সুলভ, আরামদায়ক আর নিরাপদ- এইসব গুণের কারণে রেল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু দাতাদের অসহযোগিতা ও সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় না থাকায় আমাদের দেশে রেল যোগাযোগ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও এখাতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় না। সরকার একা এত বড় একটি খাতকে এগিয়ে নিতে পারছে না সেটাও এতদিনে প্রমাণিত। লোকসানের অজুহাতে এতদিন কোনো সরকার এ খাতের উন্নয়নে রাজি হয়নি।
১৯৪৭ সালে দেশে মাত্র ৬০০ কিলোমটার পাকা রাস্তা ছিল। এখন দেশে পাকা রাস্তার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কিলোমিটার। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে যতটুকু রেলপথ তৈরি হয়েছিল, এরপর আর সেটা উল্লেখযোগ্য পরিমানে বাড়েনি। স্বাধীনতার পরে কোনো সরকারই রেলের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও অভাব ছিল বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
তবে এরকম ভাবনার সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, বিদেশী দাতাগোষ্ঠী রেলখাতে অর্থ দিতে কখনোই খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বরং তারা নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা করে পয়সা দেয়। তিনি বলেন: রেলওয়ে খাতে উন্নয়ন করেছে শুধু এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক। কখনো কখনো ব্রিটেন সহায়তা দিত তাদের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য। তাতে থাকতো নানান শর্ত। যেসব জায়গার রেললাইন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান নয় তারা সেগুলো বন্ধ করতে বলতো। বিশ্বব্যাংকও আমাদের কখনো রেলে সাহায্য করেনি।
দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা কেন এতদিনেও তেমন শক্তিশালী হলো না- জানতে চাইলে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আক্তারুজ্জামান বলেন, অতীতে সব সময়ই এই খাতকে অবহেলা করা হয়েছে। তিনি বলেন: রেলওয়েকে যুগোপযোগী করার জন্য সেসমস্ত প্রকল্প নেয়ার দরকার ছিল তা আসলে নেয়া হয়নি। তাছাড়া রেল কাঠামো উন্নয়নের জন্য উন্নতমানের যন্ত্রপাতি কেনা এবং প্রয়োজনীয় লোকবলও রাখা হয়নি। প্রত্যেক সরকারই ক্ষমতায় এসে বলেছে রেলখাত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তারা রেলের সেবার প্রতি মূল্যায়ন না করে অর্থ আয় করাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এটা করা ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে উন্নত হওয়ায় বর্তমানে মহাসড়কে চলছে বিলাসবহুল সব গাড়ি। আর এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা এমনকি মন্ত্রীরাও। ফলে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই তারা রেলকে দুর্বল করে রাখেন, এমন অভিযোগও শোনা যায়। দুর্নীতি আর অদক্ষতার কারণে বছরের পর বছর রেলওয়ে লোকসান গুণছে বলেও অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, রাজনীতিবিদরা নন, বরং সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেন আমলা আর দাতাগোষ্ঠীর পরামর্শকেরা। আর এর ছিটেফোটা, উচ্ছিষ্ট রাজনীতিবিদদের পকেটেও আসে এটা সত্য। তিনি জানান, নরওয়ে, বাংলাদেশের রেলের জন্য কাজ করে দিয়েছে। বিনিময়ে তাদের টেলিফোন চালু করে দিতে হলো। বুঝতে হবে বিনা স্বার্থে কেউ আসে না। এত দয়ার শরীর তাদের না। এক পয়সা দিলে তারা দশ পয়সা নিয়ে যায়। তারা পরে আমাদেরকে উল্টো দুর্নীতিবাজ বলে।
দেশের ৪৪০টি রেল স্টেশনের মধ্যে লোকবলের অভাবে ৯৮টি বন্ধ হয়ে গেছে। ইঞ্জিন স্বল্পতায় ট্রেনের সময়সূচিও রক্ষা করা যায় না বলে জানালেন ঢাকার কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. সৈয়দুজ্জামান। আর এ কারণে অনেক সময়ই ট্রেন ছাড়তে এবং পৌঁছাতে দেরী হয়।
বিগত দিনগুলোতে অবহেলা করা হলেও বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যেমন, রেলের টিকিট বিক্রি ও তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা সহজ করা এবং নতুন লাইন নির্মান ও সময় মেনে আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়া ইত্যাদি। তবে এসব উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আর এগুলোর বাস্তবায়নে শেষ পর্যন্ত টাকা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারী বা পিপিপির মাধ্যমে রেলের উন্নয়নে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার ১৬টি চুক্তি করেছে। এসব প্রকল্প ও সংস্কার শেষ হলে রেলের চেহারা কিছুটা হলেও ফিরবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোজাম্মেল হক খান বলেন, রেলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকার আন্তরিক। সৈয়দপুর রেল কারখানা আধুনিক করার কাজ শুরু হয়েছে, রেলের বগি, ইঞ্জিন কেনা এবং লাইন নির্মাণ ও সংস্কার কাজও প্রক্রিয়ায় আছে বলে তিনি জানান। রেলের যেসব কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে, যেমন- ক্রয় সম্পাদন করা, পুনর্বাসন করা, এগুলো যদি সম্পন্ন করা যায় তাহলে বাংলাদেশে রেলওয়ের আধুনিকিকরণের জন্য সরকার যে অঙ্গীকার করেছে তার অনেকটাই সফল হবে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা থেকে আশেপাশের শহরগুলোতে দ্রুতগতির কমিউটার রেল সেবা চালু করে রাজধানীকে চাপমুক্ত রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে ২০০৯ এর জুলাইয়ে নারায়নগঞ্জ-জয়দেবপুর পথে "তুরাগ এক্সপ্রেস" নামে নতুন ট্রেন চালু হলেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এসব উদ্যোগ সফল করতে আরো সময় লাগবে বলে জানান যোগাযোগ সচিব। রেলপথ, ইঞ্জিন এবং বগিগুলোর বেশির ভাগ পুরনো এবং মেয়াদোত্তীর্ণ। এ কারণে ট্রেনের গতি কমে আসছে বলে স্বীকার করেন সচিব। তিনি বলেন: আমাদের যে লোকোমটিভ আছে, কোচগুলোকে যেটি টেনে নিয়ে যায়, যেখানে প্যাসেঞ্জার বসে বা মাল যায়, আমাদের দেশে সেগুলো চাহিদা মোতাবেক নেই। দ্বিতীয়ত, ২০-২২ বছর হল রেলের স্বাভাবিক লাইফ। সেটি হয়ে গেছে তার দ্বিগুনেরও বেশি, ৬০-৭০ বছর। কাজেই ট্রেন যে গতিতে যাওয়া দরকার সেই গুতিতে চলতে পারছে না বলে তিনি জানান।
রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি আনতে সরকার বেশ কিছু বিকল্প নিয়ে কাজ করছে। এরই একটি মেট্রো রেল। যোগাযোগ সচিব জানান, ২০১১ সালে উত্তরা থেকে পল্লবী হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার পথে মেট্রো রেল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হতে পারে। তিনি আরো বলেন: এটা করতে একটু সময় লাগবে। প্রাথমিক আলোচনায় এবং ভারতের অভিজ্ঞতা চিন্তা করলে আমাদের দেশে এই ২২ কিলোমিটারের জন্য কমপক্ষে ৩-৪ বছর সময় লাগবে।
যাত্রীদের অনেকেরই মত, সময় বাঁচানোর জন্য তারা সড়ক পথের ওপর নির্ভর করেন। রেলপথের উন্নয়ন হলে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো সম্ভব। তাদের অভিমত প্রতি ঘন্টায় হলে ভালো হয়। কারণ একটা ট্রেস মিস হলে দুই আড়াই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেকে আবার বলছেন দেরী করে ট্রেন ছাড়ে বলে তারা বাসে করে গন্তব্যে যান।
জ্বালানি সাশ্রয়ী আর পরিবেশ বান্ধব হয়েও রেলওয়ের মতো সম্ভাবনাময় সেবা খাতটি দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনছে। সহজে টিকেট পাওয়া, পথের সময় কমিয়ে আনা, নিরাপত্তা বাড়ানো আর যাত্রীসেবার মান নিশ্চিত করা গেলেই যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে যাত্রীরা মনে করেন।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ২০১০ সালের ১১ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, রেলের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব স্টেশন থেকে তারাকান্দি, ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে পদ্মা সেতুর পূর্ব প্রান্ত, পদ্মা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে ভাঙ্গা থেকে যশোর, বরিশাল, খুলনা ও মংলা পর্যন্ত রেলপথ বাড়ানোর কাজ চলছে।
ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে চালু এবং চট্টগ্রাম বন্দর আরো সক্রিয় হলে পণ্য পরিবহনের চাপ বাড়বে। এসব বিবেচনায় দেশের প্রায় সব মহাসড়ক চার লেন করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় আছে বলেও জানা গেছে। রেল যোগাযোগকে আরো আধুনিক, সেবার মান বাড়ানো ও নিরাপদ করতে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




