ষক সারা জীবন জ্ঞানের আলো বিতরণ করে আজ অবসরে চলে গেছেন, মনে পড়ে কি কখনো তাঁদের কথা ? কখনো সখনো মনে পড়লেও তা জীবনের ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে যায়।
এমনই এক বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে প্রাইমারি টিচার্স ফেইসবুক গ্রুপ ঘোষনা করেছিল ঈদ ও পূজার পরে অন্তত ৩ জন অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে দেখতে যাওয়া হবে। আমরা বর্তমান প্রজন্মের কয়েকজন শিক্ষক (প্রাইমারি টিচার্স ফেইসবুক গ্রুপের এডমিনগণ) সিলেট জেলাধীন দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকগণকে দেখতে যাই।
শ্রদ্ধেও মোঃ আব্দুল মুতলিব স্যারের সাথে আমরা
প্রথমে আমরা যাই জনাব মোঃ আব্দুল মুতলিব, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, উলালমহল সপ্রাবি স্যারের বাড়িতে। অল্প কয়েক দিন আগে তিন স্ট্রোক করায় শরীরের ডান অংশে হাত এবং পায়ে শক্তি পাচ্ছেন না। আমরা স্যারকে দেখতে গিয়েছি জেনে তিনি এতাটাই আনন্দিত হয়েছেন যে, কঠিন অসুস্থ অবস্থায়ও তাঁর ছোট ছেলের উপর ভর করে ড্রইংরুমে এসে আমাদের সাথে চেয়ারে বসলেন। আমার মনে হলো তিনি যেন অনেকটা সুস্থবোধ করছেন। আমরা তাঁর শরীরের অবস্থা জানতে চাইলাম, তিনি ডান হাত একটু একটু নাড়ালেন, বললেন আমি অসুস্থ ছিলাম কিন্তু এখন সুস্থ। আপনারা আমাকে দেখতে এসেছেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি তাঁর বড় ছেলেকে ডাকলেন, বললেন তাঁদের জন্য এখনই চাউলের রুটি ও মাংস ভুনা কর এবং আমাদেরকে বললেন আপনারা আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যাবেন। স্যারের অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। স্যার তাঁর পুরাতন স্মৃতিগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করলেন এবং আমাদেরকে উপদেশ দিলেন নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে এবং এক নাতি আছেন। বড় ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
স্যার অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাথে সারাক্ষণ ছিলেন। আমাদের সাথে গল্প করেছেন এবং অন্তরের অন্তস্থর থেকে আমাদের জন্য দোয়া করেছেন।
শ্রদ্ধেও আব্দুল ওয়াদুদ স্যারের সাথে আমরা
তারপর আমরা যাই দাউদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি শিক্ষক জনাব আব্দুল ওয়াদুদ মহোদয়ের বাড়িতে। তিনি ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে অবসরে গেছেন। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আতিথেওতার সথে আমাদেরকে রিসিভ করেন। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষকগণ অবসরে যাওয়ার শিক্ষকগণের খুঁজ খবর নিচ্ছেন এতে শিক্ষকতা পেশার প্রতি তাঁর আস্তা আরও বেড়ে গেছে এবং তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন বলে গর্ববোধ করছেন। স্যার আমাদের সামনে তাঁর স্মৃতিময় শিক্ষকতার দিনগুলো স্মরণ করেন। একসময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান এবং তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে প্রবাসে আছেন, বর্তমানে ছুটিতে দেশে এসেছেন। মেয়ে তিনজনকেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রহমতে তিনি সুস্থই আছেন।
শ্রদ্ধেও আব্দুল মতিন স্যারের সাথে আমরা
তারপর আমরা যাই জনাব আব্দুল মতিন, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, সৈয়দ কুতুব জালাল সপ্রাবি এর বাড়িতে। তাঁর বাড়ি হচ্ছে মোগলাবাজার ইউনিয়নের ছতিঘর গ্রামে। আমরা স্যারের বাড়িতে গিয়ে স্যারকে ডাকলাম। অপ্রস্তুত অবস্থায় স্যার ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম এবং বললাম আমরা আপনাকে দেখতে এসেছি। স্যার কি যে আনন্দিত হলেন, ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। স্যার গেঞ্জি পরা অবস্থায়ই আমাদেরকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসলেন। বললেন এই যুগে আপনারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা কল্পনাই করা যায় না। ২০০৮ সালে অবসর জীবনে গেলেও স্যার সুস্থ আছেন বলে আমাদেরকে জানান। স্যার আরও বলেন তিনি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। যা আমাদেরকে অবাক করেছিল। তৎকালীন সময়ে স্যার আরও ভাল চাকুরিতে যেতে পারতেন কিন্তু শিক্ষকতা পেশার প্রতি ভালবাসার কারণে তিনি অন্য পেশায় যাননি। অবসর সময় দিনের বেলা স্যারের শখ এবং প্রিয় গাভি পালন করেন এবং বিকাল বেলা স্থানীয় খালোমুখ বাজারে হোমিওপ্যাথি প্যাকটিস করেন। তিনি আমাদেরকে পেয়ে এবং বর্তমান শিক্ষকরা তাঁরে স্মরণ করছে জেনে বার বার আবেগাপ্লুগ হয়ে পড়েছেন এবং বার বার তাঁর চোখে পানি আসছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। তিনি আমাদেরকে পেয়ে এতোটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে আমাদেরকে বিদায় দিতে যেন তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। তিনি আমাদের সাথে হেটে মুল সড়ক পর্যন্ত এসে আমাদেরকে বিদায় দেন।
অবসর জীবনটা যে কতটা বেদনাবিধুর তা আমরা উপলব্ধি করলাম কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত স্যারদেরকে দেখে। কেমন জানি একটা একাকিত্ববোধ আর হাহাকার। সমবয়সী অনেকেই আজ আর নেই। বর্তমান সমাজ ও প্রজন্ম যেন তাঁদের সাথে মিশতে চায় না। এই সময়টাতে উচিত ছিল বর্তমান প্রজন্ম তাঁদেরকে বেশি বেশি সময় দেয়া। কিন্তু ব্যস্ত সবাই। সকলের কাছে অনুরোধ আমাদের কাছাকাছি যে সকল অবসরপ্রাপ্ত স্যারেরা আছেন, মাঝে মধ্যে যেন আমরা তাঁদের খুঁজ খবর নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৩:১০