আপিটা যেন আমাকেই উলটো বকছে। ভাইয়া, তুমি এতো ভীরু! এত টুকুন রক্ত দেখেই......। অথচ তোমার কাছেই কত সাহসের গল্প শুনেছি। শুনেছি জয়নাবের কথা, শুনেছি হামিদার কথা। কত শত সাহসীদের গল্প তুমিই তো আমায় শুনাতে। তুমি আমায় কিনে দিয়েছ 'সাহসী মানুষের গল্প'। জানো, তোমার কাছে এত এত সাহসীদের গল্প শুনে শুনে প্রচন্ড রকম একটা সাহস আমার সঙ্গী হয়ে গেছে...। তাই তো যে সময় গুলো তুমি বন্দীশিবিরে ছিলে, যখন সকাল সন্ধ্যা মা পালা করে কাঁদতো...
আমি একফোঁটা অশ্রু ও ঝরাই নি...।
ছোট বোন একটা কবিতা লিখেছে...।
"নীলিমায় ভেসে যাওয়া মেঘমালা অপরূপ;
সারাবেলা বসে দেখি জানালায়,
এতটুকু ছুঁয়ে দিতে হাতটা বাড়াই আর
জানালার কাঁচে হাত থেমে যায়।
কচি পাতারং মাখে পৃথিবীর আঙিণায়
মহাকাল তার গান গেয়ে যায়।
সময় পেরিয়ে চলি সময়ের হাত ধরে,
উদাসী গানের শুধু সুরখানি মনে করে,
কথাগুলো ধীরে তাই সময়ে মিলায়।
অমিয় আলোর বাণী কাছে এসে ডেকে যায়
বলে যায় ছুটে চলো মনোরম ঠিকানায়।
আলোকিত রূপ দেখি...কবিতায় লেখালিখি;
অধরা সে আলো থাকে।আমি আঁধিয়ায়।
আলো আলো চারপাশে আমি আঁধিয়ায়....
আলোকিত হবো বলে হাতটা বাড়াই আর
জানালার কাঁচে হাত থেমে যায়.............।"
লেখাটিতে আমার কিছু মন্তব্য এবং ওর জবাবঃ
আমি ওর বেশ প্রশংসা করি এবং জানালার কাছের বাঁধা পেরিয়ে আসতে উপদেশ দিই।
অতিরিক্ত প্রশংসায় ও খুব রেগে যায় এবং বলে- জানালার কাঁচটা আমিও ভেঙে ফেলতে চাই...
আমি : তোর রাগ আমাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে...।
তুই আরো বেশি রাগ করবি।
কাঁচ ভাংতে গিয়ে যেন হাত কেটে না যায় লক্ষ্য রাখিস কিন্তু। কেটে গেলে ছুঁয়ে দেয়ার স্বপ্ন ও দেখা যাবে না।
ওর রিপ্লাইঃ
আনন্দ দিচ্ছে!!......ঠিক আছে আমিও সবাইকে বলে দিলাম,
"আমার একটা ভাই আছে.......বোনের হাত কেটে গেলেও ফিকফিক করে হাসে তবুও স্যাভলন লাগিয়ে দেয় না।অথচ সে কষ্ট পেলে বোনটা কত সান্ত্বনা দেয়.....! কী সেলফিশ ভাই !"
মূল লেখাঃ এই মন্তব্য পড়ার পর কেমন যেন নস্টালজিয়ায় ভূগছি। কত কি মনের ভিতর আনচান করছে। নিজে নিজেই কত কথা বলছি বিড়বিড় করে।
না আর একা একা পারছি না। লিখতেই হচ্ছে আমাকে। সব ফাঁস করে দিব। ফাঁস করে দিব ভাই-বোনের যত গল্প।
সর্বশেষ কমেন্টটা পড়ার পর আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, সত্যিই আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম কল্পনার জগতে। সত্যি সত্যিই আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম...আমার আপি'টার কঁচি দুটো হাত থেকে রক্ত ঝরছে। ঝরছে ঝির ঝির করে শ্রাবণ ধারার মত। আমি নির্বাক, আহা! জানালার কাঁচটা ভাংতে গিয়ে কি বেপরোয়াই না ছিলো আপিটা। আমি সেভলন লাগিয়ে দিচ্ছি আর বকছি(বড় ভাইরা যা করে আর কি)। বকছি অনর্গল...কি প্রয়োজন ছিলো এত তাহাহুড়া করার...আমাকে বললেই তো পারতি...।
তোর হয়তো মনে নেই আপি, মনে থাকার কথাও না। তুই তখন ও তো সেই 'পিচ্চি' টিই ছিলি। তখনও গরম-ঠান্ডার অনুভূতি তোর হয়ে উঠেনি। প্রচন্ড গরমের মধ্যে এসেই বলতি, ভাইয়া শীত-শীত।আমরা হাসতাম তোর এসব কান্ড নিয়ে। আলোর প্রতি তোর তীব্র আকর্ষণ টা আমি তখনি অনুভব করতাম। একদিন রাতে কি কান্ডটাই না করে বসেছিলি। আমাদের ঘরটা ছিল ছোট্ট তিন কামরার। রমজানের ভোর রাতে সেহেরি খেতে যখন উঠতাম, তোকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগত না। তাই মামুনির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তোকে উঠাতাম। বিদ্যুৎ ছিল না তখনও। কুপি অথবা মোমবাতিই ছিল এতটুকু আলো পাওয়ার উপায়। তোর সামনে কুপি রাখা ছিল অনিরাপদ। পেলেই ধরে ফেলতে চাইতি। সেদিন তোকে বসিয়ে রেখে কি যেন করছিলাম...ওমা একি! তোর হাতে আগুন! আলোটাকে তুই নিজের দখলে নিয়ে নিলি...যা হবার তাই হল...সারা জীবনের জন্য কিছু চিহ্ন...। বই পড়তে পড়তে যখন সারা রাত কাটিয়ে দিয়ে লাল লাল চোখ দুটি নিয়ে মা-মনির বকা খাস...তখন দেখিস নি আমি তোর পাশে থাকি। মাকে বুঝাই। "মা, বোন আমার আলোর পথের অভিযাত্রী। 'আলেয়া' ওকে বিভ্রান্ত করতে পারবেনা। তুমি একদম নিশ্চিন্ত থেকো"। কখনো কি খেয়াল করেছিস...? গভীর রাতে যখন তুই বইয়ের মধ্যে ডুবে আছিস কিংবা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস রাতের তারা'দের পানে তখন তোর এই ভাইয়াটি চুপে চুপে সন্তর্পণে নকিয়া ১২০৩ এর মিঁটি মিঁটি আলো জ্বালিয়ে জায়নামাজে বসে থাকে প্রভূর কাছে দু-হাত তুলে...। যেমন করে তুই বলেছিলি " ভাইয়া, আল্লাহর দুনিয়ার সবটুকু আলো আমার চাই" তেমন করেই দোয়া করে। হয়তো টের পাস্ নি। পাওয়ার কথাও না। তুই থাকিস ধ্যানে। আমায় দেখবি কি করে।
যেই জানালার কাঁচ টা ভাংতে গিয়ে তুই আজ হাত কেটে ফেললি...।জানিস! এই জানালার কপাট গুলো ছিল কাঠের। তাও কি ঢালাই করা কাঠ। ঠিক ভর দুপুরে যখন সারা দুনিয়া আলোয় ঝলমল করতো, তখনও আমাদের ঘরটায় থাকতো অমাবস্যা। একদম ভালো লাগতো না আমার। কত বলেছি বাবাকে...। বাবা'র ভীষণ ভয়, অতি আলো নাকি ঝলসে দেয়। চোখের জ্যোতি কমিয়ে দেয়। অতি বেগুনি রশ্মি আরো কত কি...। অবশেষে বাবা রাজি হয়েছেন। তবু আমার দাবিমত খোলা জানালা নয়, থাকবে কাঁচ। এতটুকুতেই আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। এবার আলোর দেখা পাব। মিতালী হবে রাতের জোসনার সাথেও। জানিস সে আনন্দে দুদিন ধরে আমার একদম ই খেতে ইচ্ছে করেনি। শুধুই আনন্দ আর আনন্দ...। বিজয়ের আনন্দ।তুই তো আমার চেয়ে অনেক বেশি বেপরোয়া...। তাই তোর এই সামান্য কাঁচ কে ও সহ্য হয় না...। এতেও আমার আপত্তি ছিল না বরং ভালোই লাগতো তোর আগ্রহ দেখে, মেঘেদের সাথে ভেসে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ কি করলি তুই! এ যে আমার কলিজা ছিঁড়ে ছুটে আসা রক্তকনিকা। আমি কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছি। আমি যেন সইতে পারছি না। আপি এমন পাগলামি গুলো আর করিসনে। লক্ষী বোন আমার...। মিনমিন করে বলে চলছি আমি ঝকঝক করে চলা ট্রেনেরা যেমন চলে সমান তালে। তুইও শুনে আছিস গভীর নিস্তব্ধতার সাথে। চোখ তুলে তাকাই...ভাবছি হয়তো দেখব আপি'র অশ্রু ছলছল আঁখি দুটি।
কিন্তু!! এ এক অসাধারণ দৃশ্য! ভাইয়ের কোলে মাথা রেখেই সে কি নির্মল ঘুম। মুখাবয়ব থেকে যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলোর ঝলকানি ঠিক যেন শীতের দুপুরে গোমতী পারের চিকচিক করা বালিকা-রাজীর মত। আর ফুটে উঠছে এক অপরাজেয় প্রত্যয়। সূর্যের সাথে মিতালী আর অপরূপ মেঘমালার সাথে ভেসে বেড়ানোর স্বপ্নেরা যেন খেলা করছে এক নিষ্পাপ চাহনীতে। আমি আনন্দের উত্তেজনায় ভাসছি। চোখ চলে যায় জানালার দিকে.........।
জানালার কাঁচ গুলো ভেসে যাচ্ছে...ভেসে যাচ্ছে যেমন করে তরল বাষ্পীভূত হয়ে মিশে যায় বাতাসে। অপরূপ মেঘমালার উপর যেন কী সুন্দর রংধনু এঁকে দিচ্ছে। ছোট্ট জানালাটি বুঝি রূপান্তরিত হল বিশালাকার দরজায়। আহ! কি সুন্দর! কী মনোহরি সে দৃশ্য!
আপিটা যেন আমাকেই উলটো বকছে। ভাইয়া, তুমি এতো ভীরু! এত টুকুন রক্ত দেখেই......। অথচ তোমার কাছেই কত সাহসের গল্প শুনেছি। শুনেছি জয়নাবের কথা, শুনেছি হামিদার কথা। কত শত সাহসীদের গল্প তুমিই তো আমায় শুনাতে। তুমি আমায় কিনে দিয়েছ 'সাহসী মানুষের গল্প'। জানো, তোমার কাছে এত এত সাহসীদের গল্প শুনে শুনে প্রচন্ড রকম একটা সাহস আমার সঙ্গী হয়ে গেছে...। তাই তো যে সময় গুলো তুমি বন্দীশিবিরে ছিলে, যখন সকাল সন্ধ্যা মা পালা করে কাঁদতো...
আমি একফোঁটা অশ্রু ও ঝরাই নি...।
আমি দূরের নীলিমাকে ছুঁতে চাই ভাইয়া। আমায় পিছু ডেকো না............।
লিখাটার ব্যাখ্যা
এখানে মা বাবার আসনে যারা তারা হচ্ছেন উম্মাহ'র নেতৃবৃন্দ।
কাঠের জানালা,অমাবস্যা- উম্মাহ'র গত ৫-৬ শত বছরের পিছিয়ে পড়া।
বক্তার (আমি) আসনে- যারা উম্মাহ'র অমাবস্যা কালে স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছে।
জানালার কাঁচ- অমাবস্যা থেকে উত্তরণের প্রথম ধাপ।
"অতি আলো নাকি ঝলসে দেয়। চোখের জ্যোতি কমিয়ে দেয়"- ইজতিহাদে অভিভাবক দের ভয়।
"জানালার কাঁচ গুলো ভেসে যাচ্ছে..."- একটা সুন্দর সকালের স্বপ্ন, যা আসবেই।
"আপিটা যেন আমাকেই উলটো বকছে"- প্রথম দিকের স্বাপ্নিকদের চেয়ে আজকের তরুন তরুনীরা অনেক বেশী উজ্বীবিত(মধ্যপ্রাচ্য)।
যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা (আপি)- উম্মাহ'র সবচেয়ে প্রান-চঞ্চল তরুন, যারা দুনিয়া জয়ের স্বপ্ন দেখে।