বিশ্বের দরবারে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। রাজনীতি, সন্ত্রাস, ভর্তি প্রক্রিয়ার জটিলতা, ভর্তি বাণিজ্য, ধর্মঘট, শিক্ষার মান কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এখন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে উৎসাহিত হচ্ছে না। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটে সর্বাধিক বিদেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি আছে। এর বাইরে হাতেগোনা কয়েকটি বিভাগে অল্প কয়েকজন বিদেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি রয়েছে, যা নিতান্তই নগন্য।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের বর্তমান সংখ্যা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের বৃত্তি শাখায় বিদেশি ছাত্র ভর্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তারা শুধু ভর্তি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোই দেখে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই আসে ভারত, নেপাল এবং তুরস্ক থেকে। চীন এবং ইরান থেকেও কিছু শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে ৪ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে ২ জন নেপালের , যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত থেকে ১ জন করে। ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে তুরস্কের ৩ জন , চীন, নেপাল এবং ফিলিস্তিনের ১ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে । এছাড়া নতুন করে নেপালের ৩ জন এবং কোরিয়ার ২ জন শিক্ষার্থীর ভর্তির প্রক্রিয়া অনুমোদন কমিটিতে রয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ফার্মেসি, ইংরেজি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এছাড়াও চারুকলা, অর্থনীতিসহ আরও কয়েকটি বিভাগে কিছু বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বর্তমানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের রিজিওনাল মাস্টার্স প্রোগ্রামেও বেশ কিছু বিদেশি ছাত্র অধ্যয়নরত রয়েছে। তবে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএল)। এখানে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হয়। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ৩৬ জন এবং ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ২৬ জন বিদেশি শিক্ষার্থী আইএমএল-এ ভর্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারেই নগন্য।
ভর্তির কোনো আলাদা শাখা নেই:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে বিদেশি ছাত্রদের ভর্তির জন্য আলাদা কোনো শাখা নেই। বৃত্তি শাখাতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। কিন্তু বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা বৃত্তি শাখায় নেই। এ ব্যাপারে বৃত্তি শাখার সহকারি রেজিষ্ট্রার মো. হামিদুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আলাদা শাখা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। বছর দশেক আগে এমন একটি উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো পর্যন্ত এটি বাস্তবায়িত হয়নি। এ ব্যাপারে তিনি সরকারের অনিহাকেই দায়ী করেন। কম্পিউটার না থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের কোনো ডাটাবেস সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয় না। যে কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতেও হিমশিম খেতে হয় বলে জানান হামিদুর রহমান।
আলাদা শাখা না থাকার কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বলেন: বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই নগন্য। তাই আলাদাভাবে কোন শাখাও নেই। তবে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লে আলাদা শাখা খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদাভাবে ডাটাবেস সংরক্ষণ করা হবে কিনা সে প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন: দেশি শিক্ষার্থীদেরই এখনো কোন ডাটাবেজ নেই। তবে যখন দেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ডাটাবেজ রাখা হবে তখন বিদেশি শিক্ষার্থীদেরও তাতে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। ডাটাবেজ সংরক্ষণের ব্যাপারটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টিতে রয়েছে।
ভর্তি প্রক্রিয়ায় জটিলতা :
বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অনেক দুরূহ ব্যাপার। সাধারণত যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে থাকে বিদেশি শিক্ষার্থীরা। এমনকি ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীরা ই-মেইলের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত তথ্য সম্প্রতি সংযোজন করা হয়েছে। ই-মেইলের মাধ্যমে ভর্তির জন্য আবেদন করলেও একটি কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৩টি ফরম দেয়া হয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। এ ৩টি ফরমের মধ্যে ১টি পাঠানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ১টি ফরম পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পাওয়ার পর ১টি ফরম পাঠানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। সচিবের স্বাক্ষর পাওয়ার পর একটি ফরম ফেরত পাঠানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পরই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগে ২-৩ মাস। এ দীর্ঘ এবং বিরক্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিদেশি ছাত্ররা যেতে চায় না।
তবে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী মনে করছেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও অনুমতি প্রয়োজন হয়। এটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু ভর্তির ব্যাপারে এই তিন মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি আলাদা কক্ষ থাকলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বারবার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় না। উপাচার্য জানান, বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য একটি আলাদা ডেস্ক রাখার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন।
সহকারি রেজিষ্ট্রার মো. হামিদুর রহমান অভিযোগ করেন, বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ফরমটি আছে তা অনেক পুরনো । ইন্টারনেটেও ঐ একই ফরম দেয়া আছে। হালনাগাদ ফরম তৈরি করে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে এই ফরমটি থাকলে বিদেশী শিক্ষার্থীদের ঝক্কি কিছুটা হলেও কম হত বলে তিনি মনে করেন।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানান, ফরমটি পুরনো হয়ে থাকলে ভর্তি শাখা থেকে এ ব্যাপারে প্রশাসনকে জানালে কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখবে । বিদেশি শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে পড়াশুনার জন্য আগ্রহী করতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকেই কাজ করতে হবে বলে তিনি জানান।
হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থী র সংখ্যা ও হাতেগোনা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য রয়েছে স্যার পিজে হার্টগ আন্তর্জাতিক হল। মোট ১২২ কক্ষবিশিষ্ট এই হলে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৬৩টি রুম এবং ৪টি গেস্টরুম। এছাড়া শিক্ষকদের জন্য রয়েছে বাকি ৫৫ টি কক্ষ। অথচ বর্তমানে হলটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত মাত্র ১৫ শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। এর মধ্যে নেপালের ১১ জন, ফিলিস্তিনের ২ জন, ভারত এবং শ্রীলঙ্কার ১ জন করে ছাত্র রয়েছে । হলে অবস্থানরত ১২৫ বিদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে এ ১৫ জন ছাড়া বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, পিজি হাসপাতাল ও আইএমএল। এছাড়াও হলে অবস্থান করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ শিক্ষক । হলে শিক্ষকদের অবস্থানের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে আন্তর্জাতিক হলের প্রভোস্ট ড. আসিফ নজরুল জানান, এটি শিক্ষক এবং ছাত্র কারও জন্যই ভালো অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসন সুবিধা দিতে পারছে না, তাই বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের রেজ্যুলেশন অনুযায়ী এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ছাত্র সংখ্যা বাড়লে এর বিকল্প সমাধান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করবে বলে তিনি মনে করেন।
আন্তর্জাতিক হলের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানতে চাইলে নেপাল থেকে আগত ছাত্র রাজেস শাহ বলেন, হলের সুযোগ-সুবিধা আন্তর্জাতিক মানের নয় । হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে লোডশেডিং, ডাইনিংসহ আরও কিছু সমস্যা উঠে আসে। শিক্ষার্থীরা হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথাও জানান। যে কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে তাদের প্রভোস্টের কাছে আবেদন করতে হয়। এমনকি রুমে একটি বাল্ব লাগানোর জন্যও প্রভোস্টের কাছে অনুমতি নিতে হয়। ব্যাপারটি নিয়ে প্রভোস্টও অসন্তোষ প্রকাশ করেন । তিনি বলেন, যেহেতু এই হলের প্রভোস্ট অনাবাসিক, তাই অনুমতি হাউস টিউটরদের কাছ থেকে নিতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু নিয়মানুযায়ী সবকিছুই প্রভোস্টের অনুমতি নিয়ে করতে হয়।
বিদেশি ছাত্রীদের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক হল নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আগে ইন্টারন্যাশনাল হলে ছাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে শুধু ছাত্ররাই হলটিতে অবস্থান করছে। ছাত্রীদের অনেকেই অবস্থান করছে শামসুন্নাহার ও রোকেয়া হলে।
কিছুদিন আগে স্পেনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ৬ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৯২২ নম্বরে। এ লজ্জা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এটি সমগ্র বাংলাদেশের জন্যই একটি লজ্জার বিষয়। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে সন্ত্রাস, সহিংসতা ও রাজনীতির করালগ্রাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করে একে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে। তবেই বিদেশি শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
#
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




