কখনো কখনো যখন খুব রাত হয়ে যায়, নিশি দ্বি-প্রহর কিংবা তারও কিছু পর যখন জোনাকি কিংবা ঝিঁঝি পোকারাও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, ঠিক তখনি মনে হয় জানালায় কে যেন টোকা দিয়ে যায়। মেলভিন ঠিক স্পষ্ট শুনতে পায় দু-পায়ের হেটে যাওয়ার আওয়াজ। আরও বেশি চমকে উঠে যখন নুপূরের শব্দ পায়ের তালে তালে সেই চির পরিচিত সুরের মুর্ছনা তুলে। হঠাৎ করে ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠে মেলভিনের। বিছানা থেকে উঠেই দৌড়ে গিয়ে জানালাটা খুলে। কিছুটা চাপা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। দূরের চাঁদটা যেন মলিন মুখে চুপ করে একটানা চেয়ে থাকে তার দিকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে। মেলভিনের মনে হয় দেহটা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে যেন । আর একটা ভয় তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে।
ঘার ঘুরাতেই অদূরে চাঁপাফুল গাছটার নিচের নতুন কবরটা চোখে পড়ে আর তার সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠে। আবছা অন্ধকার তখন আরো রহস্যময় মনে হয়। কি যেন একটা ভয় আর অনুরাগে মেলভিনের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে……
সিলভিয়া ফিলোসফির ছাত্রী ছিল। ঈশ্বরে তার বিশ্বাস ছিল না। এ নিয়ে সিলভিয়ার সাথে প্রায়ই তর্ক হতো মেলভিনের। অথচ কোনদিনও যুক্তি দিয়ে সিলভিয়াকে বুঝানো যেত না । ফিলোসফি পড়লেই যে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করা যাবে না এমনটা মেলভিন মেনে নিতে পারত না। তবুও সিলভিয়ার সাথে মেলভিন তার অত্মার মিল খুঁজে পেত। তাই ধর্মকে উপেক্ষা করে তাদের সম্পর্কটা সংসার পর্যন্ত গড়ায়।
বাসরের প্রথম কথাটি সিলভিয়াই বলেছিল- “এই হাদারাম, দেখলে তোমাকে আমি আপন করেই ছাড়লাম! তুমি আমাকে ফেলে কখনো হারিয়ে যাবে না তো?”
অথচ কি বিস্ময় সিলভিয়াই তার কথা রাখেনি। কি সহজ ভাষায় সিলভিয়া সেদিন বলেছিল, “আমি মরে গেলে তুমি আবার বিয়ে করবে, না?
এ প্রশ্নের উত্তরে মেলভিন কিছুই বলে নি, শুধু পলকহীন চোখ জোড়া দিয়ে ফোটা ফোটা জল কোলে রাখা সিলভিয়ার হাতটা ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
সিলভিয়া তখন বিস্ময় মাখা চোখ নিয়ে বলেছিল- “কাঁদছ কেন তুমি? তুমি না বলে ছিলে মরে গেলে সবাই ঈশ্বরের কাছে চলে যায়। তাহলে আমিও তো তারই কাছে যাবো। তাকে বলব আমি তাকে বিশ্বাস করেছি। আর সেখানে আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। আচ্ছা তুমি আমাকে ফাঁকি দেবে না তো? আমি তোমাকে ছাড়া থাকব কি করে?”
- তোমার কিচ্ছু হবে না সিলভিয়া। দেখো তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।
- মিছে শান্তনা দিচ্ছ আমাকে, আমি জানি আমি আর বাঁচব না।
মেলভিন তখন বলে সিলভিয়া আব্বা-আম্মা এসেছেন।
সিলভিয়া ঘার ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের অবাধ্য হয়ে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আব্বু তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। মা কেঁদনা প্লিজ! মেলভিন….
- বলো?
- তুমি ঈশ্বরের কাছে বলো আমি তাকে বিশ্বাস করেছি; তিনি যেন আমাকে গ্রহণ করেন। বলবে না?
- বলবো সিলভিয়া বলবো । (মেলভিন হু হু করে কেঁদে উঠে)
- তুমি কাঁদছ কেন? বিশ্বাস করো আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। আমি পরপারে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। তোমাকে বলার যে কত কথা ছিল সব তো আর এক জীবনে বলা হলো না। তোমাকে ভালবাসারও যে অনেক বাকী রয়ে গেল। পৃথিবীটা অনেক ছোট না মেলভিন? তার সময়টা খুব অল্প! তুমি কেঁদনা বলছি। তুমি কাঁদলে আমারও যে খুব কন্না পায়।
হাত দিয়ে চোখের জল মুছে মেলভিন। আজ সিলভিয়া আর তার পথ কত দূরে সরে গেছে। ধীরে ধীরে কবরটার পাশে গিয়ে দাড়ায় সে। যেন কোন ভয় নেই। হঠাৎ কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে, তোমাকেও আমার অনেক কথা বলার ছিল সিলভিয়া।
বুকের ভিতর একটা চাপা কষ্ট অনুভব করে সে, রাতের আকাশের অজস্র তারার ফাঁকে ফাঁকে মেলভিন কি যেন খুঁজে ফিরে। হয়ত কোন এক নক্ষত্র হয়ে সিলভিয়া এখন তার দিয়ে চেয়ে আছে।
একটা পেঁচা চিৎকার করে উড়ে যায় এক গাছ থেকে অন্য গাছে। মেলভিনের মনে পড়ে সিলভিয়া গান খুব ভালবাসতো। মাঝে মাঝে শ্রাবণ কিংবা বসন্তে সে কবি হয়ে উঠত। এই চাপাফুল গাছটি তার খুবই প্রিয় ছিল। এখানে বসে সিলভিয়ার গাওয়া শেষ গানটা মেলভিনের খুব মনে পড়ে- বড় স্বপ্ন ছিল/ সাজাব বাসর প্রেম দিয়ে/ তবে কেন হলো ভুল; অবেলায় ঝড়ে গেল ফুল/ বেদনার গিরি বুকে লয়ে… বড় স্বপ্ন ছিল…
সিলভিয়ার ডাইরিটার কথা মনে পড়ে মেলভিনের। শেলফ থেকে বের করে হাতে নেয়। সিলভিয়া একদিন বলেছিল চলো আজ সারা রাতের জোৎস্নায় তোমার হাত ধরে আমি হাটব। কিন্তু মেলভিন ভূতে খুব ভয় পেত। তাই সেটা কখনোই হয়ে উঠত না। অথচ আজ তার কোন ভয় হচ্ছে না। আজ সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরে দাড়িয়ে তারও ইচ্ছা হয় অবুঝ শিশুর মতো সিলভিয়ার হাত ধরে হাটতে। কিন্তু কোন উপায় নেই...
কখনো কখনো যখন খুব রাত হয়ে, নিশি দ্বি-প্রহর কিংবা তারও কিছু পর যখন জোনাকি কিংবা ঝিঁঝি পোকারাও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, ঠিক তখনি মনে হয় জানালায় কে যেন টোকা দিয়ে যায়। মেলভিন ঠিক স্পষ্ট শুনতে পায় দু-পায়ের হেটে যাওয়ার আওয়াজ। আরও বেশি চমকে উঠে যখন নুপূরের শব্দ পায়ের তালে তালে সেই চির পরিচিত সুরের মুর্ছনা তুলে। হঠাৎ করে ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠে মেলভিনের । বিছানা থেকে উঠেই দৌড়ে গিয়ে জানালাটা খুলে। কিছুটা চাপা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই ।বিষন্নতা যেন আজ কথা বলে আর সেই সুরে যেন একটাই ধ্বনি- মনের আকাশ মেঘলা হয়ে কেন যায়/ ভোরের বাতাস থমকে কেনো গো দাড়ায়? বড় ব্যথা জমে এ বুকে/ কেনো মনে পড়ে গো তোমায়।
অদূর অন্ধকারের কোন একটি রেলপথ জংশনে এসে দু’দিকে চলে গেছে যেন। আর তারেই পথের কোন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে সেই করুণ সুর। দুই ফোটা নোনা জলও যেন নি:শব্দে সে রাগের সাথে রাগ মিলিয়ে বলে উঠে আমি আসছি প্রিয়... আমি আসছি..
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫১