
আমার শ্বশুর শহরের পাশে একটি পুরাতন টিনের বাড়ি কেনেন। বাড়ির প্রথম মালিক ছিলেন একটি হিন্দু পরিবার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এক বিহারীর কাছে তারা বিক্রি করে চলে যায়। সেই বিহারীর কাছ থেকে সস্তায় বাড়িটি কেনেন আমার শ্বশুর ১৯৮৮ সালে। ওঠার পর থেকেই তারা অস্বাভাবিক কিছু বুঝতে পারেন। কিন্তু সবকিছু অগ্রাহ্য করে দিন কাটাতে থাকেন। হাজার হলেও নিজেদের বাসা।
বাসাটির ডিজাইন সম্বন্ধে ধারনা না দিলে হয়ত ব্যাপারটি বোঝা যাবে না। বাসাটি ছিল ৪ কোনা কিন্তু ঘরগুলো ছিল ইংরেজী " L " সেপ্ড। মানে ঘর গুলো " L " এর দাগের বরাবর। দুটো উঠোন। একটি বাসার ভেতরের পেছনের অংশে। অন্যটি বাসার সামনে রোডের সাথে লাগানো। সামনের উঠোনটা সরকারী জায়গা। তবে ঘিরে নিয়ে উঠোন মত করা। পেছনের উঠোনটিতে ৩টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের জবা গাছ, একটি গাব গাছ, ডেওয়া, কাঁঠাল ও বরই গাছ ছিল। কাঁঠাল গাছের গোড়ায় টিউবয়েল। আর গাব গাছের পাশে পায়খানা ছিল। বাসায় বাউন্ডারী দেয়া। আর বারেন্দা থেকে টিনের চালা এক মানুষ উঁচু ছিল। রান্না ঘর টিউবয়েলের পাশে। বারান্দার শুরুর মাথায় ডাইনিঙ স্পেস। এই ডাইনিঙ স্পেসের গা ঘেসে বরই গাছ। অন্যদিকে সামনের আঙিনায় একটা বড় পেয়ারা গাছ, আর কিছু ফুলের গাছ ছিল।
আমি এখন ঘটনায় চলে যাচ্ছি।
১.
ঐ বাড়িতে ওঠার পর, আমার শ্বশুর-শ্বাশড়ী দুজনই লক্ষ্য করলেন, মাঝরাতে তাদের বারান্দায় প্রায় প্রত্যেক দিন, দু তিন জন মানুষ কথা বলে। প্রথম প্রথম চোর ডাকাত মনে করলেন। পরে একদিন নারী কন্ঠও শুনলেন। এভাবে চলার কিছুদিন পর সাহস করে তারা বের হতেন, কিন্তু কোন কিছু দেখা যেত না। দরজা বন্ধ করার কিছু পরেই আবার কথাবার্তা শুরু হত।
এরপর প্রতিরাতেই টিউবয়েল চাপার শব্দ পাওয়া যেত। মনে হত কেউ যেন কল চাপছে এবং গোসল করছে। কিন্তু গিয়ে দেখা যেত কলের পাড় একেবারে শুকনা। কোন শব্দও নেই। প্রশ্ন জাগতে পারে, অন্য টিউবয়েলের শব্দ শোনা যেত কিনা । কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ঐ এলাকায় কাছাকাছি ৩ টা বাসা ছিল, যার মধ্যে শুধু আমার শ্বশুরের বাড়িতে টিউবয়েল ছিল। আর তাছাড়া নিজের টিউবয়েল চাপার যে শব্দ, তা অবশ্যই বাড়ির লোকদের চেনা থাকে। কাজেই ভুল হবার কথা না। তবুও তারা প্রমানের অভাবে চুপ থাকলেন।
এরপর একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল। তখন সময়টা ১৯৮৯ সাল। শীতের শুরুতে, মাঝরাতে আমার শ্বাশুরী টয়লেটে গেলেন, হেরিকেন হাতে। হঠাৎ তার মনে হল, কেউ যেন তার পিছে পিছে আসছে। কিন্তু পিছনে ঘুরে দেখলেন কেউ না। টয়লেটের সিঁড়িতে পা রাখতেই মনে হল, কেউ যেন গা ঘেসে গেল। টয়লেট সেরে বের হতেই তিনি লক্ষ করেলেন ভীষণ ঝড় হচ্ছে। মনে হচ্ছে ডাল পালা ভেঙ্গে পড়বে। তিনি তাড়াতাড়ি করে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় পা রাখলেন। ঠিক সে সময়, এক দমকা হাওয়াতে ওনার হেরিকেন নিভে যায়। সেই সাথে বুঝতে পারলেন, তিনি শূন্যে উঠে যাচ্ছেন। তিনি এতটাই উঠে গেছেন যে, শেষে টিনের চালা টেনে ধরেলেন। আল্লাগো বলে চিৎকার দিয়ে, জোরে জোরে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করেন। সাথে সাথে ৩-৪ হাত উপর থেকে পড়ে যান তিনি এবং পা মচকান। আমার শ্বশুর তখনও ঘুমাচ্ছিলেন। ঘরে ঢুকে দেখতে পান তার বুড়ো আঙ্গুলের নখটাও উপরে গেছে।
পরের দিন তাবিজ দেয় ইমাম সাহেব। আর বলা হয় যে, প্রেগনেন্ট অবস্থায় একা রাতের বেলায় কোথাও যাওয়া যাবে না। এর দু'তিন
পর তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, কেউ একজন ওনাকে বলছে, তার সাথে যেতে হবে। নয়ত একটা সন্তান মেরে ফেলবে।
এই ঘটনার ঠিক এক মাস পর, যখন প্রেগনেন্সির সাড়ে সাত মাস চলছে, বাদ এশা ওনার ডেলিভেরি পেইন ওঠে। আমার শ্বশুর দাই ডেকে আনেন। রাত দুটার দিকে ডেলিভেরী হয়, কিন্তু শিশুটি মিনিট দশেক পর মারা যায়। সে রাতেই দাই চলে যায়। আমার শ্বশুর মৃত শিশুটিকে তুলা আর তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে ঘরের মেঝের এক পাশে রাখেন। ঘর কম থাকায় অন্য দুই বাচ্চাকে (যাদের বয়স ছিল ৩ বছর ও ২ বছর) চাচা শ্বশুরের সাথে এক ঘরে রাখেন। আর আতুর ঘরে আমার শ্বশুর বিছানার উপরে শুয়ে পড়েন, শ্বাশুরী মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, ফজরের নামাজ শেষে ইমাম কে ডেকে নিয়ম মাফিক দাফন করা হবে। শীতের রাত হওয়ায় দরজা জানালা সব লাগানো ছিল। এক ফাঁকে তারা ঘুমিয়েও পড়েন।
ভোরে আযান শুনে ঘুম ভাঙ্গে। আমার শ্বাশুড়ী খুব দুর্বল ছিলেন। তারপরেও বাচ্চাটার মুখ দেখতে চান, শেষবারের মত। আমার শ্বশুর বিছানা থেকে নেমে প্যাচানো তুলা আর তোয়ালা ওনার কাছে নিয়ে আসলেন। কিন্তু দেখলেন ভেতরে কিছুই নেই। দুজনেই স্তম্ভিত। ঘরের সব কোনায় কোনায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু কোন ইঁদুর, বিড়াল বা চিকা কিছুই পেলেন না, যা কিনা খেয়ে ফেলতে পারে বা টেনে সরে নিয়ে যেতে পারে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যে ভাজে শিশুটিকে তোয়ালের ভেতর রেখেছিলেন, ভাজটা সেরকমই ছিল।
সাথে সাথে ইমাম কে জানান হল। উনি যা বললেন, তা হল, দাই এসে গা থেকে সব তাবিজ কবজ খুলে ফেলেছিল, তাতেই এই সমস্যা হয়েছে। খারাপ কিছু বাচ্চাটাকে নিয়ে গেছে বা খেয়ে ফেলেছে।
২.
এরপর মোটামুটি ভালই গেছে বেশ কয়েকটা বছর। পরে আরও ৩ সন্তান জন্ম নেয়। ঘটনা নতুন করে শুরু হয় ১৯৯৭ এর মাঝামাঝি থেকে। তখন আমার ওয়াইফ ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ হঠাৎ বুঝতে পারে যে, রাতে কে যেন তার গায়ের কাঁথা আস্তে আস্তে টেনে নামায়। কিংবা মনে হয় ঘরের ভেতর কেউ যেন হাঁটাহাঁটি করছে।
এদিকে এক কবিরাজের কথা মত লোহার গ্রিল দিয়ে বাসার ভেতরের আঙিনাটাকে পুরোপুরি পৃথক করা হয়েছে। গাব গাছ কেটে ডেউয়া ফলের গাছ লাগান হয়েছে। টয়লেটটা বাসার ভেতরে বানান হয়েছে। পেয়ারা গাছটা মরে গেছে। বাকিটা আগের মতই আছে।
আমার স্ত্রী হঠাৎ এক সন্ধ্যায় দেখেন, গ্রীল ধরে এক মোটা সোটা লম্বা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার দেয়ার সাথে সাথে চোখের সামনে থেকে লোকটা উধাও হয়ে যায়। এরপর আমার শ্বাশুরী মাঝ রাতে শুনতে পান যে কেউ যেন ডাইনিং স্পেসে মেয়েলি কন্ঠে ফিস ফিস করছে। তখন আমার শ্বশুর দেশে নেই। তাই তিনি নিজেই দরজা খুললেন, তারপর একটা নারী মুর্তিকে ভ্যানিস হয়ে যেতে দেখলেন। এসবের পরে উনি বিভিন্ন কবিরাজের কাছে দৌড়াতে থাকেন। কিন্তু কাজ হয়না। দিন কে দিন ভীতিকর অবস্থা বাড়তে থাকে।
এভাবে দিন যাচ্ছিল। এরপর আমার স্ত্রী এস.এস.সি পাশের পর একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটে। সকালে উঠে টয়লেটে যাবে। রান্নাঘর পেরিয়ে টিউবয়েল, তার পেছনে নতুন টয়লেট। কিন্তু রান্না ঘরের সামনে আসতেই দেখে, চক দিয়ে পাকা মেঝেতে কেউ যেন গোল করে আলপনা এঁকেছে। সে টয়লেটে না গিয়ে তার মাকে ডাকে। তারা দেখতে পায়, গোল সারকেলের মধ্যে কিছু ঘর কাটা। তার মাঝে আরবীর মত হরফ লেখা। সেটি মুছে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। কিছুপরে ঐ চিত্রটি আপনা আপনি উধাও হয়ে যায়। এরপর একসঙ্গে ২ টা সারকেল দেখল। তবে অন্যদিন। সেবারের অক্ষরগুলো ঠিক বুঝতে পারেনি। সেগুলোও আপনা আপনি ভ্যানিস হয়ে যায়।
আরও টুকরো টুকরো যে সব ঘটত সেগুলো সংক্ষেপে বলছি, ডাইনিং স্পেসে আর টয়লেটের সামনে মাসিককের রক্ত পড়ে থাকত। কখনও মাথার খুলি, কখনও শশ্মানের পোড়া মাটি, লাল কাপড়ের টুকরা, এসব পড়ে থাকত। রাতের বেলা বা খাড়া দুপুরে টিনের চালের উপর দিয়ে লাফালাফি বা জোরে জোরে হাঁটার মচ মচ শব্দ পাওয়া যেত । কিন্তু সাথে সাথে গিয়ে একটা বিড়াল পর্যন্ত পাওয়া যেত না। আবার নেমে আসার সাথে সাথে শব্দ শুরু হত।
মাঝে মাঝে ওড়না বা লুঙ্গি উঠোন থেকে নাই হয়ে যেত। একদিন রাতে সাবাই খেতে বসেছে, দেখল, আমার স্ত্রীর একটা ওড়না বারান্দায় উড়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক ওড়া না, অনেকে যেমন মাথার উপর দিয়ে পেচিয়ে ঘাড়ে একটা অংশ ফেলে হাঁটে, তেমন করে হাটছে বা উড়ছে। অথচ তখন কোন ঝর বৃষ্টি বা বাতাস ছিল না।
এভাবে দিন যাচ্ছিল। পড়ে টিউবয়েলের কাছে এবং ডাইনিং স্পেসের ঢালাই করা মেঝে খুড়ে অনেক গুলো তাবিজ পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় টিনের চালের ফাঁকে, গাছের ডালে, আলমারির ভেতরে তাবিজ পাওয়া গেছে। ওদের ধারনা, জ্বীন পরী বা অশুভ কিছুর মাধ্যমে এসব রাখা হয়। তিন মাস আগেও আমি যখন শ্বশুর বাড়ি যাই, বাগানের ভেতরে আমি ২ টা নতুন তাবিজ পেয়েছি। যার ভেতরে কিছু মাটি, একটা সুতা, একটা কাগজ, কাগজে নকশা আঁকা, ভেতরে কিছু সেম্বলের আঁকাআঁকি।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমার স্ত্রী ওই বাসায় আগুনের গোলাও উড়তে দেখেছে আমাদের বিয়ের আগে। রিসেন্টলি ওই বাসায় আমাদের ডিজিটাল ক্যামেরার কিছু ছবিতে আগুনের গোলার মত কিছু একটা ধরা পড়েছে। আমি ঠিক জানি না এটা কি? লেন্সের ধূলার কনাও হতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ৪ টা ছবির ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় এই আগুনের গোলার ছবি। ধূলার কনা হলে লেন্সের একই জায়গায় থাকার কথা। অথবা পরপর সব ছবিতে থাকার কথা। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঘটেছে রানডমলি।
আজ এ পর্যন্তই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



